ঝরাপাতা
পর্ব - ২৩
🧡💖🧡💖🧡💖🧡
গত সপ্তাহে তিন চারদিন রনি বেশ দেরি করে বাড়ি ফিরেছে। নির্দিষ্ট সময়ের এক থেকে দেড়ঘন্টা পর। তবে বাড়ির কেউ অত মাথা ঘামায়নি। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গল্পগুজবে মেতে আছে, অথবা লাইব্রেরি যাচ্ছে, এরকমই কিছু বলে ধরে নিয়েছে।
পুজোর ছুটির শেষে কলেজ ইউনিভার্সিটি সব খুলে গেছে। সবচেয়ে আনন্দের কথা, মিলি কলেজ যাচ্ছে। অঙ্কুরের সঙ্গে গিয়ে ইতিহাসের ডিপার্টমেন্টাল হেড এবং তার সঙ্গে করে ভাইস প্রিন্সিপালের কাছে মিলির মেডিকেল রিপোর্ট জমা দিয়ে এসেছে ওর বাবা আর কাকু। ছোট করে সমস্ত ঘটনা জানিয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, একটা আস্ত সেমিস্টার ও ক্লাস করেনি। ভাইস প্রিন্সিপাল বলেই দিলেন, ও যদি দুটো সেমিস্টারের পড়া একসঙ্গে করে পরেরবার পরীক্ষা দেয়, রেজাল্ট খারাপ হওয়ার একশোভাগ চান্স। যারা সারা বছর পড়ে, কোনো বিশেষ কারণে শুধু পরীক্ষাটুকু দিতে পারে না, তাদেরই চাপ হয়ে যায়। দুটো সিলেবাস একসঙ্গে পাশাপাশি পরীক্ষা চলে বলে। সেখানে মিলি প্রায় পুরো সেমিস্টার পড়াশোনা করেনি, এখনও অসুস্থতা আছে, চিকিৎসা চলবে। তার সঙ্গে এত চাপ দেওয়াও উচিত নয়, ওর পড়াশোনার যা কন্ডিশন, তাতে উনি পারমিশন দেবেনও না।
তাঁর বক্তব্য, মিলি আগের সেমিস্টার ক্লাস করুক, পরীক্ষা দিক। এটা ক্লিয়ার করে তবেই পরের ধাপে যাবে।
দু ভাই বোঝে, এটাই ঠিক কথা। কিন্তু একটা কাঁটা খচখচ করছে, বন্ধুদের থেকে পিছিয়ে পড়াটা মিলি কিভাবে নেবে?
একদিন ছেড়ে ডঃ গিরির সেশন। ওভাবেই ডেট নিতে বলে দিয়েছিলেন। কলেজের সঙ্গে কথা হলেই ওর এ্যাসিস্টেন্টকে জানাতে, সে বুকিং দেবে। সেশন এ্যাটেন্ড করে মিলি ক্লাস শুরু করবে।
পিউ কলেজের কথাবার্তা আর ডাক্তারের ডেট খোঁজ নিয়ে রনিকে জানিয়ে দিল। ও সেদিন সন্ধ্যায় এসেছে টাকা দিতে, এই নিয়ে দ্বিতীয়বার। টাকাটা দিতে ও একাই আসে। কোনোভাবেই সমর যেন নিচু বোধ না করে। ঘরে এসে গোপার সঙ্গে কথা বলে, সাহস করে মিলিকেও কেমন আছ, ছুটির পর টিউশন কবে শুরু, এসব বলে কথাবার্তা শুরু করে।
গোপা আর সমর, দুজনেরই ইচ্ছে, মিলির সঙ্গে রনির সম্পর্কটা সহজ হয়। যাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এলে মিলি অন্ততঃ বন্ধু হিসেবে, ভালো প্রতিবেশী হিসেবে কনসিডার করে রনিকে। তাই কথা বলতে কোনো বাধা নেই। আর রনি যে কথা তুলেছে, সে তো ওর চিকিৎসার অঙ্গ, কলেজ, পড়াশোনার জন্য মোটিভেট করা।
এদিকে মিলির বরং রনিকে নিয়ে সম্পূর্ণ নতুন একটা অনুভূতি তৈরি হয়েছে। ও জানে, দিদির সঙ্গে বিয়ে হয়নি রনিদার। ব্যস, ঐটুকুই জানে। তাই ওর চোখে রনি প্রতারিত, অপমানিত এবং সেগুলো ওদের পরিবারের হাতেই, ওর সহোদরার হাতেই অপমানিত। তাই রনির সামনে খুব অস্বস্তি হয় ওর। রনি যেদিন বিজয়ার দেখা করতে এল, ও সরাসরি বেশি কথা বলতে পারেনি। বলা ভালো কথা যোগায়নি মুখে। বরং বারবার আড়চোখে রনির দিকে চেয়েছে আর ভেবেছে, কত বড় মন হলে দিদির কাজটা ভুলে ওদের সঙ্গে সহজভাবে মিশছে। কৃতজ্ঞতা, তার সঙ্গেই মায়া, করুণা, সহমর্মিতা, সব একাকার হয়ে আশেপাশের সকলের চেয়ে অনেক বড়মাপের মানুষ মনে হয় রনিকে, যাকে ওর দিদি এত ছোট করে দিয়েছে সবার সামনে। ওর ইচ্ছে করে দিদির কাজের জন্য ক্ষমা চায়, রনিদাকে নিজের মতো করে ভালো থাকতে বলে। আবার এইসব ভাবনার কথা বলতেও লজ্জা করে, রনিদা হয়ত ডেঁপো মেয়ে ভাববে। আর আলাদা করে কথাও হয়নি এসব বলার মতো।
