Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 6

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৬

দেবতার প্রতি শুক্রের শত্রুতা এবং শুক্রের মহাদেবের উদরে প্রবেশ

 

প্রাককথন

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

 

দেবতার প্রতি শুক্রের শত্রুতা এবং শুক্রের মহাদেবের উদরে প্রবেশ

 

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির মহামতি ভীষ্মকে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “পিতামহ! মহামতি শুক্রাচাৰ্য্য কি কারণে দেবগণের অপ্রিয় ও অসুরগণের প্রিয়কার্য্য সাধন এবং কি কারণেই বা স্বয়ং দেবর্ষি হয়েও দেবগণের শক্তি হ্রাস করেছিলেন? কিভাবে তাঁর শুক্রত্ব ও পরম ঐশ্বৰ্য্য লাভ হয়েছিল এবং কি কারণেই বা তিনি নভোমণ্ডলের মধ্যস্থলে যেতে সমর্থ হন না, এই বিষয়ে জানবার জন্য আমার একান্ত কৌতূহল হয়েছে; অতএব, আপনি কৃপা কোরে এই বিষয়ে সমুদয় বৃত্তান্ত বর্ণনা করুন।”

ভীষ্ম বললেন, “ধৰ্ম্মরাজ! আমি ইতিপূৰ্ব্বে এই বৃত্তান্ত সম্পর্কে যেমন শুনেছি ও যা কিছু জানি, সে সব যথাসম্ভব বর্ণনা করছি, মন দিয়ে শোনো। ভৃগুবংশে মহামুনি শুক্রাচাৰ্য্য জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যে বংশে পরশুরাম দ্বারা মাতৃবধের কারণে দেবতাদের নিতান্ত বিদ্বেষভাজন হয়েছিলেন। যক্ষরাক্ষস অধিপতি কুবের দেবরাজ ইন্দ্রের রাজকোষ রক্ষায় নিযুক্ত ছিলেন। মহামুনি শুক্রাচার্য্য যোগবলে কুবেরের শরীরে প্রবেশ কোরে যোগবলে তাঁকে অবরুদ্ধ কোরে সমস্ত সম্পদ অপহরণ করেছিলেন। ধনপতি কুবের এইরূপে হৃতসৰ্ব্বস্ব হোয়ে একান্ত ব্যাকুল চিত্তে দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে গিয়ে তাঁকে বললেন, ‘মহেশ্বর! ভগবান ভার্গব যোগবলে আমার শরীর মধ্যে প্রবেশ করার পর আমাকে অবরুদ্ধ কোরে আমার সর্ব্বাস্ব অপহরণ কোরে বেরিয়ে গেছেন। মহাযোগী মহেশ্বর কুবেরের এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ঙ্কর ক্রোধে আরক্তনেত্র হোয়ে শূলগ্রহণপূর্ব্বক বারবার বলতে লাগলেন, ‘দুরাত্মা ভার্গব কোথায়?’ ঐ সময় মহাত্মা শুক্রাচার্য্য নিজের উগ্রতর তপস্যার বলে দূর থেকেই মহাদেবের ক্রোধ ও অভিপ্রায় জানতে পেরে মহাদেবের শূলের অগ্রভাগে অবস্থান করতে লাগলেন। তখন ভগবান মহাদেব শুক্রকে সেখান দেখতে পেয়ে পিনাকের ন্যায় শূলাগ্ৰ নিচু করলেন। দেবাদিদেবের শূলাগ্র নিচু করার সঙ্গে সঙ্গে শুক্রাচার্য্য তাঁর হস্তগত হোলেন। তখন মহাদেব শুক্রাচার্য্যকে মুখের ভিতর ঢুকিয়ে নিয়ে গ্রাস করে ফেললেন। মহাত্মা শুক্রাচাৰ্য্য এইরূপে মহাদেবের উদর মধ্যে প্রবেশ কোরে সেখানে পরিভ্রমণ করতে লাগলেন।”

