জঙ্গলের প্রহরী / ২
পর্ব - ২
❤🖤❤🖤❤🖤❤
আজ সকালে এই লোকটির মৃত্যুর কারণ যে চিতাবাঘের আক্রমণ, সেকথা জানাজানি হতেই সবাই বলাবলি করছে, পূর্ণিমার রাতে ঐ পাহাড়ের গা থেকে ঠাকুরাণীর চিতা নেমে আসে, একথা ওরা কবে থেকেই জানে।
পুলিশের স্থানীয় কর্মীদের মধ্যেও একটা ঢিলেমির ভাব চোখে পড়ছে, যেন সমাধান হয়ে গেছে হত্যারহস্যের। ঠাকুরাণীর চিতাই যেখানে অপরাধী, সেখানে তদন্তের দরকারই বা কি? অপরাধীকে তো আর শাস্তি দেওয়া যাবে না।
শুধুমাত্র সিদ্ধার্থ আর ঋষিই জানে বিডি স্যার এখনও এই তত্ত্ব বিশ্বাস করেননি।
♣♥♣♥♣♥♣
আজ থেকে পাঁচদিন আগে
-----------------------------------
রায়চৌধুরীদের এই পুরনো ভাঙা জমিদার বাড়ি আর বাকি জমিজমা দেখভাল করে প্রসাদ। ভাঙা জমিদারবাড়ির আউটহাউজে থাকে ছেলে পল্টনকে নিয়ে। ওর মা মরা ছেলে পল্টন বিশেষ লেখাপড়া করেনি বটে, তবে ছেলে ভাল। বাবার কাছে কাজ শিখে নিয়েছে। দুজনেই রায়চৌধুরীদের মাত্র এক দুবার আসতে দেখেছে। এ বাড়িতে তারা থাকেনি, উত্তরবঙ্গ বেড়াতে এসে একটু পিকনিক মতো ঘুরে গেছে।
এবার একটি বছর পঁচিশের ছেলে এসে হাজির, সঙ্গে বড় তরফের চিঠি, মাসখানেক থাকবে। আউটহাউজের মোটামুটি আস্ত, সেরা ঘরখানায় ওকে থাকতে দেয় প্রসাদ। সামনের জঙ্গলের গ্রাম থেকে রাখু নামে একটা বাচ্চা ছেলেকে ঠিক করে দেয় ওর হাতে হাতে কাজগুলোর জন্য। রান্না প্রসাদ আর পল্টন করে দেবে।
নতুন ছেলে আশীষ বেশ মিশুকে। এক বেলায় ভাব হয়ে যায় পল্টন আর ওর কাজের ছেলে রাখুর সঙ্গে। রোজ ওদের নিয়ে দুমাইল দূরের বাজারে যায়, ডিম, মাংস সব কেনে, সবার জন্য রান্না করতে বলে। এবেলা মাংস, ওবেলা ডিম, রাখু কেন, পল্টনও খায়নি। তার উপরে কত গল্প করে দাদা। সারা পৃথিবীটা সবার জন্য। কেউ কেউ ঠকিয়ে বেশি নিয়ে নিয়েছে।
ওরাও দাদাকে গল্প করে, জঙ্গলে বর্ষায় কেমন পাকিয়ে পাকিয়ে পাহাড়ের জল নেমে সরু শুকনো নালাগুলো ভরে যায়, গাছের পাতা আরও ঘন হয়ে অন্ধকার করে ফেলে। এককোমর আগাছা ঠেলে তখন জঙ্গলে ঢোকা যায় না। কিছুই পাওয়া যায় না। তার উপর শুকনো কাঠ পর্যন্ত মেলে না।
আবার কখনো বলে এই অঞ্চলের সবচেয়ে গা ছমছমে, সবার মুখে মুখে ফেরা কাহিনী, ঠাকুরাণীর চিতার গল্প। এই রায়চৌধুরীদের জমিদারবাড়িরই ছেলে, কোন স্বদেশী নেতাকে এক বিশ্বাসঘাতক ধরিয়ে দিচ্ছিল যখন, তখন একটা চিতা এসে সেই বিশ্বাসঘাতককে মেরে ফেলেছিল। মারবেই তো, সেই হল ঠাকুরাণীর চিতা, ভালো মানুষের রক্ষাকর্তা, দুষ্টুদের যম।
