মানুষ তার আদিম-বন্যজীবন অতিক্রম করে সভ্যজীবনে প্রবেশ করল,- সমাজবদ্ধ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হল,- সেদিন হতেই সে প্রয়োজন অনুভব করল অনুশাসনবাদ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপনের । আর, এই অনুশাসনবাদের জন্যই প্রয়োজন হয়ে পড়ল ধর্মবোধ।
ধর্ম মানে তা'ই যা আমাদের বাঁচা-বাড়াকে ধরে রাখে। ধর্ম আমাদের সুষ্টু ও সুস্থ জীবনচলনা অক্ষুন্ন রাখে। সভ্যতার সেই শুরুর দিনগুলিতে স্বভাবতই নব্য সমাজবদ্ধ মানুষের চেতনা, বোধ, জ্ঞান-বুদ্ধি ছিল আদিম পর্যায়ের,- অনুন্নত। প্রকৃতির কূলে অবস্থিত বিভিন্ন বস্তু, বিষয় ও ঘটনাবলি ছিল তাদের কাছে ব্যাখ্যার অতীত, অজ্ঞাত ও বিস্ময়কর। আর সেই বিস্ময় বা অজ্ঞতা থেকেই তারা বিভিন্ন গাছ, পাথর, সূর্য, চন্দ্র, পবন, বৃষ্টি, অগ্নি ইত্যাদি বস্তু ও বিষয়গুলির মধ্যে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ঈশ্বর বা দেবতার অস্তিত্ব কল্পনা করতে লাগল। সূর্যদেবতা, পবন দেবতা, অগ্নিদেবতা, চন্দ্রদেব ইত্যাদি দেবতার জন্ম সেই সময়কালেই আমাদের পূর্বপুরুষদের অনুসন্ধিৎসু মনে উদয় হয়েছিল। সেইসব অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন দেব-দেবীকে নিত্য পূজা করা এবং তাদের প্রতি ভয় ও সম্ভ্রমমিশ্রিত ভক্তির দ্বারা নিজেদের সংযম, শৃঙ্খলা, আত্মনিয়ন্ত্রন বজায় রেখে সমাজকে সুস্থ ও সুন্দর রাখাই ছিল সমাজের নীতিনির্ধারকদের মূল উদ্দেশ্য। যদি এইসকল দেবদেবীর কল্পনা ও প্রচার সেই সময়কালে না করা হত, - তবে সমাজে অনুশাসন,শৃঙ্খলা, নিয়ন্ত্রন,সংযম বলে কিছুই থাকত না। আমাদের সভ্যতা শুরুতেই নষ্ট হয়ে উৎশৃংখল, অসভ্য, অনিয়ন্ত্রিত জীবনচলনায় মানবজাতিকে ধ্বংসমুখে ঠেলে দিত।
এইসকল কল্পনাপ্রসূত দেবদেবীর পূজা-অর্চনা এবং তাদের প্রতি ভয় অথবা সম্ভ্রমমিশ্রিত ভক্তি মানবসমাজকে একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত শৃঙ্খলা ও অনুশাসনে বেঁধে রাখতে সক্ষম হল।
মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি, সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের জীবনযাত্রা আরো উন্নত হয়,- সভ্যতা আরো এগিয়ে চলে আধুনিকতার দিকে। ব্যাক্তিজীবন ও সমাজজীবনকে আরো নিয়ন্ত্রিত ও সুগঠিত করার জন্য প্রয়োজন হয় নানা সুচিন্তিত উপদেশ ও নীতিবাক্যের। কিন্তু নীরস কাঠকোট্টা নীতিবাক্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকেনা। তাই আর্যঋষিগন একেকটা প্রয়োজনীয় নীতি-উপদেশকে বিভিন্ন অর্থবাহী মূর্তির রূপ দিলেন। উদাহরণস্বরূপ,- বিদ্যার্থীদের বিদ্যা অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় যে নীতিউপদেশ,- সেই নীতিউপদেশগুলিকে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে রূপ দেওয়া হল দেবী সরস্বতীর মূর্তির মধ্যে। বই পাঠ করে তার সারাংশকে মজ্জাগত করা উচিত,- সম্পূর্ন বইটি মূখস্ত