নয়ন যে ধন্য
লেখক
নরেন্দ্র মোদী
(1)
_______________________________________
অনুবাদ
মল্লিকা মুখার্জী
_______________________________________
ভূমিকা
প্রতি বছর সেপ্টেম্বের মাসে আমাদের কার্যালয়ে ‘হিন্দি একপক্ষ’ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। ২০১৪ সালে বরিষ্ঠ নিরীক্ষা অফিসারের পদের সাথে হিন্দি অফিসারের কার্যভার আমার কাছেই ছিল। সেপ্টেম্বর মাসে আয়োজিত ‘হিন্দি একপক্ষ’র অধীনে, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব প্রফেসর এবং বর্তমানে আমেদাবাদে অবস্থিত গুজরাত বিদ্যাপীঠের ভাষা সংস্কৃতি সংস্থানে অধ্যাপন কাজে ব্যস্ত সুবিখ্যাত মহিলা-কবি ড. অঞ্জনা সন্ধীরকে, প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলাম। আমাদের কার্যালয়ে হিন্দি ভাষার প্রচার-প্রসার উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রায়ই ওঁনাকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত করা হয়।
এইবারও উনি আমার আমন্ত্রণ স্বীকার করলেন। আমাকে বললেন, ‘মল্লিকা, আজ আমি তোমায় একটি ভালো খবর শোনাচ্ছি। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদীর লেখা ‘আঁখ আ ধন্য ছে’ গুজরাতি কাব্যগ্রন্থের আমি হিন্দিতে অনুবাদ করেছি, বইয়ের কপি আমি আজই পেয়েছি; নাম হচ্ছে ‘আঁখ ইয়ে ধন্য হায়’। আমি বইটি হাতে নিয়ে ওঁনাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানালাম। সেপ্টেম্বরের তিরিশ তারিখে আমাদের অনুষ্ঠনে সমাপ্ত হল। সেইদিন প্রধান অতিথি অঞ্জনাদি আমাদের কার্যক্রমকে সবচেয়ে সফল করে তুললেন। ওঁনার অভিভাষনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল, আমেরিকায় থেকে দীর্ঘদিন ধরে বিভন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অদ্ধ্যাপনা করা কালীন হিন্দি ভাষাকে বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত ভাষায় স্থান দেবার ওঁনার চেষ্টা। অনুষ্ঠন শেষ হতে আমি ওঁনাকে ছাড়তে গিয়েছি।
রাস্তায় উনি আমাকে মোদীজীর হিন্দী কাব্যগ্রন্থের একটি কপি দিলেন আর বললেন, ‘দেখো যদি তুমি এই বইয়ের বাংলায় অনুবাদ করতে পারো।‘ পরের মুহুর্তেই আমি রাজি হয়ে গেলাম। মনের মধ্যে ভয় ছিল যে কাজটা করতে পারব কি না। কিছুক্ষণ পরে আমি বললাম, ‘অঞ্জনাদি, এক বার আমি পড়ে নিই, শেষ হলে আপনাকে জানিয়ে দেবো। কয়েক দিন বাদেই আমি ওঁনাকে ফোন করে জানালাম যে আমি এই গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ করব। অঞ্জনাদি অনুমতি দিলেন। আর কি? মনে-প্রাণে লেগে গেলাম এই অসাধারণ কাজে। আজ তার পরিনাম আপনাদের সামনে রয়েছে।
বাবা শ্রী ক্ষিতীশচন্দ্র ভৌমিক গুজরাতে, পশ্চিম রেলের বরোদা বিভাগে (Baroda Division)সহায়ক স্টেশন মাস্টার ছিলেন। বিভিন্ন স্টেশনে বদলির কারণেই আমার শিক্ষা-মাধ্যম গুজরাতি ছিল। বাবা পরিবারকে প্রচন্ড ভালবাসতেন। ওঁনার মত ছিল, উনি যে জায়গায় থাকবেন, ওঁনার পরিবার সেখানেই থাকবে। বাবা গুজরাতি ভাষা জানতেন না, তাই উনি বাড়িতেই গুজরাতি শিক্ষার ব্যবস্থা করলেন। আমার মনে আছে, তিন বছর বয়সে যখন আমার লেখাপড়া শেখার সময় হল, বাবা ছোটা উদয়পুর, উপজেলার তেজগঢ রেলওয়ে স্টেশনে পদস্থ ছিলেন। সেই গ্রামে আমার গুরুজি কান্তিভাই, যিনি আমাকে পড়াতে আসতেন, নিজেই ছিলেন অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র! এক সময়ে আমাদের বাড়িতে ‘গুজরাত সমাচার’ খবরের কাগজ আনা শুরু হল। গুজরাতি ভাষা শেখার আগ্রহে আমি তারক মহেতা, কান্তি ভট্ট, বকুল ত্রিপাঠি, ড.শরদ ঠাকর, ফাদার ভালেসের ধারাবাহিক স্তম্ভ মন দিয়ে পড়তে শুরু করলাম। আমি অনুভব করতাম ফাদার ভালেস যেন গুজরাতি ভাষাকে আত্মসাৎ করে নিয়েছেন! ছোটো-ছোটো পংক্তির মাধ্যমে কত সহজে উনি বড়ো কথা বলে দিতেন!
