অনেকদিন আগের কথা, তখন এই বঙ্গভূমি ছোট বড় নানা রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এমনই এক রাজ্যের নাম ছিল আজবনগর আর লঘুকর্ণ নামে এক রাজা সেখানে রাজত্ব করতেন । রাজার পারিষদবর্গের মধ্যে প্রধান আমাত্যের নাম ছিল রাসভেন্দ্র, সভাপণ্ডিতের নাম ছিল অকৃতবিদ্য, রাজজ্যোতিষীর নাম ছিলো গ্রহাক্রান্ত চক্রবর্তী আর কোতোয়ালের নাম ছিলো বজ্রকান্ত সিংহ।
সেই রাজ্যের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বিলোচন চক্রবর্তী নামে একজন ব্যক্তি সপরিবারে বসবাস করতেন । ঐ গ্রামে বিলোচনবাবু ছিলেন সবচেয়ে সম্পন্ন এবং বয়সে প্রবীণ ব্যক্তি। গ্রামের সকল ব্যক্তিই বিলোচনবাবুকে বিশেষ সম্মানের চোখে দেখতেন।
ঐ গ্রামে বসবাসকারী কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি প্রতিদিন বিকালে বিলোচনবাবুর বৈঠকখানায় একত্রিত হয়ে দাবা খেলতেন । তারপর সান্ধ্যকালীন জলযোগ শেষে যে যার ঘরে ফিরে যেতেন।
এমনই একদিন শেষ বিকালে তখন সন্ধ্যা আসন্ন প্রায়, বিলোচনবাবু উপস্থিত সকলকে বললেন, আমি একটু বাহ্যকর্মে যাচ্ছি তোমরা ততক্ষণ খেলতে থাকো। এই কথা বলে বিলোচনবাবু কাঁধের উপর একখানি গামছা আর হাতে জলভরা গাড়ু নিয়ে বাগানের দিকে গেলেন।
মলত্যাগের জন্য বিলোচনবাবু যেই পশ্চাদ্দেশের বস্ত্র উন্মোচন করে বসেছেন, তখনি তিনি পায়ুমুখে হালকা কিছুর পতনজনিত সুড়সুড়ি অনুভব করলেন। চমকে গিয়ে বিলোচনবাবু পিছন দিকে তাকিয়ে দেখলেন যে কাকের একটি পালক, যেটি তাঁর পায়ুমুখে পতনের ফলে সুড়সুড়ি অনুভূত হয়েছে। এমন ঘটনায় বিলোচনবাবু আসন্ন কোনো ঘোর বিপদের আশঙ্কায় ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। এরকম আসন্ন সন্ধ্যার সময় পায়ুমুখে কাকের পালক পতনের মতো ঘটনা কোন ভয়ঙ্কর বিপদের পূর্বাভাষ বলে তাঁর মনে যথেষ্ঠ ভীতির সঞ্চার হলো। তাঁর মলত্যাগ বন্ধ হয়ে গেলো এবং ভীষণ দুশ্চিন্তা নিয়ে পাংশুমুখে বিলোচনবাবু ঘরে ফিরে গেলেন।
বিলোচনবাবুকে এত তাড়াতাড়ি এবং পাংশুমুখে ফিরে আসতে দেখে উপস্থিত সকলেই উদ্বিগ্ন হয়ে সমস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, চক্রবর্তীমশাই আপনাকে এমন চিন্তান্বিত দেখাচ্ছে, কি হয়েছে বলুন না। অনেক অনুরোধের পর বিলোচনবাবু বললেন তোমরা যদি কথা দাও কাউকে বলবে না, তবেই আমি বলতে পারি। তখন উপস্থিত সকলেই সমস্বরে বিলোচনবাবুকে আশ্বস্ত করলেন যে তারা কাউকে কিছু বলবে না।
এভাবে আশ্বস্ত হয়ে বিলোচনবাবু পায়ুমুখে কাকের পালক পতন এবং তজ্জনিত সুড়সুড়ি অনুভব ও ভয়ঙ্কর বিপদের আশঙ্কা বিস্তারিত ভাবে বললেন। সবকিছু শোনার পর, উপস্থিত সকলেই বিলোচনবাবুর ন্যায় ভীষণ শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। এমতাবস্থায়, সেদিন দাবাখেলা বন্ধ করে ও সান্ধ্যকালীন জলযোগ না করেই সকলে যে যার বাড়িতে শঙ্কিত মুখে ফিরে গেলেন।