তাই রনির প্রশ্নে কথা বলার ছুতো পেয়ে একটা সেমিস্টার মিস করার ব্যাপারে বলে ফেলে। রনি খু্ঁটিয়ে খুঁটিয়ে সমরকে প্রশ্ন করে, ভাইস প্রিন্সিপাল কি বলেছেন, ডিপার্টমেন্টাল হেড কি বলেছেন। মিলির নিজের ইচ্ছে কি, সেটাও জিজ্ঞেস করে শেষে। মিলি একটু লাজুক হেসে বলে, বন্ধুদের সঙ্গে পাশ করার শখ তো হচ্ছেই, তবে উপায় নেই।
একফাঁকে সমরের সঙ্গে আড়াল খুঁজে টাকাটা দিয়ে দেয়। সমর আগেরবারের মতোই গাঁইগুঁই করে, বলে, "বারবার বলছি তোমাকে, এটা নিয়ে এত রিজিড হয়ে যাচ্ছ কেন? এখনই তুমি টাকা না দিলেও হত। দরকার হলে তখন নাহয় চেয়ে নেব।"
রনিও মাথা নিচু করে বলে, "আমাকে যে এত সহজেই মাপ করবেন না, সেটা জানি।"
- "আহা, এর মধ্যে মাপ করার কথা আসছে কেন?"
- "আর কথা বলবেন না কাকু। মিলি শুনে ফেললে কেলেঙ্কারি হবে।" টাকাটা রেখে দিয়ে চলে আসে ও।
বেশি রাতে ফোন করে বলে, মিলির কলেজের একজন সিনিয়র প্রোফেসর চৈতালী মুখার্জীর সঙ্গে ওর চেনা বেরিয়েছে। তার সঙ্গে কথা বলেছে ফোনে। উনি মিলির প্রশংসাও করেছেন স্টুডেন্ট হিসেবে। ভালো ছাত্রী বলে মিলির দায়িত্ব নিতে রাজি। ভাইস প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলবেন আগামীকাল, উনি নিজে মিলিকে আপাততঃ হেল্প করবেন পড়ায়। পরীক্ষার আগে যদি দেখেন মিলি তৈরি হতে পেরেছে, তাহলে যেন ভাইস প্রিন্সিপাল স্যার পারমিশন দেন।
সকলেই খুশি রনির এই চেষ্টায়। ডঃ গিরি হালকা গল্প করেন মিলির সঙ্গে, মিলি উচ্ছ্বসিত, হঠাৎ এই সুযোগ পেয়ে। ডঃ গিরিও বলেন, মিলি যেন খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করে। আর রনি এই সুযোগটা করে দিয়েছে, ওর সম্মান যেন থাকে প্রোফেসরের কাছে। মিলি আরও কৃতজ্ঞ হয়ে পড়ে রনির কাছে।
কলেজে ক্লাস শুরু করে মিলি। প্রথমদিন গোপা সঙ্গে গেছিল। অঙ্কুর আছে, বন্ধুরা আছে, নিজেই টীচার্স রুমে গিয়ে চৈতালী ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলে এল দেখে সবাই খুশি। সপ্তাহে দুদিন কলেজের পর ওকে বাড়িতে ডেকেছেন চৈতালী ম্যাডাম। সমর অফিস ফেরত নিয়ে আসবে।
সবাই বোঝে এখন অনেক অপেক্ষা করতে হবে। আর কোনোদিন কোনো অবস্থায় মিলির স্মৃতির ভাঁড়ার জেগে উঠলে, যতটা খারাপ হতে পারে বলে ভয় পাচ্ছে ওরা, অতটা কিছুও যেন না হয়, সেই প্রার্থনা করতে থাকে।
❤💜❤💜❤💜❤
এরমধ্যে রনির দেরি করে বাড়ি ফেরাটা নিয়ে কেউ ভাবিত নয়। রনিও তো বেশ আছে। মিলির পড়ার ব্যবস্থাও করে দিয়েছে, এমনটাই মনোভাব সবার। আজ কলেজ থেকে ফিরে বনি আবার বেরিয়েছিল কিছু কেনাকাটা করতে। রনি বাড়ি ফেরার খানিকক্ষণ পরে ফিরে মায়ের আড়ালে রনিকে পাকড়াও করল, "তুই কোথায় ছিলি, কি করছিলি?"