বড়ো হয়ে আমি মহাত্মা গান্ধি, পান্নালাল পটেল, কনাইয়ালাল মুন্সী, জ্যোতিন্দ্র দবে, উমাশংকর জোশী, গোবর্ধনরাম ত্রিপাঠি, কবি কলাপী, সুরেশ দলাল, রমেশ পারেখ, ভক্ত-কবি নরসিংহ মহেতা, ভক্ত মহিলা-কবি মীরাবাই, সুশ্রী কাজল ওঝা বৈধ ইত্যাদি অনেক গুজরাতি লেখক ও কবিদের রচনা পড়ার সুযোগ পেয়েছি। গুজরাতি ভাষা যেন আমার শিরায়-শিরায় ঝরনা হয়ে বইতে লাগল।
বাবা বলতেন, প্রতিটি লোকের মাতৃভাষার জ্ঞান থাকা দরকার। বাবা আমায় বাড়িতেই বাংলা পড়াতেন। বাংলা সাহিত্য পড়ে আমার রুচি বাড়লো। আমার মা বই পড়তে খুব ভালোবাসতেন। মা-র কাছে বিবাহ উপলক্ষ্যে পাওয়া অনেক সাহিত্যিকের বই ছিল। আমি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মহর্ষি অরবিন্দ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, স্বামী বিবেকানন্দ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়, বিমল মিত্র, মহাশ্বেতা দেবী, তসলিমা নাসরিন ইত্যাদি সাহিত্যকদের রচনা বাংলায় পড়ার সুযোগ পেয়েছি।
অনুবাদের জন্য অননুদিত ভাষা (source language) এবং সুনির্দিষ্ট ভাষা (target language)উভয়ই জানা দরকার। যদিও আমি বাংলা ভাষা বলতে, লিখতে, পড়তে জানি, আমি এই অনুবাদের কাজে বাংলা অভিধানের/শব্দকোষের সাহায্য নিয়েছি কারণ ভাষা মধ্যে ভাষার (language within language)প্রতীতি হওয়া দরকার। একই শব্দের এত মানে। এই অনুবাদ কাজে আমি বাংলা ভাষার সমৃদ্ধির পরিচয় পেলাম। শব্দের উচিত অর্থ খোঁজার প্রক্রিয়া আমার সৃজনশীলতা কে আরও একটি বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছে। আমি চেষ্টা করেছি, এই কাব্যগ্রন্থের অনুবাদে মৌলিকতা যেন সুরক্ষিত থাকে। ভাষা উচিত শব্দ পায় এবং আমি মূল রচনার সাথে ন্যায় করতে পারি। আমি অনুবাদের জন্য পেরাফ্রেজ (paraphrase)বিকল্প মনোনীত করেছি, মূল-কে কোনো ক্ষতি না করে, শব্দান্তরে অর্থপ্রকাশ করে, কৃতির নিকট যাবার চেষ্টা করেছি। যেখানে অসুবিধে মনে হয়েছে, অঞ্জনাদির হিন্দি অনুবাদিত কাব্যগ্রন্থের সাহায্য নিয়েছি। যেই শব্দের অনুবাদ সম্ভব নয়, মূল শব্দই রেখে দিয়েছি। যেমন-‘গরবা’, এক ধরনের লোকনৃত্য যার উদ্ভব গুজরাতে হয়েছে। এই নামটি সংস্কৃত শব্দ ‘গর্ভ’ এবং ‘দীপ’ থেকে নেওয়া হয়েছে। মুখ্যত নবরাত্রি পর্বের উপলক্ষে গরবা আয়োজন করা হয়।
মোদীজী দুটি কবিতায় তরনেতরের মেলার উল্লেখ করেছেন। এই মেলার স্মৃতি ওঁনার মনকে তরঙ্গিত করে তোলে। গুজরাতে সুরেন্দ্রনগর জেলায় অবস্থিত থানগঢ নগরের পাশে তরনেতর নামে একটি গ্রাম আছে, সেখানে ত্রিনেত্র্শ্বর মহাদেব মন্দিরের প্রাঙ্গনে প্রতি বছর, ভাদ্র মাসে, (August-September) শুক্ল পক্ষের চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠীর দিনে মেলার আয়োজন করা হয়। গুজরাতি লোকনৃত্যের সাথে-সাথে গীত-সঙ্গীত, পূজা-উপাসনার আয়োজন করা হয়। প্রধানত আদিবাসী ছেলে-মেয়েরা পরম্পরাগত গয়না, পোশাক পরিধান করে সহচর খোঁজ করতে এই মেলায় আসে।
মোদীজীর সাথে আমার কোনো প্রত্যক্ষ পরিচয় নেই। এক বার ওঁনার ভাষণ শোনার সুযোগ হয়েছিল। ভারতের সি.এ.জি. সংস্থার নিয়ন্ত্রণে গুজরাতের আমাদের আঞ্চলিক কার্যালয়ে। এই প্রতিষ্ঠান ১৬ নভেম্বর, ২০১০ সালে তার সংস্থাপনের ১৫০ বছর পূর্ণ করেছে। ঐ সময় মোদীজী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উনি এবং গুজরাতের তৎকালীন রাজ্যপাল মাননীয়া শ্রীমতী কমলা বেনীভাল আমাদের সম্বোধীত করেছিলেন। মোদীজী শুধু আমাদের প্রতিষ্ঠানের কার্যপ্রণালী সম্বন্ধে বক্তব্য রাখেন নি, হিসাবপরীক্ষা সম্বন্ধে কিছু দামি পরামর্শও দিয়েছিলেন। কার্যালয়ের সব সদস্য ওঁনার সম্বোধনকে প্রশংসা করেছিলেন।
