Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

বিবাহবিভ্রাট - 2

জীবনের শুরুতে আমাদের সকলের মনেই স্বপ্ন থাকে,- নিজের একখানা সুন্দর, সর্বসুবিধাসম্পন্ন বাড়ী হোক। তারজন্য প্রথমেই এক টুকরো জমি আমি ক্রয় করি। তারপর আমি যাই আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ারের কাছে,- তার কাছে জানাই আমার আর্থিক সামর্থ্য, জমির পরিমান, আমার স্বপ্ন ও প্রয়োজনের কথা। ইঞ্জিনিয়ার বাবু আমার দেওয়া সকল তথ্য এবং তার বিদ্যা,জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার প্রয়োগে আমার জন্য একখানা বাড়ীর প্ল্যান বানিয়ে দেন৷ সেই প্ল্যান অনুযায়ী আমি বাড়ী বানাই৷ দেখা যায়,- ভূমিকম্প আসলেও সেই বাড়ী ভেংগে পড়ছে না। ভয়ংকর ঝড় আসলেও আমি সেই বাড়ীতে নিরাপদে বসবাস করছি।  

তা না করে,- আমি যদি সুন্দর সুন্দর বাড়ীর ছবিওয়ালা একখানা এলবাম এনে সেখান থেকে যেকোন একটা বাড়ীর ছবি পছন্দ করে  সেই বাড়ীটাকেই বানিয়ে দেওয়ার জন্য  রাজমিস্ত্রীকে আদেশ করি,-কেমনটা হবে? দেখা যাবে হয়ত আমার আর্থিক সামর্থ্য নেই এমন এক বাড়ী আমি পছন্দ করে ফেলেছি৷ অথবা যে বাড়ীটির বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে আমার খুব পছন্দ হয়ে গেল তার ভিতরের সুবিধা যথাযথ নেই। ভূমিকম্প প্রতিরোধক ব্যাবস্থা ঠিকঠাক নেই। আমার স্বপ্নপূরণ আর হল না৷ বিবাহের ক্ষেত্রে কিন্তু আজকাল আমরা এমন ভুলই করে থাকি। ফেইসবুক প্রোফাইলে ছবি দেখে, টিকটক ভিডিও র নাচে মুগ্ধ হয়ে আর মেট্রিমনিয়াল সাইটে লেখা সুন্দর গুছানো মিথ্যা বায়োডাটা পড়েই পাত্র পাত্রী নির্বাচন করে ফেলছি। কিছুদিন পরেই কোর্টে দৌড়াচ্ছি৷  

বাড়ী তৈরীর স্বপ্নের মতই সকলের জীবনের শুরুতে একজন জীবনসংগী বা সংগীনির স্বপ্ন আমরা  দেখে থাকি৷ কিন্তু বাড়ীর জন্য প্রথমেই যেমন এক টুকরো জমির প্রয়োজন, - ঠিক তেমনি বিয়ে করার আগে প্রয়োজন আমার যোগ্যতা।  সেই যোগ্যতা অর্জন না করে যদি বিয়েতে ঝাঁপ দেই,- তবে জ্বলেপুড়ে মরতে হবে। সংসার জীবন জ্বালাময় হয়ে উঠবে। 

আর, যোগ্যতা অর্জন মানে শুধু ডিগ্রি অর্জন ও অর্থ সঞ্চয় নয়৷ প্রত্যেক পুরুষের প্রয়োজন বয়ঃসন্ধি কালের সময় থেকেই জীবন্ত আদর্শ বা সদগুরুর সাথে সক্রিয় ভালবাসার মাধ্যমে যুক্ত হয়ে জীবনের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করা। মানুষ হিসাবে নিজেকে গড়ে তুলা৷ আমার জীবনের ভিত্তিই যদি টলমল হয়, আমিই যদি জীবনচলার পথে যোগ্য ও দক্ষ না হয়ে উঠি,- তবে কিভাবে আমি আরেকজনের কন্যার  সারাজীবনের দায়ীত্ব নেব?শুধু বিয়ে করে সন্তান উৎপন্ন করলেই কি বিয়ে সফল হয়ে গেল!! সেই মেয়ে যদি আমার জীবনে এসে শারীরিক, মানসিক, আধ্মাত্ত্বিক ও সামাজিকভাবে যথাযথভাবে পরিপূরিত না হয়,- তবে সে আমাকে বিয়ে করে  প্রতিনিয়ত কপাল চাপড়াবে। আমি নিজে যখন সদগুরু বা জীবন্ত আদর্শের সাথে যুক্ত হয়ে তাঁর মাধ্যমে পরিপূরিত হব,- তখনই আমার পক্ষে সম্ভব আরেকজনকে পরিপূরন করা। তা নাহলে হীনবল হয়ে হাঁপাতে থাকব সংসারের ঝামেলা পোহাতে পোহাতে। 

