Read Jharapata - 10 by Srabanti Ghosh in Bengali Love Stories | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

ঝরাপাতা - 10

ঝরাপাতা

পর্ব - ১০

🏜🍂🏜🍂🏜🍂🏜

- "এসে তো কিছু বললি না আমাকে?" মণিকা কোনোমতে ঢোঁক গিলে বলল। 

পিউ যেন আর নিজের মধ্যে নেই। ছোট্ট একটুকরো হেসে বলল, "কি বলতাম মামনি? মিলি ফিরে এসেছে, ওর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি শুনেই তোমার মুখ কালো হয়ে গেল। মিলির খবর নেওয়ার কথা তোমার মতো মানুষেরও মনে হল না? উলটে বলে দিলে, তাড়াতাড়ি ফিরতে। এতো দেরি দেখেও ফেরার পর ওদের কথা জানতে চাইলে না। একরাশ বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলে দিয়েই ঘরে চলে গেলে।"

- "আমি ঠিক বুঝতে পারিনি, মানে আমি ভাবতেই পারিনি এরকম কান্ড হয়েছে।" মণিকা যেন পিউর ছাত্রী, হোমওয়ার্ক না করে ক্লাসে এসে ধরা পড়েছে। 

- "তুমি কি ভেবেছিলে মামনি? মিলির সঙ্গে যা ঘটেছে, সেটা হজম করা খুব সহজ? মিলি ওর মামার বাড়িতে সিনেমা থিয়েটার দেখে, আরামে আয়েশে দিন কাটাচ্ছিল? আর সেটাই যদি হতো, এই যে ও বাড়িতে ফিরে এল, এখন কি করতে? তোমাদের বাড়ির ছেলে আবার কোথাও চলে যেত, আর তোমরা সেটাকে সমর্থন করতে?"

- "পিউ তোমার অভিযোগ থাকতে পারে। সেটা এমন করে বোলো না যাতে তোমার নিজেরই পরে লজ্জা করে।" বনি অত্যন্ত বিরক্ত পিউয়ের এই খোঁচাগুলোতে। 

- "আজ আমি একটাও কথা বলতে চাইনি। তোমাদের প্রশ্নের উত্তরে আমি শুধু নিজেকে ডিফেন্ড করছি। হ্যাঁ, নিজেকে, মিলিকে নয়। আজ মিলির আয়নায় আমি দেখেছি, এই বাড়িতে আমার গুরুত্ব আছে, কারণ আমি তোমাদের পছন্দমত। যদি আমার বিয়েও মিলির মতো করে হত, মিলির মতোই দশা হত। ঘাড় ধরে বের করে দিতে তোমরা।"

- "একথা বলিস না পিউ ! তোকে আমি কতটা ভালবাসি, জেনেও যদি তুই এভাবে বলিস !"

- "সত্যি বাবা, কি থেকে কোথায় চলে যাচ্ছ।" বনি নিজের বৌকে বোঝাতে না পারার আপশোষে দুদিকে মাথা নাড়ে। 

- "তুমি আমাকে ভালবাসো না মামনি। আমি তোমার গুছিয়ে নেওয়া জীবনটার ফ্রেমের সঙ্গে মাপসই। তাই সবাই মিষ্টি সুরে কথা বলতে। আজ একটু জোরে টিভি চালিয়েছি, তাতেই তোমরা আপত্তি করলে? কেন, আমি সন্ধ্যাবেলা টিভিতে কিছু দেখতে পারি না? ঐ সময়টুকু তোমরা অন্য কোনো একটা ঘরে গিয়ে গল্প করতে পারতে না?"

- "ও তার মানে তুমি টিভিটা ইচ্ছে করেই জোরে চালিয়েছিলে আমাদের এই কথাগুলো শোনাবে বলে?" অক্ষম আক্রোশে ফুঁসছে বনি। কারণ টিভির আওয়াজটা কমাতে বলেছিল ও নিজে। 

- "ইচ্ছে করেই চালিয়েছিলাম। তবে কথা শোনাতে নয়। নিজের জায়গাটা আসলে কোথায়, মেপে নিতে।"

- "কথার মারপ্যাঁচগুলো বেশ শিখেছ ! আমি এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতে পারি না। সোজা কথাটা শুনে রাখ। একবার বলেছি, আবার বলছি। আমি রনির চলে যাওয়াটা সাপোর্ট করিনি। ওকে বুঝিয়ে বাঝিয়ে ফিরিয়ে না এনে, অন্যলোকের বাড়িতে থাকতে দিল মা, এটাও পছন্দ করিনি। তবে মায়ের বিরোধিতা করতে পারিনি, কারণ ভয় পাচ্ছিলাম। রনি যতটা হঠকারিতা করে ফেলেছে, তাতেই বুঝেছিলাম, ওর মানসিক অবস্থা ঠিক নেই। এখন কিছু করে বসলে আর ক্ষতিপূরণ করতে পারব না। বুঝেছ তুমি?"