নিজের শরীর, মন এবং হৃদয়কে প্রভুর প্রসাদ মেনে চলেন মোদীজী। কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, উনি সাহিত্যক বা কবি নন, কিন্তূ যে সহজতা নিয়ে উনি নিজের মনোভাবকে শব্দে প্রকাশিত করেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই যে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে কবি বা লেখক নিহিত থাকেন। যতক্ষণ আমরা কোনো ব্যক্তি বিশেষের কাল্পনাজগতে ভ্রমণ না করি, ওঁনাদের যাত্রার পরিচয় পাওয়া যায় না। মোদীজীর পদ-প্রতিষ্ঠাকে দূরে রেখে, আমি অবশ্যই বলব যে ওঁনার কবিতায় উনার ব্যক্তিত্বের একটি স্পস্ট ছবি ভেসে ওঠে। স্থিতি আর গতির সমন্বয়ে উনি আস্থা রাখেন। জীবনের প্রতিটি আহবানকে স্বীকার করে বর্তমানে কর্মরত থাকতে পারেন। নিজের ধর্মের ওপর গর্ব বোধ করেন কিন্তূ সাম্প্রদায়িকতার গলি এড়িয়ে চলেন। নিজের সংকল্প সঙ্গে নিয়ে চলেন। জীবনের অভিষ্ট লক্ষ্য একটি বটবৃক্ষের মতো ওঁনার হৃদয়ে বিকশিত হয়েছে। গুজবের প্রতিক্রিয়া দেওয়া বা খোশামুদে প্রভাবিত হওয়া তাঁর স্বভাবে নেই।
জীবনের প্রতি ন্যায়সঙ্গত ভাবনা তাঁকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কাছে নিয়ে যায়। তাই তো তিনি গ্রীষ্মের হৃদয়ে বসন্ত হয়ে কল্লোল করতে চান। সাধারণ মানুষের মত কখনো ভাবপ্রবনতায় ভেসে যান আবার মনকে সংযতও করে নেন। কয়েকটি আধ্যাত্মিক রচনাও রয়েছে। উনি লিখেছেন কখনো কাঁচা আমের স্বাদও একটু অন্য রকম স্বাদের অনুভূতি দিতে পারে। তাঁর এই কথা সর্বথা সত্য। মোদীজী নিজের জীবনের সাথে জড়িত অনুভূতির কথা, গদ্যকবিতার রচনাশৈলীর পালন না করেও, বিশেষ ধারায় কাগজে এঁকেছেন। কোনো কোনো রচনায় ছন্দের আভাস পাওয়া যায় যা সত্যিই কাঁচা আমের স্বাদের অনুভূতি দিয়ে যায়! তাঁর কবিতা বারবার একই কথার অনুভূতি করায় যে মানবের হৃদয়ে অনন্ত সোন্দর্য নিহিত থাকে, দরকার হল তাকে উন্মেষিত করা।
আমার সৌভাগ্য যে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী লিখিত ‘আঁখ আ ধন্য ছে’ গুজরাতি কাব্যগ্রন্থের বাংলা অনুবাদ করার সুযোগ পেয়েছি। এই বড়ো কাজের সম্পুর্ন কৃতিত্ব আমি অঞ্জনাদি কে দেবো, তাঁর অনুপ্রেরণা ছাড়া এ সম্ভব ছিলনা। আমার প্রিয় সন্তান সৌরভের যোগদান ভোলা যাবেনা। সেই আমার স্মার্ট ফোনে প্রথমে ইংরেজী-বাংলা শব্দকোষ ডাউনলোড করে দেয়। আমার বড়ো ভাসুর জয় মুখার্জী এবং দিদিভাই শ্রীমতী অপর্ণা মুখার্জী আমায় অনুবাদের সঠিক পরিভাষার ব্যাখ্যা করে আমায় বাংলা অভিধান সংগ্রহ করতে বললেন। আমার অনুবাদের কাজ সহজ হয়ে গেল। আমার পারিবারিক বন্ধু দম্পতি কুশাঙ্কুর দে ও মাম্পি সরকার, আমি যেখানে সংশয় বোধ করেছি, শব্দের সঠিক অর্থ খুঁজে পেতে আমাকে সাহায্য করেছে। আমার সহকর্মী বান্ধবী ভারতী গোহেল কম্পিউটারে প্রাথমিক কাজে সবসময় আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। কার্যক্ষেত্র ও সংসারের মাঝে সামন্জস্য করে এই কার্যসম্পাদন করা মুশকিল ছিল, কিন্তূ অসম্ভব ছিলনা। এই কাজে আমার জীবনসঙ্গী পার্থ মুখার্জীর সমর্থনও ভুলবার নয়। আমার পুত্র-পুত্রবধু, সোহম-আকাঙ্ক্ষা সর্বদাই আমায় লেখালেখির কাজে অনুপ্রেরিত করে।
এই গ্রন্থের প্রকাশক মাতৃভারতী ডট কোম এবং আমেদাবাদের গ্রাফিক ডিজাইনার শ্রী অমরিশ পাঁচালকে, যে এই বইয়ের প্রচ্ছেদ তৈরি করেছেন, আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি
আজ মোদীজীর গুজরাতি কাব্য সংগ্রহের বাংলা অনুবাদ ‘নয়ন যে ধন্য’ আপনাদের সামনে হাজির করে আমি গর্বিত বোধ করছি। আমার বিশ্বাস যে আপনাদের অবশ্যই ভালো লাগবে।
২৩ অক্টোবর, ২০১৫
মল্লিকা মুখার্জী
Mallika Mukherjee,
18, Shubhakamna Society,
Anandnagar Road,
Satellite, Ahmedabad-380015,
Gujarat.
