Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

ভুল পথে পেলাম তোমাকে - Part 3


Part 3: “অন্ধকারের দরজা প্রথমবার খুলল”

ইরা ছাদ থেকে নামার সময় বুঝতে পারছিল—
তার ভেতরে কিছু একটা গভীরভাবে বদলে গেছে।
এটা ভয় না, উত্তেজনা না,
এটা এমন এক অনুভূতি
যেমন রাত্রির অন্ধকারে কোনো আলো না থাকলেও
তুমি জানো—
কেউ আছে পাশে।

মায়ার সঙ্গে আজকের সময়গুলো
অস্বাভাবিক শান্ত করেছিল তাকে।
অস্বাভাবিকই, কারণ
মায়ার হাসির আড়ালে এমন একটা ব্যথা আছে
যা কথায় ব্যাখ্যা হয় না।

ইরা দু’হাত চোখে চেপে ধরল।
মায়া চলে যাওয়ার পরে সে ঠিক যেন শ্বাস নিতে ভুলে গেল।
এত দ্রুত, এত গভীরে
কীভাবে একজন মানুষ কারও মনে জায়গা করে নিতে পারে?

কলেজের লাইব্রেরিতে বসে
মোবাইলে মায়ার নাম টাইপ করতে গিয়েও
হাতে থেমে গেল।
ফেসবুকে খুঁজবে?
ইনস্টাগ্রাম?
কিছুই তো জানে না তার সম্পর্কে।

শুধু একটা কথা মনে আছে—

“আমার জীবন সহজ নয়, ইরা।”

এটা যে শুধু কথার কথা নয়
তা সে বুঝেছিল
মায়ার ব্যান্ডেজ-ঢাকা হাত দেখে।

হঠাৎ ফোন ভাইব্রেট করল।
Unknown Number.

ইরা ধীরে কল রিসিভ করল।
— “হ্যালো?”
— “চোখ বন্ধ করো।”

ইরা চমকে উঠল।
এটা… মায়ার কণ্ঠস্বর।
কিন্তু কেন এত গভীর, এত থমথমে?

— “মায়া?”
— “দ্বিতীয়বার বলছি, চোখ বন্ধ করো।”

ইরা না বুঝে চোখ বন্ধ করল।
— “এখন বলো, তুমি আমাকে কতটা বিশ্বাস করো?”

ইরা নিঃশ্বাস আটকে ফেলল।
এ প্রশ্নটা এমনভাবে করল যেন
তার উত্তরের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।

— “আমি… জানি না। কিন্তু হয়তো—”
— “জানো। তুমি জানো।”

ইরা চুপ।
হঠাৎ গলায় একটা গরম ঢেউ উঠল।
এটা কি ভয়?
না কি অদ্ভুত আকর্ষণ?

মায়া বলল,
— “আজ সন্ধ্যায় ছাদে এসো। একা।”

— “আসলে আজ তো—”
— “আমি বলেছি। একা। আর দেরি কোরো না।”

লাইন কেটে গেল।

ইরা বিচলিত হয়ে গেল।
আগের দিনের উষ্ণ মায়া আজ পুরো আলাদা।
তার কণ্ঠে শীতলতা।
অদ্ভুত তাড়াহুড়া।
আর এমন এক কর্তৃত্ব,
যার সামনে দাঁড়িয়ে ইরার গা শিউরে ওঠে।

কিন্তু সে আবার ভয়ও পেল না।
বরং মনে হলো—
মায়ার ভিতর কিছু একটা হচ্ছে।
গভীর কিছু।


---

সন্ধ্যা – সেই একই ছাদে

ছাদে ওঠার সিঁড়িতে অন্ধকার নেমে গেছে।
ইরা ফোনের ফ্ল্যাশ অন করল।
কিন্তু অনুভব করল—
আজ বাতাসও যেন অন্যরকম।

ছাদে পৌঁছেই দেখে
মায়া দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে।
চুল খোলা।
কিন্তু মুখটা ছায়ায় ঢাকা।

ইরা আস্তে বলল,
— “তুমি ঠিক আছ তো?”

মায়া নড়ল না।
তার হাত দুটো পিছনে।
শরীরটা অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠছিল
যেন সে অনেকক্ষণ ধরে
শ্বাস আটকে রেখেছে।

— “মায়া…?”

