ঝরাপাতা
পর্ব - ৪৬
💟💕💟💕💟💕💟
খুঁজে খুঁজে বড়বাজারের গলির গলি তস্য গলির ভিতরে যুগলদের এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানির গদিতে হাজির হয় রনি। ও ভেবে দেখেছে, আদতে যুগলের বাবার সঙ্গে কথা বলার দরকার। তিনি এসময় গদিতে। আর বাড়ি ভর্তি লোকজন হবে ওদের বড় ফ্যামিলিতে। ফলে তারা সবাই আলোচনায় যোগ দিলে, ওর কথাগুলো গুছিয়ে বলতে পারবে না।
একটা বহু পুরনো পাঁচরঙা বাড়িতে ঢুকে ঘুপচি আধো অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে উঠে তিনতলায় অফিস। ফরাস এবং চেয়ার, বসার দুরকম ব্যবস্থাই আছে। ওদের অফিসের অংশটার সম্ভবত জানালা ইত্যাদি নেই, বড়বাজারের বহু অফিসের মতো। তাই এসি চলছে।
ঢুকেই রনি যুগলের বাবা মরুৎ সিং এর খোঁজ করে। একটি ওর বয়সী ছেলে সামনে বসা ছিল, সে ঝুলোঝুলি শুরু করে, তাকে বলার জন্য, সে সবই দেখভাল করে, সব করে দেবে রনিকে। কোনোমতে রনি বলতে পারে, ওর দরকারটা ব্যক্তিগত।
অবশ্যম্ভাবী প্রশ্ন আসে, "আপনাকে চাচাজি চেনেন?"
- "না। তবে দরকারটা ওনার। আমি এসেছি কিছু আইন কানুনের ব্যাপারে ওনার সঙ্গে কথা বলতে।" পরিবারের লোক বুঝলেও এই ছেলেটিকে যুগলের নাম রনি বলতে চায় না, তাহলে যদি মরুৎ সিং দেখা না করেই হাঁকিয়ে দেন?
এদিকে ছেলেটি ওকে ট্যাক্স বা ভিজিল্যান্স ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছে ধরে নেয়। এমনিতেই রবিবারের বিকেল, কাস্টমার নেই, সে রনিকে ভিতরের চেম্বারে এনে বসায়, রুম ফ্রেশনার স্প্রে করে, প্রবল হাঁকডাক করে দু তিনজন কর্মচারীকে চা, কফি, কোল্ড ড্রিঙ্কস ইত্যাদি আনতে পাঠায়।
রনি ভিতরের চেম্বারে বসে, কারণ এখানে কথা বলাই ঠিক হবে, তবে এক ধমক দেয়, এভাবে কেন সময় নষ্ট করা হচ্ছে। ওর অন্যকিছু চাই না, শুধু মরুৎ সিংকে চাই।
ছেলেটি হাত কচলে বলে, চাচাজি কি গলদ কাম করেছেন, ও বললে, ওরা সব কাগজ দেখাবে। এবার রনি বোঝে, ছেলেটি ওকে কি ভেবেছে।
ও শান্তভাবে বলে, "আপনি ভুল করছেন। আমি আপনাদের ব্যবসা নিয়ে কথা বলতে আসিনি। আমি পারসোনাল ম্যাটারে কথা বলতে এসেছি। একেবারেই পারসোনাল কথা। সেটা শুধু মিঃ মরুৎ সিং কেই বলব।"
ছেলেটি দ্বিতীয় দফা ভেবলে যায়। ব্যবসা দেখছে বেশ ক বছর। এসব সরকারি লোকের চক্কর ওকে ওর বাবা আর কাকা হাতে ধরে শিখিয়েছে। এসব লোককে বশ করার মন্তর ও সবটাই জানে। কিছুদূর পর্যন্ত সেসব মন্তর ও নিজে এ্যাপ্লাই করবে। তারপর বড়ে ভাইয়া, নয়ত চাচাজি। কিন্তু আজ পর্যন্ত সিং মার্চেন্টের অফিসে পারসোনাল কথা হয়নি।
