ঝরাপাতা
পর্ব - ২০
❤💟❤💟❤💟❤
দুর্গাপুজো শেষ, তবে বনির কলেজ খুলতে দেরি আছে, রনির ইউনিভার্সিটিও। এই সময়টায় ওরা কোথাও বেড়াতে যায় সাধারণত। দুই ছেলে, মণিকাও পাড়ার পুজোয় থাকতে ভালবাসে, আলোয় আলো কলকাতার পথে পথে ঘুরে কতরকম কারুকাজের প্যান্ডেল আর মূর্তি দেখে বেড়াতে ভালবাসে। তাই পুজোর কদিন বাড়িতেই থাকে। এবার গোটা ছুটিটাই বাড়িতে। যদিও এই বছরটাই বরং খুব দরকার ছিল কিছুদিন বাইরে ঘুরেফিরে মন আর মগজের ছট ছাড়ানোর, মিলিদের সামনে দিয়ে বেড়াতে যাওয়ার পরিস্থিতি হবে কিনা বুঝতে পারছিল না। আর কে না জানে, টিকিট ওপেন হওয়ামাত্র শেষ হয়ে যায় এই ছুটির সময়ে ! তাই সময় থাকতে বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করতে না পারায় কোথাও যাওয়া হয়নি ওদের।
একাদশীর সকালে বেশ দেরিতে ঘুম থেকে উঠে চা নিয়ে বসে পিউ বলল, "আমাদের এবার কিছু একটা ভাবতে হবে। কাল যা হল... "
বনি থামিয়ে দিয়ে বলে, "কাল কিছুই হয়নি। ভাই একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। নে *শাটা অতিরিক্ত হয়ে গেছে সেটা মানছি। আমি তো ছিলাম রে বাবা। এই নিয়ে তুমি আর শুরু কোর না।"
- "দেখো তুমি কিন্তু ভুল করছ। আমি এসব পছন্দ করি না ঠিক। এখন সেসব নিয়ে বলছি না। ওর ঐ অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কথাই বলছি। কি হচ্ছে এগুলো? হয় ঘরে বসে থাকছে, নাহলে এত নে *শা করল দুজন ধরে আনতে হল ! পাড়ায় ওকে নিয়ে কথাবার্তা শুরু হবে এবার। দেখে নিও।"
- "শুধু কথা না, ছেলেটা এরকম কেন করছে সেটাও তো নজর রাখতে হবে।" মণিকা আজকাল অল্পেই ভয় পায়। মিলির মতো কিছু না রনির সঙ্গে হয় !
- "শোনো এবার ! মামনিও কি না ভেবেই বলছে !" পিউ বনিকে আবার খোঁচায়।
- "আরে না, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ওর খেয়াল ছিল না। এই তো একটা দিন, দশমী, সবাই থাকে, বোঝো তো। অনেকেরই একই অবস্থা ছিল। ওকে নিয়ে আলাদা করে কথা হবে না। আর দেখো না দুদিন। আজই ছেলেটাকে খুঁচিও না। আজ ঘুম থেকে উঠলে নিজেই লজ্জা পেয়ে যাবে। আর পিউ, খবরদার তুমি ওকে বকাঝকা দেবে না। কিছু বলতে হলে মা বলবে। আবার অভিমান করে...."
- "রাখো তো অভিমান ! আরেকদিন করলে না !" পিউ সত্যিই রেগে গেছে। গতকাল মিলিরা যতক্ষণ ছিল, পিউ খুব আশা করেছে, যদি এরা দু ভাই না হোক, অন্ততঃ রনি বাড়ি চলে আসে ! দিনরাত ওর মনে নানান রোমান্টিক স্বপ্ন খেলে বেড়ায় রনি আর মিলিকে নিয়ে। কতরকম কল্পনা করে, মিলিকে যদি রাস্তায় গু *ন্ডা ধরে আর ভাই এসে — থাক বাবা, ভাই যদি ওকে সেভ করতে না পারে ! আবার ভাবে, যদি ভাইয়ের জ্বর হয়, মিলি ওকে দেখতে আসে — নাঃ অসুখ টসুখ হয়ে কাজ নেই। মোট কথা কোনো রাস্তা বের করতে পারেনি, যাতে স্বাভাবিক ভাবে দুজনের একটা প্রেম করাতে পারে। অথচ এই চিন্তাতেই ওর দিন কেটে যাচ্ছে।
গতকাল হঠাৎ সুযোগ বয়ে এল বাড়িতে। দুজনের বেশ বিজয়ার আবহে দেখা হয়ে যেত। মিলি মুখচোখ ধুয়ে এলেও, মুখখানা লালচে, সিঁথিতে সিঁদুর রয়েছে। এই রূপে রনি একবার ওকে দেখুক, মিলি প্রণাম করলে নিশ্চয়ই দুটো একটা কথাও হবে। পিউর মনটা নেচে উঠল। তাই বারবার ওরা বাড়ি যাওয়ার কথা বললেও ও আটকেছে। কোথায় কি? রাত দশটায় আর আটকে রাখা যায় না।
