ঝরাপাতা
পর্ব - ৭
🌵🍁🌵🍁🌵🍁🌵
ঘন্টাদুয়েক পর গাড়ির আওয়াজে দু বাড়ি থেকেই সবাই বারান্দায় ঝুঁকে পড়ে। মণিকাদের বেরিয়ে যাওয়াটা মিলির বাড়ির সবাই টের পেয়েছিল। কি হয়েছে জানতে ফোন করা হয়েছিল মিলিকে। ফোন কেটে সুইচ অফ করে দেয় ও। তখন ভরসা পিউ। পিউ বলেছে বটে ওরা একটু ব্যাঙ্কে গেছে, এমন অদ্ভুত দল বেঁধে কেউ ব্যাঙ্কে যায় না।
মিলির মামী রমলা মিলির সঙ্গেও কথা বলতে চেয়েছিল। পিউ নিজে মিথ্যে বলার হাত থেকে বাঁচতে তক্ষুণি মিলিকে ফোন ধরিয়ে দেয়। মিলি আদৌ কোনও প্রশ্ন শুনেছে কি না সন্দেহ, দশ সেকেন্ড পরেই একটা হুম বলে ফোন কেটে দেয়। আবার ফোন করার সাহস পায়নি কেউ, কি হয়েছে, কতটা সিরিয়াস ঘটনা, তাই তো জানা যাচ্ছে না।
এখনও কিছুই বুঝতে পারে না মিলির বাড়ির কেউ। এদিকে শেষ লোকটি গাড়ি থেকে নামার পরও পিউ আর শোভনা, রনির ছোটমামী জুঁই, সাত্যকি, সুবর্ণ, ছোট মামার ছেলে সৌভিক উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে। ওদের চূড়ান্ত হতাশ করে ভাড়া করা গাড়িটি ফিরে যায়। রনি আসেনি।
বাকিরা ছুটে নিচে যায়, সব কথা জানতে হবে। পিউ বারান্দা থেকে ঘরের দিকে তাকাতেও জোর পায় না। মিলি বসে আছে যে। একটু পরেই অবশ্য বনির হাঁকডাক শোনা যায়, ওকে মিলিকে নিয়ে আসতে বলছে।
মিলির হাত ধরে নেমে এসে দাঁড়ায় পিউ। কোনো প্রশ্ন নেই ওর তরফে। রনি যখন ফেরেনি, কি, কেন, কবে, কার, সব যেন অকিঞ্চিৎকর। তবে মণিকা আর তার দাদাদের আলোচনায় বোঝা যায়, রনি স্পষ্ট বলেছে, ওর এখন বাড়িতে ফেরার ইচ্ছে নেই। আর সেটাকে মণিকা সমর্থন করায় ওরা খুব ক্ষিপ্ত।
তন্ময়ের বাড়ির সামনে গিয়ে ওকে ফোন করেছিল বনি। রনিকে নিয়ে বাইরে কোথাও বসে আলোচনা করতে চায়। প্রথমে রাজি না হলেও মা নিজে এসেছে শুনে রনি আসে। কাছাকাছি একটা পার্কে নিয়ে যায় তন্ময়। তবে রনি ওর মত স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে।
বড়মামু বলে, "মণি, তুই একটু জোর দিতে পারতি। তোর কথা ঠিক শুনত। সেখানে তুই খালি আমাকে থামালি।"
মণিকার আগে বড়মাইমা কেকা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, "কাকে জোর করবে? ঐ তো চেহারা হয়েছে ছেলের। আগে ছেলেটাকে সুস্থ হতে দাও। আসবে তো বটেই। ওর বাড়ি ওর ঘর। এদিকের সব বন্দোবস্ত হলেই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসবে।"
