Read Jharapata - 22 by Srabanti Ghosh in Bengali Love Stories | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

ঝরাপাতা - 22

ঝরাপাতা

পর্ব - ২২

🧡💛🧡💛🧡💛🧡

- "কথা তো একটাই লিলি। আর সেটা আমি না, তোমার বলার কথা। তুমি বিয়েতে রাজি ছিলে না, সেটা একবারও বললে না কেন? আমার ফ্যামিলির লোকেদের এত বড় অপমান, ক্ষতির মুখে ঠেলে দিলে কেন? আমরা তোমাকে বিয়ে করতে হবে জোর করিনি, অন্য কোনো ক্ষতিও করিনি কখনো তোমাদের কারও। এখন এত বড়বড় কথা বলছ, তখন কেন চুপ ছিলে?"

লিলি চুপ করে আছে। তার মধ্যে যুগল ঝাঁঝিয়ে ওঠে, "ও আপনাকে বিয়ে করেনি, তারপর আপনার লজ্জা করছে না? আবার জানতে চান, কেন বিয়ে করেনি? আমার ওয়াইফকে চোখ গরম দেখাবেন না।"

- "লিলি, তুমি কি চাও আমি কেস করি? নাহলে একে থামতে বলো। আমাকে আর একবার একটা খারাপ কথা বললে আমিই আর তোমাদের সঙ্গে কোনো কথা বলব না। যা বলার আমার উকিল বলবে।"

- "না রনিদা, শোনো, শুধু শুধু ঝামেলা করে কি করবে তুমি? তোমার সঙ্গে তো মিলির বিয়ে হয়েছে। তারপর তুমিই ওকে ছেড়ে দিয়েছ। মিলি অসুস্থ হয়ে গেছিল। এখন বলছ আমাদের নামে কেস করবে। এইসব কেন করছ?" লিলি তাড়াতাড়ি ক্ষিপ্ত রনিকে বোঝাতে যায়। 

- "অনেক খবর রাখ তো আমার !" চোখ সরু করে লিলিকে দেখছে রনি, "তখন থেকে যে এত তড়পাচ্ছেন এই ভদ্রলোক, উনি জানেন, তুমি আমার এত খবর রাখ?"

- "এ্যাই, শুনুন, অনেক হয়েছে। আর একটা বাজে কথা বললে না.... " এবার সত্যিই তড়পে ওঠে যুগল। ও বুঝতে পারছে না, রনি ইচ্ছাকৃত ওসকাচ্ছে ওকে। 

- "আপনি ভুলে যাচ্ছেন, পাড়াটা আমার, আইনের হাত আমার মাথায়। বড়জোর আমার গায়ে হাত দিতে পারবেন। আর সেটাও আপনার বিরুদ্ধে যাবে।" যুগল আর লিলিকে কোণঠাসা করতে করতে রনির ভিতরের এতদিনের অস্থিরতাটা ক্রমশঃ শান্ত হয়ে যাচ্ছে। 

আশেপাশের লোক দেখছে, সেসব ভুলে গিয়ে লিলি কেঁদে ফেলল, "তুমি কি চাও? আমাদের সংসারটা ভেঙে দিতে চাও?"

- "যদি চাই, খুব অন্যায় চাওয়া লিলি? তুমি আমার কি কি ক্ষতি করেছ মনে নেই? তবে আমি তোমার সমান না। তোমরা বুঝতে পারছ না, তুমি কেন আমাকে বিয়ে করলে না, আমি জানতে চাই না। তুমি চুপ করে থাকলে কেন, আমাদের অপমান করলে কেন, আমি সেটা জানতে চাই।"

- "সেসব অনেক কথা রনিদা। তুমি শুনে কি করবে? এখানে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে আর কত অপমান করবে আমাদের? আমাদের যেতে দাও তুমি।"

- "কথাগুলো আমি জানবই। এখানে বলতে না পারলে, যেখানে বলতে পারবে মনে হচ্ছে, সেখানে চলো। নাহলে তোমাদের অফিসের ঠিকানায় উকিলের চিঠি পাঠাচ্ছি আমি।"

