“অন্ধকারের অধিকার”
রাতের বাগানে যে ছায়াটা নড়েছিল—
সেই মুহূর্ত থেকেই সবকিছু বদলে গেল।
ইরা নিঃশ্বাস আটকে তাকিয়ে আছে,
আর মায়া—
যে এখন তার রাতের রূপে দাঁড়িয়ে—
শিকারী চোখে অন্ধকারের দিকে তাকিয়েছে।
এটা স্রেফ ভয় নয়।
এটা অধিকার।
এটা রাগ।
এটা সুরক্ষা।
আর অজানা এক নিষিদ্ধ আকর্ষণ।
ইরা বুঝে গেল…
রাতের মায়া ভয়ঙ্কর, কিন্তু সে হিংস্র রাগে ইরাকে রক্ষা করে।
---
১. ছায়াটির প্রকাশ
বাগানের ঝোপের ভেতর থেকে কেউ বেরিয়ে এলো।
একজন ছেলে।
বয়স ২২–২৩ এর মতো।
চেহারা শান্ত, কিন্তু চোখে অদ্ভুত চাহনি।
হাতে একটা কালো ব্যাগ।
ইরা তাকে চিনতে পারল না।
কিন্তু মায়া— চিনল।
মায়ার ঠোঁট থেকে হালকা গর্জন বেরোল—
— “তুই আবার এদিকে?”
ছেলেটা শান্ত কণ্ঠে বলল—
— “মায়া, আমাকে তোমার সঙ্গে কথা বলতে হবে।”
ইরা লক্ষ্য করল,
রাতের-মায়ার চোখ আরও জ্বলে উঠল।
— “তুই আর আমার কাছে আসবি না। কখনোই না।”
ছেলেটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
— “তুই বদলে গেছিস, মায়া। আমি জানতাম…
একদিন তুই নিজেকে সামলাতে পারবি না।”
ইরা অবাক।
মায়া কি আগেও এমন ছিল?
তার রাতের রূপ সম্পর্কে কেউ জানত?
ছেলেটা ইরার দিকে তাকিয়ে বলল—
— “তুমি ইরা?”
ইরা থমকে গেল।
— “তুমি… আমাকে চেনো?”
— “মায়া তোকে নিয়ে খুব বেশি ভাবে।
তাই তোকে দেখতে এসেছি…”
রাতের-মায়া পাগলের মতো ছুটে গেল তার দিকে।
দুই সেকেন্ড।
মাত্র দুই সেকেন্ডে
সে ছেলেটাকে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরল।
গলায় মায়ার বরফ-ঠান্ডা হাত।
ইরার ভয়ে হাঁটু কাঁপছে।
— “তুই আবার তার নাম নিলে…
এই হাতে তুই মরবি।”
ছেলেটার চোখে কোনো ভয় নেই।
— “তুই তো জানিস, রাগ তোর নিয়ন্ত্রণে নেই।
তুই আমাকে মারবি না।”
মায়ার দাঁত চেপে ধরল।
গলা থেকে গর্জন বেরোল।
— “ইরাকে দেখিয়ে আমার রাতকে জ্বালাচ্ছিস?”
ইরা দৌড়ে এগিয়ে এলো।
— “মায়া, থামো! ছাড়ো তাকে! প্লিজ!”
ইরার স্পর্শে
মায়া থেমে গেল।
তার হাতটা আলগা হয়ে গেল।
মাথা নিচু করল—
যেন হঠাৎ নিজেকে ঘৃণা করছে।
ছেলেটা দম নিয়ে বলল—
— “যা ভয় পেতাম, তাই ঘটেছে…
মায়া এখন পুরোপুরি ভেঙে গেছে।”
ইরা তাচ্ছিল্য ভরা চোখে তাকাল—
— “তুমি কে? তুমি কেন এসেছ?”
ছেলেটা ধীরে বলল—
— “আমার নাম রোহান।
মায়ার পুরোনো থেরাপিস্ট।”
ইরা শ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল।
মায়ার রাতের রূপ ঝড়ের মতো থেমে গেল।
চোখের আগুন নিভে গেল।
“থেরাপিস্ট…”
তার মানে…
মায়া আগে থেকেই মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ছিল?
কী যন্ত্রণা?
কেন?