যুধিষ্ঠির বললেন, “পিতামহ! মহাতেজস্বী শুক্রাচার্য্য কি কারণে ভগবান দেবাদিদেবের উদর থেকে বের না হোয়ে সেখানে পরিভ্রমণ করলেন এবং পরিভ্রমণ কোরে সেখানে কি কাজ করলেন, সেই বৃত্তান্ত আমার কাছে বর্ণনা করুন।”

ভীষ্ম বললেন, “বৎস! ভগবান কৈলাসনাথ শুক্রাচার্য্যকে গ্রাস করে জলের মধ্যে প্রবেশ কোরে বৃক্ষের ন্যায় নিশ্চলভাবে বহুকাল কঠোর তপস্যা করলেন। তারপর তিনি জল থেকে উঠে আসার পর পিতামহ ব্রহ্মা তাঁহার কুশল ও তপস্যার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। তখন মহাযোগী মহেশ্বর ব্রহ্মার কাছে নিজের তপস্যার বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা কোরে তপোবলে আপনার তেজ বর্দ্ধিত হোতে দেখলেন এবং নিজের তপস্যা ও ঐশ্বৰ্য্য দ্বারা ত্রিলোকমধ্যে অসাধারণভাবে পরিশোভিত হোয়ে পুনর্বার ধ্যানযোগ অবলম্বন করলেন। মহাযোগী শুক্রাচার্য্য নিতান্ত উদ্বিগ্ন চিত্তে তাঁর উদরের মধ্যে অবস্থানরত অবস্থায় সেখান থেকে বাইরে আসার জন্য বারংবার মহাদেবের স্তব করতে লাগলেন; কিন্তু, কোনো ভাবেই কৃতকার্য্য হোতে পারলেন না। অবশেষে তিনি বারবার মহেশ্বরকে সকাতরে বলতে লাগলেন, ‘ভগবান! আপনি প্রসন্ন হোয়ে আমাকে পরিত্রাণ করুন। আমি আর কষ্ট সহ্য করিতে পারছি না।’ তখন ভগবান মহাদেব নিজের সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার রুদ্ধ কোরে তাঁকে বললেন, ‘ভার্গব! তুমি আমার লিঙ্গদ্বার দিয়ে বেরিয়ে এসো।”

‘‘মহেশ্বর এই কথা বললে, মহর্ষি শুক্রাচার্য্য প্রথমতঃ বাইরে বেরিয়ে আসার পথ দেখতে না পেয়ে কিছুক্ষণ উদরমধ্যে ইতস্ততঃ ভ্রমণ করবার পর অবশেষে দেবাদিদেবের লিঙ্গদ্বার দিয়ে বাইরে এলেন। মহর্ষি ভার্গব মহেশ্বরের লিঙ্গদ্বার দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন বলে  শুক্র নামে বিখ্যাত হয়েছেন। মহাদেবের ক্রোধের কারণে মহর্যি শুক্রাচার্য্যকে আকাশের মধ্যস্থলে কখনই দেখা যায় না। তারপর ভগবান দেবাদিদেব সেই মহাতেজস্বী শুক্রাচার্য্যকে বেরিয়ে আসতে দেখে ভীষণ ক্রোধে শূল দিয়ে তাঁকে বিনাশ করতে উদ্যত হোলেন। দেবী পাৰ্ব্বতী মহাদেবকে ক্রুদ্ধ দেখে বললেন, ‘স্বামী! এই ব্রাহ্মণ আপনার উদর থেকে লিঙ্গদ্বার দিয়ে বেরিয়ে আসবার কারণে আমার পুত্রস্বরূপ হয়েছে; অতএব একে বধ করা আপনার উচিৎ নয়।

“পার্ব্বতী এই কথা বললে, ভগবান মহাদেব প্রসন্ন হোয়ে হাসিমুখে তাঁকে বারবার বললেন, ‘দেবী! আমি খুশী হয়েছি, একে যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে বল।’ তখন মহর্ষি শুক্রাচাৰ্য্য দেবাদিদেব মহাদেব ও দেবী পাৰ্ব্বতীকে প্রণাম কোরে অভীষ্ট স্থানে প্রস্থান করলেন। এই হোলো ভৃগুনন্দন মহাত্মা শুক্রাচার্য্যের বৃত্তান্ত।”

______________

(ক্রমশ)