ওদিকে চা, কফি সব এসে গেছে। এগুলো দেবে নাকি দেবে না, এটাও বুঝতে পারে না বেচারা। রনি এককাপ চা নিয়ে বিনয়ের সঙ্গে বাকি সব ফেরত দেয়।
ছোকরা চেম্বারের বাইরে এসে ফোন লাগায় চাচাজিকে। অফিসের একেবারে শেষ ঘরে খাওয়া দাওয়া করে একটু টানটান হয়েছিলেন চাচাজি, সব শুনে চলে আসেন।
কমবয়সী ছেলেটির মতোই নিখুঁত স্যুট টাইতে রোগাটে গড়নের মরুৎ সিং এই চেম্বারে আসেন। রনি উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে নমস্কার করে, পরিচয় দিয়ে কথা শুরু করতে যেতেই, যুগলের নামে উনি রে রে করে ওঠেন, শ্রেয়ান সরকার কে উনি জানেন না, তার সঙ্গে কোনো কথা নেই। এমনকি বাচ্চা বাঙ্গালী ভেবে আভি নিকালো পর্যন্ত গর্জন করেন।
কমবয়সী ছেলেটি তো বটেই, আরও দুজন এসে দাঁড়িয়েছে চেম্বারের দরজায়। রনি অপমান চেপে শান্তভাবে বলে, "আমিও আপনাকে চিনি না। তবে যুগলের হয়ে কিছু কথা বলতে এসেছিলাম। যেহেতু যুগল আমার ফ্যামিলিতে বিয়ে করেছে, ওকে কোর্টে টেনে প্যা *ন্ট খোলাতাম না। এই এদের সামনেও বলতে চাইনি। আপনাকে আমার কথামতোই কাজ করতেও হতো না, শুধু দশ মিনিট সময় দিয়ে শুনতেন। প্রথমেই শুনলে, এতক্ষণে কথা শেষও হয়ে যেত।"
এরপরেও কাজ হত কিনা সন্দেহ, তবে রনির কপাল বোধহয় ফিরছে, যুগলের ঐ জেঠতুতো দাদা ওদের সলিসিটর ফার্মেও ফোন করে দিয়েছিল, ভিজিল্যান্সের ঝামেলা ভেবে। সেখান থেকে একজন পার্টনার এসে পড়েন এসময়। গোবিন্দ পাটানি রনির কথা শোনেন, কোর্ট শব্দটা শুনেই এদের চোখের ইশারা করেন, কি বলে শোনা যাক।
চেম্বারে গোবিন্দজি, যুগলের বাবা আর জ্যাঠা থাকলেন। বন্ধ দরজার বাইরে পাহারায় জেঠতুতো ভাই, কর্মচারীরা কেউ যেন ঢুকে না পড়ে।
রনি গোবিন্দজিকেই বলে, "যুগল আর লিলির আইনি বিয়ে হয়েছে। ওরা বিয়ের সময় সাবালক ছিল। এখনও কোনো স্ট্রং কারণ নেই বিয়ে ভাঙার। এমনকি লিলি বিয়ে ভাঙতে চাইছে না। সেক্ষেত্রে আপনারা কি চাইছেন?"
- "সেটা আপনাকে বলব কেন? চালাকি করে আমাদের পেটের কথা জেনে যাবেন, বাঙ্গালী এতো চালাক আছে আমরা জানি।" দুলে দুলে হাসছেন গোবিন্দজি।
রনির মুখেও হাসি, "বেশ তো, বলবেন না। বলতে হবেও না। দুটোই তো কথা, যার মধ্যে একটা আপনাদের পেটে আছে। হয় ছেলেবৌকে বাড়িতে ঢুকতে দেবেন না, নয় ডিভোর্স করিয়ে ছেলেকে ফিরিয়ে আনবেন। ডিভোর্সের কেস কিন্তু আমরা করব না। আপনাদের করতে হবে, আর আমরা কনটেস্ট করব।"
- "আপনি আমরা বলছেন কাকে?" মরুৎ সিং নিজেই বলেন। ওরা নিশ্চিন্ত আছে, লিলিকে ওর বাড়ি ত্যাগ করেছে, ও জগতে একা। সেখানে ওর বোনের স্বামী, একলা একটা ছেলেকে ভয় পাওয়ার কি আছে?