🧡💛🧡💛🧡💛🧡

লিলি আর যুগলের বাড়িতে চুপ করে বসে আছে রনি। বাড়ি মানে, একটা বড় বাড়িতে এক কামরার ভাড়া। দুবার বনি ফোন করেছে। রনি দুবারই বলেছে, ওর কাজ শেষ হয়নি, পরে আসবে।

এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট রনির সামনে রেখে লিলি বলল, "আমি রান্না বসাচ্ছি। তুমি খেয়ে যাবে।"

- "উঁহু, আমার সময় হবে না। তবে যেদিন তোমাদের সব সমস্যা মিটবে, আমি এসে খেয়ে যাব।"

- "কবে যে সব মিটবে, জানি না।" ম্লান মুখে যুগল বলল। 

লিলি সেটা দেখে বলল, "সত্যিই তাই। তোমাকে তো বললাম, ওর বাড়িতে কোনোদিন আমাকে মেনে নেবে না। ওরা মাড়ওয়ারের আদি বাসিন্দা। ওদের ফ্যামিলি আছে এখনও ওখানে। বিয়ে শাদীতে তাদের সঙ্গে যাওয়া আসা আছে। তাদের কাছে হেঁট হয়ে মচ্ছিখোর বাঙালি মেয়েকে বৌ করবে না ওদের বাড়ি। তাহলে ওর বাবা মার সঙ্গে আর ওদের বাকি ফ্যামিলি যোগাযোগ রাখবে না। ফ্যামিলি বিজনেস ভাগ করা যাবে না। করতে দেবে না ওর জ্যাঠা কাকারা। ফলে এসব নিয়ে শুধু শুধু একটা বিরাট ডামাডোল হবে মাঝখান থেকে। তাই কেউ এই সম্পর্ক মানবে না।"

- "এগুলো তো আমাকে বলতে পারতে তখন।" রনি আক্ষেপে মাথা নাড়ে। 

- "ও বলতে চেয়েছিল। ওর বাড়িতে বলতে চেয়েছিল। আমিই বারণ করেছি।" যুগলের গলায় এখন আর ঝগড়ার সুর নেই। 

লিলিই প্রস্তাব দিয়েছিল, ওদের বাড়ি কাছেই। অফিসে কোনো হাঙ্গামা না করে রনি ওদের বাড়িতে আসুক। যুগলের প্রবল আপত্তি উড়িয়ে দিয়ে ও রনিকে নিয়ে আসে। বাড়িতে এসে বসে ঠান্ডা মাথায় বলে, এখন বিয়ে করার কোনো প্ল্যান ছিল না ওদের। কারণ যুগলের বাড়ি ওকে মানবে না। এদিকে ওরা দুজনেই সামান্য চাকরি করে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে দুজনেই এম বি এ পড়ছে। পাশ করে, ভালো চাকরি পেয়ে, নিজেদের দায়িত্ব নেওয়ার মতো হয়ে ওরা বিয়ে করত। আর তিনটে বছর পেলেই সব সেট হয়ে যেত। 

এদিকে লিলি নিজের বাড়িতেও সব কথা বলতে পারেনি, কারণ রনিকে অপছন্দ বলার পরও ওর বাবা মায়ের প্রথম পছন্দ রনি। ওরা ক্রমাগত বুঝিয়ে যাচ্ছিল, রনিকে বিয়ে করলে কি কি ভালো হবে লিলির। 

তাই ওরা ভয় পেয়েছিল, যুগলের কথা বললে উলটো ফল হবে। অন্য ভাষা সংস্কৃতির ছেলেকে মানতে তো পারবেই না। বরং লিলির সঙ্গে যুগলের যোগাযোগ বন্ধ করতে চাকরি ছাড়িয়ে দিতে পারে, ফোন নিয়ে নিতে পারে। যেমন শোনা যায়, সিনেমায় দেখায়। তখন কি করবে ও? 

