Read Jharapata - 19 by Srabanti Ghosh in Bengali Love Stories | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

ঝরাপাতা - 19

ঝরাপাতা

পর্ব - ১৯

🌹🌿🌹🌿🌹🌿🌹

দুর্গাপুজো এসে পড়েছে। মিলিও যেহেতু সুস্থতার পথে, প্রথমে রাজি না হলেও, রনি মিলির চিকিৎসার খরচ খরচার দায়িত্ব নেওয়ায় সমররা সবাই অনেকটা চিন্তামুক্ত এখন। রনির বারণে ওর মামাদের টাকার কথাটা না জানানো হলেও, সমর আর গোপা বরং ওদের ভাইবোনদের জানিয়েছে। তারাও যে ওদের পরিবারকে নিয়ে চিন্তায় আছে ! এই খবর শুনে যদি একটু নিশ্চিন্ত হয় ! 

দুর্গাষষ্ঠীর দিন গোপা আর দীপা উপোস করে পুজো দেয়। ঠাকুরমশাইকে লিলির নাম বলতে গিয়ে গোপা আটকে গেলেও দীপা তো বোঝে মায়ের মন। গোপার পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করে ও বলে, "অদ্রিকা সিং রাঠোর।" মিলিকে নিয়ে অঙ্কুরসহ বন্ধুবান্ধবরা আশেপাশের ঠাকুর দেখতে গেছে, নিশ্চিন্তে মিলির নাম বলে, অদ্রিজা সরকার। 

ষষ্ঠী সপ্তমীতে সন্ধ্যায় সমর আর অমর পরিবারের সবাইকে নিয়ে আরও কিছু ঠাকুর দেখেছে, ছবি তুলেছে, বাইরে থেকে খাবার এনেও খেয়েছে। মিলিকে খুশি দেখে নিজেদেরও ভালো লাগছে। যেন মায়ের আগমনে সব অশুভ কাটছে। 

ষষ্ঠীপুজো দিতে যাওয়ার সময় পিউর দেখা হয়েছিল মিলির সঙ্গে, বন্ধুরা দল বেঁধে বেরোচ্ছে। আজ অষ্টমীর অঞ্জলির লাইনে মিলিকে দেখে মণিকার বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে। গোপাই বোধহয় নিজের একটা লালপাড় গরদ পরিয়ে এনেছে, সদ্য স্নান করা ভিজে চুল ক্যাচারে আটকানো। বন্ধুদের দলের সঙ্গে লেপটে আছে। একেকবার ক্যাচার খুলে চুল ঝেড়ে আবার আটকাচ্ছে। একহাতে একটা কারুকাজ করা লাল - কালো মোটাসোটা চুড়ি, বাঁ হাতে ঘড়ি। কানে ম্যাচিং লাল - কালো ঝুমকা। ছোট্ট সোয়েটের টিপ, লিপস্টিক, পারফিউমে গুছিয়ে সাজগোজ করেছে। মণিকার পাশেই, লাল পাড় তসর, টুকটাক সোনার গয়না পরে পিউ। ওর সঙ্গে ম্যাচিং লাল ডিজাইনার পাঞ্জাবি পরে বনি। বনির সঙ্গে কি একটা বলতে বলতে যে নীল পাঞ্জাবি পরা রনি একবার মিলির দিকে তাকালো, সেটাও মণিকা খেয়াল করে। 

পুরনো দিনের মানুষ মণিকা রনির সামনে, মা দুর্গার সামনে, মিলির সাদা সিঁথিটা সহ্য করতে পারছিল না, একমনে শুধু মায়ের মূর্তির দিকে তাকিয়ে রইল। অঞ্জলির মন্ত্রে বলতে থাকল, "মা মাগো, তুমি তো অন্ততঃ মায়ের মন বোঝো। শুধু আমার না, গোপারও নিশ্চয়ই এতেই শান্তি হবে। আমার পাপে ওদের আর শাস্তি দিও না। আমার রনি আর মিলিকে সুখী করো, ওদের মিলিয়ে দাও। আর কখনো যেন আলাদা না হয়। দুই ছেলে, দুই বৌয়ের সুখী জীবন দেখতে দাও মা। মিলিকে আর কোনো আঘাত দিও না। সুস্থ হয়ে উঠছে মেয়েটা, আবার হাসছে, ওর মুখের হাসিটুকু এমনি থাক।"

চরণামৃত নিয়ে লাইন থেকে বেরিয়ে পিউ বলে, "মা দুর্গা ঠিকই আমাদের কথা শুনবে, বলো মা?"