Email: Mukherjee.mallika@gmail.com
সম্বোধন
বিশ্বের সাধারণ লোক এবং বিশিষ্ট লোক, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী সম্বন্ধে যার যার অভিমত জানিয়েছেন; তাঁর প্রশংসা করেছেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন রূপের সমালোচনাও করেছেন, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্বের একটি রূপ হচ্ছে সুক্ষ্মদর্শী এবং সংবেদনশীল কবির রূপ। মাতৃভাষা গুজরাতিতে উনি ভালো কবিতা লেখেন যা পড়ে তাঁর ব্যক্তিত্বের অধিকাংশ রূপের পরিচয় পাওয়া যায়। গুজরাতি ভাষায় লেখা তাঁর কাব্য-গ্রন্থ ‘আঁখ আ ধন্য ছে’(আঁখ য়ে ধন্য হায়) 2007 সালে প্রকাশিত হয়। এই কাব্য-গ্রন্থে সাতষট্টি কবিতার সাথে-সাথে আকর্ষনীয় ছবিও রয়েছে।
সক্রিয সাংবাদিক হবার সুত্রে মোদীজীর সাথে আমার পরিচয় ওই সময় থেকে আছে যখন উনি প্রথম বার কাশ্মিরে ধ্বজ উত্তোলন করে ফিরলেন। আমেদাবাদে, এম.জে. লাইব্রেরির বেসমেন্টে ভারতীয জনতা পার্টির তরফ থেকে একটি বিশেষ সভার আয়োজন করা হয়েছিল। এই সভায় শহরের বিশিষ্ট বিদ্বান্, লেখক এবং কিছু প্রখ্যাত সাম্বাদিকরা আমন্ত্রিত ছিলেন। এই সভায় ভারতীয় জনতা পার্টির বরিষ্ঠ নেতা শ্রী লালকৃষ্ণ আডবানী, গুজরাতের এম.পি. শ্রী হরিন পাঠক এবং বী.জে.পি.র কার্যকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। যুবা কার্যকর্তা শ্রী নরেন্দ্রে মোদীকে এই কঠিন কাজ করার জন্য অভিনন্দন জানানো হয়েছিল। এই সভায় লেখিকা এবং সক্রিয সাংবাদিক হিসেবে আমিও আমন্ত্রণ পত্র পেয়ে ছিলাম। ১৯৯৫ সালে বিবাহের পর আমি আমেরিকায় চলে গেলাম। সময়ের সাথে মোদীজীর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার গ্রাফ উঁচুতে উঠতে লাগল। তিনি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হলেন।
আমি আমেরিকার থেকে প্রতি দু বছরে ভারতে আসতাম। প্রতিবারের স্বদেশ যাত্রায় আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাতে তাঁর সাথে এক বার অতি অবশ্যই দেখা করতাম। এমনকি হিন্দি সাহিত্যের যা বই আমি যখন সম্পাদনা করেছি, তাঁকে উপহার স্বরূপ দিয়েছি, উনি আমার কাজের প্রশংসাও করেছেন।
নিউ ইয়র্ক শহরে, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশী ভাষা হিসেবে হিন্দি পড়াতে-পড়াতে ফিল্মি গানের সাহায্যে হিন্দি শেখানোর একটি নতুন পদ্ধতি খুঁজে পেলাম। একটি বই লিখলাম, ‘Learn Hindi And Hindi Film Songs’ কারণ বিদেশে ছাত্রদের পন্ডিত সেজে হিন্দী পড়ানো সম্ভব নয়। এই পদ্ধতি খুব কাজে লেগেছে কারণ আমাদের ফিল্মি গানের মধ্যে ভাষা, পরিবেশের সাথে ব্যাকরণ রয়েছে, যেমন-
‘সৌ সাল পহলে মুঝে তুমসে প্যার থা,
আজ ভী হায় ঔর কল ভী রহেগা।’
এই দুটি লাইনের মধ্যে তিনটি কাল রয়েছে :
বর্তমান কাল : তা তে তী Present Tense
অতীত কাল : থা থে থী Past Tense
ভবিষ্যত কাল : গ গে গী Future Tense
থা হায় ঔর গা
was is and will
ব্লেক বোর্ডে যখন এই বক্স তৈরি করে আমি গানটি শোনাতাম, কক্ষ জীবন্ত হয়ে উঠতো। ছাত্ররা সহজেই ক্রিয়ার কাল শিখত সাথে-সাথে গানও শিখত। ঠিক এইরকম আর-একটি গান :
‘মেরা জুতা হায় জাপানী, য়ে পতলুন ইংলিশতানী,
সর পে লাল টোপী রূশি, ফির ভী দিল হায় হিন্দুস্তানী’
এই গানে জাতিগত বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। জাপান থেকে জাপানি, ইংলিস্তান থেকে ইংলিস্তানী, রুস থেকে রূশি আর হিন্দুস্তান থেকে হিন্দুস্তানি।
আমাদের নতুন প্রজন্ম যারা বিদেশে বসবাস করে, এই গান শুনে আনন্দ পায় কিন্তু গানের অর্থ জানেনা। সেই জন্য আমি ওখানে আর.বি.সি. রেডিওতে ‘আও শিখে হিন্দি ভ হিন্দি ফিল্মি গীত’ নামে একটি কার্যক্রম হোস্ট করতাম। প্রতি সপ্তাহে একটি গান, তাতে সম্মিলিত বিশেষ গুরুতর শব্দের অর্থ এবং গানের অনুবাদ প্রস্তুত করে, সবশেষে গানটি শোনাতাম। অনুষ্ঠানের শেষে তিনটি শব্দের অর্থ বলতাম যেমন, ‘হেলো’ কে হিন্দিতে বলে ‘নমস্তে’। ‘গুড নাইট’ কে বলে ‘শুভ রাত্রি’ এবং ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ কে বলে ‘ধন্যবাদ’ বা ‘শুক্রিয়া’। এই কার্যক্রম এত নাম করল যে দশ মিনিটের এই রেডিও শো শেষ হওয়ার পরেও আধ ঘন্টা অবধি ফোনের রিং বাজত, যে আগামী সপ্তাহে এই বা ওই গানটি শুনতে চায়। গানের অর্থ জানার পর গান শোনার আনন্দ অনেকটা বেড়ে উঠেছে বলে শ্রোতারা বিশেষভাবে শুভ কামনা ও অভিনন্দন জানাত।
