আমার ছয় বছর বয়সী কন্যাকে তার ঠাম্মু প্রায়ই মজা করে বলে,-" দুষ্টুমি করলে একটা বুড়ো বরের কাছে বিয়ে দিয়ে দেব।"
এই কথা বলা মাত্র,- আমার কন্যা তার ঠাম্মুকে বলে উঠে,-" না। আমি বাবাকে বিয়ে করব।"
বিয়ে কি জিনিস, কেন করতে হয়, কাকে করতে হয়,- সে ব্যাপারে বুঝার মত বুদ্ধি আমার এই অবুঝ কন্যার হয়ে উঠেনি। কিন্তু সে পরিবার,পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক থেকে এতটুকু বুঝতে পেরেছে,- যে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে, আগলে রাখে, প্রশ্রয় দেয়, যার কাছে নিরাপদ ও নিশ্চিন্তে থাকা যায় তাকেই বিয়ে করতে হয়। তার এতটুকুই বুঝ। তাই সে বাবাকে বিয়ে করতে চায়।
তার ভিতরে এখনও বৃত্তি-প্রবৃত্তি ও রিপুর খেলা শুরু হয়নি,- তাই তার ভাবনাটা এত মৌলিক ও পবিত্র৷ এবং, আমার মনে হয়,- প্রত্যেক মেয়েই তার স্বামীর কাছে প্রকৃতপক্ষে এমনটাই প্রশ্রয়, নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা চায়। সমস্ত বাহ্যিক ও রংগীন চাহিদার পেছনে প্রত্যেক নারীই তার স্বামীর প্রতি এই আন্তরিক চাহিদাটুকু হৃদয়ের অন্তরে পোষন করে বলেই আমার মনে হয়।অর্থাৎ সে চায় স্বামী নামক পুরুষটি তাকে সর্বোতভাবে পরিপূরন করুক।
তাই আমাদের শাস্ত্রে,- স্বামী আর পিতাকে নারীদের নিকট সমপর্যায়ের শ্রদ্ধেয় বলে গন্য করা হয়েছে। শুধুমাত্র যৌন সম্পর্কটুকু বাদ দিলে স্বামী ও পিতার ভূমিকার মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। অন্ততঃ আমাদের আর্যসংস্কৃতি অনুযায়ী তাই বলে জানি।
শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন,- পুরুষ মানে যে বা যিনি পূরন করেন। যার পূরন করার ক্ষমতা যত বেশী তার পুরুষত্ব তত বেশী। স্ত্রী চায় পুরুষের দ্বারা পূরিত হতে,- শারীরিক-মানসিক-আধ্মাত্তিক ও সামাজিকভাবে। আর পুরুষ চায়,- স্ত্রীর মাধ্যমে পোষিত হয়ে আরো বৃহৎ হতে,- নিজেকে আরো আরোভাবে বৃহৎ আদর্শের সাথে যুক্ত করতে । প্রত্যেক পুরুষের অন্তর্নিহিত সুপ্ত চাহিদা এটাই। সে কখনো স্ত্রীর আঁচলের নীচে মূখ গুজে নিজেকে সংকোচিত রেখে সুখী হয়না।
তাই,- স্বাভাবিকভাবেই পুরুষ যদি বর্ন-বংশ-বিদ্যা-বয়স-অভিজ্ঞতা-পারিবারিক স্থিতি ইত্যাদি সর্বদিকে স্ত্রীর তুলনায় কম যোগ্যতাসম্পন্ন হয়ে থাকে তবে সেখানে স্ত্রীর পূরিত হওয়া বিঘ্নিত হয়। আর, সেই পুরুষও তার অবচেতন মনে ঘাপটি মেরে বসে থাকা হীনমন্যতার দরুন প্রতিনিয়ত তোষামোদ, অহেতুক মাত্রাতিরিক্ত অধিকারবোধ প্রদর্শন বা অযাচিত লাগামছাড়া স্তুতি ও সেবার মাধ্যমে স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে একসময় স্ত্রীর মনে বিতৃষ্ণার সৃষ্টি করে। কারন,- প্রত্যেক নারীও তার অবচেতন মনে এটাই কামনা করে,- স্বামী যেন তার আঁচলের নীচ থেকে বেরিয়ে বিস্তৃতির দিকে এগিয়ে যায়। তাতেই সে সূখী হয়।
যে বিয়েতে এই ভারসাম্য সহজে রক্ষা হয়,- সেই বিয়ে তত সফল৷ সেই স্বামী-স্ত্রী তত সুখী।
কিন্তু বর্তমান সমাজে অধিকাংশ মানুষ বিবাহ বিভ্রাটের কারনে জীবনে দুঃসহ যন্ত্রনায় ভুগছে। দিন দিন বাড়তে থাকা মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদের কারনে কত কত সন্তান মানসিকভাবে প্রচন্ড বিপর্যস্ত। বিভিন্ন গবেষণায় এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান, - যে সকল ছেলেমেয়েদের মা-বাবা বিবাহবিচ্ছেদের কারনে পৃথক হয়ে গেছে সেইসকল ছেলেমেয়েদের মধ্যেই বিভিন্ন মারন নেশার প্রকোপ বেশী৷ সেইসকল ছেলেমেয়েরা ভবিষ্যৎ সংসার জীবনে এক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তার অভাব বোধ করে,- এবং প্রায়শঃ সুখী হতে সক্ষম হয় না।