- "আমরা মানে মেয়েপক্ষ। আমরা সবাই লিলির সঙ্গে থাকব এবার। দেখুন, আপনাদের ছেলে আমাদের বাড়ির মেয়েকে ভাগিয়ে এনেছে, আইনি বিয়ে করেছে বলে আমরা কিছু করতে পারিনি। ছেলের পিছনে গু *ন্ডা লাগাইনি, মেয়ে কষ্ট পাবে বলে। বিয়েটাই যদি না থাকে, যুগল আমাদের কে?"
- "আপনি আমাদের ছেলের গায়ে হাত তোলার ভয় দেখাতে এসেছেন? জানেন এর ফল কি হবে?" গোবিন্দজি গলা চড়ান।
- "দূর, হাত কেন তুলব? সেটা বললাম নাকি? আমি বললাম, আমরা হাত তুলব না। আমরা ডিভোর্স রোখার জন্য লড়ব। আপনি কি ডিভোর্স ল ইয়ার? আপনি বোধহয় ট্যাক্স কনসালটেন্ট। তাও এটা নিশ্চয়ই জানেন, মেয়ে ডিভোর্স না চাইলে, মেয়ের কোনো দোষ দেখাতে না পারলে, প্রেম করে লুকিয়ে বিয়ে আর ঘর ছাড়ার পর, বছর ঘোরার আগে ডিভোর্স করতে হলে আপনাদের প্রমাণ করতে হবে, ওরা কাপল হিসেবে কমপ্যাটিবল নয়। সে এক লম্বা প্রসেস।"
- "আমরা এরকম কেস বাঁ হাতে মেটাই। ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। এবার আপনি আসুন।" যুগলের জ্যাঠা উঠে পড়েন।
- "ভয় কে দেখাচ্ছে? ভয় দেখালেই আপনারা দেখবেন না জানি বলেই খোলাখুলি কথা বলতে এসেছি। আমি বলে দিলাম, মিউচুয়াল ডিভোর্স হবে না। আর তখন কী পরিমাণ এ্যালিমনি দিতে হবে, সেটা হল আসল কথা, যেটা আমি বলতে এসেছি।"
খানিকক্ষণ কোনো কথা নেই, প্রত্যেকে ভেবে নিচ্ছেন কি বলবেন। রনি ভাবে, "অনেক কষ্টে এদের বাধা পেরিয়ে এই কথাটা অবধি পৌঁছে বলতে পেরেছি। এবার কি করবে সিং সাহাব?"