করা নয়। এই নীতিবাক্যটি বুঝাতে দেবী সরস্বতীর মূর্তিতে বাহন করা হল একটি হাঁসকে,- যার নাকি একবাটি দুধ থেকে শুধু ছানাটুকু খেয়ে ফেলার ক্ষমতা রয়েছে। বিদ্যাপাঠ ও অনুশীলন প্রতিদিন নিয়মিত ছন্দাকারে চলা উচিত বুঝাতে দেবীর হাতে দেওয়া হল বীনা,- যার বৈশিষ্ট্য হল ছন্দে ছন্দে সুর সৃষ্টি করা। বিদ্যার্থির মন ও পরিবেশ সর্বদা শান্ত-পবিত্র হউয়া প্রয়োজন বুঝাতেই দেবীর পরিধেয় শাড়ীর রং দেওয়া হল শ্বেতশুভ্র।
তেমনি একজন আদর্শ আর্যনারীর কি কি বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন,- সেই নীতি ও উপদেশকে ফুটিয়ে তোলা হল দেবী দূর্গা রূপে। একজন আদর্শ আর্যনারী সংসারের দশদিক লক্ষ রেখে সুচারুভাবে সংসার পরিচালনা করেন, -তা বুঝাতেই দেবীর দশ হাত দেওয়া হল। সেই নারীর সতীত্বের তেজ ও শক্তির কাছে সিংহের মত হিংস্র, ধূর্ত, শক্তিশালী মানুষও পদাবনত হয়,- অসুরের মত চরিত্রহীন,দুষ্ট পুরুষ ও পরাস্ত হয়,- তা বুঝাতেই দেবীর পায়ের নীচে দেওয়া হল সিংহ, ত্রিশূলের নীচে দেওয়া হল ভয়ানক বলশালী অসূর৷ এমনকি সেই নারীর বিচক্ষনতা ও বুদ্ধি এত প্রখর হয় যে,- কোন দুষ্ট লোক নীরিহ ও শান্ত রূপের ভেক ধরেও তার কাছে টিকে থাকতে পারেনা,- তা বুঝাতেই দেবীর পায়ের নীচে দেওয়া হয়েছে গলাকাটা মহিষ,- যার ভিতর থেকে অসুর বেরিয়ে আসছে। সর্বোপরি সেই সতী নারীর সবকিছুর মূলে থাকে তার অটুট স্বামীনিষ্ঠা,- তা বুঝাতেই দেবীর মস্তকের পেছনে দেওয়া হল ভগবান শিবের ছবি।আর,- এইরূপ স্বামীনিষ্ঠা, সতীত্ব ও সর্বপরিপূরনী সেবাদৃষ্টি নিয়ে চললে আদর্শ, চরিত্রবান, বিচক্ষন, গুনধর,শক্তিশালী সন্তান-সন্ততির জন্ম হয়,- তা বুঝাতেই লক্ষী, সরস্বতী, কার্তিক,গনেশের মূর্তি দুই পাশে দেওয়া হল।
বসন্ত ঋতুতে বসন্ত রোগ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে শীতলা পূজা করা হত৷ এই শীতলা মূর্তির মাথায় থাকে কূলো, হাতে ঝাড়ু। ঝাড়ুর তাৎপর্য হল স্বচ্ছ অভিযান,- নিজের ঘর, পরিবেশ, চারদিক পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কূলোর তাৎপর্য হল,- আমাদের আবাসে শীতল বায়ুপ্রবাহ বজায় রাখা। যাতে জীবানু সংক্রমন কম হয়। এমনিভাবে প্রতি প্রত্যেকটি হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তির মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত নীতিবাক্য ও উপদেশ রয়েছে। মূর্তিপূজার মাধ্যমে সেই নীতি ও অনুশাসনকে স্মরন-মননের মাধ্যমে নিজের জীবনে অনুশীলন ও আত্মস্থ করাই হল মূর্তিপূজার মূল উদ্দেশ্য।এই পবিত্র উদ্দেশ্য নিয়েই আর্য ঋষিগন বিভিন্ন পূজাপার্বনের প্রচলন করেছিলেন।
সভ্যতা এগিয়ে চলল। মানুষ আরো বুদ্ধিমান, আরো জ্ঞানী ও জটিল মানসিকতার অধিকারী হতে লাগল,- আধুনিকতার দিকে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল। মুনি ঋষিদের প্রবচন, পূজা অর্চনা, যজ্ঞ, মূর্তিপূজা, - এইসব আর জটিল মানসিকতাসম্পন্ন মানবজাতির অনুশাসনবাদের জন্য যথেষ্ট উপায় হয়ে রইল না। প্রয়োজন দেখা দিল একজন আদর্শ মানুষের,- যিনি তাঁর জীবনচলনায় ধর্ম ও অনুশাসনবাদকে আচরন করে দেখিয়ে দেবেন, যিনি হবেন সকল মানবজাতির জীবনের শিক্ষক, জীবন্ত আদর্শ।
