ঝরাপাতা
পর্ব - ৩৩
❤💕❤💕❤💕❤
ডঃ গিরি মিলিকে সুনিপুণ ভাবে একটু একটু করে প্রশ্ন করে বুঝতে পারেন, শ্রেয়ান অর্থাৎ রনি সম্পর্কে সে এখন গদগদ। বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের ঘটনা। বিয়েটা শেষপর্যন্ত টিঁকে যাক, পরিবারের সকলেরই মনের ভিতর এই ফল্গুধারা বয়ে যাচ্ছে জানেন। শ্রেয়ান ওকে ভালোবাসে বলেছে, সত্যিই ভালোবাসে, নাকি নিজের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত, এটুকুই তাকে জানতে হবে। কারণ মিলির সব মনে পড়ল বলে।
তবে এই সেশনের শেষে মিলিও আরও ঝলমলে, কারণ ওর নিজের ব্যাপারে যে খটকাগুলো ছিল, সেগুলোর উত্তর মিলিয়ে দিয়েছেন ডঃ গিরি। আবার রনির সঙ্গে সম্পর্কটা তৈরি হতেই রনির দাদা বৌদি মেনে নিয়েছে জানে। এখন ডাক্তারও ওর কাছে রনির গল্প শুনে বেশ খুশি হলেন। সুতরাং নতুন প্রেম নিয়েও চাপমুক্ত এখন।
বাড়ি ফিরে ফোনে সব কথাই হয় রনির সঙ্গে। দুজনেই একমত, দাদা বৌদিকে কোনোভাবে এদিক ওদিক পাঠিয়ে দুজন আলাদা গল্প করবে আগামীকাল সিনেমা দেখার পর।
অবশ্য পরদিন প্রথম চমক, নামী একটা শপিং মলের সিনেমা স্ক্রিনিং এ পৌঁছে বনি ভাইকে বলে, "তোর ফোন দেখ। দুটো ই-টিকিট পাঠালাম। নম্বরটা বলে ঢুকে পড়। বেস্ট অফ লাক।"
দাদা বৌদির মিচকে হাসিটা দেখে রনি অবাক, "মানে? আমরা ঢুকে পড়ব? আর তোরা?"
- "আমরা তোদের লেজে বেঁধে ঘুরতে পারব না রে। এই মুভি দেখার প্ল্যানটা আমাদের ছিল, তোদের জন্য এটা গুবলেট হতে দেব না। টুকাইকে ও বাড়িতে রেখে এসেছি। এখন আমরা চুটিয়ে উইন্ডো শপিং করব, পরের শো তে আমাদের টিকিট কেটেছি। কিছু খেয়ে দেয়ে মুভি দেখব। তারপর ও বাড়ি যাব। রাতে ওখানে খেয়ে বাড়ি ফিরব। সব কথা মা জানে। তোরা পপকর্ন আর কোল্ড ড্রিঙ্কস কিনে ঢুকে পড়। মুভি দেখে যা ঘোরার ঘুরে নে। মিলির পরীক্ষা না হলে আর কোথাও যেন না দেখি দুটোকে।"
- "কি রে, কেমন দিলাম?" পিউ মিলিকে একটা ধাক্কা মারে। মিলি লজ্জায় লাল, উত্তর যোগায় না।
বনিকে একবার জড়িয়ে ধরে থ্যাঙ্কিউ বলে রনি দৌড় দেয়, "মিলি চলে এসো। কি খাবে দেখে নাও।"
পিউ একহাতে মিলিকে ঠেলে এগিয়ে দেয়, "যা বাবা। আর লজ্জা পেতে হবে না। নিজেরাও শান্তিতে প্রেম কর, আমাদেরও একটু শান্তিতে প্রেম করতে দে।" মিলি আর পিছন ফিরে তাকায় না লজ্জা আর আনন্দের ডবল ধামাকায়।
পিউয়ের হাত ধরে বনি হাঁটা দেয়, "চলো চলো, অল্প একটু ঘুরে ফিরে দেখি আমরা।"
পিউ ঘুরে ঘুরে দেখেশুনে ছেলের জন্য কিছু জামাকাপড় কেনে। বাচ্চারা সবসময়ই বাড়ছে, জামাকাপড় এই গায়ে ঠিক, এই ছোট। তাই দু তিনমাস অন্তর কিনতেই হয়। নিজের আর দুই মায়ের জন্য পারফিউম পছন্দ করে। বনি নিজের আর ভাইয়ের জন্য দুটো জ্যাকেট কেনে। সেই স্টোরেই একটা ফ্যাশনেবল শ্রাগ এ চোখ আটকে যায়। পিউকে বলে, "এটা দেখোতো, পছন্দ হলে তোমার আর মিলির জন্য দুটো নিয়ে নাও।"