তার কারন,- বর্তমান আধুনিক সমাজব্যাবস্থায় আমরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে বড় বড় ডিগ্রী অর্জন করছি, অনেক বুদ্ধিমান-বুদ্ধিমতি হচ্ছি, স্মার্ট হচ্ছি,- কিন্তু জীবন সম্পর্কে আমাদের ধারনা ততই ভোঁতা হচ্ছে। জীবনের গূরত্বপূর্ন সিদ্ধান্তগুলি নিতে আমরা ততই ভুল করছি।
বিজ্ঞান-সাহিত্য-অর্থনীতি-গনিত-কারিগরি বিদ্যা-ম্যানেজমেন্ট সবকিছুই শেখানো হচ্ছে,- কিন্তু কোথাও কেউ শেখাচ্ছে না কিভাবে জীবনে সুখী হওয়া যায়৷ না পরিবারে,- না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বিজনেস ম্যানেজমেন্ট, হোটেল ম্যানেজমেন্ট, পলিটিকেল ম্যানেজমেন্ট কত কত ম্যানেজমেন্টে দক্ষ হচ্ছি,- কিন্তু সংসার ম্যানেজমেন্টে ডাহা ফেল!! কিভাবে একজন যোগ্য-ভাল মানুষ হওয়া যায়, ভাল সন্তান হওয়া যায়, ভাল স্বামী বা স্ত্রী হওয়া যায়, ভাল বাবা-মা হওয়া যায়, ভাল প্রতিবেশী হওয়া যায়, একজন সুনাগরিক হওয়া যায়,- তার শিক্ষা কোন সিলেবাসে নেই। জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ যে সিদ্ধান্ত,- বিবাহ,- সে ব্যাপারে কোন নিয়ম বা বিধি আমরা জানিনা,- জানতে ও চাইনা৷ তথাকথিত শিক্ষাব্যাবস্থায় কেউ কোথাও শেখানোর ব্যাবস্থা ও রাখেনি। ফলে বিয়ে করার নামে জীবন নিয়ে জুয়া খেলতে বাধ্য হচ্ছে সকলে।
সারাজীবন কঠোর পরিশ্রম করে, বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে শুধুমাত্র বিবাহের ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্তের কারনে কত কত দম্পতির জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। কত আত্মহত্যা হচ্ছে, বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে, সংসার তছনছ হয়ে গেছে,- ইয়ত্তা নেই৷ দেশের কত মানবসম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে! আবার কত কত মানুষ বিবাহের পর অত্যন্ত সুখী-সফলভাবে জীবন কাটাচ্ছে, সুসন্তানের জন্ম দিচ্ছে।
প্রত্যেক সংসারেই স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ছোটখাট ঝামেলা, ঝগড়াঝাঁটি, ভুলবুঝাবুঝি, মন কষাকষি এইসব থাকেই। কিন্তু পারস্পরিক শ্রদ্ধা, স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের মূল আন্তরিক চাহিদা পূরিত হওয়ার জন্য যে যে বৈশিষ্ট্য প্রয়োজন সেগুলি যদি বর্তমান থাকে তবে শত ঝামেলার মধ্যে সেই দম্পতির সুখ-শান্তি বিঘ্নিত হয়না৷
জীবনকে সুখী ও সার্থক করার জন্য এমন গুরত্বপূর্ণ যে পদক্ষেপ,- সেই বিবাহের কি কোন সঠিক বিধি নেই? বিবাহের উদ্দেশ্য কি, বিবাহের নিয়ম কি, কোন পাত্রের সাথে কোন পাত্রীর বিবাহ হলে বিবাহ সফল হয়, কেমন পুরুষ কেমন নারীর স্বামী হওয়ার যোগ্য, বিবাহের পর স্বামী ও স্ত্রীর কেমন ভাবে চলা উচিত, কেমনভাবে সুসন্তানের জন্ম দেওয়া সম্ভব,- এসব ব্যাপারে কি কোন নিয়মকানুন নেই? বিবাহবিজ্ঞান বলে কি কিছু নেই? যদি থেকে থাকে তবে সেইসব নিয়ম যথাযথ ভাবে সমাজে প্রচলনের প্রয়োজন নেই?