আর এসব ঝঞ্ঝাটে একবার যুগলের বাড়িতে খবর চলে গেলে, ওকে সোজা রাজস্থানের বাড়িতে পাঠিয়ে দিত। চিরকালের মতো আলাদা হয়ে যেত ওরা। তাই দুজনে পরামর্শ আঁটে, নিঃশব্দে বন্ধুদের সাক্ষী করে বিয়ে করে ফেলে। এই বাড়ি ভাড়া নেয়। এমনকি আগে থাকতে এখানে আসেনি, যদি খবর পেয়ে গিয়ে যেকোনো একজনেরও বাড়ির লোক এসে যায় ! যতই রেজিস্ট্রি বিয়ে হয়ে যাক, লিলিকে ধরে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়ে দিতে হাঙ্গামা বাধাতে পারে। 

রনি শুনে আপশোষে সারা হয়েছে, ওদের ধমকেই বলেছে, "আমাকে লুকিয়ে বলতে পারনি? আমিই বলে দিতাম, তোমাকে বিয়ে করব না। তোমাদের বিয়েতে হেল্প করতে পারতাম। তোমরা এখন বিয়ে না করলেও, কথাটা লুকিয়ে তোমাদের পাশে থাকতাম।"

দুজনেই স্বীকার করেছে, ওদের সম্পর্কের এতজন বিরোধী আছে যে রনির উপর ভরসা করার কথা ভাবতেই পারেনি। তবে আজ সব কথা বলতে বলতে তিনজনের একটা বন্ধুত্বের সূচনা হয়। লিলি বলে, পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ আছে ওর। তাদের কাছে শুনেছে, ঐ লগ্নে মিলির বিয়ে হয়েছে। তারপর মিলির অসুখের খবরও শুনেছে। সেজন্য ইচ্ছে করলেও বাড়ি যাওয়ার সাহস পায়নি এতদিন। এবার পুজোয় মিলিকে ঘুরতে বেড়াতে দেখে তারাই খবর দিয়েছে, সব ঠিক হয়ে গেছে। তাই বিজয়ার প্রণাম করতে গেছিল দুজন। কিন্তু চিঁড়ে ভেজেনি। মা বলে দিয়েছে, ওর জন্য যখন মিলির জীবন শেষ হয়ে গেছে, ওর জায়গা হবে না ও বাড়িতে। 

লিলি একটু ইতস্ততঃ করে জিজ্ঞেস করে, রনি যখন বিয়েই করেছে, মিলিকে মানছে না কেন? 

রনিও ওর কথাগুলো খুলে বলে। লিলির জন্যই যে মিলিকে ভরসা করতে পারেনি, আর এখন রনির হাতে কিছু নেই। মিলির অসুখ, চিকিৎসা, সবটাই বলে, কেবল ও টাকাপয়সা দিচ্ছে, সেটুকু বাদ দিয়ে। 

যুগল বলে, এবার ও বুঝেছে, কেন লিলিকে কখনও ক্ষমা করবে না বলেছে ওর মা।

লিলি প্রশ্ন না করে পারে না, একদিন মিলি সুস্থ হয়ে যাবে বোঝা গেল, এরপর মিলিকে নিয়ে রনি কি ভাবছে। 

রনি এও স্বীকার করে, মিলির জন্যই ও অপেক্ষা করছে। সেজন্যই লিলিকে দেখে ও মরিয়া হয়ে উঠেছিল, লিলি কেন ওকে সব লুকিয়েছিল জানতে। কারণ ওর বিয়ের দিন থেকে প্রশ্নটা মাথায় ঘুরছিল, ওর উপর বিশেষ কোনো রাগ আছে কিনা লিলিদের। রনিকে কোনো শাস্তি দিতে, ছোট করতে চাইছিল কিনা ওরা। লিলির রাগ থাকলে, মিলিরও আছে কিনা। কারণ আজকের দিনে শিক্ষিত, ভদ্র সহকর্মীর সঙ্গে সম্পর্ক আছে, বিয়ে করতে চায়, এটা বাড়িতে লুকোনো তো অস্বাভাবিক। আজ সব পরিষ্কার হল। 