ওদিকে দুজন মশালা পপকর্ন আর কোল্ড ড্রিঙ্কস নিয়ে ভেতরে গিয়ে দেখে একেবারে পিছনের রো তে কর্ণারে ওদের সিট। বোঝাই যায় ইচ্ছে করে দেখেশুনে বনি টিকিট কেটেছে। দুজন বসে পড়ার পরও দশ মিনিট বাকি মুভি শুরু হতে। দুজনেই দুজনের দিকে তাকাতে গিয়ে চোখাচোখি হয়ে যায়, হেসে ফেলে। একটা বড় পপকর্নের পেপার বাকেট নিয়েছে ওরা। সেটা মিলির কোলের উপর। মিলি তাড়াতাড়ি খানিকটা পপকর্ন হাতে নিয়ে রনিকে বলে, "তুমিও নাও। একটু পরেই ঠান্ডা হয়ে যাবে।"
রনি হাত বাড়িয়ে পপকর্ন নিতে গিয়ে আরেক বিপত্তি। বাকেটে উঁচু করে সাজানো পপকর্নের খানিকটা মিলির কোলের উপর ঝরে পড়ে। সরি বলে রনি তাড়াতাড়ি পপকর্নগুলো হাতে করে তুলে নিচ্ছে। মিলির গা শিরশির করে ওঠে। থাক থাক বলে রনির হাতটা ঠেলে বাকিগুলো ও তুলে নেয়।
এসবের মধ্যে মুভি শুরু হয়েছে। চেনা জানা পড়া গল্প। অভিনেতাদের কাজ আর গল্পে কতটা বদল আনা হয়েছে যুগোপযোগী করতে, সেদিকে মন দুজনের। মাঝে মাঝেই পপকর্ন নিতে গিয়ে দুজনের হাতে ধাক্কা লাগছে। মাঝখানের হাতলে কোল্ড ড্রিঙ্কস রেখেছে। সেটা তুলতে গেলেও একই ঘটনা। ওগুলো শেষ হতে পপকর্নের বাকেটে কোল্ড ড্রিঙ্কসের প্লাস্টিক গ্লাসদুটো ভরে পাশের ফাঁকা সিটটায় রেখে দেয় রনি। রো টার ওপাশে আরেকটা কাপল, মাঝে দুটো সিট খালি। দু দলই তাদের এসব বাতিল বাকেট আপাততঃ খালি চেয়ারে রেখেছে।
মিলি বুঝতে পারছে, রনি ওর দিকে অনেকটাই হেলে বসেছে, ওর কাঁধে রনির বাহুর ছোঁয়া লাগছে। যতটা অস্বস্তি হচ্ছে, ঠিক ততটাই ভালো লাগছে। তবুও ওর উসখুশানিটা রনি বুঝতে পেরেছে। আরেকটু ঝুঁকে প্রায় ওর কানে মুখ ঠেকিয়ে বলে, "কি হল, অসুবিধা হচ্ছে? আমি পাশের সিটটায় চলে যাব? তুমি ভালো করে দেখো।"
রনির আসল ইচ্ছে, মিলি বলে, না তুমি যাবে না। এদিকে সেটা বলতে মিলির ভীষণ লজ্জা ! ফলে রনির প্রশ্নে মিলির রাগই হয়ে যায়। আহত চোখ তুলে হলের আবছায়ায় রনির মুখ দেখতে চায়, প্রশ্নটা রাগের না মজা করে? ঠিক সেই মুহূর্তেই পর্দায় ইন্টারভ্যাল লেখার সঙ্গে সঙ্গে হলের জোরালো আলো গুলো জ্বলে ওঠে। দুজনেই হকচকিয়ে যায়। তারপরই সোজা হয়ে বসে।
ঐ খণ্ড সময়েই রনি মিলির চোখে অভিমান দেখতে পেয়ে গেছে। মিলি সোজা হয়ে বসায় বুঝতে পেরেছে, মিলিও ওর দিকেই ঝুঁকে বসেছিল। ইতিমধ্যে মিলি আবার ওর দিকে তাকাতে হাসার চেষ্টা করে রনি। মিলিও ওর হাসিতে বুঝতে পারে রাগ করে লাভ নেই, হেসে ফেলে।
- "আরেকটা কোল্ড ড্রিঙ্ক নিয়ে আসব তোমার জন্য?" রনি আবার ঝুঁকে আসে মিলির দিকে।
- "এক্ষুণি শুরু হয়ে যাবে।" মিলি মাথা নাড়ে।
- "তুমি কি মন দিয়ে মুভি দেখছ?" রনি মজা পেয়ে গেছে।
প্রশ্নের অর্থ বুঝেই মিলি ইচ্ছে করে বোকা সাজে, রনি এত আলোর মধ্যে আবার ওর দিকে ফিরে বসায় বুক ঢিপঢিপ করছে। না বোঝার মতো বলে, "সে তো দেখছিই। ভালোও লাগছে। কেন, তোমার ভালো লাগছে না?"