হঠাৎ মায়া ঘুরে বলল,
— “আমার ওপর রাগ করবে?”

ইরা চমকে গেল।
— “রাগ? কেন?”
— “কারণ আমি তোমাকে একটা কথা বলেছি… আর সেটা আসলে মিথ্যে।”

ইরার বুক ধক করে উঠল।
— “কোন কথা?”

মায়া কাছে এসে দাঁড়াল।
খুব কাছে।
যে দূরত্বে দাঁড়ালে
শরীরের উষ্ণতা স্পষ্ট লাগে।

— “আমি বলেছিলাম হাতটা পড়ে গিয়ে কেটেছি।”

ইরা তাকিয়ে রইল।
মায়া তার ডান হাতের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলল।
ব্যান্ডেজের নিচে শুধু ক্ষত নয়—
নীল দাগ,
কাঁচের আঁচড়,
আর কয়েকটা ফোলা দাগ।

ইরা শ্বাস রোধ করে বলল,
— “এগুলো… এভাবে হলে পড়লে হয় না।”

মায়ার চোখে কঠিন আলো।
— “হয় না। কারণ এগুলো পড়ে হয়নি।”

ইরা এক পা এগোতে গিয়ে থেমে গেল।
মায়া নিজেই ধীরে বলল—
— “এগুলো আমার নিজের বাড়িতে হয়েছে।”

ইরার মাথা ঝাঁকুনি খেল।
— “বাড়িতে? কে—?”
— “শান্ত হও। জিজ্ঞেস করো না। কিছু জিজ্ঞেস কোরো না।”

মায়া হঠাৎ ইরার হাত চেপে ধরল।
কথাটা খুব নিঃশ্বাস আটকে বলল—
— “ইরা… তুমি যদি জানতে আমার জীবনে কী চলছে… তুমি আমার কাছে আর আসতে না।”

ইরার চোখ ভিজে উঠল।
— “তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দিতে চাইছ?”

— “আমি বাধ্য।”

এই শব্দটা ছুরির মতো বিঁধল।
ইরা হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইল।
কিন্তু মায়া আরো শক্ত করে ধরে ফেলল।

— “মায়া… তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ।”
— “আমি চাই তুমি ভয় পাও!”

মায়ার কণ্ঠ খুব কঠিন, খুব তীক্ষ্ণ।
এটা আগের সেই মায়া নয়।
এটা যেন অন্য কেউ।

— “তুমি আমাকে যতটা কাছে টানছ… ততটাই বিপদে পড়বে।”

ইরা কাঁপতে কাঁপতে বলল,
— “আমি… আমি কিছুই বুঝতে পারছি না—”

মায়া দুই হাত দিয়ে তার মুখ ছুঁয়ে বলল,
— “এই কারণেই তোমাকে বলতে চাই না। তুমি বিশ্বাস করলে, তুমি আমার কাঁধে একটা দায়িত্ব হয়ে যাবে।”

ইরার চোখে অশ্রু।
— “কিন্তু আমি তোমার দায়িত্ব হতে চাই না। আমি শুধু জানতে চাই তুমি ঠিক আছ কি না।”

মায়ার ঠোঁট কাঁপল।
সে ফিসফিস করে বলল—
— “আমি ঠিক নেই।”

ইরা এগিয়ে এসে তার হাত ধরল।
— “তাহলে আমাকে দূরে কেন ঠেলে দিচ্ছ?”

মায়ার চোখের কোণে পানি জমে উঠল।
কিন্তু সে সেটা পড়তে দিল না।

তার ঠোঁটের কঠিন রেখা আবার ফিরে গেল।
— “কারণ তুমি ভালো। আর আমার জীবনে যারা ভালো থাকে… তারা শেষ পর্যন্ত কষ্ট পায়।”

ইরা বলল—
— “তুমি ভাবছ তুমি আমাকে কষ্ট দেবে?”
মায়া মাথা নেড়ে বলল,
— “আমি না… আমার জীবন দেবে।”

হঠাৎ ছাদের ওপর কোথাও একটা শব্দ হলো।
ধাতব কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ।
ইরা চমকে ওঠে।
মায়া মুহূর্তে তার সামনে ঢেকে দাঁড়াল,
যেন কেউ আক্রমণ করতে আসছে।

ইরা স্তব্ধ।
— “মায়া…?”
মায়া গলায় খুব আস্তে বলল—
— “তুমি আজই বাড়ি চলে যাও। আর কাল থেকে… তুমি এখানে আসবে না।”

ইরা তীব্র কণ্ঠে বলল,
— “আমি আসব। তুমি যতই না বলো।”
মায়া চোখ বড় করল।
— “তুমি বুঝছ না! এটা খেলাধুলা নয়। এটা বিপদ!”