ততক্ষণে যুগল পর্যন্ত সব রাগ ভুলে গেছে। দুজনেই ক্ষমা চায় রনির কাছে, কোনো ব্যক্তিগত রাগ ক্ষোভের ব্যাপার নেই বারবার বুঝিয়ে বলে। লিলি তার সঙ্গে সঙ্গে বলে মিলি আসলে রনির ভক্ত বলা যায়। বিয়ের কথা নিয়ে মিলি রনির কত প্রশংসা করেছিল, একটা একটা করে মনে করে করে বলে লিলি। মাথা নিচু করে বসে সেসব শোনে রনি। কতদিন, কতমাস পর যে ওর আজ শান্তি লাগছে, আনন্দে গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে মিলি ওর প্রশংসা করত শুনে। নতুন করে আশা জাগছে, এত ভালো ভালো কথা যখন ওর নামে ভাবত, ওকে কি একেবারেই ফেলে দেবে মিলি? 

💖💜💖💜💖💜💖

সেদিন বিকেল করে বাড়ি ফিরে রনি শুনেছিল, লিলি আসার কথা মোটামুটি জানাজানি হয়েছে। এমনকি পিউও গেছিল খবর পেয়ে। গোপা ওর কাছেও কান্নাকাটি করেছে। হয়তো লিলির জন্য মনখারাপ সারাতেই ওরা পরদিন মিলির মামারবাড়ি যাচ্ছে। 

রনির খুব ইচ্ছে ছিল, বিজয়ার দেখা করার প্রসঙ্গ তুলে একবার বৌদিকে পটিয়ে পাটিয়ে ও বাড়ি যাবে। ওর তো সত্যিই উচিত ওদের বিজয়ার প্রণাম করা। আর গেলে কি মিলিকে দেখতে পাবে না ! 

এখন লিলির খবর পাড়ায় জানাজানি হয়ে গেছে শুনেই চুপ করে যায়, ওকে লিলির সঙ্গে কথা বলতে দেখেনি তো পাড়ার কেউ? 

অবশ্য ওকেও জেরার মুখে পড়তে হয়, এতক্ষণ কোথায় ছিল, এমন উলটোপালটা কাজ করে সবার মাথা খারাপ কেন করছে। বাড়ির ছোট ছেলের মতোই রনি সোজা সারেন্ডার করে, আর করব না। এরপর তো আর বকাবকি চলে না। 

বরং মণিকা কথা তোলে, "গতকাল বাড়িতে থাকলে, ও বাড়ির সবাই এসেছিল, বিজয়ার দেখাটা করতে পারতি। তোকে তো বলতে পারি না, গিয়ে প্রণাম করতে। অথচ ভদ্রতা বলেও তো একটা কথা হয়।"

রনি লাফিয়ে ওঠে, মার যদি তাই ইচ্ছে হয়, ও এক্ষুণি যাচ্ছে। মণিকা বলে, তক্ষুণি না, সন্ধ্যায় ভদ্রস্থ একটা সময়ে যেতে। সেইমতো তিনজন দল বেঁধে গিয়ে হাজির হয়। ওরা প্রণাম করে, মিষ্টি এনে দেয় গোপা আর মিলি। সমর আর বনি, বিশ্বকাপ, ভারত, চাল ডালের দাম নিয়ে এন্তার বকবক করে। পিউ আর মিলি দুজনের ফোন ঘেঁটে পুজোর ছবি দেখে। রনি চুপ করে বসে সেগুলোই দেখার চেষ্টা করতে করতে মিষ্টি খেয়ে যায়। ওকে যা সরাসরি জিজ্ঞেস করা হয়, হুঁ আর হ্যাঁ দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে। 

ও শুধু দেখছে, মিলি কি সুন্দর করে হাসছে, হাসতে হাসতে চুলের গোছা ঝাঁপিয়ে পড়ছে চোখে মুখে। সেগুলো তুলে তুলে কানের পাশে গুঁজে দিচ্ছে। রনির আবার রাগ হচ্ছে লিলির উপর, কি দরকার ছিল আসার ! এখন এই বাড়িতেই থাকবে না মিলি। ওর সঙ্গে দেখা করার কোনো সুযোগই থাকবে না। কে বলবে, মিলির সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে? সেটা মনে হতেই লিলিকে মাপ করে দেয়, লিলির জন্যই তো বিয়েটা হয়েছে। 


চলবে