Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

প্রিয়তমা শুধু তোমাকে চাই

বিয়ের পরে মাস না ঘুরতেই শ্যামাকে বরের সঙ্গে চলে যেতে হলো বরের কর্মস্থলে। শ্যামা... মানে শ্যামশ্রী। কালীপুজোর রাতে জন্ম বলে ঠাকুরদা-ঠাকুমা আদর করে শ্যামামা বলে ডাকতেন। পরে স্কুলে ভর্তির সময় বাবা পোশাকি নামটা নিজেই দিয়ে দেন শ্যামশ্রী। আধা-মফস্বলের মেয়ে হলেও বাবার চাকরির সুবাদে গোটাটা পশ্চিমবঙ্গই চষে ফেলা শ্যামার। বারবার স্কুল বদল হওয়ায় লেখাপড়ার ক্ষতি হচ্ছিলো বলে স্কুলের উঁচু ক্লাসে উঠতেই শ্যামাকে কলকাতার স্কুলে ভর্তি করে শ্যামার মেজোপিসিমার বাড়িতে রাখা হলো। পিসেমশাই মারা যাবার পরে একলাই থাকতেন নিঃসন্তান মেজোপিসিমা। শ্যামা আসাতে আঁকড়ে ধরলেন শ্যামাকে। বুক দিয়ে আগলে রাখতেন। সর্বক্ষণ চোখেচোখে। তবে প্রেম ব্যাপারটা ভারি বেয়াড়া গোছের। ওসব পাহারাদারির গরাদ হোক, কিম্বা পাহারাদারের লাল-চোখ হোক... সবকিছুর ফাঁকফোকর গলে ঠিক বিপরীত লিঙ্গের দুটি কুসুমকোমল প্রাণে ফুল ফোটাবেই ফোটাবে। সুতরাং মেজোপিসিমার শাসন-সোহাগের আগল ভেদ করে শ্যামার মনেও প্রেমের কলি ধরলো... প্রেমের ফুল পুরো ফুটলোও যথাসময়ে। ফুল ফোটানোর মালিটি হলো মেজোপিসিমার পড়শি ছেলে বাণীব্রত। ছেলের নামেই মালুম যে সে বড়ো পোড়ো ছেলে। তবুও প্রেম কি আর পড়ার বেড়া মানে? তা বাণীব্রতর হৃদকমলে গিয়েও সোজা ধাক্কা মারলো শ্যামশ্রীর গাণ্ডীবের মতো বাঁকানো দুই-ভ্রুর মধ্যস্থলের কালো বিন্দির টিপখানি। ধীরেধীরে বাণীব্রতর মনোমহলে বিরাজমানা শ্যামশ্রী। চিনিপাতা দইয়ের মতো জমে উঠলো প্রেম। তবে কিনা সংরক্ষণশীল দুই পরিবারেই "রে-রে" করে ওঠার লোকের অভাব না থাকলেও... অভাব ছিলো বাণী ও শ্যামার বুদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো মাথার। সুতরাং নির্বিঘ্নে আটবছরের প্রেমপর্ব পার করে বাণীব্রত আর শ্যামশ্রী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলো। তার আবার অন্য গল্প।

এক্ষেত্রে ঘটকালিটা পাকাপোক্ত করেছিলেন শ্যামার মেজোপিসিমা। মেজোপিসিমার রান্নাঘরের জানালা আর বাণীব্রতদের রান্নাঘরের জানালা মুখোমুখি। তিনফুটের গলির মুখোমুখি দুইবাড়ি। লম্ফঝম্পে পটু হলে ছাদ টপকে বাড়িতে ঢুকে আসা তেমন অসম্ভব নয়। তবুও এই ছাদের ঝুঁকি বাণী শ্যামা নেয়নি। ওরা রাত নিশুত হলে রান্নাঘরের জানলা খুলে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে ভাববিনিময়... থুড়ি প্রেমবিনিময় করতো। মুশকিল আসান করে দিয়েছিলেন মেজোপিসিমা নিজেই। আসলে ঘনঘন মেজোপিসিমার অদ্ভুত অদ্ভুত সব অসুখ করতে লাগলো। রাতবিরেতে কোথায় ডাক্তার খুঁজতে বেরোবে দুই একাকিনী রমণী? সুতরাং ডাক