ইরা কঠিন স্বরে বলল—
— “তাহলে আমাকে বলো। কি বিপদ?”

মায়া এক মুহূর্তে চুপ হয়ে গেল।
তার চোখে যে ভয় ছিল,
সেটা সত্যি ভয়—
কোনো অভিনয় নয়।

সে ধীরে বলল—
— “যে আমাকে মেরেছে… সে আমার পরিবার নয়।”

ইরা আবার কেঁপে উঠল।
— “কে?”
— “আরও খারাপ কিছু।”

মায়া ইরার দুই গাল ধরে ফিসফিস করে বলল—
— “তুমি আমার কাছে এসেছ ভুল পথে… কিন্তু আমি চাই না এটা তোমার শেষ পথ হয়ে যাক।”

ইরা চোখে পানি নিয়ে বলল—
— “আমি তোমাকে ছাড়ব না।”

মায়ার ঠোঁটে একটা অসহায় হাসি ফুটল।
— “তুমি যদি আমাকে ছাড়তে না চাও… তাহলে তোমাকে একটা শেষ কথা মানতেই হবে।”

ইরা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
— “কি কথা?”

মায়া ইরার কানের খুব কাছে এসে বলল—
— “রাত নামলে আমার ওপর বিশ্বাস ভেঙে যায়।”

ইরা ফিসফিস করল,
— “মানে?”
মায়া চোখ নামিয়ে বলল—
— “মানে… রাতে আমি অন্যরকম হয়ে যাই।”

ইরা থমকে গেল।
মায়া খুব শান্তভাবে বলল—
— “তুমি আমাকে আজ যে ছাদে পেয়েছ… এটা আমার দিনের রূপ।”

— “আর রাতের?”
মায়া পেছনে তাকিয়ে বলল—
— “ওটা তোমার বোঝার সময় এখনো আসেনি।”

ঠিক তখনই অন্ধকার থেকে একটা ছায়া নড়ল।
ইরা ভয় পেয়ে মায়ার হাত চেপে ধরল।

মায়া তীক্ষ্ণ গলায় বলল—
— “যে-ই থাকো… বের হও!”

ছায়াটা কিছু না বলে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ইরা পুরো ঘটনা দেখে পাথর হয়ে দাঁড়াল।

মায়া তার হাত আলতো করে ছাড়িয়ে দিয়ে বলল—
— “চলে যাও, ইরা। আজই।”

ইরা মাথা নেড়ে বলল—
— “আমি আবার আসব।”

মায়া চোখ বন্ধ করল,
যেন এই কথাটা শুনে ব্যথা পেল।

— “তাহলে তুমি সত্যিই ভুল পথে হাঁটছ, ইরা…”
— “…কারণ আমায় ভুল পথে পেলে মানুষ নিজেকে হারায়।”

ইরা কিছু বলতে গেল—
কিন্তু মায়া এগিয়ে এসে
তার কপালের ঠিক মাঝখানে আলতো চুমু দিল।

হালকা।
নরম।
কিন্তু এমন তীব্র
যেন সেখানে কেউ আগুন লাগিয়ে দিল।

মায়া ফিসফিস করে বলল—
— “এটাই প্রথম… আর হয়তো শেষ।”

ইরা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল।
চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল।
মায়া তাকে ছাদ থেকে নামিয়ে দিল,
কিন্তু নিচে নামার সময়
মায়ার চোখে একটুকরো ভয় ছিল—

যেন এটা
শুধু ভালোবাসার গল্প নয়।
বরং এক এমন পথ
যেখানে প্রেমের পাশে দাঁড়িয়ে আছে
অন্ধকার আর বিপদ।

আর ইরা সেই পথেই পা রাখল—
কারণ সে জানত না
মায়ার রাতের রূপটা
ঠিক কতটা ভয়ংকর।


---

চলবে _____