" ঠিক আছে,-তোর কথায় আমি বুঝতে পারলাম,- জীবনে একজন গুরুর দীক্ষা নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু আমি কোন্ গুরুর দীক্ষা নেব,- তা কি করে সিদ্ধান্ত নেব? আমাদের দেশে তো সাধু-গুরু-ঠাকুর-দেবতার অভাব নেই !! তাদের মধ্যে কে সঠিক গুরু আমার জন্য,- তা বুঝব কিভাবে? " প্রায় এক ঘন্টা নানা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর আমার এক দিদির মূখ থেকে এই উক্তি বের হল।. বললাম,-" জীবনের কোন্ প্রয়োজন পূরনের উদ্দেশ্যে দীক্ষা কেন নিতে চাস,- সেই প্রয়োজনটা আগে ঠিক কর। তারপর নিজেই বুঝতে পারবি কোন গুরুর কাছে দীক্ষা নিতে হবে। গুরু নির্বাচন করার জন্য শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। সাধারণ সাংসারিক বুদ্ধিতেই তা অনুধাবন করা যায়।"প্রত্যুত্তরে দিদি জবাব দিল,-" সব গুরুই তো সমান। দীক্ষা তো জীবনের মঙ্গলের জন্যই নেওয়া,- তাই যে কোন গুরুর দীক্ষা নিলেই তো হল।"
" প্রথমতঃ সব গুরুই সমান,- কথাটা সম্পূর্ন ভূল। সব গুরুই আমার নিকট সমান শ্রদ্ধার, সমান নমস্য হতে পারেন,- কিন্তু তাই বলে সবাই সমান ভাবাটা ভুল। আমার নার্সারী স্কুলের শিক্ষককে দেখলে আমি যে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সহিত প্রনাম করি, আমার ইউনিভার্সিটির প্রফেসরকেও তাই করি। দুইজনই আমার কাছে সমতূল্য। কিন্তু নার্সারির শিক্ষকের যোগ্যতা-দক্ষতা আর ইউনিভার্সিটির প্রফেসরের যোগ্যতা-দক্ষতা সমান সমান নয়,- দুইজনকে সমান ভাবলে ভুল হবে। আমার পাশের বাড়ীর তিলক কাটা কূলগুরু আর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে যদি আমি একই স্তরের ভাবি,- তবে তা আমার বোকামি ছাড়া কিছুই নয় । তাই সব গুরুকে এক পাল্লায় মাপার ভূল করোনা দিদি।
দ্বিতীয়তঃ দীক্ষা জীবনের মঙ্গলের জন্যই নিতে হয়, - সেটা ঠিক। জীবন তো বহুধা বিস্তৃত এবং মঙ্গলও বহুবিধ। কোন প্রকারের এবং কতটুকু মঙ্গল তুমি চাও,- তা আগে স্থির কর। দীক্ষা নেওয়ার অর্থই হল দক্ষতা অর্জনের রাস্তায় প্রবেশ করা। তুমি কোন বিষয়ে কতটুকু দক্ষ হতে চাও,- তা আগে ঠিক কর। তবে তুমি সঠিক গুরুর খোঁজ পাবে অনায়াসে ।"
" কি বলছিস? একেক গুরু একেক বিষয়ে দক্ষ করে তুলে? আমি তো জানি সব গুরুর আধ্যাত্মিক সাধনায় আগ্রসর হতে সাহায্য করে!"