পড়তে লাগলো বাণীব্রতর মায়ের। তিনি আবার মেজোপিসিমার গঙ্গাজল সই কিনা! সারাবিকেল ছাদের আলসে ধরে দাঁড়িয়ে ইনিয়েবিনিয়ে বলা মেজোপিসিমার রোগের কাহিনী শুনে একদিন তিনিই বলে বসলেন, "বাণী থাকতে তুমি বাইরের ডাক্তার ডাকতে যাবেইবা কেন? মেডিকেল কলেজের ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। ওষুধপাতি আজকাল ভালোই দিতে শিখেছে বাণী। রাতবিরেতে অসুবিধে হলেও কোনো সঙ্কোচ কোরোনা। তবে কিনা একটাই কথা... ঘি আর আগুনতো! দুজনকেই একটু চোখেচোখে রেখো।" সঙ্গেসঙ্গে মেজোপিসিমাও গলা নামিয়ে বলেন, "সে আর বলতে? হাজার হোক আমার ভাইঝিতো... মেয়ের তরফের অনেক জ্বালাগো সই!" তারপর থেকেই যেদিন যেদিন বাণীব্রতর রাতডিউটি না থাকে সেদিন সেদিনই রাতে শ্যামার মেজোপিসিমার রোগের প্রকোপটা বড়ো বেড়ে যায়। আর রাতে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাণীর মা'কে দেখেই শ্যামা সুরেলা মিষ্টি গলায় ডাকে, "সইমা, মেজোপিসিমার আজ আবার শরীরটা বড্ড কেমন করছে! একবার আসবেন?" সইমাও নির্দ্বিধায় বলেন, "আহা, সই বড়ো ভুগছে... আচ্ছা, আমি এখনি বাণীকে পাঠাচ্ছি। একটুক্ষণ ধৈর্য্য ধরো মা। ভয় পেয়োনা।"

বাণীব্রত ডাক্তারি পাশ করে সরকারি হাসপাতালে চাকরি পেলো। এবারেই বাধলো গোল। ছেলের তেমন ছুটিছাটা নেই... কাজের বড়ো চাপ। দিনরাত পড়ে থাকতে হয় হাসপাতালে। জুনিয়র ডাক্তার। চাকরিতে টিকে থাকতে সিনিয়র ডাক্তারদের মন জুগিয়ে চলতে হয়। না সময়ে নাওয়া, না সময়ে খাওয়া। সোনার বরণ ছেলে দিনেদিনে শুকিয়ে যাচ্ছে ডাক্তারদের মেসের রাঁধুনিমাসির হাতের অখাদ্য রান্না খেয়ে। মা'কে বাণী বলে তার কাছে গিয়ে থাকতে। তাই কখনো হয়? কলকাতায় ভরাভর্তি সংসার ফেলে রেখে তিনি কী করে যাবেন? বাণীর বাবার রিটায়ার হতে আরো গোটা দুটো বছর। বাণীর মায়ের মাথায় খেলে গেলো ছেলের বিয়ের কথা। কোথায় কোন অচেনা অজানা মেয়ে খুঁজতে যাবেন? চোখের সামনেই গলির উল্টোপিঠেই এমন সুশ্রী সুলক্ষণা মেয়ে শ্যামা থাকতে? বাণীর চোখেমুখের ভাবেওতো মনেহয়... শ্যামাকে তার সেই প্রথমযৌবনের ভালোলাগার ছটা এখনো তার মনে লেগে আছে। মায়ের চোখতো... ছেলের মন ঠিক পড়ে নিয়েছেন। তবে আর দেরি কিসের? বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে বাণীব্রতর মা নিজে এলেন শ্যামশ্রীর মেজোপিসিমার কাছে। তারপরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত। একমাসের মধ্যেই চারহাত এক হলো সানাইয়ের সুরে। আর তার একমাসের মধ্যেই শ্যামাকে চলে আসতে হলো বরের কর্মস্থলে। সরকারি কোয়ার্টার পেতে মাসদুই-তিনেক লাগবে, অগত্যা ভাড়াবাড়ি। নয়তো এমন নাটকীয় মিলনের শেষেও বাণী ও শ্যামাকে যে আলাদাই থাকতে হতো। কলকাতা শহরের জগঝম্প ছেড়ে এই দিনাজপুরের নির্বান্ধব আধা-শহরের একমাত্র সরকারি হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তার বাণীব্রত বসু সস্ত্রীক এসে ভাড়াবাড়িতে উঠলো।