এই বইটি ‘Learn Hindi And Hindi Film Songs’ তাৎপর্যপূর্ণ প্রমাণিত হল। নিউ ইয়র্ক লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানি দ্বারা আমেরিকায় হিন্দি প্রসার হেতু বইটি মনোনীত হল। কোম্পানি দশ হাজার বই ও সিডি সারা আমেরিকায় বিতরিত করলেন। এই বইটি একটি আন্দোলন শুরু করলো আর জনতা ভাবতে লাগল যে ওদের সন্তানদের হিন্দি শেখা উচিত। আমার ভারত উপস্থিতির সময় আমি শ্রী নরেন্দ্র মোদীকে এই বই ও সিডি উপহার স্বরূপ দিলাম। তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে বইটি দেখলেন, আমার কাজের প্রশংসা করলেন, শুধু তাই নয় তাঁর বিদেশ যাত্রার কিছু অনুভবের কথাও বললেন। তিনি বললেন মরেশিয়াস ঘানা, ত্রিনিদাদে ভারতবাসীদের আবাসে হিন্দি গান শোনা যায়, কারণ ওরা ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে সম্পর্ক রাখতে চায়। যদিও সেই গানের মানে ওরা জানেনা, ওদের অনুভূতি এখনও ভারতীয় আস্থা তে ডুবে আছে। মোদীজী নিজের অনেক অনুভবের কথা বলে আমার মনোবল বাড়িয়েছেন, যার ফল হল, আমি কোম্পানির তরফ থেকে বিনামূল্যে পাঁচশ বই তাঁকে পাঠালাম। ‘প্রবাসী ভারতীয় দিবস’ সমারোহের উপলক্ষ্যে ‘গুজরাতি পরিবার মহোৎসব’ অনুষ্ঠানে বিশ্বের প্রতিটি কোন থেকে গুজরাতে প্রবাসী এন.আর.আই.রা আসেন। এই অনুষ্ঠানে তাদের এই বই তথা সিডির গিফট পেক তৈরি করে গুজরাত সরকারের তরফ থেকে উপহার হিসেবে দেওয়া হল। মোদীজীর রাষ্ট্রভাষা হিন্দি ও ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি প্রেমের এটাই শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
২০০৬ সালে নিউ ইয়র্ক লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানির দ্বারা আয়োজিত স্পর্ধার বিজেতা পনের যুবক-যুবতীরা ভারত ভ্রমনে, গুজরাতে এসেছিল। আমিও ছিলাম আমন্ত্রিত। দু সপ্তাহের গুজরাত ভ্রমনের কার্যক্রম ছিল, ফিল্মও তৈরি হচ্ছিল। এই সফর কালে মোদীজী আমাদের প্রায় এক ঘন্টা দশ মিনিটের সময় দিয়েছিলেন। আমেদাবাদের কর্ণাবতী ক্লাবে আয়োজিত এই সভায় এন.আর.আই. এবং বিজেতা যুবক-যুবতীরা মোদীজীকে নানা রকম প্রশ্ন করেছিলেন, যার পরিতোষপূর্ণ উত্তর তিনি দিয়েছিলেন। একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা আপনাদের ডলার চাই না। হ্যাঁ, যদি আপনাদের মনে ভারতের জন্য কিছু করার ইচ্ছে থাকে তাহলে আপনারা প্রত্যেকে একটি পরিবারকে ভারত ভ্রমনে পাঠাতে পারেন, অনেকটা সাহায্য হবে।’ আমার মনে আছে, তখনো তিনি ‘গুজরাতে পাঠাতে পারেন’ না বলে ‘ভারতে পাঠাতে পারেন’ বলেছিলেন। এই কথাতেই তাঁর বিশাল দৃষ্টিকোণের পরিচয় পাওয়া যায়।
২০০৭ সালে আমি, আমার মেয়েরা যাতে ভারতীয় মূল্যবোধ ও চেতনা পায় আর নিজের মূলের সাথে জুড়ে থাকতে পারে ভেবে, মেয়েদের সঙ্গে ভারত ফিরে এলাম। মেয়েদের কাছে ভারত বিদেশ ছিল অতএব আমি তাদের বন্দোবস্তে ব্যাস্ত হয়ে গেলাম। মাঝে-মাঝে আমার লেখক-সাংবাদিক বন্ধুদের সাথে দেখাও করতাম। ইতিমধ্যেই মোদীজীর কাব্য-গ্রন্থ প্রকাশিত হল। একটি কাব্যগোষ্ঠীতে, গান্ধিনগরের এম.বী.পটেল হায়ার সেকেন্ডারী স্কুলের প্রিন্সিপাল শ্রী ললিত অগ্রওয়াল আমায় বললেন, ‘অঞ্জনাজী, কি ভালো হয় যদি আপনি সদ্য প্রকাশিত মোদীজীর কাব্যগ্রন্থের হিন্দি ভাষায় অনুবাদ করতে পারেন, কারণ আপনি বাদে কেউ এই ভালো কাজটি করতে পারবে না। আমি বললাম, ‘না ললিতজী তেমন কোন কথা নয়।’ আমার কথার মাঝেই তিনি বলে উঠলেন, ‘যা অনুবাদ আপনি করেন, সবার পক্ষে সম্ভব নয়।’ কতটা আত্মবিশ্বাস ছিল ওঁনার আমার ওপর...! যাই হোক, আমি কাব্যগ্রন্থ পড়লাম। কয়েকটি হৃদয়স্পর্শী কবিতা আমার খুব ভালো লাগলো যেমন ‘যাত্রা’, ‘স্বপ্নের বীজ্কনা’, ‘লক্ষ্য’, ‘কারগিল’, ‘জানা নেই’, ‘ঘুড়ি’ ইত্যাদি। মনে-মনে ঠিক করলাম, এই গ্রন্থের হিন্দি অনুবাদ আমি অবশ্যই করবো।
২০০৮ সালে যখন মোদীজীর সঙ্গে দেখা হলো, আমি তাঁর গুজরাতি কাব্যগ্রন্থ সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওই বৈঠকে আমি তাঁকে কবিতার অনুবাদের ইচ্ছা জানালাম। তিনি তৎক্ষণাৎ ওই বইয়ের গায়ে ‘জয় জয় গরবী গুজরাত’ লিখে দিলেন আর গুজারাতিতে প্রকাশিত তাঁর গল্পের বই ‘প্রেমতীর্থ’ আমায় দিলেন।