ওরা চলে যাওয়ার পরও পাত্তা নেই দু ভাইয়ের। আটটা নাগাদ ঠাকুর ভাসান দিয়ে দলবল ফিরে এসেছে, মাইকে এ্যানাউন্সমেন্ট শুনেছে। আচ্ছা আধঘণ্টা, একঘন্টা বছরে একদিন ছেলেরা নিয়মের সি *দ্ধির শরবত দিয়ে শুরু করে আরও খানিক এগিয়ে যায়, বকাঝকাও খায় পরদিন। এসব প্রতি বছরের কাহিনী। সে দলে ওর বাড়ির দুটোও থাকে, তবে মাপের মধ্যে। কিন্তু এতক্ষণ কি হচ্ছে এবার? যখন রনি আর মিলির কথাবার্তার একটা এত ভালো সুযোগ এল, তখনই বাড়ির কথা একজনেরও মনে পড়ছে না? বনিকে ফোন করে ও। পরে কথা বলছি বলে কটাং করে ফোন কেটে দিল বনি।
শেষে রাত একটায় তুলনামূলক সুস্থ পাড়ার আর দুটো ছেলেকে নিয়ে বনি ভাইকে বাড়িতে আনল। মণিকা উঠে ঘরে চলে গেছিল। রাগ মণিকারও হয়েছিল তখন, তবে এত বড় ছেলেদের সেই মুহূর্তে বকাবকি করে কোনও লাভ নেই। তাছাড়া রনির খুব একটা হুঁশ আছে এমনও নয়, যে বকুনি দিলে কানে ঢুকবে। বনিই ভাইকে ঘরে নিয়ে গেল, ওর জামাটাও ছাড়াতে পারেনি।
নিজের ঘরে যেতে পিউ তখনই একচোট অশান্তি করেছে। বনি বুঝিয়েছে, রনিকে সামলাতে হচ্ছিল। ওরা দু চারজন যারা হুঁশে ছিল, তাদের বাকিদের সামলাতে হয়েছে, তাই ফোন করতে পারেনি। পিউ ওকেও এক দাবড়ানি দেয়, "নিজের হাল কি এমন ভালো, সে আবার অন্যদের সামলাচ্ছিল ! সামনের বছর দোল আর পুজোর মিটিং হোক, আমি সব বৌদের নিয়ে বলব, দোলের দিন বেলা বারোটার পর আর দুর্গাপুজোর ঠাকুর ভাসান দিতে নিয়ে গেলে আমরা মেয়েরা ক্লাবঘরে তালা দিয়ে দেব। কি শুরু করেছ কি পাড়ার মধ্যে? আমি বুঝেছি, তোমরা দু ভাই হচ্ছ আসল পালের গোদা। দুজনে আবার কলেজে পড়ায়, ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া উচিত। শঙ্কু এম এস সি পড়ে না? ও তো ছিল ওখানে। ভাই কি ওর সঙ্গে একসঙ্গে গ্লাস নিয়ে বসেছিল?"
বনি তাড়াতাড়ি জড়িয়ে ধরে ওর মুখে হাত চাপা দেয়, "আরে চেঁচিও না, মা শুনবে। শঙ্কু অনেক আগে চলে গেছিল। আর এত বাড়াবাড়ি তো কখনো করেনি ভাই।"
- "সরো তো।" এক ধাক্কায় বনিকে সরিয়ে আবার গজগজ করে পিউ, এবার গলা নামিয়ে, "তোমার মা তো অন্ধ, আমি বললে তবেই শুনবে ! তাই গজগজ করতে করতে ঘরে চলে গেল ! তোমাদের লজ্জা নেই, মামনির তো আছে।" বনি নিঃশব্দে শুয়ে পড়ে। পিউকে বোঝাতে গেলে, কি আদর টাদর করে ভোলাতে গেলে আরও খেপে যাবে। আর যদি ছেলের ঘুম ভাঙে পিউয়ের বকবকানিতে, বনির কপালেই আরও দুঃখ আছে। পিউও ছেলের ঘুমের কথা ভেবেই বনিকে স্পেয়ার করে।
রাতের অসমাপ্ত ঝাড় এখন শুরু হতেই তাই বনি কাঁটা হয়ে আছে। মায়ের সামনে ওকেও ধুয়ে দেবে পিউ।
❤💜❤💜❤💜❤
ওদিকে রনির ঘোর তখনও কাটার কোনো চান্সই নেই। বরং সে স্বপ্নে দেখছে সিঁদুর মাখা একটা হাসিমুখ ওকে কি যেন বলছে, রনি কিছু শুনতে পাচ্ছে না। যত এগিয়ে যাচ্ছে, মুখটা পিছিয়ে যাচ্ছে। শেষে এত দূরে চলে গেছে, আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে, তখনই হঠাৎ রনি বুঝতে পারল এটা তো মিলি ! চমকে লাফিয়ে উঠল রনি, উঠে বসেই দু হাতে নিজের মাথা চেপে ধরল, ঘর দেওয়াল সব পাক খেয়ে গেল। তারই মধ্যে আবার মনে পড়ল, মিলির কথা। ও কি স্বপ্নে মিলিকে দেখছিল, নাকি সত্যিই গতকাল মিলি দাঁড়িয়ে ছিল দুর্গা ঠাকুরের সামনে?