সেই পরিপ্রেক্ষিতেই ত্রেতাযুগে আসলেন মর্যাদাপুরুষ প্রভু শ্রীরামচন্দ্র। তাঁর সামগ্রিক জীবনচলনাটাই ছিল সেই যুগের মানবজাতির কাছে বাঁচা-বাড়ার আদর্শ। আজকের যুগেও তিনি সমগ্র মানবজাতির কাছে সমান প্রাসঙ্গিক ।আদর্শ পুত্র, আদর্শ স্বামী, আদর্শ ভাই, আদর্শ রাজা, আদর্শ নেতা, আদর্শ মানুষ হিসাবে তিনি তাঁর জীবনকালে সমগ্র আর্যসমাজে পূজিত হয়েছেন। সমস্ত ঋষিগন তাঁকেই মানবজাতির জীবন্ত আদর্শ হিসাবে তুলে ধরেছিলেন। মানুষ তাঁকে অনুসরণ করে, তাঁর জীবনের অনুশাসনবাদকে অভ্যাস করে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে,- শান্তি-স্বস্তির অধিকারী হয়েছে।
সভ্যতা অগ্রসর হয়ে চলল। ব্যাক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবন আরো জটিল হল। বাক্তিজীবন, সমাজজীবন, রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছে সুনির্দিষ্ট, আরো বিস্তৃত ও গভীর দিকনির্দেশনা, আরো সুস্পষ্ট অনুশাসনবাদ, এক সর্বজনগ্রাহ্য জীবনদর্শন। দ্বাপর যুগে অবতাররূপে আবির্ভূত হলেন পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ। তিনি তাঁর জন্ম থেকে তিরোধান পর্যন্ত পুরো জীবনকালটিই কাটিয়েছেন নানা সংগ্রাম, সমস্যা ও দ্বন্দের মধ্য দিয়ে,- কিন্তু তার মধ্যেও প্রতিক্ষন ধর্মপ্রতিষ্ঠায় ছিলেন অচল-অটুট। কর্ম ও ধর্মের সমন্বয় তিনিই দেখিয়েছেন আচরন করে। সমগ্র মানবজাতির জীবনচলনার জন্য তিনি সম্পূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন গীতা নামক মহাগ্রন্থের মাধ্যমে। মানবজাতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে আদর্শরূপে গ্রহন করে, - তাঁর দেওয়া গীতার বানী অনুসরণ করে জীবন উপভোগ করতে লাগল।
সভ্যতা এগিয়ে চলল,- মানুষ আধুনিক হতে লাগল। তার জ্ঞান, বুদ্ধি, শিক্ষা আরো আধুনিক হতে লাগল। পন্ডিতেরা তাদের জ্ঞান- বুদ্ধি অনুযায়ী গীতার বানী নানাভাবে ব্যাখা করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ছাপিয়ে তাঁর গীতার ব্যাখ্যাই মূখ্য হয়ে উঠল। " ঋষি বাদ দিয়ে ঋষিবাদের উপাসনা শুরু" হল। বিভিন্ন পন্ডিতেরা গীতা ব্যাখ্যার সময় তাদের প্রবৃত্তিরংগীল মনের প্রভাব সেই ব্যাখ্যায় ছাপ ফেলতে লাগল। একই বানীর বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেখা দিল। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হতে লাগল। আমরা মানবরূপী শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে গিয়ে এক অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন, অতিপ্রাকৃত ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পূজা করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম,- তাঁর অলৌকিক ক্ষমতাপ্রসূত আশীর্বাদ লাভের আশায়। কিছু না করে অনেক কিছু পাবার আশায় ব্যাস্ত হয়ে উঠল মানুষের মন। অনুশাসনবাদ অভ্যাস না করে, - আনুষ্ঠানিক নিয়মরক্ষার গীতাপাঠকেই পূন্য বলে বিবেচনা করতে লাগল ভক্তগন,- স্বর্গ লাভের আশায়।