রনির মাথা আরও নিচু হয়ে যায়। শুধু নিজের পরিস্থিতি নিয়েই ভেবেছে এতদিন। বিয়ের আগে এক ফোঁটাও প্রতিশোধের ভাবনা ছিল না ওর মনে। বন্ধুর বাড়ি গিয়েও ভাবেনি, এতে মিলিকে জব্দ করা হল। বরং বাড়ি ফিরে এসেও প্রতিদিন ভেবেছে, এক বোন ওর বিয়ের দিন পালিয়ে গিয়ে একরকম সামাজিক অসম্মানের সামনে ঠেলে দিয়েছে। আর আরেক বোনকে বিয়ে করে ফেলেছে, এখন সে চলে গেলে আরও ভয়ানক অসম্মানের মুখোমুখি হতে হবে। সেই চিন্তায় কাঁটা হয়ে এতগুলো দিন কেটেছে। 

অথচ সম্পূর্ণ অন্যদিক থেকে এলো একটা অভাবনীয় আঘাত। ওর ভয়, আশঙ্কা, সন্দেহ, সবকিছু ওকে দিয়েই আসলে ঘোর অন্যায় করিয়ে নিয়েছে একটি নিরপরাধ মেয়ের উপর ! 

- "খুব ভালো বুঝেছি।" পিউর গলায় ক্ষোভ, ব্যঙ্গ না হতাশা, কে জানে, "রনি নিজেদের ছেলে, তার মানসিক যন্ত্রণা তোমরা বোঝ। আর মিলি পরের বাড়ির মেয়ে, তার মন বলে বস্তুটাকে যত খুশি আঘাত করা যায়।"

- "পিউ, আমি শেষবার বলছি, তোমার কথা ঠিক, কিন্তু সেগুলো বলার ভঙ্গিমা ঠিক কর। তোমরা তোমরা করে যে কথাগুলো বলছ, সেগুলো মায়ের নামে বলছ তো? আমি এটা সহ্য করব না। তুমি ভদ্রভাবে কথা বলো।"

- "আমি ভদ্রভাবেই কথা বলছি। কথাগুলো তোমাদের গায়ে লাগলে, আমি কি করব? তুমিই বা কি করবে? মারবে ধরবে নাকি বাড়ি থেকে বের করে দেবে?"

- "পিউ, কি সব বলছিস? আর বনি, তুই চুপ কর। পাগল হলি নাকি তুই? পিউর আমার উপর রাগ হয়েছে। রাগ করার মতোই কাজও করেছি। বুঝতে পারছিস না, ও কত কষ্ট পেয়েছে আমাদের ভুল করতে দেখে? সেটা কাকে বলবে? আমার পিউ তো এ বাড়ির কোনো কথা বাইরের কাউকে বলতে পারে না। তাই আমাদের বকাবকি করছে। এখানে আয় পিউ, আমার কাছে আয়। মামনিকে মাপ করে দে মা। আজ আর রাতে গিয়ে উঠব না। কাল তোতে আমাতে গিয়ে মিলিকে দেখে আসব।"

- "তোমরা কেউ দয়া করে এই সর্বনাশটা কোর না। মিলির সামনে গিয়ে ওর উদ্বেগটা বাড়িয়ে দিও না। আমার কথা যদি বলো, আমি মিলির দিকেই থাকব। মিলির চিকিৎসা শুরু হলে আমি লড়াইটা জারি রাখব জেনো। যে লড়াইটা আসলে তোমাদের বিরুদ্ধে। আমি এ বাড়িতে নিজের মর্জিতে কিছুই করতে পারব না, টিভিও দেখতে পারব না প্রমাণ হয়ে গেছে। সেখানে মিলির জন্য লড়াই ! সেটা আমি বাড়ি থেকে চলে গিয়ে লড়ব। কাল সকালে আমি চলে যাব।" পিউ উঠে পড়ে। 

