মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-২
রাজা ভঙ্গস্বনের কাহিনি
প্রাককথন
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
রাজা ভঙ্গস্বনের কাহিনি
মহাভারতে বর্ণিত অসংখ্য কাহিনির মধ্যে রাজা ভঙ্গস্বনের কাহিনি যেমন আশ্চর্যজনক তেমনই রোমাঞ্চকর।
অর্জুন কর্তৃক বাণবিদ্ধ হোয়ে শরশয্যায় শায়িত থেকে ভীষ্ম অপেক্ষা করতে থাকলেন সূর্যের উত্তরায়ণ থেকে যাত্রা শুরুর জন্য। সূর্যের উত্তরায়ণ থেকে যাত্রা শুরুর সময় অত্যন্ত পূণ্যলগ্ন, যে সময় ভীষ্ম ইচ্ছামৃত্যু বরণ করবেন।
যুদ্ধের পর— বহুদর্শী ত্রিকালজ্ঞ ভীষ্ম শরশয্যায় রয়েছেন সূর্যের উত্তরায়ণ থেকে যাত্রা শুরুর অপেক্ষায়। এই রকম অবস্থায় প্রতিদিন যুধিষ্ঠির এসে তাঁকে রাজ্য শাসন, রাজধর্ম, প্রজাপালন, সংসারধর্ম, ইত্যাদি বিষয়ে নানারকম প্রশ্ন করেন এবং ভীষ্মের অভিজ্ঞতালব্ধ প্রাজ্ঞতাপূর্ণ উত্তরে প্রভূত সন্তোষলাভ করতেন।
এমনই একদিন অনেক ইতস্তত করার পর যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে প্রশ্ন করলেন, পিতামহ, নারী এবং পুরুষের মধ্যে সংসর্গকালে উভয়ের মধ্যে কার স্পর্শসুখ অধিক হয়, এই বিষয়ে আমার মনে অতিশয় সংশয় সৃষ্টি হয়েছে, আপনি এই বিষয়ে অনুগ্রহ করে আমার সংশয় দূর করুন। মহামতি ভীষ্ম, যিনি সারাজীবনে কখনো কোন নারীকে স্পর্শ করেননি, তিনি এই প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, প্রশ্নটা খুব জটিল বটে, কিন্তু এ-সম্পর্কে রাজা ভঙ্গস্বনের আখ্যান তোমাকে শোনাবো এবং আশা করি শোনার পরে তুমি তোমার উত্তর পেয়ে যাবে। ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে ভঙ্গস্বনের আখ্যান বলতে শুরু করলেন -
“বৎস, অনেক দিন আগে ভঙ্গস্বন নামে এক ধর্ম্মপরায়ণ রাজা ছিলেন, তিনি নিঃসন্তান হওয়াতে সন্তান লাভের উদ্দেশ্যে অগ্নিস্ফুত নামক এক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। অগ্নিস্টুতের প্রতি দেবরাজ ইন্দ্র ছিলেন বিদ্বেষ মনোভাবাপন্ন। ঐ যজ্ঞানুষ্ঠান করার ফলে ভঙ্গস্বন একশত পুত্রের জনক হন। দেবরাজ ইন্দ্র রাজা ভঙ্গস্বনকে পুত্রকামনায় অগ্নিস্টুত যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতে দেখে নিরন্তর সুযোগ খুঁজতে থাকলেন তাঁকে বিপদগ্রস্ত করার জন্য, কিন্তু সহজে কৃতকার্য্য হোতে পারলেন না।