সামান্যকিছু মালপত্র নিয়ে ভোরে কলকাতা থেকে রওনা হয়ে শ্যামা বাণীর হাত ধরে আধা-শহরের একপ্রান্তে ভাড়াবাড়িতে এসে পৌছলো। রাত প্রায় দশটায়। পথেই রাতের খাওয়া সেরে নিয়েছিলো... পৌঁছে ক্লান্ত শরীরে ওসব রান্না-খাওয়ার হাঙ্গামা পোষাবে না। তবে রান্না-খাওয়ার হাঙ্গামা পোষাবে না বলেকি আর অন্য খাওয়ায় আপত্তি থাকবে? মোটেই নয়। আসলে ফুলশয্যার রাতে আড়িপাতার জ্বালায় দুজনের ফুলশয্যার শিহরণ জাগানো প্রেমের পরিকল্পনা ভেস্তে "ভ" হয়ে গিয়েছিলো। তারপরতো পরেরদিনই অষ্টমঙ্গলার নিয়মরক্ষার জন্য শ্যামাদের বর্ধমানের আধা-মফস্বলের বাড়িতে যাওয়া এবং শ্যামাকে ওখানেই রেখে আসা। কারণ বাণী বর্ধমান থেকেই দিনাজপুরে ফিরবে। বেচারা ছুটি পায়নি। তারপর তড়িঘড়ি বিয়ের একমাস পূর্ণ হবার আগেই বাণী বৌ নিয়ে এই ভাড়াবাড়িতে... মেসবাড়ি ছেড়ে দিয়ে। সুতরাং অফিসিয়ালি সেদিন বিয়ের পঁচিশতম রাত্রি হলেও, আসলে সেই রাতটাই হলো প্র্যাকটিক্যালি বাণী ও শ্যামার প্রকৃত ফুলশয্যার রাত। সেইরাতে ভাড়াবাড়ির জানালা, দরজা, দেওয়াল-ঘড়ি, রঙীন-ছিটের পর্দা, বিছানা-বালিশ মায় খাটটিও পর্যন্ত জানলো... রোমান্স কেমন হয়! জড়বস্তুরাওতো ঘরের অধিবাসী বটে! ফ্যালফেলে বিস্ফারিত নয়নে তারা বাণী ও শ্যামার রোমান্টিসিজমের চাক্ষুষ সাক্ষী হয়ে রইলো। তবে আরো কেউকেউ যে সাক্ষী হলো তা শুধু বাণী আর শ্যামা জানতে পারাতো দূরস্থান... কাকপক্ষীও টের পায়নি।

পরদিন সকালে উঠেই শ্যামা ভরপুর গিন্নি। একটি কাজের মাসি আগেই ঠিক করে দিয়েছিলো ভাড়াবাড়ি খুঁজে দেওয়া দালাল ভদ্রলোকই। সমস্যা হলো তার বিহারী দেহাতি উচ্চারণের কথাবার্তা উদ্ধার করতে শ্যামার নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। এদিকে ডাক্তারবাবুতো সকালের চা-বিস্কুট খেয়েই গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে বৌকে বিস্তর চুমু-টুমু খেয়ে সাবধানে থাকতে বলে হাসপাতালে ছুটেছে। মর্নিং শিফটে ডিউটি। আউটডোর আছে। ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে যাবে। শ্যামার মনটা খচখচ করে ওঠে... বরকে ভরপেট কিছু খাইয়ে পাঠাতে পারলো না বলে। আসলে সারারাত ঘুমোতে দেয়নি বাণী... ডাক্তার না ডাকাত একেবারে। ঐজন্যইতো সকালে উঠতে দেরী। ঠোঁটের কোণে মুচকি হেসে শ্যামা স্নান-টান সেরে রান্নাঘরে ঘরে ঢোকে। মেজোপিসিমা ওদের সম্পর্কের কথাটা জানা ইস্তক শ্যামাকে এই আটবছর ধরেই তালিম দিয়ে গেছেন রান্নাবান্নায়... বাণী