ঝরাপাতা
পর্ব - ৩৯
💜💕💜💕💜💕💜
মিলির চোখের সামনে একটা একটা করে দৃশ্য ফুটে উঠছে। যা যা ঘটেছিল, যা ঘটবে বলে ওরা সবাই ভয় পেয়েছিল, যা কিছু নিয়ে কেউ না কেউ আলোচনা শুরু করত। সেগুলো শুনে শুনে ও প্রথমেই কথা বলা বন্ধ করেছিল। বিয়ের কথা হতেই মনে হয়েছিল, রনিদার সঙ্গে কথা বলা দরকার। নিজের বিয়ের কথাই ভাবেনি তখনও পর্যন্ত, পড়াশোনা আর নাচ নিয়েই মেতে ছিল। রনিদার কাছে ক্ষমা চাইবে ভেবেছিল দিদির কাজের জন্য। দুই বাড়ির সম্মান বাঁচাতে যদি বিয়েই করতে হয়, ওকে পড়াশোনা করতে একটু সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ করবে ভেবেছিল। বিয়ে, রনিদার বাড়ি, সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে ওকে একটু সময় দেওয়ার অনুরোধ করবে ভেবেছিল। রনিদার বন্ধু হতে চেষ্টা করবে ভেবেছিল।
সেই কথাগুলো মনে করে আজও একটা গভীর শ্বাস পড়ল, "রনিদার কখনো আমার কথা শোনার সময়ই ছিল না। আমিও যে একটা মানুষ, গোটা মানুষটার জন্যই সময় ছিল না। দিদি বিয়ে করল না বলে রনিদা এভাবে লোক হাসিয়ে চলে গেল !
কবে ফিরে এল রনিদা? ডঃ গিরির চেম্বারে সেই যে দেখেছিলাম প্রথমবার, তখনই কি? কে ফিরিয়ে আনল? আমার অসুখের কথা জানিয়েই ফিরিয়ে আনা হয়েছিল? রনিদা তার মানে আমাকে সুস্থ করার চেষ্টা করছিল এতগুলো দিন? সেইজন্যই বাড়ির সবাই আমাদের দুজনকে একসঙ্গে ঘোরাফেরা করতে দেয়? সেইজন্যই রনিদা জোর দিয়ে বলত, বাড়িতে জিজ্ঞেস করলে আমার নাম বলবে? এই সব তাহলে আমার ট্রীটমেন্টের পার্ট?" এতদিন যে প্রশ্নগুলো মনে উদয় হচ্ছিল, তার সহজ উত্তর হাতড়ে চলেছে মিলি।
আবার ভাবে, "যদি সবটাই ট্রীটমেন্টের জন্য হয়, আমাকে ভালোবাসে বলল কেন রনিদা? সেটা কি সত্যি? আমার ট্রীটমেন্টের জন্য সঙ্গে থাকতে থাকতে আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে? নাকি সেটাও...."
💜💕💜💕💜💕💜
বনি আর পিউ বাড়িতে ঢুকে রনির উপর ফেটে পড়ে। যে রাগ, উত্তেজনা মিলির উপর রনি দেখিয়েছে, তার দশগুণ ফিরিয়ে দেয় ওরা। আর ওদের মুখে এই কাহিনী শুনে মণিকা প্রথমে গুম মেরে থাকে, শেষে বলে, "ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত, সবসময় অতিরিক্ত কথা বলা ছাড়া তুই কি করেছিস বলত? দাদাকে দেখেও কিছু শিখতে পারলি না? যাদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর মুখ রাখিসনি, তারা ভদ্রলোক বলে, তোকে বাড়িতে ঢুকতে দেয় বলে, এই অসভ্যতা করে এলি? মিলি দোষ করেছে কিনা জানলি না, শুনলি না, ওকে শাসন করতে গেলি? তুই ওকে শাসন করার কে?"
রনির মুখে কথা নেই। বনি লাফিয়ে উঠে বলে, "আমি প্রথমদিন দেখে তোকে বলেছিলাম, ডাক্তার বলেছেন, তুই ওর থেকে দূরে থাক। তখন কি বললি? তোর জন্য মিলির কোনো ক্ষতি হবে না। আর আজ কি করলি?"