" ঠিক তাই দিদি। তুমি যদি সংগীতে দক্ষ হতে চাও তবে নিশ্চয়ই যিনি সংগীতে সর্বোচ্চ দক্ষ সেই গুরুর আশ্রয় নেবে, যদি ফুটবল শিখতে চাও তবে যিনি সর্বোত্তম ফুটবল কোচ, - তার কাছেই যাবে,- ঠিক তেমনি গুরুর দীক্ষা গ্রহন করার ক্ষেত্রে ও। দীক্ষা গ্রহন আর স্কুলে ভর্তি হওয়া একই ব্যাপার। একটাতে বাংলা,ইংরেজি, অংক ইত্যাদি বিষয়ে পূঁথিগত বিদ্যা শেখানো হয়,- আরেকটায় জীবনের শিক্ষা দেওয়া হয়, মানুষ হবার শিক্ষা দেওয়া হয়,সংসারে চলার কায়দা শেখানো হয়। আধ্যাত্মিকতা মানে জীবনের উদ্দেশ্যকে জানা, জীবনের চরম সত্যকে উপলব্ধি করা, জীবনের কারনকে জানা। আর,- জীবনের বাস্তব বোধ ছাড়া, সংসারের ঘাতপ্রতিঘাতে সঠিকভাবে চলার শিক্ষা ছাড়া এই আধ্যাত্মিকতা অধরা।
তুমি যদি বুজরুকি , বাটপারী, লোক ঠকানো ব্যাবসায় দক্ষ হতে চাও তবে সেই বিষয়ে পারদর্শী অনেক অনেক গুরু আমাদের দেশে পাবে। তারা নিজেকে গুরু, ভগবান বা অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ঈশ্বর প্রতিপন্ন করার জন্য মূখে নানা রঙ মেখে, নানান চিহ্ন এঁকে, মাথায় বাহারী পাগরী ও নানান রঙ-বেরং এর ঝলমলে পোশাক, বিভিন্ন আকৃতির মালা গলায় ঝুলিয়ে, হাতে ত্রশূল নিয়ে, নিজেকে অদ্ভুত দর্শন প্রতিপন্ন করে টিভিতে, পত্রিকায়, বিজ্ঞাপনে প্রতিনিয়ত নিজেদের নানাভাবে বিজ্ঞাপিত করে বেড়ায়। নিজেদেরকে মহান শক্তিশালী প্রমানের জন্য নিজের সম্পর্কে নানা গালভরা অলৌকিক গল্প বলে বেড়াবে, মানুষের মনের কথা বলে দেবে, মানুষকে নানা প্রলোভন দেখাবে, কিছু না করেই অনেক কিছু পাওয়ার লোভ দেখাবে, মনোস্কামনা পূরনের দারুন দারুন উপায় দেখাবে, সুন্দর সুন্দর গালভরা মূখস্থ প্রবচন আবৃত্তি করে শুনাবে, মানুষের প্রবৃত্তি পূরনের সহজ পথ দেখাবে। চোখের জলে বুক ভাসাবে। নিজেকে ঈশ্বর বা স্বয়ং গুরু বলে আখ্যায়িত করে থাকেন উনারা। তাদের মধ্যে অনেকেই ইদানিং জেলের ভাত খাচ্ছে। তুমি যদি বুজরুকি আর চিটিংবাজীতে দক্ষ হতে চাও তবে নিশ্চিন্তে তাদের কাছে গিয়ে দীক্ষা নিতে পার। লেগে থাকলে, - নিষ্ঠাসহকারে তাদের অনুসরণ করলে তাদের মত তুমিও যে একদিন দক্ষ লোকঠকানো ধান্ধাবাজ হয়ে উঠবে,- তাতে কোন সন্দেহ নেই।
তুমি যদি দীক্ষা নিয়ে কিছুই না করতে চাও, যেমন চলছ তেমনি চলতে চাও, বৃত্তি- প্রবৃত্তির মোহ থেকে না বেরোতে চাও, নিজের চলন-স্বভাবে কোন পরিবর্তন না চাও, নিজের গতানুগতিক জীবনযাত্রা থেকে বেরিয়ে আসতে না চাও,- শুধু " আমি দীক্ষিত" এই তকমাটুকু গায়ে মেখে পূন্য অর্জনের ধান্ধায় ঘুরে বেড়াতে চাও,- তবে তার জন্যও ভাল ভাল গুরু পাবে আমাদের দেশে। তারা যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় উত্তরাধিকার