ভীষণ চেষ্টা পেতো লুসির। অন্যের আত্মা যখন তার শীর্ণ দেহ খাঁচা ছেড়ে চলে যেত মহাকালের আকাশে, লুসির সমস্ত শরীর কি এক অনুভূতিতে থর থর করে কেঁপে কেঁপে উঠতো।
জন্ম জন্মান্তরের সঞ্চিত পিপাসা যেন গ্রাস করতো তার জিভ, চোখ দুটি ঠিকরে বেরিয়ে আসবে, হাত বেঁকে যাচ্ছে, মাথায় ভীষণ যন্ত্রনা। কোষে কোষান্তরে সংবাহিত অনন্ত বেদনা।
এক একটা ঘটনার পরে লুসি ভাবতো আর বাঁচবে না। তবু সে বেঁচে রইলো। সেদিনের চার বছরের ছোট্ট মেয়ে লুসি আজ চোদ্দ বছরের কিশোরী।
প্রাকৃতিক নিয়মে তার দেহে যৌবন এঁকেছে পদচিহ্ন। কিন্তু লুসি সে ডাকে সাড়া দিতে পারেনি। এই রোমাঞ্চিত বয়েসে সে ভালোবাসে না বসন্ত বাতাস। তার কানে ঢেউ তোলে স্তব্ধ রাতের মৌনতা। প্রেম তার কাছে অজানা। সে দেখেছে কবরের প্রশান্তি। প্রস্ফূটিত গোলাপের চেয়ে মৃত মানুষের হাড় সে বেশি ভালোবাসে।
আঁকড়ে ধরে কালো বেড়াল, অন্ধকারে ঘুমোতে চায়। পৌঁছে যেতে চায় মাটির নিচে, সেই অতলে, যেখানে সঞ্চিত আছে তার গত জন্মের দেনা।
সেই সেঁতসেঁতে শীতল প্রাণহীন ছড়া কুঠি যেনো লুসির তৃষিত আত্মাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বলছে - এসো, এসো, দেখে যাও। এখানে তোমার পিপাসার শেষ, তোমার আত্মার মুক্তি। পৃথিবীতে যে জীবন সেটা হলো অনন্ত অসীম আত্মার যন্ত্রনা।
- এসো লুসি, আমরা পাতাল ঘরে ঢুকবো।
ক্লারা আগে চলে। লুসি চলেছে একটির পর একটি সিঁড়ি পারি হয়ে পাতাল ঘরের মধ্যে। লোহার তৈরী দেওয়াল, নিঃশাস নেওয়ার মতো যথেষ্ট বাতাস নেই, নেই সূর্যের আলো প্রবেশের ছিদ্র।
আলো বাতাসহীন এই কারাগারের তাপমাত্রা শীতল করা হয়েছে। যাতে মানবিকতার ওপরে আচ্ছন্নতার প্রলেপ আনা যায়।
লুসি দেখতে পেলো তার বাবাকে। ঘরের এককোনে নিস্তব্ধ তার দেহ। সামনে শায়িত একটি প্রায় নিশ্চিহ্ন কঙ্কাল।
লুসিকে লোহার চেয়ারে বসালো ক্লারা। তার হাত বেঁধে দেওয়া হলো, মাটিগার সঙ্গে লাগানো হলো ইলেকট্রিক তার। এবারে শুরু হবে ডাক্তার হেনরির বিশেষ পরীক্ষা। লুসির অবচেতন মনে আলোড়ন তুলে তার আত্মাকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে গত জন্মে।
স্থির হয়ে বসে আছে লুসি। ঘরে জ্বলে ওঠে মৃদু নীলাভ আলো। বিদ্যুৎ তরঙ্গ পাঠানো হলো তার মাথার কোষে। কেমন একটা ঘুম ঘুম অনুভূতির মধ্যে লুসির মনে হলো সে যেনো চোদ্দ বছরের মেয়ে নয়, নয় এক শিরনা কিশোরী, সে যেনো আগাথা, মিডলসেক্স রাজপরিবারের গর্বিতা বধূ আগাথা ব্যানিস্টার।
শায়িত কঙ্কালটা যেনো উঠে দাঁড়িয়েছে। এগিয়ে আসছে লুসির দিকে। দুটি কোটরাগত চোখে দপ দপ করে জ্বলছে কি বীভৎস লাল আলো, বুঝি শত শতাব্দীর খুদা তার।
ভয়ে চোখ বন্ধ করলো লুসি। বাবা হেনরির গলা শুনতে পেলো। অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে তার গলা।
- মনে করো লুসি, তোমার গত জন্মের কথা। মনে করো লুসি, তুমি ছিলেনা আমার মেয়ে, ছিলে অন্য দেশে, বলো, কি বলবে তুমি? বলো, তোমার ফেলে আসা জন্মের কথা।