সবাই যা নয় তাই বলে যাচ্ছে। আরও অনেক রাগ দেখাত ওরা, টুকাইয়ের খাওয়ার সময় হয়ে যেতে, ওর ঘ্যানঘ্যানানি, কান্নায় পিউ উঠে যায়। মণিকা ছেলেকে একবার ধমকেই চুপ করে আছে। পিউ চলে যেতে বনিও আপনমনে ওকে ধমকানো ছেড়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে, এতক্ষণে একটাও কথা বলেনি, এখন খেয়াল হয়। সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে আছে রনি। একটা পা ভাঁজ করে সোফায় তোলা, অন্য পা টা লম্বা করে রাখা। বসার ভঙ্গিতে কেমন একটা নিস্পৃহ ভাব ধরা পড়ে বনির চোখে।
ভাইয়ের কাঁধ ধরে নাড়িয়ে বলতে যায়, "কি রে, তোকে বলছি তো?" গায়ে হাত দিয়েই বোঝে আবার জ্বর এসেছে ওর। খারাপও লাগে, কি না যাচ্ছে ছেলেটার উপর দিয়ে। পাশে বসে ভাইকে জড়িয়ে ধরে বনি, "কি রে, এত বকছি, জ্বর এসেছে বলবি না? তোর প্রবলেমগুলো আমাকে বল ভাই। আজকের কথাই ধর না, সবচেয়ে অপমান তোর হয়েছে। আর তোকেই কাকু যা তা বললেন। তুই অত ধমকালি কেন মেয়েটাকে? আমি গেছিলাম, আমি কথা বলতাম। তাহলে তোর উপর কেউ রাগ করত না। এত করলি তুই মিলির জন্য, তাও তোর নামেই দোষ পড়ল।"
- "আমি দোষ করে ফেলেছি। মিলি বাচ্চা মেয়ে। বন্ধুদের থেকে পিছিয়ে পড়ার লজ্জায় কাজটা করেছে ধরে নিয়েছিলাম। সেটা না করলেই বা আর কি হত?" রনির হাসিটা ভীষণ ফ্যাকাশে লাগে সবার, "তোরা কেউ বুঝিসনি, পলাশ কে? কেন ও এতটা করেছে?"
পিউ ছেলের খাবার নিয়ে এসে বসেছিল সবে। ঘরের তিনজনই এ ওর দিকে তাকায়, কি বলতে চায় রনি? ওরা যে সন্দেহটা মন থেকে তাড়াতে চাইছে, সেটাই রনিও ভাবছে?
মণিকা উঠে এসে ছেলের মাথায় হাত রাখে, "কি হয়েছে রনি? কথা বলছিস না কেন? তোকে নাহয় আমরা একটু বকাবকি করেছি, তাই বলে কি মন থেকে বলেছি রে? বরং রাগারাগি না করে তোর কোনো কথা থাকলে আমাদের বল। আমি নিজে কথা বলব ওদের সঙ্গে।"
- "কেউ ওদের সঙ্গে আমাকে নিয়ে কথা বোলো না মা। আমার উপর সবাই রেগে গেছে, ভালোই হয়েছে। এভাবেই আমার সঙ্গে যোগাযোগটা বন্ধ হয়ে যাবে। দাদা, তুই ঠিক বলেছিলি, আমার মিলির সঙ্গে কথা বাড়ানো উচিত হয়নি।"
- "কি বলছিস এগুলো ! সে যখন বলেছিলাম, তখন অন্য পরিস্থিতি ছিল। তারপর তো আমরা সবাই দেখেছি, মানে ইয়ে আরকি" মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার বলে, "মানে তোকে ভালোবাসে মিলি। আজ রাগারাগি ঝগড়া করেছিস, আমরা আছি তো। কেন এত ভেঙে পড়ছিস? বললাম না কাকিমা বিয়ে ভাঙার কথাই হতে দিল না। মিলির রাগও পড়ে যাবে দেখিস।"
রনি আবার হাসে, কান্নার থেকেও অন্ধকার সেই হাসি, "ওর রাগ ভাঙাস না দাদা, আমি রিকোয়েস্ট করছি। তোরা কেউ বুঝিসনি, নয়ত বুঝেও চোখ বন্ধ করে থাকতে চাইছিস আমার জন্য। পলাশ মিলিকে ভালোবাসে। হয়ত মিলিও।"
রনিকে থামিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে পিউ, "একদম বাজে বকবে না। পলাশের কথা জানিনা। আর পলাশ সত্যিই মিলিকে ভালোবাসাই স্বাভাবিক। তাহলে ওর কাজকর্মের কারণটা বোঝা যায়। মিলি ওকে ভালোবাসে? বলে দিলে? ও তোমার উপর রাগ করেছে বলে এত বড় একটা মিথ্যে বলে দিলে? এই ভালোবাসো ওকে?"