- "আমি তো মুভি দেখছি না। যেটা দেখছি, সেটা ভালো লাগছে।" রনি ওর চোখ থেকে চোখ সরায় না।
মিলি লজ্জা পাচ্ছে, সঙ্গে এটাও বুঝতে পারছে, ও যত লজ্জা পাবে, রনি আরও বেশি বেশি এগুলো বলবে এখন। ও সোজা পর্দার মুভি শুরুর লেখার দিকে তাকিয়ে বলে, "আমি বাবা এটাই দেখছি। এরপর ওরা এই একই মুভি দেখবে। তারপর বৌদি আমাকে পড়া ধরবে, গল্পে কখন কি হয়েছে। একটা ফাঁক পেলে...."
আলো নিভে যাওয়ায় নিশ্চিন্ত রনি মিলির একটা হাত মুঠোয় নিয়ে বলে, "পড়াটা তুমিই ধোরো। না পারলে ও দুটোকে আমি আচ্ছা করে দেব।"
- "মানে?"
- "তোমার কি ধারণা? ও দুটো সিনেমা দেখবে বলে আলাদা শো এর টিকিট কেটেছে? হুঁহ, চেনোনা ওদের। সেই কোনকাল থেকে ওরা সিনেমা হলে প্রেম করছে জানো? আজ অবধি কারও সঙ্গে সিনেমায় আসেনি। এবার ভাবলাম আমাদের দুজনের জন্য ওরা বড় হয়ে গেল। কোথায় কি !"
মিলি ফিক করে হেসে ফেলে। প্রেমের গল্পে কার না উৎসাহ থাকে? রনির কানে ফিসফিস করে, "ওরা দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসে। আমার দেখা বেস্ট কাপল।"
- "তাই? তাহলে মুভি শেষ হলে একটা আয়না কিনে দুজন সামনে দাঁড়িয়ে থাকি চলো।"
- "সে আবার কি?"
- "কেন? আমরা কিসে কম বেস্ট হতে?"
- "তুমি একটা যা তা। হাতটা ছাড়।" মিলি এবার হাতটা টানে।
- "চুপ করে বসে থাকো। বেস্ট কাপল এ্যাওয়ার্ডটা আমার চাই।"
সেই সময়ে পলাশ হাজির হয়েছে মিলির বাড়িতে। রবিবারের বিকেলে মিলির বাড়িতে এসে, ওর বাড়ির সবাইকে সারপ্রাইজ দিয়ে রনিদার প্রভাব ধূলিসাৎ করে দেবে ভেবেছিল। সে জায়গায় শুনল, ওদের সিনেমায় যাওয়ার খবর। হিংসেয় পলাশের মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, "আপনারা ওকে ছাড়লেন?"
গোপা অবাক হয়ে বলল, "সে কি? ছাড়ব না কেন? ওর শ্বশুর বাড়ির লোক, ওর হাজব্যান্ড সঙ্গে যাচ্ছে।"
পলাশের মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি জ্বালা করছ মনে হয়, বলে ফেলে, "ওর হাজব্যান্ড? যে লোকটার জন্য ওর জীবনটাই নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে, তাকে ওর হাজব্যান্ড মানছেন?"
ওদের মনে হয়, বন্ধুর জন্য খারাপ লাগা থেকে পলাশ এসব বলছে। সমর বুঝিয়ে বলে, "দেখো, কেউ না মানলেও রনি ওর হাজব্যান্ড। তবে ওদের বিয়েটা এত গোলমাল ঝামেলার মধ্যে হয়েছে যে তার কিছু জের টানতেই হচ্ছে। তোমার বন্ধুকেই সবচেয়ে বেশি টানতে হচ্ছে। তেমনি রনিও ওর পাশে আছে। তাই এ নিয়ে আমরা কেউ কিছু না বলাই ভালো।"
পলাশ ভাবে, "বেশ, কিছু বলার নেই যখন, মিলিকে হেল্প করব, চমকে দেব ভেবেছিলাম। ওটাই ফাইনাল করি।"
চলবে