সূত্রে গুরু বনে আসছেন। কোন সাধনা-তপস্যা করতে হয় না, নিজের চলা-বলা-জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রিত করার কোন প্রয়োজন নেই, বৃত্তি- প্রবৃত্তির বন্ধনে আবদ্ধ থেকে স্বয়ং হাবুডুবু খেলেও,- তারা গুরু। তাদের রক্তেই নাকি গুরুগিরি প্রবাহিত হয়। তারা সহজ সরল মানুষকে দীক্ষা দিয়ে নিজের পা ধোওয়া জল পান করায়, নিজের সেবা-শুশ্রূষা করায়, নিজে মাছ-মাংস-পেয়াজ-রসুন সব খেয়ে তার স্বপক্ষে নানা যুক্তির অবতারণা করে শিষ্যদেরও তা খেতে উৎসাহিত করেন। তবে তারা একটা জিনিস ভাল পারে,- গীতার ভাল ব্যাখ্যা করতে পারেন,- একেক সময় একেক রকম। নিজের দোষ-ত্রুটি ও প্রবৃত্তিমাফিক চলনের সমর্থনে যখন যা প্রয়োজন তা তারা গীতার শ্লোক থেকে ব্যাখ্যা করে বলে দিতে পার। তাই তুমিও যদি এই বিষয়ে দক্ষ হতে চাও তবে তাদের শরণ নিতে পার।
আবার এমন অনেক গুরুদেবই রয়েছেন যারা দীর্ঘকাল পাহাড়ে-জংগলে- গুহায় কঠোর তপস্যা করে ঈশ্বরোপলব্ধি করেছেন। কৃচ্ছসাধন ও কঠোর তপস্যায় তারা দক্ষ-সিদ্ধ। সাধনান্তে তারা তাদের মত করে ঈশ্বর উপলব্ধি করেছেন,- মানুষের মঙ্গলের নানা পথ উপলব্ধি করেছেন। তারা সেই সাধনালব্ধ অনুভূতি ও উপলব্দি মানুষের মাঝে বিলিয়ে মানুষকে ঈশ্বরমুখী করে তুলেন, মানুষের মঙ্গল সাধন করেন। কিন্তু তারা যেহেতু সংসারত্যাগী,- তাই সাংসারিক মানুষদের মঙ্গল ও উন্নতির পথ তাদের উপলব্দিতে থাকলেও তা মূলতঃ ধারনাপ্রসূত। তুমি যদি কঠোর তপস্যা করে ঈশ্বরোপলব্ধি করতে চাও, সংসার ত্যাগ করে গুহায় বসে সাধনা করে সিদ্ধি লাভ করতে চাও,- তবে অবশ্যি তুমি এমন গুরুর আশ্রয় নাও। তারা তোমাকে সংসারের মায়া- মোহ কাটিয়ে সন্নাসী হতে সাহায্য করতে পারবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
আরেক প্রকার গুরু আছেন,- যাদের বলে সদগুরু। তাঁরা সংসারে অতি সাধারণ জীবের মত থাকেন,- স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে যাদের পুরোদস্তুর সংসারী জীবনযাপন। নিজের মহিমা প্রকাশে যার বিশেষ অনীহা। কোন রঙচং লাগিয়ে, জটা-দাড়ি রেখে, অদ্ভুত সাজে সজ্জিত হয়ে তারা নিজেকে গুরু প্রতিপন্ন করতে চান না। অতি সাধারন মানুষের মতই তারা জীবনধারন করেন। কিন্তু সর্বজীবের প্রতি তাঁদের অপরিসীম-অতুলনীয় প্রেম স্বাভাবিকভাবেই তাঁদেরকে মানুষের ঈশ্বর করে তুলেছে। তাদের ধারন-পালন-সম্বেগসিদ্ধ ব্যাক্তিত্বই তাদের ঈশ্বরত্বের প্রকাশ। কোন অলৌকিক-বুজরুকিতে তারা বিশ্বাস করেন না,- কিন্তু কিভাবে চললে মানুষ আদর্শ সঙ্গতিপূর্ন জীবনের ( Balanced life) অধিকারী হয়ে উঠতে পারে তা উনারা নিজে আচরন করে শিখিয়ে থাকেন- মানুষের জীবনের