🏜🌵🏜🌵🏜🌵🏜

হতভম্ব বনি শুধু বলে, "কি সব করছ পিউ? শান্ত হও।"

মণিকা এবার কেঁদে ফেলে, "আমি ভুল করেছি পিউ, বিরাট বড় ভুল করেছি। কিন্তু বিশ্বাস কর, মিলির ক্ষতি চাইনি। প্রতিশোধের কথা তো ভাবিইনি। বরং মিলির সঙ্গে বিয়েতে আমি খুশি হয়েছিলাম। আর কোনো কেলেঙ্কারি হবে না ভেবেছিলাম। রনি যখন চলে গেল, আমি বুঝলাম, ও বিয়েটা মানতে পারেনি, বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে। তখন কি করতাম বল? রনিকে সময় দেওয়া ছাড়া কি করার ছিল? মিলি এখানে থাকলে রনি আর ফিরবে না। তাই ওকে তখন ও বাড়িতে পাঠালাম।"

- "এই কারণগুলো আমি মানি। কিন্তু রনি যদি বলতো, বিয়ে করব না, আমি প্রথম ওর সঙ্গে থাকতাম। বিয়ের পর মেয়েটার সঙ্গে যা করেছে, তার ক্ষমা হয় না। তেমনি তুমিও, না সমরকাকুর খবর নিতে গেলে, না মিলির। রনি ফেরার পর, ওর সঙ্গে এসব কথাই তুললে না। ওদের বাড়িতে তোমাদের দুজনের কাজের কি উত্তর দেব ভেবে আমিও মুখ লুকিয়ে থাকলাম। পিউর কথাগুলো খারাপ, কিন্তু সত্যিকথা। এটা স্বীকার করছি।" বনি দুহাতে মুখ ঢেকে বসে থাকে।

- "আমি আজই চলে যেতাম। তবে আমার কাছে মিলির সমস্ত গয়নাগাঁটি রয়েছে। সেদিন রাতে ওর সাজগোজ ছাড়িয়ে আমার আলমারিতে রেখে দিয়েছিলাম। পরদিন যেভাবে মিলিকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ওগুলোর কথা মনে ছিল না। পরে ভেবেছি, এ বাড়ির বৌ যখন, ও তো ফিরে আসবে, তখন ওকে দিয়ে দেব। এখন আর সেগুলো রাখার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া ওরা কান্নাকাটি করছিল, এতো বড়ো খরচের পর, কাকুরও শরীরটা খারাপ, চিকিৎসা চলছে, মিলির চিকিৎসার বিশাল খরচ। গয়নাগুলো সেই কাজে লাগলেও ভালো হবে। খুব তো বৌ হল শাড়ি গয়না পরে। কাল আমি ওদের সব ফেরত দেব। যদি কিছু হারিয়ে থাকে, আমার একার দায়িত্ব, সে গয়না আমি গড়িয়ে দেব। তোমাদের কারও কোনো দায়িত্ব নেই।" মণিকা কাঁদতে কাঁদতে বারবার ডাকেলেও পিউ কারও দিকে আর ফিরে তাকায় না।

খানিকক্ষণ পর, নিজেদের ঘরে পিউকে বোঝাচ্ছে বনি, রনি বাইরে থেকে ডাকল। বনি সাড়া দিতে ভিতরে এল। পিউকে দেখার দরকার নেই, রনি জানে প্রচুর কান্নাকাটি করছে। এখন দাদাকে দেখে বুঝল, সেও চোখ মুছছে। রনি সরাসরি সারেন্ডার করে, "বৌদি, আমি নাহয় অন্যায় করেছি, তার জন্য তোমাদের সংসারটা ভেঙে যাবে? আমাকে শাস্তি দিতে গিয়ে তুমি নিজেকে শাস্তি দেবে?"