কোন সুন্দরী মেয়ের রূপে-গুনে মুগ্ধ হয়ে শাহরুখ খানের মত রোমান্টিক জোকার সেজে,-সেই মেয়েকে বিয়ে করার জন্য পেছন পেছন ভাদ্র মাসের কুকুরের মত ঘুরঘুর করলেই বিয়ে করার যোগ্যতা জন্মায় না। হিন্দি সিনেমা দেখে দেখে রোমান্টিক হিরো সাজলেই সংসার জীবনে সুখী হওয়া যে যায়না,- এই বোধটুকু আজকালের অনেক ছেলেমেয়েদের নেই।শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন,- কোন পুরুষ যদি কোন নারীতে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করার জন্য পেছন পেছন ঘুরতে থাকে তবে সেই পুরুষটিই হল বিয়ের জন্য সর্বাপেক্ষা অযোগ্য পুরুষ ৷ তিনি বলেন,-" মেয়ে বরে বরন করে/ সেই বিয়েতে সমাজ বাড়ে।"নারীরই একমাত্র অধিকার রয়েছে তার বর নির্বাচন করার। সেই কারনেই আমাদের দেশে " স্বয়ম্ভর সভা"র আয়োজন করা হত৷ কখনো " স্বয়ং কন্যা সভা" র আয়োজন করা হয়নি৷ শ্রীশ্রীবাবাইদা বলেন,-" ছেলেদের বিয়ে হয়,- আর মেয়েরা বিয়ে করে।" শ্রীশ্রীঠাকুরের মতে পুরুষ ছুটবে আদর্শের পেছনে উম্মত্ত হয়ে৷  নারীর পেছনে পেছনে পাগলা কুকুরের মত ছোটা পুরুষ কখনোই সেই নারীকে পরিপূরন করে সুখী করতে পারেনা৷  

যে মেয়ে আরেকজনের পরিবারে গিয়ে তার ব্যাক্তিজীবন, পরিবার জীবন, সমাজ জীবন ও আধ্মাত্ত্বজীবনের সাথে তালমিলিয়ে চলবে, তার সন্তান গর্ভে ধারন করবে,- সেই মেয়ে যদি তার বয়ঃসন্ধি কাল হতেই পুঁথিগত বিদ্যা ও পেশাগত শিক্ষার পাশাপাশি জীবনের শিক্ষা ও সাংসারিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়ে উঠে তবে সে কিভাবে বিবাহোত্তর জীবনে সুখী হবে? সেই জীবনীয় শিক্ষার জন্য প্রয়োজন জীবন্ত আদর্শের সাথে সদ দীক্ষার মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়া এবং ইষ্টকেন্দ্রিক পরিবারে বেড়ে উঠা। 

সেই মেয়ে যদি বেড়ে উঠার সাথে সাথে জীবনের গুরুর কাছ থেকে ও  মা-বাবার কাছ থেকে জানতে না পারে,- বিয়ের অর্থ ও উদ্দেশ্য কি, কেমন পুরুষ তার বর হউয়ার যোগ্য, কেমন করে স্বামী নির্বাচন  করতে হয়, বিয়ে করে নতুন সংসারে গিয়ে কিভাবে চললে সুখী হওয়া যায়, কিভাবে সন্তান মানুষ করতে হয়, কিভাবে প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়, কিভাবে স্বামীকে উচ্চ আদর্শে ঠেলে দিতে হয়,- তবে সেই মেয়ে যৌবনের আবেগের বশে কোন ছেলের দামী বাইক,দামী সানগ্লাস, মোটা পেশী আর মোটা মানিব্যাগ দেখে মুগ্ধ হয়ে তার সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করতেই পারে৷ তারপর কিছুদিন সংসার করার পর প্রচন্ড অনুতাপে বিবাহবিচ্ছেদ, - নয়তো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতেই পারে৷  