বহুবর্ষ পরে, ভঙ্গস্বনের পুত্রগণ কৈশোরকালে উপনীত হওয়ার পর একদিন মহারাজ ভঙ্গস্বন ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে সপার্ষদ মৃগয়ার উদ্দেশ্যে রাজধানী থেকে বিস্তীর্ণ বনভূমিতে উপস্থিত হোলেন। দেবরাজ ইন্দ্র এই সুযোগে মায়াজাল বিস্তার করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করলেন যে, ভঙ্গস্বন ইন্দ্রের মায়ায় বিভ্রান্তিবশত সঙ্গীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হোয়ে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় যারপরনাই কাতর হওয়ায় ঘোড়ায় চড়ে খাদ্য ও জলের সন্ধানে ইতস্তত ভ্রমণ করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরে রাজা ভঙ্গস্বন স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ্ব জলপূর্ণ পরম রমণীয় একটি সরোবরের নিকটে উপস্থিত হোলেন। তিনি সেই সরোবর দেখা মাত্র ঘোড়ার পৃষ্ঠ থেকে নেমে প্রথমে ঘোড়াটিকে জলপান করালেন, তারপর তিনি জল পান করলেন এবং সেই সরোবরে স্নান করলেন। সেই সরোবরে স্নান করামাত্র তিনি পুরুষ থেকে পরমা সুন্দরী এক নারীতে রূপান্তরিত হোয়ে গেলেন। তিনি শুধুমাত্র নারীতে রূপান্তরিত হোলেন না, নারীসুলভ সমস্ত লক্ষণ ও গুণাবলি তাঁর শরীরে তিনি অনুভব করলেন এবং বিস্মৃত হোলেন সমস্ত পূর্বকথা সহ যে তিনি রাজা ভঙ্গস্বন।
স্ত্রীরূপী রাজা ভঙ্গস্বন সরোবর থেকে উঠে সিক্তবসনে বিক্ষিপ্ত চিত্তে অরণ্যমধ্যে ইতস্তত ভ্রমিতে থাকাকালিন এক সুদর্শন যুবা তাপসের সাথে দেখা হোলে, সেই যুবা তাপস নারীরূপী ভঙ্গস্বনের রূপদর্শনে মুগ্ধ হোয়ে তাঁকে বিবাহ করার প্রস্তাব করায় ভঙ্গস্বন সম্মত হন এবং উভয়ে বিবাহন্ধনে আবদ্ধ হোয়ে দাম্পত্যসুখে কালযাপন করতে লাগলেন। তাপসের সঙ্গে বিবাহের পর অনেকগুলি বছর পার হয়েছে এবং নারীরূপী রাজা ভঙ্গস্বন তাপসের ঔরসে অনেকগুলি সন্তানের জন্মদান করেছেন।
এদিকে রাজা ভঙ্গস্বনের আকস্মিক অন্তর্ধানের পর থেকে সমস্ত প্রকার সম্ভাব্য উপায়ে রাজার আমাত্যগণ, পারিষদবর্গ, আত্মীয়-পরিজন, গুপ্তচরবৃন্দ নিরবচ্ছিন্নভাবে বহুবর্ষ যাবৎ রাজার সন্ধানে নিরত থাকা সত্ত্বেও রাজা ভঙ্গস্বনের কোনোরূপ খোঁজ-খবর পাইলেন না। অবশেষে, রাজ-পুরোহিতের পরামর্শে অন্তর্হিত রাজার বর্তমান অবস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য এক যজ্ঞের আয়োজন করা হয়। এই যজ্ঞের ফলে, দেবরাজ ইন্দ্র আবির্ভুত হোয়ে রাজা ভঙ্গস্বনের বর্তমান অবস্থিতি সম্পর্কে সমস্ত ঘটনা বিবৃত করেন। ইন্দ্রের বক্তব্য শুনে, রাজ-পুরোহিত জানতে চাইলেন কি উপায়ে রাজা ভঙ্গস্বনকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়। জবাবে ইন্দ্র বললেন, আমার বরে প্রধান আামাত্য তাপসের পত্নীরূপী রাজা ভঙ্গস্বনের কাছে গিয়ে তাঁর পূর্বকথা স্মরণ করালে, রাজা ভঙ্গস্বন পূর্বাবস্থায় ফিরে আসতে পারবেন। তবে, পূর্বাবস্থায় ফিরে আসা অথবা বর্তমান অবস্থায় থাকা সম্পূর্ণভাবে তাঁর ইচ্ছাধিন।
দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে রাজা ভঙ্গস্বনের বর্তমান অবস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর, প্রধান আমাত্য অবিলম্বে বনমধ্যে অবস্থিথ তাপসের আশ্রমের উদ্দেশ্যে রওনা হোলেন। তাপসের আশ্রমে পৌঁছানোর পরে তাপসের পত্নীরূপী রাজা ভঙ্গস্বনের কাছে গিয়ে তাঁর পূর্বকথা স্মরণ করাতেই, রাজা ভঙ্গস্বনের সমস্ত কথা মনে পড়ে গেলো। রাজা ভঙ্গস্বনের সমস্ত কথা মনে পড়ে যাওয়ায়, প্রধান আমাত্য রাজাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে বললেন মহারাজ, অনুগ্রহ কোরে আপনি নারীরূপ ত্যাগ কোরে স্বরূপে ফিরে এসে রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করুন। প্রধান আমাত্যের বক্তব্য শোনার পর রাজা ভঙ্গস্বন ধীরে ধীরে বললেন, আমার পক্ষে আর নারীরূপ ত্যাগ কোরে পূর্বাবস্থায় ফিরে রাজা ভঙ্গস্বন হওয়া সম্ভব নয়।
রাজার উত্তর শোনার পর প্রধান আমাত্য বিস্ময়াবিষ্ট স্বরে জানতে চাইলেন, কেন মহারাজ? প্রশ্ন শুনে তাপসের পত্নীরূপী রাজা ভঙ্গস্বন প্রধান আমাত্যকে বললেন, আমি একই জীবনে একদিকে যেমন পুরুষরূপে জীবনযাত্রা নির্বাহ করেছি, রাজকার্য পরিচালনা করেছি, দার পরিগ্রহ করেছি, সন্তানের পিতা হয়েছি, শারীরিক ও মানসিকভাবে সমস্ত পুরুষোচিত আনন্দ ও সুখ অনুভব করেছি, অপর দিকে তেমন নারীরূপে একজন সুদর্শন ও সুপুরুষের পত্নী হয়েছি, স্বামীর ঔরসে অনেকগুলি সন্তানের জন্মদান করেছি ও তাদের লালন-পালন করছি এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে নারীসুলভ সমস্ত আনন্দ ও সুখ অনুভব করেছি। সন্তানের পিতা এবং মাতা এই দুই ভূমিকাতে আমি অনুভব করেছি সন্তানের জন্য পুরষের তুলনায় নারীর অপত্য স্নেহ প্রবল, গর্ভধারণ কোরে সন্তানের জন্মদান ভয়ঙ্কর যন্ত্রণাদায়ক হওয়া সত্ত্বেও আনন্দানুভূতি সীমাহীন। শুধু তাই নয়, মিলনকালে নারী যে অবর্ণনীয় সুখ, আনন্দ ও তৃপ্তি অনুভব করে তা পুরুষের কল্পনাতীত। রতিক্রিয়াকালে নারীর মনে হয় যেন পৃষ্ঠতলে ধরাতল উথাল-পাথাল দুলছে, সমগ্র চরাচর নৃত্যচঞ্চল, আকাশ থেকে তারারাজি উল্কা হয়ে খসে পড়ছে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি পূর্বাবস্থায় ফিরে না গিয়ে এখানে থেকে স্ত্রীধর্ম পালন করবো ও সন্তানদের সস্নেহে লালন-পালন করবো। আপনি ফিরে গিয়ে আমার ঔরসজাত সন্তানদেরকে বলুন তারা যেন মিলেমিশে আপনাদের সহযোগিতায় রাজ্যশাসন করে।“
রাজা ভঙ্গস্বনের আখ্যান বর্ণনা করে মহামতি ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “আশা করি তুমি তোমার প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর পেয়ে গেছো”। যুধিষ্ঠির ইতিবাচকভাবে মস্তক সঞ্চলন করলেন।
______________
(ক্রমশ)