লুসির মনে পড়ে। কতদিন সারারাত ধরে বাবা তাকে জন্মান্তরবাদের কথা বলতো। বাবা বলতো - আমাদের চেতনার স্তরের অন্তরালে আছে অবচেতনার জগৎ। সেঝানে সব কেমন ছায়াময়, আধো অন্ধকারে দৃশ্যমান বস্তুর মতো। সেই প্যারা সাইকোলজিক মনে এসে ভিড় করে ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি। লুসি, কিছুই হারায় না। কিছুই শেষ হয়ে না। আত্মার মৃত্যু নেই। জন্মের পর জন্ম ধরে সে চলতে থাকে ঈপ্সিতো লক্ষের দিকে।
লুসির মনে পড়ে, আগাথাকে।
শরতের এক সোনালী দোকান। মিডলসেক্স রাজবাড়ীতে অনেক সুখী মানুষের ভিড়। আজ রাজবধূ আগাথার প্রথম বিবাহ বার্ষিকী। যুবরাজ পলকে দেখতে পেলো আগাথা। সুপুরুষ, শুবেশী, সুমিষ্ট স্বরের অধিকারী।
কি তুমি তার ছবিটা ভেসে উঠতেই জঘন্য অনুভূতিতে ভোরে গেলো আগাথার মন। বিয়ের প্রথম রাত থেকে সে স্বামীকে সহ্য করতে পারছে না। তার মনে হয়ে পল যেনো অত্যাচারী, তার অনিচ্ছাতে তার দেহে অধিকার স্থাপন করার চেষ্টা করছে।
বিয়ের পরে প্রথম রাত থেকেই পলের ওপর বুকভরা বিদ্বেষ জমে গেছে আগাথার। মাঝে মাঝে সে ভাবে যদি........
যদি সে মুক্তি অতো ব্যানিস্টার রাজবংশের হাপিয়ে ওঠা প্রাসাদ থেকে। আগাথা স্বেচ্ছাবন্দি জীবন পছন্দ করে না। তাকে ডাক দেয় অসংযমী সহবাস, রাতের পর রাত কেটে যাবে নতুন পুরুষের আলিঙ্গনে।
নিজের অপরিসীম তৃষ্না মেটাতে সে বেঁচে নেবে সবল সুন্দর পুরুষদের। বিশেষ করে তার চেয়ে কমবয়সী কিশোরদের প্রতি আলাদা আসক্তি অনুভব করে আগাথা। মনে হয় ওরা যেনো টগবগে উষ্ণ রক্তের প্রতীক, ওরা পলের মতো শান্ত না। এক লহমাতে তাকে নগ্না করে নিঃশেষে পান করবে শারীরিক সুধা।
যেমন ভাবে কোচয়ান জোসেফ তাকে তৃপ্তি দিয়েছিলো।
ইস্টারের ছুটি কাটাতে ওরা গিয়েছিলো গ্রাম্য প্রাসাদ ক্লেডসে। কিন্তু সেই নির্জন বাংলোতে এক রাতে একলা থাকতে হয়েছিলো আগাথাকে। বিশেষ কাজে পল এসেছিলো মিডলসেক্সে।
একা? না, সঙ্গে ছিল ঝি আর ঐ কোচয়ান।
সে রাতে আগাথা পরেছিল দুধ সাদা নাইটি। সচ্ছ আবরণ ভেদ করে তার কামাতুর দেহটা প্রস্ফূটিত হয়েছিলো। নিশীথ সমাবেশে মনে জেগেছিলো সুতীব্র আসঙ্গ লিপ্সা।
সে যখন বেডরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে যাবে তখন হটাৎ জোসেফকে দেখতে পেলো। ছেলেটা তাঁদের গাড়ি চালায়, সতেজ চেহারা, মুখের মধ্যে রুক্ষ কাঠিন্য। আগাথা বুজতে পেরেছিলো জে ছেলেটি তার পিপাসার্ত বাসনা মেটাবে।
তারপর বিশাল খাটে মৃদু আলোড়ন তুলে রাজবধূ আগাথা জড়ানো গলাতে বলেছিলো - জোসেফ তুমি আমাকে শান্ত করো।
আর জোসেফ? বন্য বর্বর জাতির সবল পুরুষ। সে দেখেছে নারী সম্ভগের সহজতম উপায়। সে জানে শরীর সর্বস্য মেয়েদের কাছে ছলনার কোনো মূল্য নেই। তারা যেনো কামনার আগ্নেয়গিরি।
মুহূর্তের মধ্যে জোসেফ নাইটির ফাঁসটা সজোরে খুলে নিরাবরণা করলো আগাথাকে। আইভরি রঙের তনুবাহার, নিখাদ অঙ্গের সমাবেশ। অভিজাত্যের সুরভিত কোমল ত্বকে এলোমেলো হাত রেখে সে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিলো অহংকারী আগাথাকে।