- "আচ্ছা, সমঝা, আপনি এসেছেন টাকা পয়সায় রফা করতে?" যুগলের জ্যাঠা সরাসরি রনিকে আক্রমণ করেন।
- "একদম না। কোনো রফা হবে না। লিলির যা পাওনা, ডিভোর্স যদি রোখা না যায়, পাইপয়সা পর্যন্ত কোর্টে লিখিয়ে তবেই নেব। এই কথাটা শুধু বলতে এসেছি। আপনাদের যুগলের নাক টিপলে দুধ বেরোয়। তাকে আপনারা সাহস দিয়েছেন, পিছনে আছেন বলেছেন, তাই ও বসে পুরো কথা শুনছে না। অথচ আমরা ওকে পরিষ্কার করে সব জানাতে চাই। আমি খোদ আপনাদের বলতে এলাম তাই। আপনারাই যুগলকে জানিয়ে দেবেন, ও যেন তৈরি থাকে।"
- "ভয়ই তো দেখাতে চাইছ বেটা। যা বলছ, বেসলেস কথা। এ্যালিমনি? যুগলের আছে কি? একটা এক কামরার ঘরও নেই। যে নোকরি করে, সেই মাপেই তো জুরমানা ভরবে।" মরুৎ সিং খলখল করে হেসে ওঠেন।
- "বেটা বললেন, অথচ আমাকে এখনও চিনলেন না চাচাজি? যুগলের কি প্রপার্টি আছে আমি জানি না? আপনাদের এই ব্যবসা তো ফ্যামিলি বিজনেস। সেভাবে পেপার করা। আপনার দাদা, পরদাদার বিজনেস। তাতে যুগলের পার্ট আছে। আপনি যুগলকে ত্যাজ্যপুত্র করলেও যুগল এই ব্যবসা আর বাড়ির ভাগ পাবে। ফ্যামিলি এয়ারলুম গয়নাগাটি পাবে। শুধু আপনার পারসোনাল টাকাপয়সা পাবে না। তাই এ্যালিমনি চার্জ করার সময় আপনাদের পুরো ফ্যামিলি বিজনেস আর প্রপার্টির ভ্যালুয়েশন করাবে কোর্ট। গোবিন্দজি, পেপার যেন ক্লিয়ার থাকে। আপনার এমপ্লয়ার যেন বিপদে না পড়েন।"
- "এ বাবুয়া, তোমার কথায় ভ্যালুয়েশন হবে নাকি?" যুগলের জ্যাঠা খেপে লাল।
- "না, কোর্টের কথায়। আমিই যখন এতটা জেনে এসেছি, আমাদের তরফে যে ব্যারিস্টার থাকবেন, উনি কি করবেন, বুঝে নিন। গোবিন্দজিকেই জিজ্ঞেস করুন, উনি বুঝিয়ে দেবেন, ভ্যালুয়েশন হবেই। প্রপার্টির ভাগ লিলি পাবেই। তখন কি বললেন, এরকম কেস বাঁ হাতে সলভ করেন? মিথ্যে কথা। আপনাদের ফ্যামিলিতে কখনো ডিভোর্স হয়নি। কারণ তাহলে প্রপার্টি ভাগ হবে। এবার ভেবেছিলেন, লিলির কেউ নেই। ওকে শুধু যুগলের চাকরি দেখিয়ে বোকা বানাবেন। অত সহজ নয়।"
- "আপ, আপনি কি চান?" গোবিন্দজি ঢোঁক গেলেন।
- "ফেয়ার ডিল। আপনারা ডিভোর্স চান, অনেক বড় ব্যারিস্টার দেবেন বুঝে গেলাম। তেমনি আমরাও লড়ব বলে গেলাম। আপনাদের ঘরের কথা কোর্টে উড়বে, প্রপার্টি ভাগ হবে, সব করব আমরা, বলে গেলাম। তখন দোষ দেবেন না।" রনি উঠে দাঁড়িয়েছে।
- "কেতো টাকা চান?" যুগলের জ্যাঠার গলাও নিভে গেছে।
- "কোর্টের বাইরে এক টাকাও না। পুরোটার ট্যাক্স দেবে লিলি। ও হ্যাঁ, গোবিন্দজি, আপনিও এদের ট্যাক্স ক্লিয়ার করে রাখবেন। কখন কে জানে বাড়ি আর অফিসে রেইড হবে কেসের সময়। আর থ্যাংকস ফর দ্য টি।" রনি হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসে। মনে মনে বলে, "আমি টাকা নয়, এ্যালিমনি নয়, ড্যামারেজ নয়, যুগলকে ফেরত চাই। কারণ তবেই লিলিও সুখী হবে, এরাও শায়েস্তা হবে। আর আজ সন্ধ্যার মধ্যেই সেটা কমপ্লিট করতেই হবে।"
চলবে