ঐ রাত যেন পরম কাঙ্খিত হয়ে নেমে এসেছিলো আগাথার জীবনে।
আজ তার বিয়ের প্রথম বছরে আগাথার বারবার মনে পড়েছে ঐ রাতের কথা।
সে রাত তাকে গরবিনী করেছিল। তারপর কতবার সে শরীরের চাবি তুলে দিয়েছে দস্যু জোসেফকে।
পলের কাছ থেকে ক্রমেই সরে গাছে সে।
সোনালী সকালটা ফুরিয়ে গিয়ে নেমে এলো রাত। উৎসব শেষে বেডরুমে প্রবেশ করলো আগাথা। পল তার প্রতীক্ষাতে বসে আছে সিগার ঠোঁটে। কিন্তু আগাথার দাউ দাউ বহ্নিকে সে কি সীমিত ক্ষমতায় মেটাতে পারবে?
আগাথা জানে এই প্রাসাদে সারাটি জীবন তার কাটবে এক দেহ খুদা নিয়ে। সে মুহূর্তে জ্বলে ওঠে, গোবলেটে রক্ত রঙা মদিরা। হাসলো আগাথা। তার দুটি ভরাট স্তনের মাঝে ঝুলছে লকেট, জেতাতে রয়েছে বিষের গুঁড়ো। আজ সকাল থেকেই এই মুহূর্তটির প্রতীক্ষা করেছিল আগাথা।
বিষের রঙ নেই, রক্ত তরল টলটল করছে। হাসতে হাসতে গোবলেট তুলে দিলো পলের ঠোঁটে, ফিস্ ফিস্ করে বললো - আজকের স্মরণীয় রাতটাকে মনে রেখো -
হায় ! বেচারী, তুমি কি যেন যে কোনোদিন ভোর দেখা হবে না তোমার?
মাঝরাতে আর্তস্বরে চিৎকার করে আগাথা। পল নাকি মারা গাছে। রাজপ্রাসাদে আলোড়ন পড়ে গেলো। নেমে এলো শোকের ছায়া।
কালো গাউন পরে আগাথা সাজলো বিধবার বেশে। শুচিতার আড়ালে শুরু হলো তার দেহ বিকিকিনি।
রাতের পর রাত কত পুরুষের কাছে আত্মনিবেদন করে তৃপ্তা হয়েছে আগাথা। জোসেফ, হালডেন, উইলিয়াম, ফ্রান্সিস - কত নাম। আগাথা সবাইকে সঙ্গী করেছে।
মাথার মধ্যে আরোপিত চেতনার ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে। অনেক গভীর ঘুমের কালরাত্রির অবসানে লুসি যেন চোখ মেলবে।
কিন্ত অর্ধ উন্মোচিত চেতনার মধ্যে কে যেন আধিভৌতিক স্বরে বলছে - লুসি, তোমার আত্মায় গত জন্মের মলিনতা। তুমি নিজের স্বামীকে বিষ দিয়া হত্যা করেছিলে। তুমি ঘটিকা, তুমি কলঙ্কিতা।
মুখে হাত চাপা দিয়ে চোদ্দ বছরের নিষ্পাপ মেয়ে লুসি চিৎকার করে বলতে চায় - ওটা ছিল আমার দুঃসপ্ন, আমার বিগত জীবনের পাপ। এ জীবনে আমি পবিত্র হতে চাই।
রুদ্ধ ঘরের শুন্য বাতাসে প্লাবন তুলে ভৌতিক সার বাজতে থাকে - তুমি হত্যাকারী। তুমি ঘাতিকা। তুমি কলঙ্কিতা।
লুসির ঘুম ভাঙে। কত বছর সে নিদ্রামগ্ন ছিল এই অপার্থিব পাতাল ঘরে।
মাথাটা ঝিমঝিম করছে। রক্ত চলাচল থেমে গেছে। গোটা শরীরকে চেয়েছে শুন্যতা। লুসি তাকিয়ে আছে, তার দৃষ্টিতে ভাষা নেই।
ধীরে ধীরে বোধশক্তি ফিরতে থাকে। লুসির বিবর্ণ চোখ রঙিন হয়ে ওঠে। কিন্তু তার স্মৃতির মধ্যে বাজছে আগাথার কণ্ঠস্বর।
- শোন, লুসির জন্ম চেতনার মধ্যে আবার বেজে ওঠে ক্লারার গলা, মনে কর লুসি, আগের জীবনে তুমি ছিলে মিড্লসেক্স রাজপরিবারের এক কলঙ্কিতা রামনি। প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর রাত্রে তোমার দেওয়া বিষ পান করে মারা গিয়েছিলো তোমার স্বামী পল। তুমি হত্যাকারী। তোমার দেহের প্রতি কোষে সঞ্চারিত হচ্ছে সেই রক্ত পিপাসা। এ হলো তোমার জন্মান্তরের দেনা, এ জীবনে তোমাকে আবার হত্যা করতে হবে।
- না, না, মুখে হাত চাপা দিয়ে ভীষণ জোরে চিৎকার করে ওঠে লুসি।
তার দেহটা গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। তখন তার বুকের মধ্যে বেজে চলেছে নারী পিশাচ ক্লারার ডাকিনি কণ্ঠের আর্তনাদ।
লুসির মনের মধ্যে সেই কালো বেড়ালটা ঘুরতে থাকে, তার মনে পড়ে যায় বীভৎস রাতে পুড়ে যাওয়া আনিলিয়ার বিকৃত লাসের কথা।
মনে মনে সে প্রশ্ন করে - সত্যি আমি কি গত জন্মে ছিলাম স্বামী ঘাতিনী এবং কলঙ্কিতা রামনি আগাথা?
বদ্ধ ঘরের শুন্য বাতাসে মৃদু স্পন্দন তুলে আলোড়িত হতে থাকে সেই বিবর্ণ মহাকালের কণ্ঠস্বর। মৌনা হয়ে লুসি শুনতে থাকে।
- শোন লুসি,
এ কার কণ্ঠ? চোদ্দ বছরের জীবনে লুসি তো কোনোদিন এমন অপার্থিব ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বর শোনেনি। তবে এই কি সেই হাজার বছরের শীতল কবরের শ্যাওলা জমা স্যাঁতস্যাতে কোণে মৃত্যুর গহন বিভীষিকার মধ্যে জন্ম নেওয়া রক্ত পিয়াসী ভ্যাম্পায়ারের কণ্ঠস্বর?
যে ভ্যাম্পায়ার জীবিত রক্তপানে নিবৃত্ত করে তার তৃষ্ণা?
লুসি আবার হারিয়ে যায় অবচেতনার অন্ধকারে। তার সমস্ত সত্বা ঘিরে বজ্রপাতের মতো, যুদ্ধক্ষেত্রে মর্টারের মতো অথবা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতো শুধু ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে অশরীরী রক্ত চোষকের অপার্থিব শব্দাবলী।
- শোন লুসি, শুধু গত জন্মে নয়; তার আগের জন্মে তুমি ছিলে মধ্য ইরাকের গাজা নগরীর এক রঙ্গিনী বারবনিতা, তুমি নিজে হাতে তুলে দিয়েছ বিষ ভরা শরাবের গোল পাত্র। শুধু কি তাই ? অপঘাতে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তোমার জঘন্য চক্রান্তে সুখী মানুষের জীবনে নেমে এসেছে দুঃখের কালোরাত্রি। সেই জন্মে তোমার নাম ছিল সেইবা।