Read Jharapata - 3 by Srabanti Ghosh in Bengali Love Stories | মাতরুবার্তি

Featured Books
  • মুক্তির আশায়

    মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, তার সাথে সাথে মেঘের ডাক আর বিদ্যুতের...

  • ঝরাপাতা - 4

    ঝরাপাতাপর্ব - ৪গোপার কান্নার পর কিছুই চাপার নেই। এতদিন লিলির...

  • Forced Marriage - 2

    শ্বেতার পুরো পৃথিবীটা যেন ঘুরতে শুরু করেছিল। ফোনের ওপারে সেই...

  • LOVE UNLOCKED - 1

    Love Unlocked :1Pritha :"এই যে চাশমিশ নাম কি ?" পাশ থেকে বেশ...

  • মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 121

    মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১২১ ভীষ্মের শরশয্যার কাহিনি   প্রাকক...

বিভাগ
শেয়ারড

ঝরাপাতা - 3

ঝরাপাতা

পর্ব - ৩

🌵🏜🌵🏜🌵🏜🌵

বিয়ের দিন সকালে আলো ফোটার আগে হবু বর আর কনের দু বাড়িতেই দধিমঙ্গলের নিয়ম থাকে। রনির দধিমঙ্গল নির্বিঘ্নে সমাধা হয়। শাঁখের আওয়াজে আশেপাশের বাকি বাড়ির মতো এ বাড়িতেও সকলে বুঝতে পারে। কিন্তু এ বাড়ির তিনটে লোক বা বিয়ের নেমন্তন্নে আসা আত্মীয়রা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে এখানে ওখানে। কারও ওঠার ইচ্ছেটুকুও যেন আর নেই। গতকাল রাতে কাজ সেরে এখানে ওখানে সবাই শুয়েছিল। দুই বোনের নিজস্ব ঘরে চেপেচুপে ওদের আরও দুই মামাতো আর মাসতুতো বোনও ছিল। তিনজনের কেউ টের পায়নি, কখন নিঃশব্দে লিলি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। 

বোনেদের কমন আলমারির গায়ে ম্যাগনেটে আটকানো একটা ছোট হাতচিঠি, 

- "মা, তোমাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি, রনিদার মতো সারাদিন মা মা করা ছেলেকে আমি বিয়ে করতে চাই না। আমি আমার মতো করে জীবন কাটাতে চাই। তাই চলে গেলাম। শুধু শুধু আমাকে খোঁজ কোরো না, লাভ নেই। আমার বন্ধু যুগল সিং রাঠোর আর আমি বিয়ে করেছি কোর্টে। এমবিএ কমপ্লিট করে, ভাল চাকরি পেয়ে বিয়ের ইচ্ছে ছিল যুগলের, আমারও। তোমরা বাধ্য করলে এভাবে বিয়েতে। তোমরা আমাদের আশীর্বাদ করতে পারবে না জানি, তবে বিশ্বাস করো, আমরা ভাল থাকব।" 

যুগলের নাম গোপা আর মিলি শুনেছিল, একসঙ্গে চাকরি করে। ওরা মাড়োয়ারি, রাজস্থান থেকে তিন চার পুরুষ আগে এসেছিল কলকাতায়। প্রথমদিকে তেজারতির কারবার ছিল। এখন এক্সপোর্ট ইমপোর্টের ব্যবসা খুব সম্ভবত। যৌথ ব্যবসা, যৌথ পরিবার। তবে যুগল আর ওর দুই জ্যাঠতুতো দাদা চাকরি করছে। একটু অভিজ্ঞতা বানিয়ে ব্যবসায় ঢোকার ইচ্ছা। একদিনে শোনোনি এসব, গত দেড় বছর ধরে লিলি চাকরিতে ঢোকার পর একটু একটু করে অফিস, কাজকর্ম, কলিগদের গল্পের মধ্যে শুনেছে। 

এত গল্পের কোথাও আভাস ছিল না, যুগলের সম্পর্কে লিলির আসল মনোভাব কি ! আগে বললে, নাহয় যুগলকেই মেনে নিত ওরা ! জাত গোত্রের প্রশ্ন তুলত না। এখন কি করবে? সামনের বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে ! কয়েক ঘণ্টা পর গায়ে হলুদের তত্ত্ব আসবে ! লিলি বাড়িতে নেই কতক্ষণ চাপা যাবে? আর চেপে রেখে লাভই বা কি, কখন কখন আইনি বিয়ে করে ফেলেছে। লিলির আর বিয়েও দেওয়া যাবে না। 

এত কথা অবশ্য মাথায় খেলছে না কারও। বরং শাঁখ আর উলুধ্বনিতে রাস্তা জুড়ে পাড়ার আরও বৌ মেয়েদের নিয়ে জলসইতে পুকুরে যাচ্ছে ওরা, সেই আওয়াজ কানে সিসে ঢালছে। পিউর গলা সবার উপরে। গোপা যে ভয়টা পাচ্ছিল তাই হয়, পিউ কাকে যেন জোরে জোরে বলছে, ওদের বাড়িতে কতদূর কাজ এগিয়েছে খোঁজ নিতে। 

