Part :2 অচেনা চেনা পথ
সেদিন ট্রেনে দেখা হওয়ার পর থেকে ঈশার ভেতর কেমন যেন অদ্ভুত অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। সে ভেবেছিল, ছেলেটি হয়তো কাকতালীয়ভাবে এসেছিল, আবার হয়তো আর কখনো দেখা হবে না। কিন্তু মানুষের মনে যে প্রশ্ন একবার ঢুকে যায়, তাকে আর সহজে তাড়ানো যায় না। ঈশার বুকের ভেতরে বারবার বাজছিল সেই অপরিচিত কণ্ঠ— “তুমি কি সব সময় বইয়ের ভেতরেই ডুবে থাকো?”
এক সপ্তাহ কেটে গেল। কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দিন। ক্যাম্পাস ভরে গেছে রঙিন পোশাকে, হাসি-ঠাট্টায়। ঈশা তেমন ভিড় পছন্দ করে না। তবু তার এক বান্ধবীর অনুরোধে লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে বের হচ্ছিল, হঠাৎই পিছন থেকে চেনা গলা শোনা গেল।
“আচ্ছা, আজও বই?”
ঈশা চমকে ঘুরে তাকাল। বুক যেন থমকে গেল এক মুহূর্তের জন্য। সেই ছেলেটি, সেই দুষ্টু চোখের অভ্র, ঠিক তার সামনেই দাঁড়িয়ে। কাঁধে ঝুলছে একটা কালো গিটার কেস, হাতে কয়েকটা কাগজপত্র।
“তুমি এখানে?” ঈশার গলায় বিস্ময় আর বিরক্তি মিশে গেল।
অভ্র হাসল, “আমি এখানকারই ছাত্র। মিউজিক বিভাগে পড়ি। আজ অনুষ্ঠানে পারফর্ম করব। মনে হচ্ছে ভাগ্য আমাদের বারবার মুখোমুখি করছে।”
ঈশা মুখ ফিরিয়ে নিল। সে জানত না কেন, অভ্রর কথায় ভেতরে ভেতরে অদ্ভুত একটা শিহরণ হচ্ছে। তবু গলায় কড়া সুর আনল, “আমি এসব ভাগ্যে বিশ্বাস করি না।”
অভ্র কেবল হেসে গেল। তার চোখে অদ্ভুত নিশ্চয়তা, যেন কিছু একটা জানে যা ঈশা জানে না।
সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান শুরু হলো। ভিড় জমেছে অডিটোরিয়ামে। হঠাৎ মঞ্চে আলো পড়তেই অভ্রর প্রবেশ। হাতে গিটার, ঠোঁটে মৃদু হাসি। প্রথমে হলভর্তি মানুষজন কোলাহল করছিল, কিন্তু যখনই তার আঙুলের ছোঁয়ায় সুর বেরোলো, পুরো অডিটোরিয়াম নিস্তব্ধ। অভ্রর কণ্ঠে এক অদ্ভুত যাদু ছিল—কোনো পেশাদারিত্ব নয়, যেন বুকের ভেতর জমে থাকা সব ব্যথা আর আশা একসাথে সুর হয়ে বেরিয়ে আসছে।
ঈশা ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রথমে সে শুধু শুনছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে মনে হচ্ছিল গানটা যেন কেবল তার জন্যই গাওয়া। সুরের প্রতিটি ঝংকারে বুক কেঁপে উঠছিল, আর অভ্রর চোখ মাঝেমাঝেই এসে থামছিল তার উপর।
গান শেষ হওয়ার পর করতালি ভরে গেল অডিটোরিয়াম। অথচ ঈশার ভেতরে যেন এক নিঃশব্দ ঝড় বয়ে যাচ্ছিল।
অনুষ্ঠানের শেষের দিকে হঠাৎ লাইট নিভে গেল। চারদিকে হইচই শুরু হলো। অন্ধকারে পথ খুঁজে বেরোতে গিয়ে ঈশা সিঁড়ির ধাপে হোঁচট খেতে যাচ্ছিল, তখনই হঠাৎ একটা হাত শক্ত করে তার হাত ধরে ফেলল। উষ্ণতা যেন শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে গেল।
আলো ফিরে আসতেই সে দেখল—অভ্র।
“ভয় পেয়েছিলে?” অভ্রর চোখে মৃদু হাসি।
ঈশা হাত ছাড়িয়ে নিল, গলায় রাগ চাপা দেওয়ার চেষ্টা করল।
“আমার কাউকে ভরসা করার দরকার নেই।”
অভ্র শান্ত গলায় বলল, “কিন্তু মাঝে মাঝে ভরসা করাটা প্রয়োজন।”
ঈশা উত্তর দিল না। দ্রুত ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল। কিন্তু রাতে বিছানায় শুয়ে বারবার মনে হচ্ছিল সেই হাতের উষ্ণতা এখনো রয়ে গেছে তার আঙুলে।
সে ডায়েরি খুলে লিখল—
“আজ মনে হলো, আমি হয়তো এক অচেনা গল্পের চরিত্র হয়ে গেছি। সেই গল্পের নাম—অভ্র।”
কিন্তু ঈশা জানত না, অভ্রর জীবনে কেবল সুর নেই। তার হাসি, তার মায়াবী চোখের আড়ালে লুকিয়ে আছে গভীর অন্ধকার, যা ধীরে ধীরে তাদের দু’জনের জীবনকেই বদলে দেবে।
---
গল্পের শেষ পর্যন্ত সঙ্গে থাকার জন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। 💌 লিখতে গিয়ে কোথাও ভুল হলে তা ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আপনাদের প্রতিটি মন্তব্য আমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান, কারণ পাঠকের প্রতিক্রিয়াই লেখকের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। আপনারা কীভাবে গল্পটা অনুভব করলেন, কোন অংশ ভালো লেগেছে বা কোথায় আরও ভালো করা যেত—সবটাই জানালে আমার পরবর্তী লেখাগুলোতে নতুন রঙ যোগ হবে। আপনাদের ভালোবাসা আর মতামতই আমার কলমের জ্বালানি। তাই দয়া করে মন্তব্য করতে ভুলবেন না।