মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১০
রাজা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
রাজা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার কাহিনি
রাজা জনমেজয়ের অনুরোধে বৈশম্পায়ন রাজা যযাতির কাহিনি বর্ণনা করার পর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র পুরুর বংশোদ্ভুত রাজা দুষ্মন্তের কাহিনি বলতে শুরু করলেন।
রাজা যযাতির কনিষ্ঠ পুত্র পুরুর বংশে দুষ্মন্ত নামে এক পরাক্রমশালী রাজা জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সমগ্র পৃথিবী শাসন করতেন। তাঁর দুই স্ত্রী লক্ষণার গর্ভে জনমেজয় এবং শকুন্তলার গর্ভে ভরত নামে দুই পুত্রের জন্ম হয়।
একদিন দুষ্মন্ত প্রভূত সৈন্য ও বাহন নিয়ে গভীর বনে মৃগয়া করতে গেলেন। বহু পশু বধ করে তিনি একা অন্য একটি বনে ক্ষুৎপিপাসার্ত ও শ্রান্ত হয়ে উপস্থিত হলেন। এই বন অতি সুন্দর, নানাবিধ ফুলভরা গাছে সেজে আছে এবং ভ্রমরের গুঞ্জনে ও কোকিলের কুহুতানে মুখরিত। রাজা মালিনী নদীর তীরে কন্ব মুনির মনোহর আশ্রম দেখতে পেলেন এবং সেখানে দেখলেন হিংস্র জন্তুরাও শান্তভাবে বিচরণ করছে।
অনুচরদের অপেক্ষা করতে বলে দুষ্মন্ত আশ্রমে প্রবেশ করে দেখলেন, ব্রাহ্মণরা বেদপাঠ এবং বহুবিধ শাস্ত্রের আলোচনা করছেন। মহর্ষি কণ্বের দেখা না পেয়ে তার কুটীরের নিকটে এসে দুষ্মন্ত উচ্চকণ্ঠে বললেন, এখানে কে আছেন? রাজার ডাক শুনে লক্ষ্মীর ন্যায় রূপবতী তপস্বিনীর বেশে একটি কন্যা বাইরে এলেন এবং দুষ্মন্তকে স্বাগত জানিয়ে সংবর্ধনা করলেন। তারপর মধুর স্বরে কুশল প্রশ্ন করে বললেন, কি প্রয়োজন বলুন, আমার পিতা ফল আহরণ করতে গেছেন, একটু অপেক্ষা করুন, তিনি শীঘ্রই আসবেন।
এই চারুহাসিনী রূপযৌবনবতী কন্যাকে দুষ্মন্ত বললেন, আপনি কে, কার কন্যা, এখানে কোথা থেকে এলেন? কন্যা উত্তর দিলেন, মহারাজ, আমি ভগবান কম্বের দুহিতা। রাজা বললেন, তিনি তো ঊর্ধরেতা তপস্বী, আপনি তার কন্যা কিরূপে হলেন ? কন্যা বললেন, ভগবান কন্ব এক ঋষিকে আমার জন্মবৃত্তান্ত বলেছিলেন, আমি তা শুনেছিলাম। সেই বিবরণ আপনাকে বলছি, শুনুন –
পূর্বে রাজা বিশ্বামিত্র ঘোর তপস্যা করছেন দেখে ইন্দ্র ভীত হয়ে মেনকাকে পাঠিয়ে দেন। মেনকা বিশ্বামিত্রের কাছে এসে তাকে অভিবাদন করে নৃত্য করতে লাগলেন, সেই সময়ে তার সূক্ষ্ম শুভ্র বসন পবনদেব হরণ করলেন। সর্বাঙ্গসুন্দরী বিবস্ত্রা মেনকাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বামিত্র তাঁর সঙ্গে মিলিত হলেন। মেনকার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল , তিনি গর্ভবতী হলেন এবং একটি কন্যা প্রসব করেই তাকে মালিনী নদীর তীরে ফেলে ইন্দ্রসভায় চ’লে গেলেন। সিংহ বাঘ প্রভৃতি হিংস্র জানোয়ার সঙ্কুল জনহীন বনে সেই শিশুকে পক্ষীরা রক্ষা করতে লাগল। মহর্ষি কন্ব স্নান করতে গিয়ে শিশুকে দেখতে পেলেন এবং গৃহে এনে তাকে দুহিতার ন্যায় পালন করলেন। শকুন্ত অর্থাৎ পক্ষীদের দ্বারা রক্ষা পেয়েছিলেন বলে তার নাম রাখা শকুন্তলা হোলো। আমিই সেই শকুন্তলা। শরীরদাতা প্রাণদাতা ও অন্নদাতাকে ধর্মশাস্ত্রে পিতা বলা হয়। মহারাজ, আমাকে মহর্ষি কন্বের দুহিতা বলে জানবেন।
