Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

বিবাহবিভ্রাট - 5

বছর দুয়েক হয়ে গেছে আমি বিয়ে করেছি। ত্রিপুরার এক গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মরত আছি। সুন্দর সেই গ্রামে ছোট্ট ছিমছাম হাসপাতাল আর সাথে নতুন কোয়ার্টার। আমার স্ত্রীকে চলে আসল কোয়ার্টারে,- আমার সাথে সংসার করবে বলে।   হাসপাতালের কোয়ার্টারেই আমার চেম্বার।

হাসপাতাল ডিউটির আগে-পরে কোয়ার্টারে প্রাইভেট প্রেক্টিস করছি। বেশ রমরমা প্রেক্টিস। চেম্বারে সারাদিন রোগীর ভীড় ।  

হাসপাতালে সরকারি ডিউটি আর চেম্বারে প্রাইভেট প্রেক্টিস নিয়ে আমি ভীষণ ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম। একই কোয়ার্টারে থাকলেও স্ত্রীর সাথে সারাদিন কথা বলার সুযোগ নেই। সকাল সাতটায় শুরু হয় রোগী দেখা,- মাঝে হাসপাতালে ডিউটি, মিটিং,- রাতে চেম্বার থেকে বেরুতে বেরুতে নয়টা-দশটা। মাঝখানে কোনমতে ঘরে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে দুটো ভাত খেয়ে আসছি। সন্ধায় বাজার-হাট, সংসারের নানা কেনাকাটা সব স্থানীয় গুরুভাই ও ঔষধের দোকানের লোকেরাই করে দিচ্ছে। আমার বের হবার কোন প্রয়োজনই পড়ছে না। রাতে চেম্বার সেরে ঘরে আসার পরও নিস্তার নেই,- একটু পর পর নানান জনের ফোন আসছে। হাসপাতালের ইনচার্জ হওয়ায় নানা উটকো ঝামেলা লেগেই ছিল। রাতে যখন সব শেষ করে ঘরে যাচ্ছি,- তখন শরীর ক্লান্ত, মাথা ঝিমঝিম। মনে হত,- একটু চুপচাপ শুয়ে থাকি। 

এদিকে সারাদিন ঘরে একা একা থাকতে থাকতে স্ত্রীও তিতিবিরক্ত। একটা কথা বলবে এমন লোক নেই। মেজাজ তিরিক্ষে হয়ে আছে!! 

  রাতে সব সেরে আমি ঘরে ঢুকামাত্র শুরু হল তার নানা অভিযোগ। আমি এক কথা বল্লে সে উত্তরে দশটা বলছে। আমার মনমেজাজ আরো গরম হয়ে গেল। আমার যুক্তি ক্লিয়ার,- "আমি তো সংসারের জন্যই খাটছি। সারাদিন চেম্বার করে টাকা কামাচ্ছি কার জন্য? তোমার এত অভিযোগ কেন?  আমি কি সরকারি ডিউটি আর চেম্বার বন্ধ রেখে তোমার সাথে কথা বলার জন্য ঘরে বসে থাকব?" আমার এই যুক্তিতর্ক স্ত্রীকে আরো রাগিয়ে দিল। তার যুক্তিও ক্লিয়ার,-" আমি কি সারাদিন চুপচাপ বদ্ধ ঘরে বসে থাকার জন্য এসেছি। আমার জন্য যদি তোমার সামান্য সময়ই না থাকে তবে বিয়ে কেন করলে?" তুমুল ঝগড়া,-কথা কাটাকাটি৷ শেষে বউ এর কান্নাকাটি!! আমার ঘুম হারাম!! মনমেজাজ চরম খারাপ। আমার জায়গায় আমি ঠিক,- স্ত্রীর জায়গায় সে ঠিক। এর সমাধান কোথায়?  