আমরা এইসব ব্যাপার ও নিয়মবিধি নিয়ে ভাবতেই নারাজ। কেউ যদি মেনে চলে তবে তাকে অশিক্ষিত ও সেকেলে বলে গালি দিতেও কুন্ঠিত হইনা। কারন,- আমরা যে সাংঘাতিক আধুনিক ও স্মার্ট!! অথচ, সেই আমরাই কিন্তু একটা কুকুর বাড়ীতে আনার আগে তার বংশপরিচয় ঘেটে দেখি ইন্টারনেটে, কত খোঁজ খবর করি,- সেই কুকুরের কোন জন্মগত দোষ আছে কিনা, তার পূর্বপুরুষ সামান্য একটা রুটির লোভে মালিকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল না, তার বংশে কখনো অন্য বংশের কুকুরের মিশ্রন ঘটেছিল কিনা, তার জেনেটিক পিউরিটি আছে কিনা,- কত কি!! বাজারে গিয়ে জাস্ট চেহারা দেখে ভাল লাগল বলে,- সেই কুকুর আমরা কিনে বাড়ীতে নিয়ে আসিনা। একটা হাড়ি কিনতে হলেও সেই হাড়ি হাত দিয়ে বাজিয়ে বাজিয়ে দেখি,- কোন ফাঁটল আছে কিনা।
অথচ যার সাথে আমি সারাটা জীবন একসাথে কাটাব, যার উপর আমার সারাজীবনের সুখ-দুঃখ নির্ভর করছে, যার মাধ্যমে আমার বংশধারা বজায় থাকবে, যার পরিবারের সাথে আমার পরিবারের আত্মীয়তা হবে,- সেই স্বামী বা স্ত্রী নির্বাচন করার সময় আমি কোন নিয়ম-বিধির ধার না ধেরে, - শুধুমাত্র আবেগের বশবর্তী হয়ে অন্ধের মত লাফ দিচ্ছি!! গর্তে-খানা-খন্দরে-সমতলে-জলে কোথায় গিয়ে পড়ছি কিছুই বিচার করছিনা। ভাল হলে ভাল,- খারাপ হলে সব শেষ!! জীবনটা কি এমনিভাবে জুয়া খেলার জিনিস??!!
শুধুমাত্র " ভাল লাগে" বলে বা ভালবাসার ছদ্মবেশে কাম আকর্ষন সৃষ্টি হয়েছে বলেই যাকে তাকে বিয়ে করা যায়? যদি এই " ভাল লাগা" বা " ভালবাসা" টাই সত্য হত, প্রকৃত হত,- তবে এত এত লাভ মেরেজের এমন জঘন্য পরিনতি কেন? কোথায় উড়ে চলে যায় সেই প্রেম আর স্বর্গীয় ভালবাসা? বিয়ের পূর্বে যে কপোত কপোতি সারা রাত জেগে ফোনে কথা বলছে, একদিন দেখা না হলে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে, দামী দামী গিফট না দিলে মন ভরছে না, ফেইসবুকে প্রেম ঘোষণা না করলে শান্তি হচ্ছেনা, একজন আরেকজনের প্রতি মুগ্ধতায় হাবুডুবু খাচ্ছে, কত প্রেমের কবিতা ঠেলেঠেলে বের হচ্ছে, - বিয়ের কিছুদিন পর দেখা যায় সেই কপোত কপোতীই কোর্টে দৌড়াচ্ছে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য। কেউ কারো চেহারা সহ্য করতে পারছে না।
আবার এরেঞ্জ মেরেজের ক্ষেত্রেও দেখা যায়,- মেয়ের মা-বাবা যে ছেলের ডিগ্রী, ব্যাংক বেলেঞ্চ, ফ্যামিলি স্ট্যাটাস আর হ্যান্ডসাম চেহারা দেখে মুগ্ধ হয়ে নিজের প্রানপ্রিয় কন্যাকে সঁপে দিল, - সেই ছেলে বিয়ের পর মেয়েকে যন্ত্রনা দিচ্ছে৷ বা,- মেয়ে সেই বিয়ের পর সন্তুষ্ট নয়,- মানিয়ে নিতে পারছে না৷ ছেলের মা-বাবাও যে মেয়ের সৌন্দর্য, ডিগ্রী আর পনের কারনে মুগ্ধ হয়ে ঘরে এনেছে,- সেই মেয়েকে আর সহ্য করতে পারছেনা। তুমুল সমস্যা৷ ফলে,- বিবাহবিচ্ছেদ বা আত্মহত্যা।
সবসময় যে এমন খারাপ পরিনতি হচ্ছে,- তা নয়। কোন কোন ক্ষেত্রে এইরকম লাভ মেরেজ বা এরেঞ্জ মেরেজ সফল হচ্ছে। সুখী দাম্পত্যজীবন নির্বাহ করছে। কিন্তু তা হল পুরুহিতের দ্বারা যজ্ঞে ঘি ঢালার মত অবস্থা৷ পুরুহিত চোখ বুঝে মন্ত্র পাঠ করতে করতে যজ্ঞে ঘি ঢালছে,- সেই ঘি যজ্ঞের বাইরে পড়তে পারে, ভিতরে ও পড়তে পারে। ঠিক তেমনই অবস্থা। কেন এমনটা হচ্ছে? ভুল কোথায়? প্রতিকারই বা কি? একটুও কি ভাববার প্রয়োজন নেই?
......ক্রমশ..