দুষ্মন্ত বললেন, কল্যাণী, তোমার কথায় জানলাম তুমি রাজপুত্রী, তুমি আমার পত্নী হও। এই সুবর্ণমালা, নানা বস্ত্র, কুণ্ডল, মণিরত্ন সব তুমি নাও, আমার সমস্ত রাজ্য তোমারই, তুমি আমার পত্নী হও। তুমি গান্ধর্বরীতিতে আমাকে বিবাহ কর, এইরূপ বিবাহই শ্রেষ্ঠ।
শকুন্তলা বললেন, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমার পিতা ফিরে এলেই আপনার হাতে আমাকে সম্প্রদান করবেন। তিনিই আমার প্রভু ও পরম দেবতা, তাঁকে অবমাননা করে আপনাকে পতিরূপে বরণ করতে পারি না। দুষ্মন্ত বললেন, বরবর্ণিনী, ধর্মানুসারে তুমি নিজেই নিজেকে দান করতে পার। ক্ষত্রিয়ের পক্ষে গান্ধর্ব বা রাক্ষস বিবাহ অথবা এই দুইএর মিশ্রিত রীতিতে বিবাহ ধর্মসংগত, অতএব তুমি গান্ধর্ব বিধানে আমার পত্নী হও। শকুন্তলা বললেন, তাই যদি ধর্মসংগত হয় তবে আগে এই অঙ্গীকার করুন যে আমার পুত্র যুবরাজ হবে এবং আপনার পরে সেই পুত্রই রাজা হবে।
কিছুমাত্র বিচার না করে দুষ্মন্ত উত্তর দিলেন, তুমি যা বললে তাই হবে। মনস্কামনা সিদ্ধ হলে তিনি শকুন্তলাকে দষ্মন্ত তাঁর নামাঙ্কিত একটি অঙ্গুরীয় পরিয়ে দিয়ে বার বার বললেন, সুহাসিনী, আমি চতুরঙ্গিণী সেনা পাঠাব, তারা তোমাকে আমার রাজধানীতে নিয়ে যাবে। এইরূপ প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং কন্ব সবকিছু শুনে কি বলবেন তা ভাবতে ভাবতে দুষ্মন্ত নিজের পুরীতে ফিরে গেলেন।
কণ্ব আশ্রমে ফিরে এলে শকুন্তলা লজ্জায় তার কাছে গেলেন না, কিন্তু মহর্ষি দিব্যদৃষ্টিতে সমস্ত জেনে প্রীত হয়ে বললেন, কন্যা, তুমি আমার অনুমতি না নিয়ে আজ যে পুরুষসংসর্গ করেছ তাতে তোমার ধর্মের হানি হয় নি। নির্জনে বিনা মন্ত্রপাঠে সকাম পুরুষের সকামা স্ত্রীর সঙ্গে যে মিলন তাকেই গান্ধর্ব বিবাহ বলে, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে তাই শ্রেষ্ঠ। শকুন্তলা, তোমার পতি দুষ্মন্ত ধর্মাত্মা এবং পুরুষশ্রেষ্ঠ, তোমার যে পুত্র হবে সে সাগরবেষ্টিতা সমগ্র পৃথিবী শাসন করবে। শকুন্তলা কন্বের নিয়ে আসা ফলগুলি নামিয়ে রেখে তার পা ধুইয়ে দিলেন এবং বললেন, আমি স্বেচ্ছায় রাজা দুষ্মন্তকে পতিত্বে বরণ করেছি, আপনি সেই রাজার প্রতি অনুগ্রহ করুন। শকুন্তলার প্রার্থনা অনুসারে কন্ব বর দিলেন, পুরুবংশীয়গণ ধর্মনিষ্ঠ হবে এবং কখনও রাজ্যচ্যুত হবে না।
কিছুকাল পরে শকুন্তলা একটি সুন্দর মহাবলশালী দ্যুতিমান পুত্র প্রসব করলেন। এই পুত্র কম্বের আশ্রমে পালিত হ’তে লাগল এবং ছ বৎসর বয়সেই সিংহ বাঘ শূকর মহিষ হস্তী প্রভৃতি ধরে এনে আশ্রমের পাশে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখত। সকল জন্তুকেই সে দমন করত সেজন্য আশ্রমবাসীরা তার নাম দিলেন সর্বদমন। তার অসাধারণ বলবিক্রম দেখে কণ্ব বললেন, এর যুবরাজ হবার সময় হয়েছে। তার পর তিনি শিষ্যদের বললেন, নারীরা দীর্ঘকাল পিতৃগৃহে বাস করলে নিন্দা হয়, তাতে সুনাম চরিত্র ও ধর্মও নষ্ট হ’তে পারে। অতএব তোমরা শীঘ্র শকুন্তলা আর তার পুত্রকে দুষ্মন্তের কাছে দিয়ে এস।
