"তুই ফিরিস না… আমি আজও আগের মতোই থাকি।"
মেঘলার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়েছিল কলেজ লাইব্রেরির সামনে—হালকা ভুল বোঝাবুঝিতে।
মেঘলার হাসি ছিল রোদের মতো—নরম, মিষ্টি, আর উজ্জ্বল।
আমি ছিলাম চুপচাপ, আঁকাআঁকিতে ডুবে থাকা এক ছেলে। আর মেঘলা?
ও ছিল প্রাণবন্ত, শব্দে-আবেগে ভরপুর।
আমাদের পরিচয়ের প্রথম দিনেই মেঘলা হেসে বলেছিল, “তুই এত চুপ কেন? কেউ কি মনে কষ্ট দিয়েছে?”
আমি কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে ছিলাম… আর ভাবছিলাম—এই মেয়েটা বুঝি আমার নিরব পৃথিবীতে প্রথম রঙ তুলল।
ভালোবাসাটা ধীরে ধীরে গভীর হয়েছিল—প্রতিদিন কলেজে চায়ের কাপ ভাগ করে খাওয়া, পরীক্ষার আগে নোট বদল, আর প্রতিদিন বিকেলে রিকশার সিট ভাগ করা।
মেঘলা ছিল আমার অভ্যাস, প্রয়োজন আর শান্তির জায়গা।
কিন্তু আমাদের এই সম্পর্ক ছিল শুধু আমাদের জানা।
মেঘলার পরিবার কিছু জানতো না, জানলেও মানতো না—এটা মেঘলা আগে থেকেই জানত।
আমি বলতাম, “আমি চাকরি খুঁজছি, একটু সময় দে, আমরা সব ঠিক করে নেব।”
মেঘলা চোখে জল নিয়ে বলত, “আমি তোর উপর বিশ্বাস রাখি অর্ক।”
কিন্তু মেঘলার পরিবার বিশ্বাস চাইত না, তারা দেখতে চাইত শুধু পাত্রের বেতন আর পদের নাম।
একদিন হঠাৎ মেঘলার ফোন বন্ধ হয়ে যায়।
খোঁজ নিতে গিয়ে মেঘলার বাড়ি গিয়ে জানলাম—ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
আমি বোকার মতো মেঘলার বাসার জানালার নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ, যদি একবার দেখা দেয়।
কিন্তু মেঘলা এল না।
সেদিন সন্ধ্যায় ফেসবুকে ওর বিয়ের ছবি দেখলাম—শাড়ি-পরা, কপালে টিপ, আর চোখে অচেনা একটা হাসি।
আমার ভেতরটা যেন থেমে গেল… শব্দহীন এক কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি।
পাঁচ বছর কেটে গেছে।
আমি এখনও একা।
রিকশায় উঠলে পাশের সিটটা খালি রাখি—মেঘলার জন্য।
চায়ের দোকানে গেলে দুটো কাপ নিই—একটা আমার, আরেকটা যাকে কখনও চুমুক দিতে দেখা যাবে না।
ভালোবাসা সবসময় পাওয়ার জন্য হয় না—অনেক সময় তাকে হারিয়েই বাঁচিয়ে রাখতে হয়।
মেঘলা আর কোনোদিন ফিরবে না, সেটা আমি জানি।
তবুও কোনো এক নীরব অভ্যাসে আমি আজও মেঘলার বাসার জানালার নিচে দাঁড়িয়ে থাকি…
কারণ কিছু অনুভব আর কিছু মানুষ—মনে না রাখলেও, মনে গেঁথে যায় সারাজীবনের জন্য।
মাঝে মাঝে মনে হয়, মেঘলা যদি আজ হঠাৎ একদিন ফিরে এসে বলত—“চল, আবার সব শুরু করি,” আমি কি রাজি হতাম?
হয়তো হতাম না… হয়তো চুপ করে আবার তাকিয়ে থাকতাম তার চোখের দিকে, সেই আগের দিনের মতো।
কারণ সময় অনেক কিছু বদলে দেয়, কিন্তু কিছু অনুভব কখনও পুরনো হয় না।
মাঝে মাঝে নিজের আঁকা সেই পুরনো স্কেচবুক খুলে বসি—যেখানে মেঘলার মুখ আঁকা ছিল, ছোট্ট হাসির রেখা ছিল।
একদিন সেই পাতা ভিজে গিয়েছিল চোখের জলে… এখন তা শুকিয়ে গেছে, কিন্তু দাগগুলো থেকে গেছে।
আমি জানি, ওর এখন নতুন জীবন, নতুন গল্প…
আমি শুধু প্রার্থনা করি—ও যেন ভালো থাকে, সত্যিই ভালো থাকে।
ভালোবাসা মানেই না হয় পাওয়া—তবুও ভালোবাসি, নিঃশব্দে… নিঃস্বার্থে।
আজও আমি মেঘলার জন্য ভালো থাকি, যদিও ওর কোনো খবর আমার নেই।
ভালোবাসা হারিয়ে গেলেও কিছু অনুভব চিরকাল বেঁচে থাকে, নিঃশব্দে… নিঃশর্তে।
...ভালোবাসা হারিয়ে গেলেও কিছু অনুভব চিরকাল বেঁচে থাকে, নিঃশব্দে… নিঃশর্তে।
আর ঠিক সেই অনুভবেই, আমি বেঁচে আছি—নিঃশব্দ অপেক্ষার ভিতর।
একেকটা দিন যেন কাটে বিষণ্ণতা আর অভ্যাসের একঘেয়ে ঘূর্ণিতে।
কলেজটা ছেড়ে অনেক বছর পেরিয়ে গেছে, তবু সেই বেঞ্চগুলো, সেই করিডোর, আর লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেঘলার স্মৃতি কিছুতেই ভুলতে পারি না।
বন্ধুরা সব বিয়ে করে সংসার করছে। কেউ কেউ বিদেশে, কেউ কর্পোরেট অফিসে ব্যস্ত জীবন কাটাচ্ছে।
আমি শুধু স্মৃতির সাথে বসে থাকি, একলা দুপুরে, একলা রাতে।
হোয়াটসঅ্যাপে আজও মেঘলার নাম খুঁজি, যদিও জানি ওর প্রোফাইল আমার ব্লক করা, বা হয়ত নম্বরটাই বদলে গেছে।
তবুও মনে হয়—হয়ত কোনোদিন হঠাৎ ‘হ্যালো’ লিখে মেসেজ করবে।
ভালোবাসা কি শুধুই একসাথে থাকা?
নাকি কোনো কোনো ভালোবাসা হারিয়েও রয়ে যায় আমাদের হৃদয়ের গভীরে, ঠিক যেন পুরনো ডায়েরির কোনো পাতায় বন্ধ হয়ে থাকা একগুচ্ছ অনুভূতি?
আমার মনে পড়ে, একদিন মেঘলা বলেছিল, “ভালোবাসা মানেই তো হাত ধরা নয় অর্ক, অনেক সময় ছেড়ে যাওয়াটাই ভালোবাসার বড় প্রমাণ।”
সেই কথাটা আজ যেন আরও বেশি অর্থবহ হয়ে ওঠে।
আমি জানি, ওর জীবন এখন অন্য কারও সাথে জড়িয়ে গেছে।
তবু আমি আজও ভালোবাসি মেঘলাকে, আগের মতোই, নিঃশব্দে, নির্জনে।
তাকে ফিরে পাওয়ার আশা করি না, শুধু চাই—ও যেন সুখে থাকে, যেখানে থাকুক।