ধীরে-ধীরে বইয়ের হিন্দি অনুবাদ ‘আঁখ য়ে ধন্য হায়’ পূর্ণ হয়ে গেল কিন্তূ কথা আছে না যে প্রতিটি কাজ তার নির্ধারিত সময়তেই পূর্ণ হয়! সঠিক সময়ের প্রতীক্ষা করতে হয়। যখন যেটা হবার তখনই হয়। মোদীজীর রাজনৈতিক ব্যস্ততা অবিরত বেড়েই চললো আর বইয়ের অনুবাদ পূর্ণ হবা স্বত্বেও তার প্রকাশনের কাজ পিছিয়ে গেল। মনে হয় এবার এই কাজের সঠিক সময় এসেছে। এতদিন আগে করা বইয়ের অনুবাদ, আমি আবার একবার পড়লাম, কিছু উচিত সংশোধন করলাম আর ভাবলাম যে পনেরোই আগষ্টের দিনেই প্রধানমন্ত্রী কে তাঁর অনুবাদিত কাব্যগ্রন্থ ‘আঁখ য়ে ধন্য হায়’ উপহার দেব। অনুবাদের কাজ যেন ‘পর কায়া প্রবেশ’। আমি মনে-প্রাণে চেষ্টা করেছি যে তাঁর মনোভাবকে সঠিক ভাবে পেশ করতে পারি। আমি মনে করি এই কবিতা তাঁর ব্যক্তিত্বের আয়না।
এই গ্রন্থের প্রকাশক, ‘বিকল্প প্রকাশন’ দিল্লির শ্রী পবনকুমার শ্রীবাস্তব এবং আমেদাবাদের গ্রাফিক ডিজাইনার শ্রী অমরিশ পাঁচালকে, যে এই বইয়ের প্রচ্ছেদ তৈরি করেছেন, আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আজ সারা বিশ্বের লোক মোদীজীর সম্বন্ধে কিছু না কিছু বলে কিন্তু মোদীজী নিজেও তো কিছু বলতে চান, যার কিছুটা ঝলক এই গ্রন্থের মাধ্যমে পাওয়া যাবে, আমার দৃঢ বিশ্বাস।
আজ, ১৫ আগষ্ট, ২০১৪, এক সংবেদনশীল কবি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদীজী, আমি আপনাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা সহ এই বইটি অর্পণ করছি। আশা করি আপনার ভালো লাগবে। পাতকদের মতামত আমার প্রয়াসকে সার্থক করে তুলবে। মঙ্গল কামনা করি।
১৫ আগষ্ট, ২০১৪
ড. অঞ্জনা সন্ধীর,
সম্প্রতি:
অধ্যাপক, ভারতীয় ভাষা সংস্কৃতি সংস্থান,
গুজরাত বিদ্যাপীঠ, আমেদাবাদ।
Dr. Anjana Sandhir,
L-104, Shilalekh Society,
Shahibag, Ahmedabad-380004
Gujarat
Email: anjana_sandhir@yahoo.com
মনের কথা
আমি সাহিত্যক বা কবি নই। খুব জোর আমার পরিচয় সরস্বতীর উপাসকের হতে পারে। দীর্ধদিন ধরে লেখা, নোট করা- ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা সব সংকলিত হতেই ছোটো একটি বই তৈরি হয়ে গেল। এই কাব্যগ্রন্থ আপনাদের হাতে তুলে দিচ্ছি। আমার অনুরোধ যে এই গ্রন্থে আমার পদ-প্রতিষ্ঠা না দেখে শুধু কবিতার পদের আনন্দ উপভোগ করুন।
আমার কল্পনাজগতের খোলা ছোট জানালা দিয়ে এই জগতে যাহা কিছু দেখেছি, জেনেছি, অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, আনন্দ উপলব্ধি করেছি-সব অনুভূতি শব্দের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। এই চিন্তন, মনন বা অভিব্যক্তি মৌলিক হবার কোনো দাবি আমার নেই। পঠন, শ্রবনের ছায়া-প্রতিচ্ছায়ার প্রভাব থাকতেও পারে। আমার রচনা কখনও সার্বজনিক পরীক্ষণে রাখা হয়নি তাই এই লেখনের ভুল-ত্রুটির প্রতি নজর দিইনি। প্রতিটি রচনা পরিপক্ব নাও হতে পারে কিন্তূ একসময় কাঁচা আমের স্বাদও অন্যরকম স্বাদের অনুভূতি দিতে পারে!
গুজরাতের অনেক সাহিত্যকের লেখা আমি পড়েছি। গুজরাতি সাহিত্য জাত্রার এক পথিক হল শ্রী সুরেশ দলাল। একবার তাঁর সাথে সাহিত্য-চর্চার সময় উনি আমার অন্তরে প্রানবন্ত কবিতার কথা জানলেন। তাঁর আগ্রহে আমি আমার অনুভূতির জগত তাঁর সম্মুখে প্রস্তুত করে দিলাম... প্রস্তুস হয়ে গেল। উনি আগ্রহের সহিত বললেন যে আমার কল্পনাজগত, আমার অনুভূতি যদিও আমার নিজস্ব সম্পদ কিন্তু আমরা যে গুজরাতি...আমাদের সম্পদ এই ভাবে ফেলে রাখা উচিত নয়। এবার আমার এদিক-ওদিকে রাখা কাব্য মিলে সংসারে বাসা বাঁধিতে শুরু করলো।
সব একত্রিত হতে হতে নীড় বেশ বড়ো তৈরি হয়ে গেল। শ্রী সুরেশভাই সময় করে কিছু কবিতা বাছাই করে নিলেন ও শিল্পকারের মতো নীড়নির্মানের কাজে আমায় সাহায্য করিলেন। আমার রচনা-নীড় আপনাদের নিমন্ত্রণ করছে। আসুন, কিছুক্ষনের জন্য বিশ্রাম করুন। আমার এই নীড়ে এসে আপনাদের অনুভূতি যেন আন্দোলিত হয়! কবিতার সাথে-সাথে প্রকৃতিযাত্রার কল্পনা শ্রী সুরেশভাই আমায় দিলেন, আমার ভালো লাগল, আশা করি আপনাদেরও ভালো লাগবে।
নরেন্দ্র মোদী
1
ধন্য
এই পৃথিবী রম্য,
নয়ন যে ধন্য!
সবুজ দূর্বার গায়ে রোদ করে খেলা,
চাইলেও যায় না ধরা, রোদ যে অধরা!
গগন বিস্তীর্ণ,
পৃথিবী অপুর্ব!
আকাশে সুগন্ধি ইন্দ্রধনু মুকুলিত হয়,
নিখিল বাতাসে রঙের বৃত্ত অঙ্কিত হয়।
কোন জনমের পুণ্য,
জীবন হল যে ধন্য!
সাগর হিল্লোলিত হয় সুদুর গগনে,
কে জানে কী আছে মেঘের নয়নে!
পূর্ণ এই শূন্য,
এই পৃথিবী রম্য!
মানবের মেলায় মিশে সম্প্রীতি জেনেছি,
অপরের সাথে চলে নিজেরে চিনেছি।
সব কিছুই অনন্য, কিছু যে অগম্য।
ধন্য, ধন্য, ধন্য, পৃথিবী আমার ধন্য!