এইভাবে কয়েকমাস চলার পর আমি অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম৷ এইভাবে সংসার করা যায় না। স্ত্রী আমাকে বুঝতেই চাইছেনা। কথায় কথায় অভিযোগ, - নানা অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা।  মানুষ কি এই জন্যই বিয়ে করে? না,- আর পারছিনা। 

  খবর পেলাম,- পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীআচার্য্যদেব  শিলং এসছেন৷ সব কাজ ফেলে দুইদিনের ছুটি নিয়ে চলে গেলাম শিলং। একাই গেলাম। গিয়ে ধরলাম আমার বন্ধুবর ডাঃ সুধারঞ্জন দেবনাথকে,-" ভাই,- আমাকে নিয়ে চল আচার্য্যদেবের কাছে। " 

নীচে একটা ঘরে আচার্য্যদেব বসে আছেন,- সামনে অনেক লোক,- দাঁড়িয়ে-বসে।ডাঃ সুধারঞ্জন  গিয়ে প্রনাম করে আমায় দেখিয়ে তাঁকে বলল,-" আগরতলা থেকে রাজেশ এসছে,- কিছু নিবেদন ছিল। " 

তিনি একঝলক আমার দিকে তাকিয়ে চোখে ইশারা করে বললেন,-" তুই ঐ কোনায় বসে থাক। পরে কথা বলছি।" 

আমি বসে রইলাম চুপ করে। সবাই চলে গেলে যখন আমি একা রইলাম,- তিনি চোখের ইশারায় কাছে ডাকলেন। 

 আমি গিয়ে প্রনাম করে তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে বসলাম। আমি কিভাবে গুছিয়ে আমার সমস্যাগুলো  বলব ভাবছি। বলতে শুরু করতেই তিনি আমায় থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,- " ভালবাসা কাকে বলে জানিস?" 

আমি থতমত খেয়ে চুপ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি তখন নিজেই বল্লেন,-" ভালবাসা মানে,- তুই যাকে ভালবাসিস বলে সামাজিক ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছিস সে যাতে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে ভাল থাকে, আনন্দে থাকে সেজন্য ভাবা, বলা, করা। 

ব্যাবসাতে শর্ত থাকতে পারে,- কিন্তু ভালবাসায় কোন শর্ত থাকবে না। তোর বউ তোর প্রতি ভাল ব্যাবহার করল,-কি করল না; তোকে রেঁধে খাওয়াল কি খাওয়াল না, তোর মনমতো চলল কি চললনা,- এইসব ব্যাতিরেকে তাকে ভাল রাখা, আনন্দে রাখা,- সেটাই ভালবাসা। কোন শর্ত থাকতে পারবে না মাঝখানে। " 

বলে তিনি চুপ করলেন। আমি তাকিয়ে আছি তাঁর দিকে৷ আবার জিজ্ঞেস করলেন,-" তোর বউ বিয়ে করে তোর কাছে আসল কেন? তার বাবার বাড়ীতে কি খাওয়া-পড়ার অভাব ছিল? তোর বাড়ীতে কি শুধু খেতে, সুন্দর কাপড় পড়তে আর টিভি দেখতে এসছে?" 

আমি নিরুত্তর৷ তিনি আবার বলে চললেন,-" শুন,-সব মেয়েরাই বিয়ের আগে একটা কল্পনা করে,- বিয়ের পর তার স্বামী তার সাথে অনেক গল্প করবে, ঘুরতে নিয়ে যাবে, সিনেমায় যাবে, খুব আনন্দে রাখবে। মেয়েরা মনের কথা বলতে চায়৷ তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলে খুশী হয়৷ "

  আমি শুনছি চুপ করে। তিনি তারপর আমায় জিজ্ঞেস করলেন,-" সারাদিন কি করিস শুনি?  

আমি বল্লাম আমার ডেইলি রুটিনের কথা৷শুনে তিনি আদেশ করলেন,-" শুন্,-সন্ধা ছয়টার পর চেম্বার বন্ধ করে দিবি। রোগীদের জানিয়ে দিবি সন্ধার পর চেম্বার বন্ধ থাকবে। সন্ধার পর বউকে নিয়ে ঘুরতে যাবি, পার্কে-সিনেমায় যাবি, মার্কেট যাবি। সৎসঙ্গে নিয়ে যাবি। কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকলে গুরুভাইদের বাড়ী গিয়ে চা খেয়ে আসবি। বউ যখন কথা বলে  তার কথা শুনবি মনোযোগ দিয়ে। তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হয়। "  

আমি প্রনাম করে উঠে চলে আসলাম।পরদিন সকালে আবার নিবেদনের লাইনে দাঁড়িয়েছি,- মনের কিছু দ্বন্দ এখনও যায় নি। তাঁর কাছে আরো কিছু নিবেদন করব। 

