মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, তার সাথে সাথে মেঘের ডাক আর বিদ্যুতের ঝলকানি। আজ ট্রেন স্টেশন পৌঁছাতে খুব লেট করেছে। আমি ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে দেখি কেও কোথাও নেই চারিদিক ফাঁকা,একটা কুকুর বা কোনো প্রাণীর দেখা প্রযন্ত নেই।
এই খারাপ আবহাওয়ায় কেই বা বাইরে থাকবে। আমাকে তাহলে এবার হেঁটে বাড়ি যেতে হবে।
আপনারা ভাবছেন আমি কোথা থেকে আসছি?
আমি শহরে কাজ করি, আর প্রতি সপ্তাহে শনিবার
হাফ বেলা ডিউটি করে গ্রামের বাড়িতে আসি, আবার সোমবার সকালে ফিরে যায়।
কিন্তু আজ যে এইরকম ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীন হবো যদি আগে জানতাম তাহলে আর এই সপ্তাহে বাড়ি আসতাম না।
আর কি করা যায় এসে যখন গেছি হাঁটা শুরু করি। ছাতা মাথায় নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। গ্রামের রাস্তা এমনি তেই অন্ধকার তার উপর আবার যা জোরে বৃষ্টি হচ্ছে যে সামনের কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, বিদ্যুতের আলোয় যতটুকু দেখা যাচ্ছে সেই ভাবে আস্তে আস্তে চলছি।
কতটা পথ চলেছি জানি না হঠাৎ মনে হলো পিছনে পিছনে কে যেনো আসছে, চলার শব্দে বুঝতে পারছি কিন্তু যখনই পিছনে ঘুরে দেখছি কাওকে দেখেতে পাচ্ছি না। আবার যখন চলা শুরু করছি তখন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি পিছনে কেও তো আসছে। আমি কিছুক্ষণের জন্য দাড়িয়ে পড়লাম দেখি কে আসছে, ভালোই হবে একসাথে যাওয়া যাবে।
কোথায় কে! কেও তো নেই,তাহলে কি আমি ভুল শুনছি নাকি? হতেও পারে বৃষ্টির যা আওয়াজ হয়তো সেই আওয়াজের জন্যই ওমনি মনে হচ্ছে। আমি হাঁটা শুরু করলাম আবার সেই আওয়াজ কেও যদি পা ঘষে ঘষে চলে যেমন আওয়াজ হয় একদম ঐরকম আওয়াজ পাচ্ছি।
আমি পিছনে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম "কেও আছ নাকি পিছনে"? আমার কথা শেষ হতে না হতে দুর থেকে যেনো কেও খনা গলায় বলে উঠলো "আমি আছি বাবু খগেন"। আমি বললাম "তো পিছনে কেনো পাশে এসো একসাথে কথা বলতে বলতে যায়"। সে বলে উঠল "না বাবু আপনি ব্রাহ্মণ লোক আপনার পাশে যাওয়ার কি আমার সাহস আছে"। কথাটা শুনে আমার খুব রাগ হলো। আমি বলে উঠলাম "এ কি রকমের কথা তুমি বলছো, আমি ব্রাহ্মণ তাই তুমি আমার সাথে যেতে পারবে না, আমি ব্রাহ্মণ বলে কি অচ্ছুত নাকি?" খগেন বলে উঠলো "না না এরকমের কথা বলে আমায় অভিশাপ দেবেন না, এমনি তে আমি অনেক কষ্টে আছি ।" আমি বললাম"তো পাশে এসে বলো তোমার কি কষ্ট?" খগেন বললো "না বাবু পাশে যেতে বলবেন না, অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে আমার তাই আপনার পাশে যেতে পারবো না।" আমার তো আরও রাগ লাগলো এতো ঝড় বৃষ্টির রাতে এ আমার সাথে মস্করা করছে! আমি রেগে বললাম "এই দুর্যোগের রাতে তুমি আমার সাথে মস্করা করছো?" খগেন বললো "না বাবু আমি মস্করা করিনি,আমি সত্যি মারা গেছি চার বছর আগে,এই রকমের এক ঝড় বৃষ্টির রাতে আমি হাট থেকে ফিরছিলাম হঠাৎ বাজ এসে আমার উপর পড়ল আর সব শেষ।" "তারপর থেকে রোজ রাতে আমি সবার পিছে পিছে ঘুরে বেড়ায় মুক্তির আশায়,কিন্তু কেও আমার উপস্থিতি অনুভব করতে পারে না। শুধু একমাত্র আপনি আমার উপস্থিতি টের পেয়েছেন, আপনি আমায় মুক্ত করুন।"
আমি তো সব কথা শুনে থ হয়েগেছি। ভয়ে আর শরীর নড়ছে না মনে হচ্ছে এখুনি হার্ট ফেল করে মারা যাবো। খগেন মনে হয় আমার অবস্থা বুঝতে পেরে খনা গলায় বলে উঠলো "দাদা বাবু ভয় পাবেন না আমি আপনাকে কিছু করব না,আপনি ব্রাহ্মণ মানুষ আপনি আমার মুক্তির ব্যাবস্থা করে দিন,প্রচুর কষ্টে আছি।" আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম " আমি কি করে তোমার মুক্তির ব্যাবস্থা করতে পারি আমি একজন সাধারন মানুষ। মুক্তি তো একমাত্র ভগবানই দিতে পারে।" খগেন বললো "তারই ব্যাবস্থা তো আপনাকে করতে বলছি, আমি একা ছিলাম আমার আগে পিছে কেও ছিল না তাই আমার মরার পর ঠিক করে সাধ্য শান্তি হয়নি, আপনি ব্রাহ্মণ মানুষ আপনি যদি গয়াই গিয়ে নিজে হাতে আমার নামে পিণ্ড দিয়ে আসেন তাহলে আমি এই কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি পেতে পারি। আমি বললাম "ঠিক আছে এতে যদি তুমি তোমার কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি পাও তাহলে গায়ই গিয়ে তোমার নামে পিণ্ড দিয়ে আসব।" আমার কথা শেষ হওয়া মাত্র আমি অনুভব করলাম পিছন থেকে কেও যেনো হওয়াই মিশে গেলো।
আমি বাড়ি ফিরে মা,বাবা কে সব কথা জানালাম। সোমবার অফিস গিয়ে কিছুদিনের ছুটি নিয়ে গয়াই গিয়ে খাগেনের নামে পিণ্ড দিয়ে এলাম। পিণ্ড দিয়ে আসার কিছু দিনের মধ্যে আমি স্বপ্নে খগেন কে দেখলাম হাসি মুখে আমায় প্রণাম করে যেনো আলো তে মিলিয়ে যাচ্ছে। স্বপ্ন শেষ হতে ঘুম টা ভেঙে গেলো।মনে এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করলাম। হয়তো খগেন কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছে, তাই আমার মনে এই শান্তি।
আপনাদের কি মনে হয় অপঘাতে মরার পর কি আত্মারা ঘুরে বেড়ায় মুক্তির আশায়??
তাই হয়তো কখনো কখনো কাওকে দেখা দেই সাহায্য চাইবার জন্য। কিন্তু আমরা তাদের দেখা মাত্র ভয় পেয়ে যায়।