2
হঠাৎ
তমসাচ্ছন্ন কাগজে
আমি আঁকছি একটি সরোবর।
সরোবরের উপর
একটি ডাল আছে নুয়ে
ভ্রমরের গুঞ্জন লয়ে।
ঘন অন্ধকারকে লঘু করা হেতু
আমি আঁকছি একটি চাঁদ।
আকাশকে দিচ্ছি নীল রং।
হঠাৎ
সরোবরের স্থির জলের মতো
সূর্যের বৈশাখী তাপ
কাগজটি কে পুড়িয়ে দিল।
থেমে গেল আমার হাতের তুলি।
দাদুরির ডাক!
স্বপ্নের মরশুম-
মরসুমের স্বপ্ন
হল বাষ্পে পরিনত!
3
আমরা
আমরা জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু,
আমরা অনুরাগ কল্প!
বাধা নাহি কোনও, নাহি পরাজয়,
আমরা মেজাজি গল্প!
যখন ইচ্ছে উড়ি আকাশে,
ডুব দিই মহাসাগরে।
সূর্য হয়ে মধ্যরাতে
উদিত হই গিরিশিখরে।
কুণ্ঠা নাহি কোনো,
নাহি কোনো ভয়;
আমরা স্নেহের নির্ঝরিনী।
বিদ্বরা আমাদের পাগল বলে,
তারাই ঠিক,
আমরা ভুল নই!
আমরা সাগরের উখাল তরঙ্গ,
নির্গত জলবুদ্বুদ নই।
আমাদের নেই কোনো কুল-কিনারা,
আমরা সাগরের মাঝদরিয়া!
4
ক্র্ন্দন
তোমার সাথে হল পরিচয়,
আমার হৃদয়-হিমালয়
প্রজ্বলিত হয়ে উঠল।
তোমায় জানিলাম,
চাঁদ উদিত হল
আমার ব্যাকুল নয়নে,
চন্দন-বন বিকশিত হল
আমার হৃদয়ে।
তোমায় পেয়ে
সৌগন্ধের গিরিমালা সেজে উঠল
মোর অঙ্গে, রোমে রোমে!
কিন্তূ হায়!
এই গিরিমালা
কেন হয়ে চলেছে ক্ষীণ?
গন্ধকাষ্ঠ বাড়ায় যন্ত্রনা অকারণ,
খাক হয়ে চলেছে
আমার স্বপ্ন সৌগত;
আমার নয়নের চাঁদ চলে গিয়েছে
গগনপ্রান্তে।
তুমি বাদে,
আমার তরী পার করে দেবে
সে কান্ডারী কোথায় পাব আমি?
5
নিখিল বিশ্ব
শেষ হয়ে গেল গতকালের পথ,
তাহার সীমান্তে অঙ্কুরিত হল
আজকের প্রভাতের তরু।
বাতাসের শাখায় দুলছে
মৃদু কিরণের ফুল!
স্বত:স্ফুর্তে পাখিরা
নিশ্চিন্তে করছে গান।
আমি খুলে দিলাম
সব জানালা,
লাগেনি কখনও এত আনন্দময়
এই সংসার!
শরীর, মন, হৃদয়কে
আমি মনে করি
প্রভুপ্রসাদ।
নিখিল বিশ্ব যেন
আমার বাহুতে সমাহিত হয়!
6
বর্তমান
এই ছিল, সেই ছিল,
এমনি ছিল, অমনি ছিল,
এখানে ছিল, সেখানে ছিল,
হওয়া-থাকার ভীতি!
মনে হয় যেন
ভ্গ্নাবশেষে বৈভবের কুটির।
ছায়ার প্রেত হয়ে
কেন বিভ্রান্ত হই আমরা
জীবনের পথে?
অতীত যেন
ভূত-প্রেতের ছায়া নিয়ে
দিকভ্রান্ত ইতিহাসের আত্মা!
আত্মা তো অমর,
অমর্ত্যেরও কী চাই বর্তমানের দেহ?
ভবিষ্যতে
অমরত্ব পাবো বলে
অতীতের মোহে জড়িয়ে,
বর্তমানকে ফাঁকি দিয়ে
বেঁচে থাকার কী অর্থ?
7
আমি
সন্ধ্যা সময়,
একা রয়েছি আমি।
তরনেতরের মেলার স্মৃতি
মনে রয়েছে দামি!
কারুর সাথে নেই কোনো লেন-দেন,
আমার-তোমারও কিছু নয়,
যা কিছু আছে এই জগতে,
পূর্ণ আনন্দময়!
পথ আমার সরাসরি,
নেই কোনো ভীড় না আছে ঠেলাঠেলি।
সন্ধ্যা সময়,
একা রয়েছি আমি।
নেই কোনো বর্ণ, নেই সম্প্রদায়;
একই মানবজাতি।
সমান আলো দেয়
কী লন্ঠন কী বাতি!
জ্বল্জ্ব্লে ঝাড়বাতির মতো
ঝোলা, হয়নি কখনও শেখা।
সন্ধ্যা সময়,
আমি রয়েছি একা।
8
বিপত্তি
ষোড়শী সুন্দরী এই নদী,
আজ হিংস্র বাঘিনী হয়ে গেল।
গভীর শ্রাবনে হলো উন্মত্ত,
আত্মসংযম হারিয়ে
হল আমুদে।
আচরণ করছে যেন ক্রুদ্ধ নারী,
সে নিজেও জানেনা তার বক্ষের জল
কত নির্মম হতে পারে!
বন্যায় ডুবে গেল কত সারি গ্রাম,
ভেসে গেল কত মৃতদেহ!
কত জনের থেমে গেল প্রশ্বাস,
নিরুপায় শেষ চিত্কার!
অপহন্তা প্রকৃতি,
জলের মধ্যে জল হয়ে বয়ে যায়।
জলের সাংঘাতিক উন্মাদের
নিষ্ঠুর পরিচয় দিয়ে যায়!
9
আশা
আলোকের আশায় আমি
ঠেলেছি অন্ধকার।
আলোকের আভা লয়ে আমি
ঘুচায়েছি নিশা।
কালচক্রের বিঁধেছি কালিমা,
আলোর যে আর নেই কোনো সীমা।
জ্যোতি প্রজ্বলিত হল
নানাবিধ রঙে আপ্লূত।
দুলিয়া উঠিল আলোক!