পিউ তো অবাক ! রনির আগেই ও বলে বসে, "কেন ভাই কি করছিল? তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে?"
- "আমি তো ইউনিভার্সিটি থেকে এই একটু আগে ফিরলাম। তারপর কিছু পড়াশোনা ছিল..." রনিও অবাক এই জেরায় !
- "পরের না, আমি আগের কথা বলছি। বাড়ি ফেরার আগে কি করছিলি?"
রনি চুপ, পিউ হাঁ ! বনি পিউয়ের দিকে ফিরে বলল, "ও মিলির সঙ্গে আইসক্রিম খাচ্ছিল।" ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে আবার বলল, "দেখ, বলছি বলে কিছু মনে করিস না। তোর সঙ্গে হয়ত দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, এর মধ্যে কোনো অন্যায় নেই। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখিস, ওর লেখাপড়ার দিকটা ঠিক করে দিচ্ছিস, কিছু দরকার হলে পাশে দাঁড়া, ঐ পর্যন্ত। বেশি কথাবার্তা, মাখামাখির দরকার নেই। ওর বাবা মা পছন্দ করবে কিনা জানিনা। তার উপর ভবিষ্যতে কি হবে, তার নেই ঠিক। এই ব্যাপারে জড়িয়ে পড়িস না। আমার কথাগুলো ভেবে দেখ।"
রনি চলে যেতেই পিউ হামলে পড়ে, "কি বেরসিক গো তুমি ! দুজনের ভাব হচ্ছে, আইসক্রিম খাওয়াচ্ছিল ভাই, একটা ছবি তুলে এনে আমাকে দেখাবে, তা না, উলটে ভাইকে বকছে ! মনে হচ্ছে ওর আন্ডারএজ ভাই পরীক্ষার পড়া ফেলে গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ঘুরছে আর ও ঠাকুর্দা হয়ে শাসন করছে !"
- "দরকারে শাসনও করতে হবে। তুমি বুঝতে পারছ না, মানুষের মন ! মেয়েটার অসহায় অবস্থা দেখে রনির মায়া হচ্ছে। এত মেলামেশা করলে শেষে যদি একটা ধাক্কা খায় ওর কি হবে? আর মিলির যদি কোনো সমস্যা হয়, ওদের বাড়ির লোক বাদ দাও, পাড়ার লোকেরাও আমাদের ছাড়বে না। বলবে, মেয়েটা একবার অসুস্থ হওয়ার পরও রনি ওকে শান্তি দিচ্ছে না কেন? আমার চোখে পড়েছে, আর কজনের চোখে পড়েছে, কে জানে ! কদিন ধরে দেখাসাক্ষাৎ হচ্ছে তাই বা কে বলতে পারে?"
বনি যুক্তি দিয়ে বোঝালেও, তা ই ঘটতে যাচ্ছে হয়ত, এই ধারণা থাকলেও, পিউ স্বপ্ন দেখতে থাকে, এইভাবে যদি দুজনের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে, মিলির যদি পুরনো কথা মনেই না পড়ে, তাহলেই আর কোনো ঝামেলা থাকে না। তখন আবার ওদের নাহয় বিয়ে দিয়ে দেবে। মিলি জানবে, এইবার বিয়ে হল ওর।
এত বিভোর হয়ে যায় নিজের স্বপ্নে, রাতে বনিকে বলতে যায়, "শুধু নেগেটিভ ভাবছ কেন? এমনও তো হতে পারে?"
বনির নাক কুঁচকে যায়, যেন বস্তাপচা একটা ভুলভাল বোকা বোকা কিশোরীর গন্ধ পিউয়ের এই প্ল্যানে, "তুমি এবার চাকরি বাকরি খোঁজ। বাড়িতে বসে থেকে থেকে মাথাটা যাচ্ছে। এক বিয়ে ভুলিয়ে ওদের আবার বিয়ে দেবে ! খবরদার পিউ, স্বপ্ন দেখা ভালো। আজব স্বপ্নের পিছনে ছুটো না, রনিকে সাপোর্ট কোর না। রনির জন্যই ভালো হবে না। এইটুকু বোধ তোমার থাকা উচিত। এসব কথা মাকে বলছি না, অকারণ টেনশন করবে। তুমি কোথায় সামলাবে, তা না !"
চলবে