রোহান বলল—
— “মায়ার এই রাতের রূপ…
এটা কোনো অলৌকিক কিছু না।
এটা ট্রমা।
ভয়।
আটকে থাকা ব্যথা।
বছরের পর বছর জমে থাকা ক্ষত।”
রাতের-মায়া দাঁত চেপে বলল—
— “চুপ কর।
ইরার সামনে এক শব্দও বলবি না।”
রোহান বলল—
— “তোর সত্যিটা সে জানবে।
অবশ্যই জানবে।”
ইরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
কোনো কথা বলতে পারছে না।
---
২. রাতের-মায়ার ভেঙে পড়া
রোহান চলে যেতেই
মায়া একদম নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
তার নিশ্বাস ছোট ছোট।
হাঁটু কাঁপছে।
মুখে যেন সমস্ত রক্ত শুকিয়ে গেছে।
ইরা ধীরে কাছে গিয়ে বলল—
— “মায়া… তুমি ঠিক আছ?”
মায়া তার থেকে পিছিয়ে গেল।
ধীরে—
যেন ইরাকে ছুঁলে তার ক্ষতি হবে।
— “আমাকে ধরো না।”
— “কেন?”
মায়ার চোখ জলে ভরে উঠল।
— “রাতের আমি…
মানুষকে আঘাত করে, ইরা।
আমি চাই না তুমি আমার হাতে ভাঙো।”
ইরা এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরল।
মায়া হতবাক হয়ে তাকাল।
— “দেখো… তুমি আমাকে আঘাত করোনি।
তুমি বরং আমাকে রক্ষা করেছ।”
মায়া মাথা নেড়ে বলল—
— “না। তুই বুঝিস না।
রাতের আমি…
অধিকারপরায়ণ।
হিংস্র।
নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি।”
ইরা তার মুখ দুই হাতে ধরল।
— “আর দিনের তুমি?”
মায়া চোখ নামাল।
— “দিনের আমি…
ভয় পাই…
সব হারানোর ভয়…”
ইরা মায়ার গাল স্পর্শ করল।
এবার মায়া কেঁদে ফেলল।
নীরবে, ধীরে, ভেতরের ব্যথা গলে গলে পড়ছে।
— “তুই কেন আমার জীবনে এলে?”
ইরা তার কণ্ঠে প্রেম শুনল।
যন্ত্রণার প্রেম।
অধিকারের প্রেম।
সে ধীরে ফিসফিস করল—
— “হয়তো আমি তোমাকে ভুল পথে পেলাম…
কিন্তু ভুল মানুষ পাইনি।”
মায়া চোখ তুলে তাকাল।
তার দুটো রূপ—
দিব্য আর অন্ধকার—
একসঙ্গে লড়ছে যেন।
— “তুই আমাকে ভালোবাসিস?”
ইরা নিঃশ্বাস ধরে ফেলল।
এটাই প্রথমবার
মায়া সরাসরি প্রশ্ন করল।
তার বুক কেঁপে উঠল।
— “হ্যাঁ।”
এক শব্দ।
কিন্তু মায়ার ভেতর যেন ভূমিকম্প।
মায়া কাঁপা কণ্ঠে বলল—
— “ইরা…
আমি তোকে খুব খারাপ জিনিসে টেনে আনছি।”
ইরা বলল—
— “আমার পথ আমি নিজে বাছি।
তুমি যতই ভুল হও…
আমি তোমাকে ভুল মনে করি না।”
মায়া তার হাত নিজের বুকে চাপল।
— “তুই জানিস না…
রাতের আমি তোর উপর কতটা অধিকার চায়।”
ইরা ঠোঁট কামড়ে বলল—
— “আমি ভয় পাই না।”
মায়া কাছে এসে ফিসফিস করল—
— “পাবি…
কারণ রাতের আমি তোর কাছ থেকে
সারা পৃথিবীটাই চাই।”
তার শ্বাস ইরার কানে গরম হয়ে লাগল।
— “আর কাউকে তোর কাছে সহ্য করতে পারি না।”
ইরা বিহ্বল হয়ে গেল।
এটা ভালোবাসা?
নাকি হিংস্র অধিকার?
হয়তো দুটোই।
---
৩. দিনের-মায়ার ফিরে আসা
হঠাৎ মায়ার শরীর আবার কাঁপতে লাগল।
সে একদম নিস্তেজ হয়ে মাটিতে বসে পড়ল।
ইরা তড়িঘড়ি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল—
— “মায়া! কি হচ্ছে?!”
