ঝরাপাতা
পর্ব - ১৭
🌷🌿🌷🌿🌷🌿🌷
বৌদির অভিযোগ শুনেই নিজের আর্জি নিয়ে রনি দাদার দিকে তাকায়, "দেখেছিস, আজকাল কিভাবে কথা বলে আমার সঙ্গে? আমাকে বকেছে বলে আমি রাগ করেছি?"
- "না, তোর কান টেনে লম্বা করে দেয়নি বলে আমি পিউর উপর রাগ করেছি। হয়েছে? দুজনেই থাম। পিউ, ওরকম করে কথা বোলোনা প্লিজ। তুমি জানোনা ওর কতটা মনখারাপ লাগছে? আর ভাই, তুইও অন্যায় করেছিস। তুই মরে যাওয়ার কথাটা কেন বললি ওকে?"
রনি মাথা নিচু করে বলে, "সরি রে। খুব রাগ হয়েছিল। একদিনও ডেকে কথা বলেনা। এতগুলো মাস, একটা জিনিস কিনে আনতে বলে না দোকান থেকে। আগে ক্লাসের মধ্যেও পঞ্চাশবার ফোন করত, দাদাকে বললে রেগে যাবে। ভাই বাড়ি ফেরার সময় এটা আনবে, ওটা আনবে। এখন আর ভাইকে দরকার লাগে না, ভাইয়ের কথা মনে পড়ে না।"
- "মনে কেন পড়বে না? খুব মনে পড়ে? যে আমার একদিনের রাগের কথাই কেবল মনে রেখেছে, আর কিছু মনে নেই, তার সঙ্গে কিসের কথা বলব? এর মধ্যে একদিনও বাড়ি ফিরে এটা বানাও, ওটা বানাও বলেছে আমাকে? ওর দোষটা তুমি কখনো দেখো না।" পিউ নিজের বরকে কড়কে দিয়ে খাটের উপর ধপাস করে বসে পড়েছে।
বনি হো হো করে হেসে ফেলে, "এইটা বোঝা গেল, তোরা দুজনই খুব ভালো পর্যায়ের শ্রমজীবী মানুষ। কেন তোদের কাজকর্মের ভার দেওয়া হচ্ছে না, তাই তোদের মনমেজাজ খারাপ। পিউ কি কি লাগবে, অর্ধেক জিনিস লিস্ট করে ওকে দোকানে পাঠাও। বাকিগুলো দুটো তিনটে ইনস্টলমেন্টে ফোন করে করে বলবে মাঝখানে। আর বনি, কি কি খাবি রাতে, বলে দে, বৌদি বানাক।" বনিও হাসতে হাসতে খাটের একধারে বসে পড়ে।
- "একদম হাসবে না। আমি তোমাদের কাছে হাসির খোরাক তাই না? আমার রাগ দুঃখ হলে হেসে গড়াবে তোমরা ! যাও আমি থাকবই না।" পিউ তেজ দেখিয়ে উঠে পড়তে যায়। বনি প্রায় ডাইভ দিয়ে ওর হাত ধরতে গিয়ে বিছানার উপর মুখ থুবড়ে পড়েছে। রনি লাফিয়ে উঠে দু হাত মেলে ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে, "আমি হেসেছি নাকি যে চলে যাচ্ছ?"
- "তুমি কেন হাসবে? তোমার দেখাতে হবে না, আমি কত খারাপ বৌদি?" পিউ কথার ঝোঁকে বলে যাচ্ছিল, রনি হাত নামিয়ে সরে দাঁড়াল, ''কাকে কি দেখাবে বলো? তবুও রাগ করে তোমাকে যা তা বলেছি, সরি। আর কখনো বলব না।"
রনির গলায় কিছু একটা ছিল, পিউ ওর দিকে ফিরে তাকাল। রনির লজ্জায়, ব্যথায় শুকনো মুখটা দেখে অনেকদিন পর সেই স্কুলে পড়া রনিকে মনে পড়ল পিউর। প্রথম এ বাড়িতে আসে বনির জন্মদিনে। বনির সঙ্গে তখন একটা সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে সবে, বনির মা আর ভাইয়ের প্রতি বেশ আগ্রহ নিয়েই এসেছিল। সবে হাইস্কুলে ওঠা ক্লাস ফাইভের রনি কি বুঝেছিল কে জানে, পিউর কাছে ঠায় সেঁটেছিল। বাড়িতে পিসি, মামা, ওদের দু ভাইয়ের বন্ধুরা, সবাই থাকা সত্ত্বেও, রনি পিউর সঙ্গে সঙ্গে। বনি বলে, সেদিন থেকেই নাকি পিউ ওর ভাইকে নিয়ে নিয়েছে। সত্যিই তাই, বালক রনির সেই নিষ্পাপ মুখ, মিষ্টি হাসি আর দুষ্টু দুষ্টু চোখ, ও যখন একটা চকলেট বাড়িয়ে ধরেছিল হাই রনি বলে, চকলেট না নিয়ে কোমরে হাত দিয়ে রনির বিজ্ঞের মতো প্রশ্ন, তুমি কে, ওদের দলের সবার হাসি। পিউ ঠাট্টায় যোগ দেয়নি, মিষ্টি হেসে চকলেটটা রনির হাতে গুঁজে দিয়ে বলেছিল, আমি পিউদিদি।