মাথা ঝাঁকিয়ে মনে করার চেষ্টা করে রনি। জগদ্দলের মতো ভারী মাথাটা, এইটুকু বুঝতে পারে, মিলির মুখটা চিনতে পেরে এত চমকে না উঠলে ওর ঘুম ভাঙত না। এখনও হ্যাং ওভার কাটার সময় আসেনি। আবার চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে, ভাবতে চেষ্টা করে এর আগের কথা। মিলিকে যদি স্বপ্নেই দেখেও থাকে এখন, গতকাল সত্যিকারের মিলিকেও দেখেছে। সেখানে কাকিমা ছিল, বৌদি ছিল, মা ছিল। মা ছিল কি? আবার সব গুলিয়ে যায়। কিন্তু মিলিকে স্পষ্ট মনে পড়ে, একটা লাল পাড় সাদা শাড়ি পরেছিল, মুখে কপালে শাড়িতেও এখানে ওখানে সিঁদুর মাখা মিলিকে দেখতে পেয়েছিল বৌদি আর কাকিমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল বলেই।
নিজে তো জানে তখনও পর্যন্ত ও কোনো নে *শা করেনি। মিলিকে দেখামাত্র তাই ডঃ গিরির চেম্বারের কিশোরীর মতো ভীরু, লজ্জিত, সংকুচিত, অসহায় মিলি নয়, বিয়ের সময় দেখা শাড়িতে, গয়নায়, সুসজ্জিত সদ্যযৌবনা মিলিকে মনে পড়েছিল। ওর নিজের অপটু হাতে সিঁদুর পরানো মিলির মুখটা মনে পড়েছিল। বিয়ের দিন ঐ সিঁদুর পরা মিলিকে দেখেই ওর মন দুলে উঠেছিল। সকাল থেকে যত দুর্যোগ গেছে, সব ভুলে গেছিল একটা মুহূর্তে। মনে হয়েছিল, বিয়ের এই অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ও একজন সঙ্গী পেল। লিলি ওকে যে অপমান, অসম্মানের মধ্যে ফেলেছে, সেটা এই মানুষটা ঢেকে দিতে পারবে।
নিজের হাতের উপর মাথা রেখে কাত হয়ে শোয় রনি। আজ এতগুলো মাস পরে আবার শুয়ে শুয়ে ভাবছে সেই মুহূর্তটা, ভালো লাগছে ভাবতে, সেদিন বড্ড আপন মনে হয়েছিল মিলিকে। মনে হয়েছিল, মিলির চোখেও সেই বন্ধুত্বের ঝিলিক। বিয়ের মন্ত্র, নিয়মকানুন, সব দিয়ে যেন সারাজীবনের বন্ধু হয়ে গেছে দুজন।
ওর বন্ধুরা রিসেপশনের রাতে গল্পে গল্পে বলল, সেই মিলি আসলে ওর কেউ নয়, সব ওর ভুল ধারণা। মিলির মন আসলে বাঁধা পড়ে আছে অন্য কোথাও, অন্য কারও কাছে। সেই মুহূর্তে ওর শরীরের কোষে কোষে এক অচেনা বিস্ফোরণ ঘটে গেছিল। মিলি ওর হয়েও ওর নয়, এটা সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না। এই আড়াই দিন ধরে নানা রূপে, নানা সাজে, নানা ভাবে মিলিকে দেখেছে। যেন যুগ যুগান্তর ধরে এভাবেই মিলিকে দেখে যাচ্ছে, এভাবেই দেখার জন্য গোটা জীবন পড়ে থাকবে।
সেই মুহূর্তে রনি বুঝেছিল, আর এখানে নয়, আরও যতক্ষণ ও মিলির কাছে থাকবে, আশেপাশে থাকবে, তত জড়িয়ে পড়বে মিলির সঙ্গে। যে ওর হবেই না, তার ছায়ারও আওতার বাইরে পালাতে হবে। যা হয় হোক, মিলি যা খুশি করুক, ওর আড়ালে করুক। রনি যথার্থ পালিয়ে গিয়েছিল সেদিন। মিলির সিঁদুর পরা মুখটার থেকে, গাঢ় কাজল পরা টানা টানা চোখদুটোর থেকে যত দূরে পারে পালিয়ে গিয়েছিল।
চলবে