একসময় হিন্দু সমাজে ধর্মপ্রদর্শকগন তর্কযুদ্ধ, শ্লোকের জটিল ব্যাখ্যা, পান্ডিত্য প্রদর্শন, প্রবৃত্তিমূখী চলনে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তাদের ব্যাক্তিজীবনে সক্রিয় ভালবাসার টানে অনুসরণ করা, তাঁকে খুশী করার ধান্ধা বাদ দিয়ে নানা শ্লোকের চর্চা ও তর্কযুদ্ধে জেতাই জীবনে মূখ্য করে তুলে। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে হাবুডুবু খেতে থাকে। সমাজে নানা কুসংস্কার, অপসংস্কৃতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। ধর্মের নামে অনাচার শুরু হতে লাগল।
তখন বাংলার বুকে আবির্ভূত হলেন প্রভু শ্রীচৈতন্য। তিনি তাঁর জন্মসিদ্ধ প্রখর মেধা ও পান্ডিত্যবলে সমাজের সকল তর্কপ্রিয়, শ্লোক ব্যাখ্যাপ্রিয় পন্ডিতদের তর্কে পরাজিত করে তাদের অহংকার চূর্ন করে দিলেন। তারপর শুরু করলেন কৃষ্ণপ্রেমের জোয়ার। নাম আর কীর্তনে মাতিয়ে তুললেন বাংলার আকাশ বাতাস। সেই প্রেমের জোয়ারে ভেসে গেল যত সব কুসংস্কার, অপসংস্কৃতি, জাতিভেদ। মানবসমাজ গীতাপাঠের আনুষ্ঠানিকতা থেকে বেরিয়ে শ্রীকৃষ্ণের প্রেমে বিভোর হয়ে থাকার স্বাদ অনুভব করল। শ্রীকৃষ্ণকে জীবনে মূখ্য করে সপারিপার্শ্বিক বাঁচা বাড়ার পথে এগিয়ে চলতে লাগল মানবসমাজ।
অনেককাল পর আধুনিক ভারতে মাথা চাড়া দিল ব্রাম্ম ধর্মের মতবাদ । সমাজের তথাকথিত আধুনিক, শিক্ষিত, যুক্তিবাদী কিছু মানুষ হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন মূর্তি পূজা ও মানুষরূপী জীবন্ত আদর্শের অনুসরনকে নিস্প্রয়োজন ভেবে নিরাকার ব্রম্মের উপাসনায় ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। কাল্পনিক অদৃশ্য ঈশ্বরের সুকঠিন আরাধনাকেই তারা সমাজে চাড়িয়ে দিতে লাগল। সেই মুহুর্তে যখন সনাতন ধর্ম কিছু উচ্চশিক্ষিত মানুষদের ভুল ব্যাখ্যায় বিনষ্ট হতে যাচ্ছিল,- সেই সময়ে বাংলার বুকে আবির্ভূত হলেন পরমহংসদেব ভগবান শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব। ব্রাম্ম ধর্মের জোয়ার ঠেকাতে ও সনাতন ধর্ম রক্ষায় প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল মূর্তিপূজার,- তাই কালীমায়ের সাধনাকেই তিনি নিজ জীবনে মূখ্য করে তুললেন। কালী মায়ের আরাধনাকে তিনি আধ্যাত্মিক চেতনা বিকাশের উপায় হিসাবে বেছে নিলেন। সেই সাথে মানবজাতির জন্য আলাপচারতায় দিয়ে গেলেন অমূল্য জীবনদর্শন, -" কথামৃত"। পূর্ব পূর্ব সকল অবতারদেরকে স্বীকার করে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়েই তিনি সহজ সরল ভাষায় সমগ্র মানবজাতির জন্য সহজবোধ্য বাঁচা-বাড়ার পথ বলে গেলেন। সংসারের পাশাপাশি ঈশ্বরে ভাব রেখে জীবনের চরম সত্য অনুভব করার রাস্তা দেখালেন। মৃতপ্রায় হিন্দু সমাজ ও আর্য সংস্কৃতিকে বিশ্বের বুকে পুনরায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তিনি তৈরি করলেন স্বামী বিবেকানন্দকে। কিন্তু তিনি বলে গেলেন এই আসা তাঁর " ছদ্মবেশে নগর পরিক্রমা"। আবার বাংলার বুকে আবির্ভূত হওয়ার আশ্বাস দিয়ে গেলেন।