এই খেতে ভালোবাসে, বাণী ওই খেতে ভালোবাসে। রিপোর্টারগিরি করেকরে মহামূল্যবান গোপন খবরগুলো মেজোপিসিমা খোদ বাণীর মায়ের কাছ থেকেই জোগাড় করেছিলেন। এবারে সেইসব বিদ্যার পরীক্ষার সময় উপস্থিত হয়েছে। মুশকিল হলো কাজের মাসি... পেঁয়াজ ডুমো কাটতে বললে ঝিরিঝিরি কাটে, পোস্ত বাটতে বললে সাদাসর্ষে বাটে। রাঁধতে গিয়ে শ্যামার কালঘাম ছুটিয়ে দিয়েছে মাসি। নাম জিজ্ঞেস করতেই মিশিমাখা কালোদাঁত বার করে হাসে, "ভুলুয়াকা বাপ সরবতিয়া বুলায়..."! বলেই সেকী হাসি মাসির! আহা-হা! গদগদ প্রেম দেখে শ্যামারও বুকে প্রেমের জোয়ার জাগে। কখন রাত হবে? অবশ্য রাত হতে হয়নি। হাসপাতাল ফেরত ডাক্তার বাণীব্রত বসু ছাব্বিশ দিনের পুরোনো বৌ শ্যামার হাতে শুক্তো, আলুপোস্ত, ডিমের কষা, ছোলার ডাল আর পাকা তেঁতুল দিয়ে মিষ্টিকুমড়োর টক খেয়ে আপ্লুত হয়ে সরবতিয়ার সামনেই চুমু-টুমু খেয়ে একাকার কাণ্ড ঘটালো। "ডাগদারবাবুর কামকাজ" দেখে সরবতিয়া মাসি একহাত ঘোমটা টেনে ঘাড় নেড়ে বিদায় নেয়। কে জানে ভুলুয়ার বাপের কথা মনে পড়ে গেছে বোধহয়! শ্যামার নাকের পাটা লজ্জায় লাল। তারপর অপরাহ্নেই শ্যামা ও বাণীর ঘরে রাত নামলো। নিশ্ছিদ্র মুড়ে বন্ধ জানালা দরজা। দিনের আলো আর লোকের উঁকিঝুঁকির পথ আটকাতে। যতই হোক একতলার ঘর... বাড়িউলি ভদ্রমহিলা দুই মেয়ে নিয়ে দোতলায় থাকেন।

মিলনক্লান্ত বাণীর বক্ষলগ্না হয়ে শ্যামার মেজোপিসিমার উপদেশবাণী মনে পড়ে, "পুরুষের হৃদয়ে পাকা আসন বানাতে পুরুষের পাকস্থলী বেয়ে হৃদযন্ত্রে পৌঁছতে হবে। নিশ্চিত পার্মানেন্ট অবস্থান। শুধু রেঁধে যাও আর খাইয়ে যাও।" হাসিমুখে শ্যামা বরের বুকে আদুরে বেড়ালের মতো মুখ ঘষে। আজ রাতে মিশন হিং-এর কচুরি আর ঘন করে ছোলার ডাল। বাণীব্রতকে সন্ধ্যেবেলায় একবার হাসপাতালে যেতে হলো ফোন পেয়ে। সরবতিয়াকে দিয়ে সব জোগাড় করিয়ে রেখেছে শ্যামা। বাণীব্রত বেরিয়ে যেতেই শ্যামা রান্নাঘরে ঢুকলো। একমনে ময়দার লেচিতে পুর ভরছে শ্যামা রান্নাঘরের টেবিলটার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। বাঁধানো স্ল্যাব নেই বলে বড়ো একটা টেবিলেই স্টোভ আর বাকি রান্নার সরঞ্জাম রেখেছে শ্যামা। লেচিগুলো থালা-চাপা দিয়ে হাত-ধুতে গিয়ে রান্নাঘরের একমাত্র জানালাটায় চোখ পড়লো শ্যামার। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এদিকটা বাড়ির পেছনদিক। অনেক ঝোপঝাড় গাছপালা আছে। গা'টা ছমছম করে উঠলো শ্যামার। কেউ যেন একটা সট করে সরে গেলো মনে হলো জানালার পাশ থেকে। যদি খুব ভুল শ্যামা না দেখে থাকে তবে একজোড়া চোখ... বেশ চকচকে উজ্জ্বল। শ্যামাকে অতিবড়ো নিন্দুকেও ভীতু বদনাম দিতে পারবে না। কিন্তু সেই শ্যামারও গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে উঠলো... ঢোঁক গিলে রান্নাঘরের জানালা বন্ধ করে শ্যামা শোবার-ঘরে ঢুকে ম্যাগাজিনে ডুবে থাকতে নিষ্ফল চেষ্টা করে গেলো। বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে... চোখজোড়া।