এত তাড়াতাড়ি শঙ্কিত মুখে ফিরে আসায় প্রত্যেকের স্ত্রী নিজ নিজ স্বামীকে উদ্বিগ্ন ভাবে কারণ জানতে চাইলে, প্রথমে সকলেই এড়িয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন এবং অবশেষে বললেন যে যদি তারা কথা দেয় কাউকে বলবে না তবেই তাঁদের তাড়াতাড়ি ফিরে আসা ও আশঙ্কার কারণ বলবেন।
স্ত্রীদের দ্বারা আশ্বস্ত হয়ে, তাঁরা নিজ নিজ স্ত্রীর কাছে বিলোচনবাবুর পায়ুমুখে কাকের পালক পতন ও তজ্জনিত আশঙ্কার কথা সবিস্তারে বললেন এবং যথারীতি স্ত্রীগণও তাদের নিজ নিজ স্বামীর ন্যায় আতঙ্কিত হয়ে পড়লো।
উক্ত ঘটনার সাতদিন পর রাজা লঘুকর্ণ জানতে পারলেন যে তাঁর রাজ্যের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বিলোচন চক্রবর্তী নামে কোনো এক ব্যক্তির পায়ুমুখ থেকে ক্রমাগত ভাবে অসংখ্য কাক বেরিয়ে আসছে এবং পায়ুমুখে প্রবেশ করছে। এই ঘটনার কথা জানতে পেরে রাজা সবিশেষ আতঙ্কিত হয়ে, এক জরুরী সভার আয়োজন করে রাজপন্ডিত, রাজজ্যোতিষী ও কোতোয়ালকে তলব করলেন। সকলে উপস্থিত হলে, রাজা বিলোচন চক্রবর্তীর সাথে যে ঘটনার কথা শুনেছেন, সেই ঘটনার কথা বলে কি করা সমীচীন হবে সেই ব্যপারে সকলের মতামত জানতে চাইলেন।
সভাপন্ডিত নাকে এক টিপ নস্যি নিয়ে, কিছুক্ষণ মাথা চুলকে, একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, মহারাজ, এমন অশ্রুতপূর্ব ভয়ঙ্কর ঘটনার জন্য রাজ্যের অমঙ্গল অবধারিত। তবে, এই ঘটনার বিহিত সম্পর্কে আমার জ্ঞান সীমিত। আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে আমাদের মাননীয় জ্যোতিষী মহাশয় উপযুক্ত বিধান দিতে সমর্থ হবেন।
রাজাজ্ঞায় জ্যোতিষী মহাশয় কিছুক্ষণ মাথায় শোভিত দীর্ঘ অর্কফলায় হাত বুলিয়ে অবশেষে বললেন, মহারাজ, বিলোচন চক্রবর্তীর ন্যায় এমন কুলক্ষণযুক্ত ব্যক্তি সমাজ ও দেশের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক। শাস্ত্রমতে এমন ব্যক্তির দেশান্তর অথবা বিনাশ দেশ ও সমাজের জন্য বিধেয়।
রাজজ্যোতিষীর বিধান শুনে রাজা কোতোয়ালকে আজ্ঞা দিলেন বিলোচন চক্রবর্তীর শিরোচ্ছেদ করে, তার ছিন্ন মস্তক রাজার কাছে পেশ করার জন্য।
রাজাদেশ পাওয়া মাত্র কোতোয়াল বিলোচনবাবুর গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন এবং পরের দিন সেখানে পৌঁছে গিয়ে রাজার আদেশ অনুযায়ী বিলোচনবাবুর মাথাটি কেটে এনে রাজার কাছে পেশ করলেন।
বিলোচনবাবুর আশঙ্কা সত্য হলো - শুধুমাত্র পল্লবিত জনরবের কারণে।
----------------