শকুন্তলাকে রাজভবনে পৌঁছিয়ে দিয়ে শিষ্যরা ফিরে গেলেন। শকুন্তলা দুষ্মন্তের কাছে গিয়ে প্রণাম করে বললেন, রাজা, এই তোমার পুত্র, আমার গর্ভে জন্মেছে। কন্বের আশ্রমে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলে তা স্মরণ কর, একে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত কর। পূর্বকথা মনে পড়লেও রাজা বললেন, আমার কিছু মনে পড়ছে না, তুমি কে? তোমার সঙ্গে আমার ধর্ম অর্থ বা কামের কোনও সম্বন্ধ হয় নি, তুমি যাও বা থাক বা যা ইচ্ছা করতে পার। দুষ্মন্তের কথা শুনে লজ্জায় ও দুঃখে যেন জ্ঞানহারা হয়ে শকুন্তলা স্তম্ভের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর চোখ রক্তবর্ণ হোলো, ওষ্ঠ কাঁপতে লাগল, তারপর ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, এই বালক তোমার আত্মজ, একে ত্যাগ করতে পারো না।
তারপর ক্রোধ ও তেজ দমন করে বললেন, মহারাজ, তোমার মনে থাকা সত্বেও নীচ ব্যক্তির ন্যায় কেন বলছ যে মনে নেই? তুমি সত্য বল, মিথ্যা বলে নিজেকে অপমানিত ক’রো না। আমাকে যদি পরিত্যাগ কর তবে আমি আশ্রমে ফিরে যাব। তখন দুষ্মন্ত বললেন, তোমার গর্ভে আমার পুত্র হয়েছিল তা আমার মনে নেই। নারীরা মিথ্যা কথাই বলে থাকে। তোমার জননী মেনকা অসতী ও নির্দয়া, ব্রাহ্মণত্বলোভী তোমার পিতা বিশ্বামিত্র কামুক ও নির্দয়। তুমি নিজেও পতিতার ন্যায় কথা বলছো। দুষ্ট তাপসী, তুমি দূর হও। শকুন্তলা বললেন, মেনকা দেবতাদের মধ্যে গণ্যা। রাজা, তুমি ভূমিতে চল, আমি আকাশপথে চলি, ইন্দ্র, কুবের আদি সকলের গৃহে যেতে পারি। যে নিজে দুর্জন সে সজ্জনকে দুর্জন বলে, এর চেয়ে হাস্যকর কিছু নেই। যদি তুমি মিথ্যারই আশ্রয় নাও তবে আমি চ’লে যাচ্ছি, তোমার সঙ্গে আমার মিলন সম্ভব হবে না। দুষ্মন্ত, তোমার সাহায্য না পেলেও আমার পুত্র সমগ্র পৃথিবীতে রাজত্ব করবে। এই বলে শকুন্তলা চ’লে গেলেন।
তখন দুষ্মন্ত অন্তরীক্ষ থেকে এই দৈববাণী শুনলেন - শকুন্তলা সত্য বলেছেন, তুমিই তার পুত্রের পিতা, তাকে ভরণপোষণ কর, তার নাম ভরত হোক। রাজা হৃষ্ট হয়ে পুরোহিত ও অমাত্যদের বললেন, আপনারা দেবদূতের কথা শুনলেন, আমি নিজেও ওই বালককে পুত্র বলে জানি, কিন্তু যদি কেবল শকুন্তলার কথায় তাকে নিতাম তবে লোকে দোষ দিত। তার পর দুষ্মন্ত তার পুত্র ও পত্নী শকুন্তলাকে আনন্দিত মনে গ্রহণ করলেন। তিনি শকুন্তলাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, দেবী, তোমার সতীত্ব প্রতিপাদনের জন্যই আমি এইরূপ ব্যবহার করেছিলাম, নতুবা লোকে মনে করত তোমার সঙ্গে আমার অসৎ সম্বন্ধ হয়েছিল। এই পুত্রকে রাজ্য দেব তা পূর্বেই স্থির করেছি। প্রিয়ে, তুমি ক্রোধবশে আমাকে যেসব অপ্রিয় কথা বলেছ তা আমি ক্ষমা করলাম।
দুষ্মন্ত-শকুন্তলার পুত্র ভরত বহু দেশ জয় এবং বহুশত অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে সার্বভৌম রাজচক্রবর্তী হয়েছিলেন। তার বংশের এক রাজার নাম হস্তী, তিনি হস্তিনাপুর নগর স্থাপন করেন। হস্তীর চার পুরুষ পরে কুরু রাজা হন, তার নাম অনুসারে কুরুজাঙ্গল দেশ খ্যাত হয়। তিনি যেখানে তপস্যা করেছিলেন সেই স্থানই পবিত্র কুরুক্ষেত্র। কুরুর অধস্তন সপ্তম পুরুষের নাম প্রতীপ এবং তাঁর পুত্র শান্তনু।
______________
(ক্রমশ)