- "তুই কি বললি মাকে?"

- "ঐ যা তুমি কেঁদে কেঁদে বলছিলে। মাকে বললাম, সামনের বছর যেন ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়েই মিলি অঞ্জলি দেয়।" পিউয়ের মুখে এই কথা শুনেই মণিকা আবার হাত জোড় করে কপালে ঠেকায়।

রনির বন্ধুরা, যারা বিবাহিত, বৌকে নিয়ে, ব্যাচেলররা একলা, সকলে মিলে গোটা কলকাতার ঠাকুর দেখে বেড়াচ্ছে। রনিকেও ডাকছে। রনি বারবার এড়িয়ে গেছে এ দুদিন, বাড়ির সবাই বেরোবে বলে। ষষ্ঠীতে পিউ, মণিকা, শোভনা সবাই উপোস করেছে বলে টুকাইকে কাছাকাছি কয়েকটা ঠাকুর দেখিয়ে এনেছে বনি আর পিউ। ওরা ভেবেছিল রনি প্রত্যেক বছরের মতো বন্ধুদের সঙ্গে যাবে। বাড়ি ফিরে শুনল, রনি সারা সন্ধ্যা ওর ঘরের ব্যালকনিতে সি *গা *রে *ট খেয়েছে। অবশ্য ব্যালকনির নিচেই রাস্তা, এখন সারাদিন লোকজনের ঢল সেখানে। তবুও সহজ হতে পারছে না বোঝা যায়। তাই সপ্তমীতে বাড়ির সবাই ঠাকুর দেখার প্ল্যান করে ওকে ধরে নিয়ে গেছিল। 

আজ অষ্টমীতে বনির বন্ধুদের দলে না বেরোলেও খারাপ লাগে। আর রনির এভাবে বন্ধুদের এড়িয়ে চলাও তো ঠিক নয়। বনি ফোন করে রনির বন্ধুদের। ওরা বাড়িতে এসে হত্যে দিয়ে পড়ে জোর জবরদস্তি রনিকে বের করে। দাদা টিপে দিয়েছে জানে না বলে, বন্ধুরা বিয়ে বা মিলির নাম করছে না দেখে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয় রনি। সারারাত ঠাকুর দেখে, নবমীরও সারারাতের প্ল্যানে এককথায় রাজি হয়ে বাড়ি ফেরে। বনি যখন ঘুম থেকে ওঠে, ও নাকি ঘন্টাখানেক আগে ঘুমোতে গেছে। 

নবমীর দুপুরে সবাইকে রেস্টুরেন্টে খাওয়ায় বনি। ফিরে এসে দুই ভাই নিজের বন্ধুদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে পড়ে। বনিরা আজও বেশি দেরি করবে না, দলের সবার ছোট বাচ্চা আছে। মণিকা, শোভনা আর পিউর বাবা পীযূষবাবুও গতকালের মতো টোটো ভাড়া করে কিছুটা ঘোরাঘুরি করে ফিরে পাড়ার প্যান্ডেলে খানিকক্ষণ বসে। রাত গড়ালে বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই ফুরিয়ে গেল আরও একটা পুজো। 

🌹🌿🌹🌿🌹🌿🌹

দশমীর বরণ দীপা নিজেদের পাড়ার পুজোতেই করে। গোপা আর মিলিকে সঙ্গে করে পিউ এসেছে ওদের প্যান্ডেলে। মোটামুটি সবাই, কুমারী মেয়েরাও আজ লাল পাড় সাদা তাঁতের শাড়িতে। ঠাকুর বরণ, এ ওকে সিঁদুর মাখানো, প্রায় যেন হোলিখেলা চলছে। তবে সেই হোলির একটাই রঙ, লাল। পরপর সবাই সিঁদুর মাখানোর ফাঁকে পিউ মিলির দু গালে সিঁদুর মাখিয়ে সিঁথিতেও টেনে দিয়েছে। মিলি ঠিক ব্যাপারটা বোঝেনি। 