এই গল্প শুনে অবশ্য আশীষ হাসে, বলে, ওদের এই জঙ্গলে এখন আর চিতা নেই। বরং কিসে চিতা বাড়বে তা নিয়ে সরকার ভাবছে। ওরা দুজন গুটিয়ে যায় শহরের বাবুর হাসিতে।
শুধু প্রসাদ বোঝেনা, বেড়াতে এসে ঘর আর বাজার ছাড়া কোথাও বেড়াতে যায় না কেন এ ছেলে? কোনো গলদ নেই তো? চিঠিটা অবশ্য বড় বাবুর হাতেই লেখা। প্রসাদকেও মাঝে সাঝে চিঠি পাঠিয়েছেন উনি, নানা কাজের কথা জানিয়ে।
তবে বলা যায় না, কলকাতায় যদি দু তরফে এই বাড়ি জমি সম্পত্তি নিয়ে লড়াই লেগে থাকে ! এই জঙ্গলে থেকে প্রসাদ তো আর কিছু জানতে পারছে না ! শেষে রাজায় রাজায় লড়াইয়ের মাঝখানে পড়ে গিয়ে কাজটা না যায় ! শুধু কাজ তো নয়, মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও তো এটাই।
প্রসাদ ঠিক করে, একটু সতর্ক থাকতে হবে।
কিন্তু প্রসাদ কিছু টের পাওয়ার আগেই, আশীষ এখানে আসার দুদিন পর পল্টন শুনল, আশীষ চুপিচুপি ফোনে বলছে, কাল ও পূর্ণিমা রাতের জঙ্গলে যাবে।
রাতে বিছানায় মটকা মেরে পড়ে ছিল পল্টন, যত রাতই হোক, দাদা বেরোবেই, ওর বিশ্বাস ছিল। ঠিক, মাঝরাতের পর সামান্য একটা শব্দ। প্রায় দুশোগজ সামনে আশীষকে রেখে অনুসরণ করছে পল্টন। ও জঙ্গলের ছেলে। গাছপালার ছায়ায় জঙ্গলের ভিতরের এই আঁকাবাঁকা পায়েচলা পথে ও আসছে টের পাওয়ার সাধ্য আশীষের নেই।
সামান্য ভিতরে এসেই আশীষ থেমে গেল। একটা শিস দিল, চাপা, থেমে থেমে বাজল, আওয়াজটা ছড়িয়ে গেল না নিস্তব্ধ জঙ্গলেও। গাছের পিছন থেকে বেরিয়ে আসা ঐ লোকটাকে দেখেই চিনল পল্টন। ভিখু আর সুখলালের ঝামেলার পর এই ভিখুকে ধরতে এসেছিল। লোকটা একটা ব্যাগ দিল আশীষকে। কথাবার্তায় পল্টন বুঝল, এই লোকটা একটা কোনো খারাপ কাজ করে। এখন বড় শহর থেকে "অপিসারবাবু" এসেছে, তাই এই দাদাকে কাজে লাগানো হয়েছে, সব সামলাতে।
যে বড় মানুষটা এসেছিল, সে যাওয়ার আগেই একটা অদ্ভুত ডাক, কোনো বড় প্রাণীর গর্জন। জঙ্গলের ছেলে পল্টন সোজা সামনের গাছটায় চেপে বসে। আশীষকে নিতে গাড়ি আসবে, সে জঙ্গলের ধারে এগিয়ে আসে ঐ গর্জন সত্ত্বেও, অন্যজন উঠি পড়ি করে পালায়।
পল্টনের ভয় করছে। আশীষের হাতে ওটা কি, ইস্পাতের নলটা চকচক করছে চাঁদের আলোয়। পল্টন চোখ তুলে তাকায়, গাছপালার মাথার উপর গোল সাদা পূর্ণিমার চাঁদ।