মায়া চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিতে লাগল।
হাঁপাচ্ছে।
দুর্বল।
এবার…
ধীরে ধীরে রাতের রূপ মিলিয়ে যেতে লাগল।
তার চোখের লালচে আভা ম্লান হয়ে গেল।
মুখ নরম হলো।
হাত উষ্ণ হলো।
ইরা বুঝল—
দিনের মায়া ফিরে আসছে।
মায়া চোখ খুলল।
চোখ দুটো…
আবার সেই কোমল, স্নিগ্ধ।
যে চোখে ইরা প্রথম প্রেম দেখেছিল।
মায়া দুর্বল গলায় বলল—
— “ইরা… আমি কি তোমাকে ভয় পাইয়ে দিলাম?”
ইরা তার কপালে চুমু দিল।
— “না।
তুমি শুধু আমাকে আরও বেশি চিনতে দিলা।”
মায়া হাসল।
একটা ভাঙা, ক্লান্ত হাসি।
— “আমাকে ছেড়ে যাস না, ইরা…”
ইরা তার মাথা নিজের কাঁধে রাখল।
— “আমি কোথাও যাচ্ছি না।”
মায়া চোখ বন্ধ করে বলল—
— “রাতের আমি তোকে ভালোবেসে ফেলেছে, ইরা…
আর দিনের আমি…”
তার কণ্ঠ ভেঙে গেল।
— “দিনের আমি তোর জন্য ভয় পাই…”
---
৪. ছায়া-মানুষটা কে?
ইরা মায়াকে তুলে দাঁড় করাল।
দুজনে বাগান থেকে বের হচ্ছিল।
হঠাৎ ইরা পিছনে তাকিয়ে জমে গেল।
বাগানের ফটকের ওপাশে
একটা মানুষ দাঁড়িয়ে।
অন্ধকারে পুরো মুখ দেখা যায় না—
কিন্তু চোখ দুটো জ্বলছে।
ইরা কেঁপে উঠল।
এ কি রোহান? নাকি অন্য কেউ?
মায়া কিছু দেখতে পেল না।
ইরা তাকিয়ে রইল—
কিন্তু মানুষটা
ধীরে ধীরে পিছিয়ে
অদৃশ্য হয়ে গেল।
ইরার বুক ধড়ফড় করছে।
ওটা কে?
কেন তাকিয়ে ছিল?
কেন ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল?
মায়া দুর্বল কণ্ঠে বলল—
— “চলো… আজ রাতে কিছুই ঠিক নেই…”
---
৫. বাড়ির সামনে—প্রথম স্পর্শের স্বীকারোক্তি
দুজনে বাড়ির সামনে পৌঁছাল।
নিস্তব্ধ রাত।
তীব্র বাতাস।
ছায়ার গন্ধ।
ইরা দরজা খুলতে যাচ্ছিল,
মায়া তার হাত ধরে ফেলল।
ইরা থেমে গেল।
মায়া ধীরে বলল—
— “ইরা…
তুই বুঝিস না…
রাতের আমি তোকে যেভাবে দেখে…”
ইরা তার দিকে তাকাল।
মায়া বলল—
— “ওর কাছে তুই
কেউ নও…”
এক সেকেন্ড থামল।
— “তুই ‘সবকিছু’।
ওর অস্তিত্ব।”
ইরা নিঃশ্বাস ফেলল।
মায়া ইরার কানের কাছে এসে বলল—
— “দিনের আমি তোকে ভালোবাসতে শুরু করেছি…
আর রাতের আমি…”
তার আঙুল ইরার ঠোঁটে বসাল।
— “রাতের আমি তোকে
নিজের করে নিতে চায়।”
ইরা পুরো শরীর কেঁপে উঠল।
মায়া ধীরে তার চিবুক তুলল।
চোখে আগুন—
কিন্তু এবার সেটা প্রেমের আগুন।
মায়া প্রথমবার
ইরার কপালে
একটা দীর্ঘ চুমু দিল।
এই স্পর্শ ছিল স্বীকারোক্তি।
কথা ছাড়াই।
ইরা মুহূর্তটা ধরে রাখল।
শরীর কাঁপছিল।
হৃদস্পন্দন তীব্র।
মায়া নিঃশব্দে বলল—
— “তুই আমার।”
ইরা তাকে জড়িয়ে ধরল।
কোনো কথা নয়।
শুধু অনুভূতি।
এই রাত থেকে
দুজনের সম্পর্ক আর একই থাকবে না।
এটা শুধু ভালোবাসা নয়—
এটা অধিকার।
এটা টান।
এটা ভয়।
এটা গভীরতা।
আর সেই ছায়া-মানুষটা?
সে কে?
কেন এসেছে?