রনিও পিউর চোখে একটা নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেখেছিল। ছোট হলেও আত্মীয়দের কাছে অনেক ঘা খেয়েছিল ততদিনে। ওর সহজাত বোধে ধরা পড়েছিল পিউ খুব কাছের মানুষ। সেই দিনটা থেকে কত আবদার, বায়না করেছে রনি। বিয়ের পর পিউদিদি ছাড়িয়ে বৌদি ডাকাতে মণিকাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। রনি চাকরি পাওয়ার অল্প কিছুদিন আগেই পিউ চাকরি ছেড়েছিল। এক দুদিন থেকে থেকেই রনি বেরোনোর আগে বা ইউনিভার্সিটি থেকে ফোনেও জানতে চাইত, পিউর জন্য কিছু আনতে হবে কিনা। রনির বিয়েতে আলপিন টু এলিফ্যান্ট কি কিনে দিতে হয়নি ওর বৌদিকে ! বনি রাগ করেছে, রনি ওকে থামিয়েছে। আবার বৌদিকে টানতে টানতে কাউন্টারে নিয়ে গেছে, আরেকটা ভালো শাড়ি দেখানতো বৌদির জন্য।
বিয়ের কথা মনে পড়লেই..........। নাহ, এবার সব বদলাতে হবে। পিউ রনির হাত ধরে খাটের দিকে নিয়ে আসে, "এত রাগ আমার উপর? আমি বকেছি, রাগ করেছি বলে আমাকে আগের মতো ডেকে কথা বলা যেত না?" বনিও হাত বাড়িয়ে ভাইকে টেনে পাশে বসিয়েছে, "কেন রাগ করছিস ভাই? আমরা তোকে ভালোবাসি না?"
- "সত্যিই বলছি। রাগ না, খুব মনখারাপ লাগে, তাই বলে ফেলেছি। আর কোনোদিন বলব না। কিন্তু তোমরা বিশ্বাস করো, রাগটা নিজের উপর করেছি। আমি আর পারছি না। আমি কত বড় অন্যায় করেছি, সেটা তো বুঝেছি। তার উপর সেদিন মেয়েটাকে দেখে, ওর ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে, আমি আর নিজেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না।" রনি দুহাতে মুখ ঢেকেছে।
- "এরকম ভেঙে পড়লে হবে? তুই এখনও সেই বাচ্চা আছিস? মা আর পিউ তোকে বড় হতে দিল না। এ্যাই ভাই, হাত ছাড়, দেখি আমি।" বনি ভাইয়ের হাত ধর টানাটানি করছে, পিউ ওর মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বলে, "আমার উপর রাগ করে থেকো না প্লিজ। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। আমারও তো মনটা খারাপ হয়ে ছিল, তোমার দিকে নজর দিতে পারিনি। নাহলে আমার ভাইটাকে আমি বাদ দিতে পারি?"
- "আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তোমরা মিলির জন্য ভাবছ। আর আমি সেটাও পারছি না, নিজের অপরাধের বোঝার তলায় চাপা পড়ে আছি।"
- "এভাবে কেন ভাবছিস? সব দোষ তোর একার নয়। বরং বলা যায় এটার শুরু করেছে লিলি, তারপর আমরা সবাই কিছু কিছু ভুল করেছি। আমাদের উচিত ছিল, লিলি এতবড় কথা লুকোনোর পর মিলির সঙ্গে নিজেরা কথা বলা। আমরা দুজন, বা তোকেও সঙ্গে নিয়ে ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তবেই বিয়েতে হ্যাঁ বলা উচিত ছিল। তাই সব দোষ এখন একা তোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেই হবে না। আমি হতে দেব না।" বনি সেই বাবা চলে যাওয়ার দিনটার মতোই দুহাতে আগলে রেখেছে ভাইকে, শুধু মাঝখানে পঁচিশটা বছর কেটে গেছে।
- "ঠিকই বলেছ তুমি। আমরা একটা কাজও গুছিয়ে ধীরে সুস্থে করিনি। তখন যেন কেমন উদভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে দেখলাম, সব হয়ে গেল। ভাগ্যে লেখা ছিল বোধহয়।" ম্লান মুখে বলে পিউ।
- "তোমার মতো মেয়ে, এত লেখাপড়া শিখে ভাগ্যের দোহাই দিচ্ছ?" রনি মাথা নাড়ছে, মুখে একচিলতে হাসি ফুটেছে। সেটা দেখে সাহস করে পিউ ওর কাঁধ ধরে নিজের দিকে ঘোরায়, "ভাগ্য ছাড়া আর কি? যাকগে আর মনখারাপ কোরো না। বরং বলো, মিলিকে কি কি দেব, সব তো দেখলে।"
- "সে তোমার আর মার ব্যাপার, যা ইচ্ছে দাও। আমার একটা অন্য কথা ছিল, বলতেই পারছি না, কেউ শুনছে না।"
- "সবাই শুনব। তুমি বলোতো !"
চলবে