সমস্যা সমাধানের বাস্তবভিত্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত উপায় বলে যান। তাঁরা বলেন,-" ধর, কর, হও, পাও"। তাঁদের জীবনচলনাই তাঁদের ধর্মগ্রন্থ। ছলে-বলে-কৌশলে সর্বজীবের মঙ্গলই তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য। তাঁরা সাম্প্রদায়িকতার উর্ধে থাকেন,- সমগ্র বিশ্বের সমগ্র মানবজাতিই তাঁদের অনুসরন করে বাঁচা- বাড়ার পথে এগিয়ে যেতে থাকে।পূর্ব্ববর্তী যত যত অবতার-গুরু আছেন,- সকলকেই তিঁনি স্বীকার করে যুগোপযোগী বিধান দিয়ে যান। তাঁর অনুশাসনবাদই তাঁর আশীর্বাদ। তিনি কাউকে পরিত্যাগ করেন না,- যত যত পাপী- তাপী- জ্ঞানী-পূন্যবান-ধনী-গরীব সকলেই তাঁর আশ্রয় ও প্রশ্রয় পায়। তিনি কারো বৈশিষ্ট্য ক্ষুন্ন না করে তাকে উন্নতির পথে তুলে ধরেন। দেশ ও কালের সীমা ছাপিয়ে তিনি বিশ্বের সকলের জীবনের আদর্শ হয়ে উঠেন। তুমি যে যুগে বেঁচে আছ সেই সময়ের যিনি যুগোপযোগী সদগুরু তুমি তাঁরই দীক্ষা নাও। ছেলের স্কুলের টেক্সট বই কেনার সময় যেমন বইটির সর্বশেষ সংস্করনই কিনতে চাও,- কারন এই সর্বশেষ সংস্করনে পূর্ব পূর্ব সমস্ত সংস্করনের তথ্যাবলীর সাথে নতুন অত্যাধুনিক সব তথ্যাবলী সন্নিবেশিত আছে,- তেমনি সদগুরুদের নধ্যে সর্ব্বশেষ যিনি তাঁকে গ্রহন করলে পূর্ব্ব পূর্ব্ব সব সদগুরু ও অবতারদের ও তাঁর মধ্যেই পাওয়া যায়। তুমি তাঁর দীক্ষাই নাও,- বাঁচা বাড়ার প্রকৃত রাস্তা পাবে। তাঁকে ধরলে গুরুত্যাগের কোন প্রশ্ন নেই,- বরং পূর্বে তুমি যে গুরুর আশ্রয়ে ছিলে তাঁর সার্থকতা আসে। ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করানোর সময় তুমি এমন স্কুলই খোঁজ যে স্কুলে শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাস নেয়, পরীক্ষার খুব কড়াকড়ি, খুব পড়াশোনা করতে হয়, ডিসিপ্লিন মেনে চলতে হয়, পরীক্ষায় প্রতি বছর বেশীরভাগ ছাত্র ভাল রেজাল্ট করে। নিশ্চই তুমি এমন স্কুলে ভর্তি করাবে না যে স্কুলে ভর্তি হলেই চলে,- পড়াশোনা না করলে ও চলে, ডিসিপ্লিনের কোন বালাই নেই, শিক্ষকরা ঠিকমত ক্লাস নেয় না, পরীক্ষায় বসলেই পাশ মার্ক দিয়ে উঠিয়ে দেওয়া হয়!!! তেমনি দীক্ষা নেওয়ার সময় ও এমন গুরুরই দীক্ষা নাও,- যেখানে অনুশীলন করে করে যোগ্য হয়ে উঠার সুযোগ খুব বেশী, যেখানে অনুশীলন ও অনুশাসনের খুব কড়াকড়ি, যেখানে শিক্ষক প্রতিটা ছাত্রকে যোগ্য-দক্ষ করে তোলার জন্য তৎপর। যে গুরুর দীক্ষা নিয়ে অধিকাংশ মানুষই নিজেকে ধন্য মনে করে, বুক ফাটো ফাটো হয়ে সারাক্ষণ শুধু তার গুরুর মহিমা বলে বেড়ায়, তার চোখে- মুখে- চলায়-বলায় পরিবর্তন লক্ষ করতে পারছ, - সেই গুরুর দীক্ষা নিলে তুমি ঠকবে না।