বাণীব্রত ফিরলো রাত ন'টা নাগাদ। গরম-গরম কচুরি ভেজে দেবে বলে বাণীকে সঙ্গে করে নিয়ে শ্যামা রান্নাঘরে গেলো। টুল পেতে বাণী শ্যামার রান্নার টেবিলের একপাশে বসেছে। স্টোভ জ্বেলে শ্যামা কচুরি ভাজছে। হিং-এর গন্ধে চারধার ম-ম করছে। বাণীব্রত উঠে একহাতে শ্যামার কোমর জড়িয়ে ধরে রান্নাঘরের জানালাটা খুলে দিলো, "একদম গুমোট হয়ে গেছে... এদিকটায় গাছপালা আছে। হাওয়া আসবে। তোমার কষ্ট হবেনা গরমে।" শ্যামা হাঁ-হাঁ করে উঠে সন্ধ্যের সেই চোখজোড়ার কথা বলতে যাচ্ছিলো। তারপর কী মনে করে কথাটা গিলে ফেললো। খাওয়াদাওয়া শেষে বাণীই আবার সব জানালা দরজা বন্ধ করে দিলো। তারপর ওদের ভাড়াবাড়ির দ্বিতীয় রাতও মধুময় হয়ে উঠলো। এইইতো যথার্থ মধুচন্দ্রিমা!
এভাবেই এই রুটিনে সপ্তাহ পার। তারপর শুরু হলো বাণীব্রতর ইভনিং শিফট। দুপুরে খেয়েদেয়ে বেরোচ্ছে। ফিরতে-ফিরতে রাত প্রায় দশটা। এমার্জেন্সির চাপ থাকলে আরো রাত। বাড়িউলির মেয়েরা এলো এক সন্ধ্যায় গল্প করতে। একথায় সেকথায় তারা বলে ফেললো, "রান্নাঘরের পেছনদিকের ঐ ঝুপসি পেয়ারা গাছটায় কেউ একজন গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিলো। অল্পবয়সী বৌ-মেয়েদের সে নাকি বিশেষ বিশেষ দিনে দেখা দেয়!" বলেই জিভ-টিভ কেটে একাকার কাণ্ড, "এমা, ভয় পেয়োনা যেন। সবাইকে দেখা দেয়না অবশ্য!" শ্যামার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেলো। পরেরদিন থেকে শ্যামা দুপুরের খাওয়া হতেই সরবতিয়াকে দিয়ে বইয়ে-বইয়ে সব রান্নার সরঞ্জাম শোবার ঘরে নিয়ে আসে। সরবতিয়া অবাক! বাণীব্রত আরো বেশি অবাক। রান্নার উৎসাহ হারাচ্ছে শ্যামা। বেচারি তলপেট চেপে বসে থাকে... বাথরুমে অবধি যায়না। বাথরুমটাও যে রান্নাঘরের পাশেই! বাথরুমেও পেছনদিকে এক ছোট্ট জানালা আছে। কী দরকার ঝুঁকি নিয়ে! এই এক সপ্তাহেই শ্যামার যেন মুখচোখ শুকিয়ে গেছে। বাণীব্রত ভাবলো বৌয়ের ওপর শারীরিক সম্পর্কের ধকল হয়তো বেশি পড়ে যাচ্ছে... তার ডাক্তারি ভাবনায়। আর বাণীর আদরের বহর কমতে দেখে শ্যামার মনে হলো বাণীর পাকস্থলী খুশি হতে পারছে না। অথচ শ্যামা এদিকে কিছুতেই বিকেলের পরে একলা আর রান্নাঘরে ঢুকতেই পারছে না, আবার বাণীকেও রান্নাঘরের জানালায় চোখের উঁকির কথা বলতে পারছে না। পনেরো দিন পার। আবার বাণীর মর্নিং শিফট। বিকেলে বৌকে চা করে খাওয়ানোর ইচ্ছে হলো তার। আজকাল আদরের