কিন্তু এইভাবে চলতে চলতে একসময় মানবজাতি ধর্ম ও সম্প্রদায়,- বিষয় দুটিকে গুলিয়ে এক করে ফেল্ল। সাম্প্রদায়িকতাকেই ধর্ম মনে করে পারস্পরিক হিংসা ও দলাদলিতে মেতে উঠল। নানা ধর্মগুরু ও মতবাদের কারনে সমাজে নানা ছোট ছোট দল-উপদল তৈরি হল। মানুষ বিভ্রান্ত হতে লাগল,- আধুনিক বিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তির সাথে ধর্মের দ্বন্ধ তৈরি হল। আধুনিক শিক্ষিত মানুষ ধর্মাচরনকে হেয়, অপ্রয়োজনীয় বোধে তাচ্ছিল্য করতে লাগল। বিজ্ঞানমনস্ক মানুষজন ধর্মের প্রয়োজনীয়তাকে অবজ্ঞা করতে শুরু করল। শিক্ষিত যুক্তিবাদী যুবসম্প্রদায় নিজেদেরকে ' নাস্তিক' বলে পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করতে লাগল।
সেই সময় পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হলেন পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্র। এসেই তাঁর অপার্থিব, অপরিসীম প্রেমের দ্বারা দিকভ্রান্ত মানুষকে কাছে টানতে শুরু করেন। সক্রিয় সেবা, ভালবাসা ও কর্মের মাধ্যমেই তাঁর ধর্মপ্রচার শুরু হয়। সাম্প্রদায়িক ও দলগত বিদ্বেষ দূর করে মানবজাতির মধ্যে পারস্পরিকতা চাড়িতে দিতে থাকেন।তিনি দৃপ্তকন্ঠে ঘোষণা করেন,- " পুরুষোত্তম আসেন যখন সব গুরুরই সার্থকতা, তাঁকে ধরলে হয় না' কো গুরুত্যাগের ঘৃন্যকথা।" ঠিক যেমনটা দ্বাপর যুগে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন,-" সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ। " ধর্ম সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্পষ্ট করতে তিনি বলেন,-" ধর্মে সবাই বাঁচে-বাড়ে/ সম্প্রদায়টা ধর্ম না'ড়ে।" " অন্যে বাঁচায় নিজে থাকে/ ধর্ম বলে জানিস তাকে।" পূর্ব পূর্ব সমস্ত অবতারদের স্বীকার করে, তাদের দেওয়া বিধানকেই নতুন আঙ্গিকে, যুগোপযোগী করে পরিবেশন করলেন। সাবধান করে বল্লেন,-" ভারতের অবনতি তখন থেকেই আরম্ভ হয়েছে যখন থেকে ভারতবাসীর কাছে অমূর্ত ভগবান অসীম হয়ে উঠেছে, ঋষি বাদ দিয়ে ঋষিবাদের উপাসনা শুরু হয়েছে। " তাই যাতে এই " ঋষি বাদ দিয়ে ঋষিবাদ" এর উপাসনায় মানুষ ব্যাস্ত না হতে পারে,- তিনি দিয়ে গেলেন,-' আচার্য্যপরম্পরা'। রেখে গেলেন তাঁরই রেতঃধারার জীবন্ত প্রতিভু। আর সুযোগ রইল না প্রবৃত্তিরঙ্গিল মন নিয়ে তাঁর বানীর বিকৃত ব্যাখ্যা করার।