হঠাৎ দেখলাম,- তিনি গলা বাড়িয়ে কাউকে বলছেন,-" কি হল? নিবেদন শেষ হয়নি?মনের দ্বন্দ্ব দূর হয়নি?"আমি আমার সামনে-পিছে দেখছি,- তিনি কাকে বলছেন খুঁজছি৷ তিনি হাত দিয়ে আমার দিকে ইশারা করে ডাকলেন সামনে। আমি গিয়ে প্রনাম করে বসলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,-" কি হল,- সমস্যার সমাধান হয়নি? শুন,- দশচক্রে ভগবানও ভুত হয়ে যায়। কারো কথায় কান দেবেনা৷ কাউকে নিজের সংসারের ঝামেলার ব্যাপারে বলে বিভ্রান্ত হয়োনা। এমনকি নিজের মা বাবাকেও এর মধ্যে জড়াবে না। মাথা ঠান্ডা রাখ,- বুকে সাহস রাখ। ধৈর্য্য সহকারে চললে সব ঠিক হয়ে যাবে।  কি? ঠিক আছে?"  

আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না৷ প্রনাম করে চুপচাপ চলে আসলাম।  শিলং থেকে ফিরে হাসপাতালে জয়েন করে কোয়ার্টারে সন্ধার পর রোগী দেখা কমিয়ে দিলাম। আমি যেখানে ছিলাম সেখানে সিনেমা হল, পার্ক বা ভাল মার্কেট ছিলনা৷ তাই প্রায়দিনই বউকে নিয়ে সন্ধায় সৎসঙ্গে যেতে শুরু করলাম,-সৎসঙ্গ না থাকলে  কোন গুরুভাইয়ের বাড়ীতে গিয়ে চা খেয়ে-আড্ডা দিয়ে চলে আসতাম।   এইভাবে কিছুদিন চলার পর কখন যেন আমাদের সেই মাথা গরম করে কথা কাটাকাটি, ঝগড়াঝাটি, মনোমালিন্য অনেক পরিমানে কমে গেল,- খেয়াল করিনি৷ 

শুধু যে আমাদের সমস্যার সমাধান হল,- তা নয়। সেই জায়গায় প্রচুর দীক্ষা হতে লাগল, অনেকেই স্বস্ত্যয়নী ব্রত গ্রহন করল, প্রচুর সৎসঙ্গ হতে লাগল। তাঁর ছোট্ট একটা নির্দেশ পালনের মধ্য দিয়ে নিজের জীবনের উপকার তো হয়ই,- সাথে আরো অনেকের জীবনেই মংগল বয়ে আনে। 

আমাদের প্রত্যেকের সাংসারিক জীবনেই অমন মনোমালিন্য, ভুল বুঝাবুঝি, ঝগড়াঝাটি হয়। ছোটখাটো ব্যাপার থেকে দিন দিন বড় সমস্যা সৃষ্টি হয়। দুই পক্ষই ভাবে,- "আমি ঠিক- সে ভুল।" কেউ কাউকে বুঝতে পারেনা, একজন অপরপজনের মনের সমস্যা ঠাহর করতে পারেনা৷ তার সাথে যুক্ত হয়,- অহংবোধ। " আমি কেন ভুল স্বীকার করব? আমি কেন নত হব?"  এর থেকে সমস্যা বাড়তে বাড়তে কত কত সংসার ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে, কত কত ডাইভোর্স হচ্ছে। অথচ দেখা যায়,- ছোট্ট একটা সমাধান সূত্রেই সব ঠিক হতে পারে। কিন্তু দুই পক্ষই তখন ক্রোধে, অহংকারে, অজ্ঞতায় নিমজ্জিত হয়ে থাকে বলে সমস্যার সমাধান কেউ সন্ধান পায় না৷ 

তাই আমাদের জীবনে প্রয়োজন, - আচার্য্যদেবের মত একজন অভিভাবক। যিনি সর্বজ্ঞ, বৃত্তিপ্রবৃত্তির আবেশমুক্ত, যিনি পক্ষপাত দোষমুক্ত। যিনি এক লহমায় বাস্তব সমাধান সূত্র বের করে আমাদের ভুল বুঝাবুঝি দূর করতে সক্ষম। তাঁকে ভালবাসলে, তাঁর ইচ্ছা পূরনে সক্রিয় থাকলে আমাদের সাংসারিক জীবনও মধুর হয়ে উঠে, জীবনে সাম্যতা বজায় থাকে।