আলোকধারা-আলোকধারা!
আলোকের আশায় আমি
ঠেলেছি অন্ধকার।
একই গতি, একই মতি,
পথ উন্নতির এক।
দৃঢ় নৈতিকতা, দৃঢ় সঙ্কল্প,
আজীবন মোর পরিধান এক।
চিরতরে
কলহকে দিয়েছি বিদায়।
আলোকধারা, আলোকধারা!
আলোকের আশায় আমি
ঠেলেছি অন্ধকার।
কামনা করিনি যশ-কীর্তির
ভেদ করিনি রুচি-অরুচিতে।
হৃদয় মাঝে ক্ষমা সর্বদা,
মোর হৃদয়ের প্রহরী রাম।
আলোকধারা, আলোকধারা!
আলোকের আশায় আমি
ঠেলেছি অন্ধকার।
10
ভালোবাসার অভাবে
ভালোবাসার অভাবে
হাঁপিয়ে উঠে মানুষ,
তবে দেয় কেন অভিশাপ
একে অপরকে মানুষ?
গাছ-পাতা-বৃক্ষ নীরস হয়
জলের অভাবে,
শুষ্ক তরুশাখে বসে
কোকিল গাইবে কিভাবে?
ভালোবেসে কেন মানুষ
করে অবহেলা,
ভালোবাসার অভাবে যদি
হাঁপিয়ে উঠে মানুষ?
হয় পঙ্গু, হয় পরাধীন
যদি না পায় ভালোবাসা,
অভাবের সুতো দিয়ে
সময় কে গেঁথে চলে মানুষ।
মৃদুহাস্যের ছুরি দিয়ে
চুপি-চুপি কাটে অশ্রুজল,
ভালোবাসার অভাবে কেমন
হাঁপিয়ে উঠে মানুষ?
11
জয় কে বরণ করো
ইহলোকের সময় কঠিন,
সকলে একজোট হয়ে যাও।
জয়কে বরণ করো আজ,
এসো, জয়কে বরন করো।
বিদ্বেষ মিটিয়ে দিয়ে,
সুরভিত মাটি হয়ে
ওঠো, জাগো, ছোটো-ছোটো!
মিলে মিশে থাকো সকলে,
কখনও থেকো না একা।
ইহলোকের সময় কঠিন।
ব্যথিত মানব, আর্দ্র জীবন,
মনে সাজায় পদ্মাসন!
সমাজের চেহারা ভিন্ন
কিন্তু বিশিষ্ট নয়।
আমরা অভ্যন্তরে পরিপূর্ণ।
ইহলোকের সময় কঠিন।
ধারন করো ধূলি ললাটে,
বসে থেকো না চতুর্দৌলায়।
চলো, চলি আজ নতুন পথে,
যেথায় আছে সপ্ন নতুন।
ইহলোকের সময় কঠিন।
নেই কোনো কাজ ভীরুদের,
সেরা লোকের স্থান এখানে।
আকাশছোঁয়া জয়ধ্বনি শোনো,
তরনেতরের মেলা এইখানে!
ইহলোকের সময় কঠিন।
12
ওঠো বীর
সুপ্তির লেপ গায়ে দিয়ে
ঘুমিয়ে আছে সকল দেহ,
সাহসী তুমি জাগো।
নিজের ক্ষমতাকে উদ্ভাসিত করো।
আকাশী তাপের
জ্বলসানো অগ্নিশিখা নিয়ে এসেছে সে!
তরোয়ালের খোঁচা সম কিরনকে
ঢাল হয়ে আবাহন করো।
দেবী কামাখ্যার আর্তনাদ
মন দিয়ে শোনো
বা তার আগেই জাগো
তবেই কিছু করা যাবে।
যদি শুনিতে পাও রুক্মিনির কান্না
দ্বারিকানাথ হয়ে ছোটো,
সময় খুব কম!
এই সময় বাঁশি বাজাবার নয়
সুদর্শন চক্র ধারণ করো,
বীর এবারে জাগো।
বাণী বিশ্রূঙ্খল হবার আগে জাগো,
মানবতা যেন কলঙ্কিত না হয়।
অন্ধ পথিক আমরা সবাই,
স্বপ্ন আমাদের চুর্ন হয়েছে
ভোট-বাক্স হয়ে গেল মৃত্যু-বাক্স,
আমরা ভোট দিইনি, দিয়েছি মাথা!
জ্বলছে হিমালয়ের অন্তর,
এই আগুন নিভিয়ে দাও।
ঈশ্বর কৃপা তলব করো,
বীর এবারে জাগো।
বধ হচ্ছে শিশুরা,
তাদের চিত্কারে কাঁপছে আসাম!
চিতার ওপর জ্বলছে সপ্তভগিনী
ওঠো বীর....ধীর....
শুধু আসাম নয়,
জ্বলছে দেশের ভবিষ্যৎ!
ভীরুতা স্বভাব হয়ে দাঁড়ানোর আগেই
বীর তুমি জাগো।
13
অশ্রুকনা
সম্পর্ক গড়ে ওঠে,
শেষ হয়ে যায়।
নয়নে দুটি অশ্রুকনা থেকে যায়!
হিমায়িত অশ্রু যেন পাথরের ভার,
কোনে রাখা সেতারের ছিন্ন তার!
লহরী লু হয়ে জ্বলে, কোথাও না যায়,
নয়নে দুটি অশ্রুকনা থেকে যায়!
ছিন্নাংস কাঁচের রক্ষা কতকাল?
অভিলাষা, আকুলতা, অনুরোধ বৃথা।
প্রবাহিত জলে কী সই করা যায়?
নয়নে দুটি অশ্রুকনা থেকে যায়!
উদাসীন সম্বন্ধ ক্রুদ্ধ করে দেয়,
ফুলের অয়নে হয় কন্টকের ঘাত।
এই কুঁজবনে আর কে গান গায়?
নয়নে দুটি অশ্রুকনা থেকে যায়!