- "কি বন্দোবস্ত হবে বড়দি? জুঁই জানতে চায়। পিউ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, কি বলে দেখা যাক। কেকা সবার দিকে তাকাতে গিয়ে পিউর চোখে চোখ পড়তে থমকে গিয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটে। তবে ওকে উত্তর দিতে হয় না, কলিং বেল বেজে ওঠে। পিউ নড়ে না, মিলির হাত ধরে যেমন দাঁড়িয়ে ছিল দাঁড়িয়ে থাকে।
সাত্যকি দরজা খুলে দেয়, মিলির মামা শ্যামল আর মেসো মনোজ এসেছে। বনি আর ওর ছোটমামা বীরেন তাড়াতাড়ি উঠে বসার জায়গা দেয়।
মনোজ মাথা নাড়ে, "না না বসবো না। আমরাও বাড়িতে সব কাজ সারছি, আপনারাও ব্যস্ত, ক্লান্ত। আমরা শুধু এসেছি অষ্টমঙ্গলায় আসার জন্য আপনাদের অনুরোধ করতে। দেখুন, এই তো সামনাসামনি বাড়ি, সবাই সবার চেনা। নিয়ম করতে নাহয় রনি আমাদের মিলিকে নিয়ে এলো, আপনারা সবাই এলে ভাল লাগতো। একসঙ্গে গল্প টল্প করতাম।"
- "আগামীকাল বাড়ি যেতাম আমরা। আপনারা সবাই এলে দুদিন আরও থেকে যাব। মণিকাদি, তাহলে সবাইকে নিয়ে আসছেন তো?" শ্যামল নেমন্তন্নের রীতি মেনে হাতজোড় করে।
বনি কোনদিকে পালাবে ভাবছে। মণিকা পরিষ্কার গলায় বলে, "দেখুন, রনি বাড়িতে নেই। ও একটু নিজের কাজে অন্য জায়গায় আছে। এখন অষ্টমঙ্গলায় যেতে পারবে না।"
শ্যামল আর মনোজের চোখাচোখি হয়, যা ভেবেছিল, কিছু গলদ আছে। মনোজ একগাল হাসে, "বেশ তো, কাজ সেরে নিক। আমরা ভেবেছিলাম আগামীকাল আপনারা যদি আসেন, তা জামাইয়ের কাজ থাকলে দুদিন যাক। বিয়ের দশদিনের মধ্যে এলেই হল, কি বলেন ধীরেনদা?" ওদের বড়মামা ধীরেনের দিকে ফেরে। ধীরেনও ঢোঁক গিলছে।
মণিকা কিন্তু স্থিতধী, কিছুটা নিশ্চিন্তও, "আমি একটু সময় নিয়ে গোপা আর দাদার সঙ্গে কথা বলতাম। তার মধ্যেই আপনারা এসে গেছেন, আপনাদেরই বলি। রনি এখন কিছুদিন অন্য জায়গায় থাকবে। বেশ কিছুদিন লাগবে ওর। আমার মনে হয় আপনারা ওকে এখন বাড়ি নিয়ে যান। পিউ ওর সব গুছিয়ে দে। আমি পরে সময়মতো ওকে আনাবো।"
শুধু শ্যামল আর মনোজ নয়, ঘরের আরও অনেকের মুখ কালো হয়ে যায়। মনোজ শান্ত ভাবেই বলে, "ওকে তো আমরা নিয়ে যেতে পারি না। আপনি বললেন, আমরা গিয়ে গোপা আর সমরদাকে সব কথা জানাবো। ওরা আপনার সঙ্গে কথা বলে নেবে। আমরা আজ আসি। আসি রে মিলি। তোর ফোনটা বোধহয় সুইচড অফ হয়ে আছে। আর মাকে কিছু বলবি?"