তাঁর দেহরক্ষার পরও যাতে মানবজাতি জীবন্ত আদর্শের অভাবে দিকভ্রান্ত হতে না পারে সেই কারনে রেখে গেলেন তাঁর জেষ্ঠাত্মজকে। তিনি বিশ্বাস করেন, "Ideology, ism can not drive a person. "প্রয়োজন জীবন্ত আদর্শের প্রতি সক্রিয় টান ও ভালবাসা৷ শুধু নীতিকথার কচকচানি কারো কোন উপকারে লাগেনা। সেই সক্রিয় টান গজানোর জন্য প্রয়োজন নিত্য ইষ্টের প্রতি সক্রিয় সেবার অনুশীলন। তাই প্রবর্তন করলেন,- নিত্য প্রত্যুষে ইষ্টভৃতির অভ্যাস। ইষ্টের ভোগের জন্য অপ্রত্যাশী ও ভক্তিসহকারে নিবেদিত অর্ঘ্য। বর্তমান যুগে মানুষের জীবনযাত্রা অনেক বেশী জটিল, ব্যাস্ততাপূর্ন ও প্রতিযোগিতাপূর্ব। মানুষের মন নানা বৃত্তি প্রবৃত্তির জালে জর্জরিত। ব্যাক্তিজীবন, পরিবার জীবন ও সমাজজীবন অনেক বেশী সমস্যাসঙ্কুল। প্রয়োজন প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় প্রতিনিয়ত ইষ্টের সাথে যুক্ত থাকার অভ্যাস। তাই প্রবর্তন করলেন যজন-যাজন- স্বস্ত্যয়নী ও সদাচারের। ব্যাক্তি,সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নতির জন্য জোর দিলেন,- শিক্ষা, দীক্ষা ও বিবাহের উপর। আধুনিক মানবজীবনের প্রতি প্রত্যেকটি সমস্যা ও তার সমাধানের সুস্পষ্ট দিক নির্দেশ করে দিলেন তাঁর অজস্র বানী ও সাহিত্যে। জীবনের এমন কোন দিক বা বিষয় নেই,- যে ব্যাপারে তিনি সমাধান দিয়ে যাননি। বিজ্ঞান, দর্শন, রাজনীতি, শিক্ষা, অর্থনীতি, পূর্তনীতি, সংসারনীতি, সুপ্রজনন, বিবাহনীতি ইত্যাদি প্রত্যেকটি বিষয়ের সাথে ধর্মের সমন্বয় করে গেছেন। ধর্ম আর আধুনিক বিজ্ঞানের মধ্যে কোন দ্বন্দ আর রইল না। তিনি কাউকে ত্যাগ করেননি। এ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত যত অবতার, গুরু, সাধু, মুনি,ঋষি এসেছেন,- প্রতি প্রত্যেককে তিনি পূরন করে গেছেন। তাদের দেওয়া পথগুলিকেই এক আশ্চর্য সমন্বয়ে এনে নতুন ও আধুনিক রূপে পরিবেশিত করলেন সমগ্র মানবজাতির জন্য। তাই খুব দ্রুত হু হু করে কোটিতে কোটিতে মানুষ তাঁর চরনতলে যুক্ত হতে লাগল। এত অল্প সময়ে সারা বিশ্বব্যাপী এত বিস্তার ও প্রসার এর আগে কখনো সম্ভব হয়নি। কারন, তিনি আধুনিকতম!! আধুনিক সময়ের সাথে ধর্মবোধকে তিনি বিবর্তন ঘটিয়েছেন। কিন্তু, সর্বদিক দিয়ে আধুনিক হলেও কিছু মানুষ তাদের ধর্মবোধকে সেই আদিম ও প্রাচীন ধারনায় আটকে রেখেছে। তাদের সেই সুপ্রাচীন ধর্মবোধের সাথে শ্রীশ্রীঠাকুরের আধুনিক ধর্মবোধকে মেলাতে না পেরে বিরুদ্ধাচারনে মেতে উঠছে। কারন, আমাদের অভ্যস্ত সংস্কারের সঙ্গে তাঁর বিরোধ উপস্থিত হয়। আমাদের সেই অভ্যস্ত সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে অনীহা। সবকিছু আধুনিক হলেও,- ধর্মকে সেই আদিম পর্যায়ে আটকে রাখতেই আমাদের আগ্রহ বেশী। কারন, শ্রীশ্রীঠাকুরকে মানতে হলে নিজের বৃত্তি-প্রবৃত্তির উপর হাত দিতে হয়। সেটা খুব মুসকিল কারো কারো জন্য। কিন্তু, সময়ের সাথে মানুষ সত্য স্বীকার করতে বাধ্য হবেই৷ বাঁচার তাগিদেই শ্রীশ্রীঠাকুরকে মানতে হবে একদিন। তাঁর জীবন, তাঁর প্রতিটি কথা যে আমাদের জীবন রক্ষার জন্য।