- "বৌদি, রাগ করে বলছি না। পলাশের কথাগুলো শোনার পর বলছি। মিলি মাঝখানের সব কথা ভুলে গেছে, সেটা তোমরা ভুলে গেলে? ওর হয়ত পলাশের সঙ্গে সবে একটা সম্পর্ক তৈরি হচ্ছিল, তার মধ্যে বিয়ে হয়ে এত কাণ্ড হয়ে গেছে। পলাশের কথা আমরা, ওর বাড়ির লোকেরা কেউ জানতাম না বলে ওটাও যে ভুলে গেছে, কেউ টের পাইনি। এটাই ঠিক, আমি বলছি না। কখনো সব মনে পড়লে তবেই জানা যাবে আসল সত্যি। এখন ওর থেকে আমার সরে থাকাই ভালো। ওর জীবনটা সাংঘাতিক জটিল হয়ে যাচ্ছে।"
কেউ কথা বলার মতো জোর খুঁজে পায় না। যদি তাই হয়? রনি মানসিকভাবে কতটা জড়িয়ে পড়েছিল মিলির সঙ্গে, একবার বিয়ে নিয়ে ভাবনা থেকে বেরিয়েও আবার একটু একটু করে মিলির সঙ্গেই গোটা জীবন ছকে ফেলেছে, আজ সকালেও সেকথা নিয়ে আলোচনা হয়েছে ওদের মধ্যে। বনি শুধু শক্ত করে ভাইয়ের কাঁধটা চেপে ধরে রাখে। মনে মনে ভাবে, "কেন আমি ডাক্তারের কথার বাইরে যেতে দিলাম ভাইকে? মিলির সব মনে পড়লে কি হবে ছেলেটার?"
- "লাগছে রে। এ্যাই দাদা আমার কাঁধে লাগছে।" রনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলতে বনির হুঁশ আসে, লোহার আঙ্গুলের মতো ওর হাত আঁকড়ে ধরেছিল রনির কাঁধ।
রনি উঠে দাঁড়ায়, "আমার খুব টায়ার্ড লাগছে। একটু ঘুমোই। আমি রাগ করে নেই। ঠিক আছি আমি। সবটা বুঝতে পেরেছি, মেনেও নিয়েছি। আমাকে নিয়ে টেনশন কোরো না তোমরা।"
💜💕💜💕💜💕💜
পরদিন কলেজে প্রায় একই সময়ে ঢোকে মিলি আর রনি। সমর এসেছে মিলিকে নিয়ে। রনি ছুটিতেই আছে। ওরা বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে ও বেরিয়েছে, বাইকে আগে আগে আসা যাবে। তখনও গায়ে জ্বর। বনির একটুও ইচ্ছে ছিল না, এভাবে ভাইকে ছাড়ার। রনি ওকে কথা দিয়েছে, আজ থেকে কখনো মাথা গরম করবে না। দাদাকে বুঝিয়েছে, দাদা ওর সঙ্গে এলে সমরকাকুর মনে হতে পারে, ও সমরকাকুর সঙ্গে লড়তে এসেছে জোট বেঁধে। ও শুধু প্রিন্সিপাল স্যারের প্রশ্নের উত্তর দেবে। কাউকে নিজে আগ বাড়িয়ে কিছু বলবে না।