পরে শ্যামা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আজও বিকেলে ঘুমিয়ে কাদা। বাণীব্রত চায়ের জল চড়িয়ে চা-পাতার কৌটো খুঁজছিলো... তারপর গরম জলে দুধ চিনি মেশাতে গিয়ে জানালায় চোখ পড়তেই কে একটা সট করে সরে গেলো বলে মনে হলো না? মুহূর্তের মধ্যে বাণীব্রত দুইয়ে-দুইয়ে চার করে নিলো, "ও, আচ্ছা, তারমানে শ্যামা ভয় পেয়েছে এই কাউকে উঁকি মারতে দেখে! লজ্জায় বলতে পারেনি আমাকে!" চা নিয়ে গিয়ে শ্যামাকে জাগিয়ে চেপে ধরতেই কাঁদোকাঁদো মুখে সব বলে দিলো বেচারি... সেই রান্নাঘরের জানালায় একজোড়া চোখের উঁকি মারা থেকে বাড়িউলির মেয়েদের বলা সেই পেছনের বাগানের পেয়ারা গাছে গলায় একজনের দড়ি দেওয়ার গল্প পর্যন্ত।

পরেরদিনই বাণীব্রত দালালকে আবার বাড়ি দেখতে বললো, আর বিশেষ করে একতলায় নয়, আর অবশ্যই বাড়িওয়ালা সেবাড়িতে না থাকলেই আরো ভালো। বাণীব্রত রাতেই পাড়ার দোকান থেকে খবর নিয়েছিলো। দোকানদার অর্থপূর্ণ হেসে বলেছিলো, "পেয়ারাগাছের মতো নরম গাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়ে কেউ ঝুলতে পারে, বলুনতো ডাক্তারবাবু? আসলে বাড়িউলির মধ্যবয়সী আইবুড়ো মেয়েদুটো অল্পবয়সী স্বামী-স্ত্রী ওবাড়িতে ভাড়া এলেই ঐরকম উঁকিঝুঁকি মারে... তারপর ভূতের গল্প বানায়। আসলে ওদের আর কোনোদিন বিয়ে-থা হবে নাতো... তাই, ঐ ওদের দেখেই আনন্দ!" দাঁত বার করে হাসে দোকানি, "অল্পবয়সী সব ভাড়াটে দম্পতিদের সাথেই একই গল্প।" সমস্যাটা ডাক্তার বাণীব্রত বসু বুঝলো পরিষ্কার, "কেস অফ নিম্ফোম্যানিয়াক পেশেন্ট।" বাড়িতে এসে বাণীব্রত বুঝিয়ে বললো সবটা শ্যামাকে, "এটা একরকমের মানসিক অসুস্থতার কারণে বাড়িউলির মেয়েগুলো অমন কাণ্ডকারখানা করে। যৌনসঙ্গম করার জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি চাহিদা থাকে এদের। নারীদের ক্ষেত্রে রোগটিকে বলে নিম্ফোম্যানিয়া এবং পুরুষদেরও এরোগ হয়, সেক্ষেত্রে একে সেটিরিয়াসিস বলে। এই অবস্থায় হস্তমৈথুন করেই এরা চরম আনন্দ পায় বা অন্যকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখেই যৌনসুখ উপভোগ করে।" চোখ গোলগোল করে শ্যামা বাণীর কথা শুনছিলো... এবারে উঠে গিয়ে রান্নাঘরের জানালা খুলে দিয়ে গলা উঁচু করে বলে, "আয় ভূত আয়... জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে যা...!" সট করে চোখজোড়া আবার সরে গেলো... সঙ্গে একটা ম্যাঁওওওও ডাক! শ্যামা বাণীর বুকে মাথা রেখে বলে, "আজ রাতে ভুনা খিচুড়ি আর ডিম টমেটোর অমলেট করি?" কথাটা শেষ করতে পারেনি শ্যামা... তার আগেই তার দুই ঠোঁট আটকা পড়েছে বাণীব্রতর পুরুষ্টু গোঁফের তলায় দুই পুরুষ্টু ঠোঁটের মাঝখানে।