অথবা, মা-বাবার পছন্দ মতেই,- শুধুমাত্র পাত্রের বড় চাকরী, বড় বাড়ী, ডার্ক এন্ড হ্যান্ডসাম চেহারা আর ছিমছাম ফ্যামিলি দেখে বিয়ে করে সেই পরিবারে গিয়ে সকলের সাথে এডজাস্ট করতে হিমসম খেতেই পারে। বড় চাকরী, বড় বাড়ী আর হ্যান্ডসাম চেহারার মোহ কাটার পর যখন সেই পুরুষের প্রকৃত স্বভাব-চরিত্র-চলনের সাথে পরিচয় হয়,- তখন হয়তো কোর্টের দরজা ছাড়া আর কোন গন্তব্য থাকেনা। যে ফ্যামিলির স্ট্যাটাস দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছিল,- সেই ফ্যামিলির মানুষদের আচার-সংস্কৃতি-মানসিকতা-স্বভাবের সাথে মেয়ে কোনভাবেই তাল মেলাতে পারছে না।  

বিয়ে করার উদ্দেশ্য কি, বিয়ে করে কি লাভ,- সেই সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারনা আমাদের নেই,- না ছেলেমেয়েদের,- না অভিভাবকদের। অধিকাংশ ছেলে ভাবছে,- একটা অতীব সুন্দরী বউ যদি বিয়ে করা যায় তবেই বুঝি জনম সার্থক!! কোন কোন শিক্ষিত ছেলে ভাবছে,- সুন্দরের সাথে সাথে ডিগ্রীটাও ঠিকঠাক থাকলেই বিয়ে সার্থক। আবার কেউ কেউ ভাবছে,- সুন্দরী -শিক্ষিত বউ এর সাথে যদি একটা ভালপরিমান টাকা পয়সা-ধন-সম্পত্তি শ্বশুরের কাছ থেকে  ফাউ হিসাবে পাওয়া যায় তাহলে কেল্লা ফতে!! যদি সুন্দরী বউ পেলেই পুরুষের জীবন সার্থক হত,- তবে সিনেমার নায়িকাদের বিয়ে করে কেউ ডাইভোর্স দিতনা।  শিক্ষিত বউ পেলেই যদি সুখী হউয়া যেত তবে,- ডাইভোর্স হতই না৷ কারন, আজকাল শিক্ষিত দম্পতির মধ্যেই ডাইভোর্স বেশী হয়৷ অর্থাৎ বিয়ে করার উদ্দেশ্যই আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।  

আজকাল শিক্ষিত মডার্ন মেয়েরা চটকদার, স্মার্ট, পয়সাওয়ালা ছেলের প্রেম নিবেদনে বিগলিত হয়ে তাকেই স্বামী বরন করছে৷ শুধুমাত্র যৌন আকর্ষন ও যৌন তৃপ্তিই যে সংসার জীবনকে টিকিয়ে রাখতে পারেনা,- সেই বোধটুকু গড়ে উঠেনি। যৌনতার মোহ কেটে গিয়ে যখন আসল স্বভাব ও প্রকৃতি বেরিয়ে আসে তখন মনে হয়,-" কি করলাম"!!  

তবে কোথায় পাব সেই আর্কিটেক্ট, - যিনি আমার জীবনের প্ল্যান বানিয়ে দেবেন? কার পরিকল্পনা ও উপদেশ মত চললে,- আমার সঠিক বিবাহের মাধ্যমে সংসারজীবন সফল হতে পারে? আধুনিক শিক্ষার ডিগ্রী নিয়ে অহংকারে মত্ত হয়ে আর দুই পাতার বিজ্ঞান মূখস্ত করে বিজ্ঞানী সেজে সেই আর্কিটেক্টকে অবজ্ঞা করে কি আমি সুখী হতে পারি? অনেক তো শিক্ষিত হচ্ছি, মডার্ন হচ্ছি, যুক্তিবাদী হচ্ছি,- সুখী হতে পারলাম কই? (....চলবে)