মিলি মুখ তোলে না, প্রায় অস্ফুটে বলে, "বাবা।"
- "তোর বাবা ভাল আছে। আজ আবার একবার প্রেশারটা চেক করানো হবে। তবে ঠিক আছেই মনে হয়। চিন্তা করিস না।" শ্যামল আবার সবার দিকে ফিরে আসি বলতে যাচ্ছিল, মণিকা বলে, "ওর বাবার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে যখন মিলিকে আপনারা নিয়ে যান।"
- "মিলি তো ওর বাবাকে দেখতে চায়নি ! বাবা কেমন আছে জানতে চেয়েছে। আর আমরা তো বললাম, মিলিকে এ বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়ার রাইট আমাদের নেই।" মনোজ এবার মুখের হাসি গুটিয়ে নিয়েছে।
মণিকা কেকার দিকে হাত বাড়ায়, "আমার ফোনটা দাও তো। একটু দাঁড়িয়ে যান মনোজদা, পিউ ওদের জল মিষ্টি দে। আমি ফোন করে গোপার সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি।" মনোজরা না না করে ওঠে, পিউ নড়ে না। জুঁই উঠে যায় মিষ্টি আনতে।
বনি মাকে নিরস্ত করতে চায়, "মা এখন থাক না। তুমি টায়ার্ড। পরে কথাবার্তা হবে।"
ততক্ষণে মণিকা ফোন করে ফেলেছে, "কে গোপা? শোনো, মিলি একটু ওর বাবাকে দেখতে চাইছে। ওকে পাঠাচ্ছি তাই।" গোপাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মণিকা ফোন কেটে দেয়, "আমার সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। মিলিকে নিয়ে যান। পিউ মিষ্টি টিষ্টি দে না।"
- "মিষ্টি পরে হবে মণিকাদি। রনি ফিরুক, নাহয় আমিই সবাইকে মিষ্টি খাওয়াবো।চলরে মিলি।" চূড়ান্ত অপমানিত মনোজ আর শ্যামল মিলিকে নিয়ে হাঁটা দেয়। বনি আর পিউ কিছুই ভেবে উঠতে পারে না, যা হল, যা হচ্ছে, ভাল না মন্দ, কি হচ্ছে !
মিলিকে নিয়ে এসে শ্যামল আর মনোজ সমস্ত ঘটনা জানায়। মিলি একটিও কথা বলেনি, এসে থেকে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বাবার কোলের কাছে বসে আছে। কোনো কথায় কান আছে বলে মনে হয় না।
গোপা কান্নাকাটি জুড়ে দেয়, "বাবাকে দেখতে তো এতগুলো লোক রয়েছি। তোকে কে বলেছিল এই ঝঞ্ঝাটের মধ্যে বাবার খোঁজ করতে?"
সমর এবার এক ধমক দেয়, "তুমি চুপ করো তো। মা হয়েছো, মেয়েদের মনের কোনো খবরই রাখো না। লিলির সঙ্গে বসে কথা বলতে পারোনি? আমার সেদিন শরীর খারাপ লেগে উঠল, তোমরা সেই সময়ে মিলিকে কি বলেছ কে জানে, মিলি আমাকে বলল, ও রনিকে বিয়ে করতে রাজি। এই বিয়ের প্ল্যানটা কার মাথা থেকে বেরিয়েছিল আমি জানতে চাই।"
মনোজও বিরক্ত, মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, "সে যদি বলো সমরদা, আমরা সবাই রাজি ছিলাম। অমরদা কথাটা তুলেছিল, আমাদের সবার মনে হয়েছিল ভাল হবে। এখন তো দেখছি ওদের অনেক চাল আছে।"
- "চাল আছে মানে?" গোপা আঁতকে ওঠে।
- "মানেটা তোকে এখনও বোঝাতে হবে? মানছি আমাদের একটা মেয়ে অন্যায় করেছে। এই মেয়েটার কি দোষ? ওরা নিজেরা রাজি হয়ে বিয়ে দিল, এখন ওদের ছেলে নাকি বাইরে কাজে গেছে। আর মিলিকে পাঠানোর জন্য তো অসভ্যের মতো করছিল মণিকাদি।" শ্যামল বলে।
- "ঠিক বলেছ দাদা। ওদের ছেলে ঐ তো আধঘণ্টার পথ গিয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। আজ সকালে সবাই মিলে কোথায় গেল, আর ছেলের বহুদিনের জন্য বাইরে কাজ পড়ে গেল? পুরোটাই সাজানো। এ্যাই মিলি, তোর সঙ্গে এ কদিন ওরা কেমন ব্যবহার করেছে রে? কি কি বলেছে তোকে?
চলবে