গোপার হঠাৎ বুক কেঁপে ওঠে। মামার বাড়িতে যখন যায়, মিলি শাঁখা সিঁদুর পরা নতুন কনেবৌ। চিকিৎসার শুরুতে ডঃ গিরি বললেন, বিবাহ চিহ্নগুলো সরিয়ে দিতে। মিলি তখন নিজের মধ্যে নেই। প্রায়ই স্নান পর্যন্ত করে না, সিঁদুর পরা অনেক দূর। হাতের শাঁখা চুড়ি খুলে নেওয়া হল। সেদিন মেয়ের প্রাণটাই বড় হয়ে উঠেছিল সব ছাপিয়ে। আজ হঠাৎ ভয় করে উঠল, কেন পিউ ওকে আবার সিঁদুর পরালো? পিউর নাকি ইচ্ছে ছিল দু বাড়িতে আত্মীয়তা হয়। তার ফল মিলি একভাবে ভুগছে। লিলিকেও হয়তো এ জীবনে গোপা দেখতে পাবে না। মিলি সুস্থ না হলে, সুস্থ হওয়ার পরও ঘটনা কোনদিকে যাবে জানা নেই। তাই লিলি যদি ওর সংসারে সুখেও থাকে, ওর বিয়ে মেনে নেবে না কেউ। আজ মা দুর্গার সামনে গোপা দাঁড়িয়ে আছে, দু মেয়ের কার কি ভবিষ্যৎ, সে জানে না। মায়ের পায়ে ছোঁয়ানো সিঁদুর পিউর হাতে আবার উঠেছে মিলির সিঁথিতে। এ কি আবার নতুন সর্বনাশ বয়ে আনবে? নাকি এটাই ইঙ্গিত মা দুর্গার আশীর্বাদে নতুন শুরুর? 

গোপার সারা শরীর কাঁপছে। পিউ বোধহয় কিছুটা বুঝেছে। এগিয়ে এসে গোপার হাতের বরণের থালা মিলিকে ধরিয়ে দিয়ে গোপাকে একপাশে সরিয়ে আনে, "কাকিমা, তুমি আর আমি তো সত্যিটা জানি। আজকের দিনে ওকে সিঁদুর না পরিয়ে পারি? এরপর যা হবে সবই মায়ের ইচ্ছে। যা ঠিক, যা উচিত, তিনি তাই করিয়ে নেবেন। আমরা চাইলেও অন্যকিছু হবে না।"

- "ঠিক ভুল, কিছুই যে বুঝতে পারছি না পিউ। আমার মিলির যদি সব মনে পড়ে, নতুন করে শক লাগবে না তো? আবার ওরকম হয়ে যাবে না তো? আর সামলে উঠলেও যদি, মানে ঐ আরকি..."

- "জানি, ভাইয়ের উপর রাগটা তো মনে পড়বেই।" ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে পিউ যেন নিজেকেই বলে, "তখন ডঃ গিরিই একমাত্র মানুষ, যার মত আমরা সবাই মানব। চলো কাকিমা, আমরা প্রার্থনা করি, মা দুর্গার যা ইচ্ছে, ডঃ গিরির মুখে সেটাই আমাদের জানান।"

দুজনের কেউ খেয়াল করেনি, দূরে, যেখানে ছেলের দল জটলা করছে, ভাসানে যাবে বলে, তাদের মধ্যে থেকে দুজন অপলকে তাকিয়ে আছে লাল পাড় শাড়ি পরা, বরণের থালা হাতে, মিলির সিঁদুরে টুকটুকে মুখের দিকে। আশেপাশের মেয়ে, বৌদের সঙ্গে মিলি কথা বলছে, সারা মুখের লালিমায়, ঠোঁটে চোখে খেলা করছে হাসির উজ্জ্বলতা, আর এই দুজনের বুকের ভিতরটা পর্যন্ত পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। 

পিউ গোপাকে তাড়া দিয়ে বলে, "এবার চলো কাকিমা। টুকাই বাড়িতে রয়েছে। আমি না গেলে ওর বাবাকে ছাড়বে না। বনি তো ভাসানে যাবে।"

বাড়ি ফিরেও পিউয়ের কথাগুলোই গোপার মাথায় ঘুরছিল। এক ফাঁকে সমরের সঙ্গে কথা বলে তিনজন যায় মণিকার সঙ্গে বিজয়ার দেখা করতে। দেখাই যাক, মা দুর্গার কি ইচ্ছে ! মিলির সব মনে পড়লে পড়ুক। যা হবে, তার সামনে দাঁড়াতে হলে দাঁড়াবে। 

ওরা যে কি খুশি হয় এতে। সবাই সেই পুরনো দিনের মতো আড্ডায় মেতে ওঠে। বিশেষ করে, ছেলেরা ঠাকুর ভাসানের পর ক্লাবে। নাচগান, পানীয়তে হুল্লোড় চলছে সেখানে। ফলে রনির অনুপস্থিতিতে সহজ হতে বাধাও নেই।  


চলবে