বলতে হয়ও না। প্রিন্সিপাল স্যারের ঘরে একটা বিরাট মেলোড্রামা শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে যায়। ভাইস প্রিন্সিপাল, চৈতালী ম্যাডাম, ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের হেড আর এডুকেশন কাউন্সিলের মেম্বারদের সবাইকে নিয়ে প্রিন্সিপাল স্যার মিটিং শুরু করেন। শুরুতেই পলাশ বলে, সব ওর প্ল্যান। অদ্রিজা কোনো কথা জানতই না। ওর বাবা বলেন, ছেলে শুধু রিকোয়েস্ট করতে বলেছিল, বই ছাপানো, রয়্যালটির কথাগুলো উনি বলেছেন। মানতেই হয়, একজন বিজনেস ম্যাগনেটই এভাবে ডীল করে।
অদ্রিজা ক্লিনচিট পেয়ে যায়, রনি একটা কথাও না বলতেই। পলাশকে শাস্তি দেওয়া হয়, এবার ও পরীক্ষায় বসতে পারবে না। পলাশের কোনো দুঃখ নেই। ও বলে, অদ্রিজা যে অপরাধী নয়, এটা সবাই মেনে নিয়েছেন, তাতেই হবে। তবে ওর বাবা তো বটেই, সমরও বলে, বাচ্চা ছেলে, বন্ধুকৃত্য করতে গিয়ে করে ফেলেছে। একবার যদি কনসিডার করা হয়। প্রিন্সিপাল স্যারও এটাই চাইছিলেন। ওকে পরীক্ষায় বসতে না দেওয়া মানে, বিরাট প্রসেস। ইউনিভার্সিটি কাউন্সিল এর তদন্ত করবে। আরও জোরদার শাস্তিও হতে পারে তখন। এখন একটু ভয় দেখিয়ে ছেড়েই দিতে চাইছিলেন। জানতেন, ওরা একটু ধরাকরা, কান্নাকাটি করবে। তাই হাবভাব দেখান, না পারতে ওকে পরীক্ষায় এ্যালাও করলেন।
ছেলে মেয়েরা ক্লাসে যায়। পলাশের বাবা বাইরে এসে সমরের কাছে ক্ষমা চায়। সমর অল্পকথায় মিটিয়ে অফিসের পথ ধরে।
পলাশ নিজে পরীক্ষা দিতে পারবে না সেটাও মেনে নেওয়ায় মিলির ওর উপর থেকে রাগ অনেকখানি গায়েব হয়ে গেছে। তাই বন্ধুদের সামনে ওকে আর কিছু বলে না। এ নিয়ে জানাজানি হলে বেচারা আরও দুঃখ পাবে ভেবে।
ছুটির পর গেটের বাইরে এসে পলাশ নিজেই বলে, "তোকে কিভাবে থ্যাংকস দেব জানি না, এত বড় কাণ্ড কাউকে বললি না, ভাবতেই পারছি না।"
- "আর কখনো এরকম কাণ্ড করিস না পলাশ। এই যে তোর যা কিছু পছন্দ হয়, তাই চাই। যা কিছু ইচ্ছে হয়, তাই করবি। এগুলো বন্ধ কর। এতে তোরই ক্ষতি হচ্ছে।"
- "আর করব না। তোর মতো করে কেউ বলেনি, কেউ আমার পাশে থাকেনি এতদিন। তোর মতো যদি আমার বাড়ির লোকেরা আমার পাশে থাকত, এতকালও করতাম না। সরি অদ্রিজা,আমার জন্য তোকে অনেক কথা শুনতে হল।"
- "ছাড় তো। বন্ধুদের মধ্যে আবার এসব কি।" পলাশের কথার উত্তরে একটুকরো হাসি দিয়ে এই আলোচনা বন্ধ করে এগোনোর জন্য পা বাড়িয়ে দেখে রনি বাইক নিয়ে এসে দাঁড়াল।
চলবে