বনি মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ঘরের অন্যদিকে। এখন এগিয়ে এসে বলল, "আমার কোনো কথাই শুনছে না। পিউ একটা কথা ভাবো, আমরা সবাই অন্যায় করেছি বলে তুমিও কি অন্যায় করতে যাচ্ছ না? আমাদের সঙ্গে, মায়ের সঙ্গে থাকবে না বলছ, টুকাইয়ের কি হবে? এখনই এভাবে কান্নাকাটি করছে তোমাদের কাঁদতে দেখে। মা যে ওকে নিয়ে বোঝাচ্ছে, সেই টুকাই কিভাবে থাকবে মাকে ছেড়ে? আমাকে, ভাইকে জিজ্ঞেস করো, আমরা বাবাকে পাইনি, সেভাবে পরিবার পাইনি। মামারা ছাড়া কাউকে নিজেদের পাশে পাইনি। একটা বয়েস পর্যন্ত এজন্য কতটা অসহায় ছিলাম, তুমি নিজেই জানো। কোন ছোটবেলা থেকে আমাদের তিনজনকে দেখছ, সেগুলো একবার ভাবো।"

দাদার কথায় সাহস পেয়ে রনি আবার বলল, "একটা খুব গোলমালের সময়, যখন আমার শক্ত হয়ে সবার পাশে দাঁড়ানোর ছিল, আমি ভুল পথে গেছি স্বীকার করছি। তুমি সেটা সংশোধন করতে পারতে না? তুমি আজকের মতো সেদিনই আমার ভুলটা ধরিয়ে দিতে পারতে না? এতগুলো দিন ধরে বলতে পারতে না? তার বদলে ভাই ডাকটাই ফেরত নিয়ে নিলে? তোমার নিজের ভাই হলে শাসন না করে ফেলে চলে যেতে?"

কথাগুলো যে পিউর উপর কোনো প্রভাব ফেলছিল না, তা নয়। মিলিকে দেখে, সেই পরিস্থিতি সহ্য করতে না পেরে ওর মতো একটা শিক্ষিত, আধুনিক মেয়ের আত্মসম্মান বিরাট ধাক্কা খেয়েছিল। ওর মনে এদের সকলের প্রতি তীব্র বিরাগ জন্মেছিল। সেই বিরাগ শক্তিশালী হয়েছিল, এরা তিনজনই সবচেয়ে কাছের মানুষ বলেই। রাগ করে মুখে বললেও, মন থেকে এদের সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে কিছু ভাবতে পারছে না নিজেই। মনের আদর্শবাদী অংশটা বলছে, ওরা অন্যায় করেছে, ওরা অপরাধী। আর এদের আপন বলে জানা মনের অন্য অংশটা ভাবছে, কেন এরা এমন করল? 

রনি মেঝেতে পিউর পায়ের কাছে বসে পড়ে বলল, "কথাও বলবে না? আমাকে ছেড়ে তাহলে চলে যাবে? একটা অন্যায়ের জন্য আরেকটা অন্যায় আমাকে দিয়ে করাবেই? টুকাই আমার জন্যই একলা হয়ে যাবে? তুমি আর দাদা আলাদা হয়ে যাবে?"

রনি যত ভবিষ্যতের এই ছবিটা তুলে ধরছে, পিউ বুঝতে পারছে, ও চলে যেতে পারে, মিলিকে বিচার পাইয়ে দেওয়ার জন্য লড়াই করতে পারে, ওর বাবা মাও ওর পাশে দাঁড়াতে পারে, টুকাইয়ের প্রতি তাতে ও সুবিচার করবে না। সেজন্য মুখে কোনো উত্তর বা অভিযোগ, কিছুই উঠে আসে না ওর, চুপ করে বসে থাকে। 

পিউ যতটা শক্ত হয়ে গেছিল, রনিকে অন্যায় স্বীকার করতে দেখে যে সেই মানসিক জোর কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে, এটা বনির চোখ এড়ায় না। বনি আবার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলে, "পিউ, মিলির সঙ্গে যত বড় অন্যায় আমরা করেছি, তার জন্য সম্ভবত পুলিশ, প্রশাসনের সাহায্য নিতে পারে ওরা, তুমিও কেস করতে পারো। যদি করো, আমি অন্ততঃ নিজেকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করব না। তুমি কি একবার সুযোগ দিতে পার না, মিলির জন্য আমি কিছু যাতে করতে পারি?"

- "আমাকে একবার একটা সুযোগ দিতে পারবে না আর? একবার একটা অন্যায়ের জন্য আমাকে আর বিশ্বাস করো না?" রনি মুখ তুলে তাকিয়ে আছে পিউর দিকে। 

চলবে