আতঙ্কিত গোপাকে আচমকা হাত ধরে টেনে তোলে ওর বৌদি, "বসে থাকলে হবে না। চলো, অন্য কেউ জানার আগে আমাদের নিজেদের মণিকাদিকে বলতে হবে। এখন কেউ নেই, সবাই ঘাটে গেছে। চলো গোপা।"

সমর রীতিমতো অসুস্থ বোধ করছে, তাকে এরা ঘাঁটায় না। তবে সমরের ভাই, ভাইয়ের বৌ, গোপার দাদা, বৌদি, বোন, ভগ্নীপতি সবাই মন শক্ত করে সামনের বাড়িতে পা রাখে। গোপাকে জোর করে ধরে এনেছে, মিলি আর ছেলেমেয়েরা বাড়িতে, সমরের কাছে। 

🌵🏜🌵🏜🌵🏜🌵

বনি আর ওর বড়মামার ছেলে গেছে মেয়েদের নিয়মকানুনের ছবি তুলতে। এতগুলো লোককে রনিই দরজা খুলে দেয়। তখনই খটকা লাগে ওর। মণিকা উঠে আসতেই গোপা ডুকরে কেঁদে ওঠে। কিছু না জেনেই মণিকা প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায়, থরথর করে কাঁপছে। রনি মাকে তাড়াতাড়ি বসিয়ে দেয়। মায়ের হাত ধরে দাঁড়ায় পাশে। 

গোপার দাদা শ্যামলই সাহস করে কথা শুরু করে। ভগ্নীপতি মনোজও পরে খানিকটা বলে। মণিকা ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের মানুষগুলোর দিকে। একটা কথারও বোধহয় অর্থ বোঝেনি। 

তবে ক্ষেপে ওঠে রনি। মায়ের এই অবস্থা দেখেছিল সেই ছোটবেলায়, বলা ভাল অবোধ বয়সে। দাদা, মামার বাড়ির সবাই ঐ কথা আলোচনা করে, শুনে আসছে। বছরের পর বছর মায়ের প্রতি ঠাকুমা আর পিসিদের স্পষ্ট ছুঁড়ে দেওয়া বাক্যবাণ শুনেছে। তাদের মুখে শুনেছে যে মা অপয়া, তাই বাবাকে চলে যেতে হয়েছে। তবেই এতগুলো বছর ধরে সেই কাঁটাটা গেঁথে আছে মনের গভীরে। একটা বয়সের পর দুই ভাই মায়ের বারণ না শুনে প্রতিবাদ করেছে। ওদের প্রতিবাদেই আক্রমণের তীব্রতা কমেছে। তবুও টের পেত, ছেলেদের সঙ্গে সখ্যতার পরেও মা একলা। সেই জায়গাটা ক্রমশ ভরাট করেছে পিউ, ওর বৌদি। 

লিলিও পাড়ার আর পাঁচটা মেয়ের মতোই রনির চোখে, বিশেষ কেউ ছিল না কখনোই। অগ্রপশ্চাৎ কিছুই না দেখে রনির তরফে এই বিয়েতে মত দেওয়ার একটাই কারণ, মা আর বৌদির সঙ্গে লিলি এবং ওর পুরো পরিবারের ভাল সম্পর্ক। লিলির সঙ্গে আলাদা করে কথা বলার কোনো চেষ্টাই করেনি, ধরে রেখেছিল, যেগুলো এই বিয়ের প্লাস পয়েন্ট বলে অন্যরা মানছে, লিলিও সেজন্যই মত দিয়েছে। বিয়ের কেনাকাটা করতে কখনও কখনও উভয়পক্ষ একসঙ্গে গেছে। লিলি খুশি বা অখুশি কিছুই জাহির করেনি। বৌদি ঠাট্টা তামাসা করলে ও হেসে ফেলেছে, লজ্জা পেয়েছে, লিলি কটমট করে তাকিয়েছে। সেটাকেও স্বাভাবিক লজ্জার প্রকাশ বলেই ধরেছে। 

অথচ এখন এমন একটা পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করিয়েছে সেই মেয়ে। কাকে কি জবাব দেবে ওরা? কয়েক ঘন্টা পর বিয়ে, কয়েকশো লোকজন, ওদের সকলের বন্ধুবান্ধব, কলিগরা আসছে। তাদের জনে জনে ওরা হাতজোড় করে বলবে, বিয়েটা হচ্ছে না, কারণ বিয়ের কনে.... 

- "অদ্ভুত মেয়ে তো আপনাদের ! মায়ের সঙ্গে এত গল্প, আমার বৌদির সঙ্গে এত গল্প ! দিব্যি ওদের সঙ্গে বিয়ের কেনাকাটা করেছে। যে কাউকে তো বলতে পারত, বিয়ে করবে না। আজ এখন যদি মা অসুস্থ হয়ে পড়ে?'' রনির চীৎকারে লিলির মামা, মেসো চুপ করে যায়, সত্যিই বলার কিছু নেই। 

গোপা আবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলতে থাকে, "একবার বলেছিল বিয়ে করবে না। আমরা বোঝালাম, আমি বোঝালাম, তোমার কাকু বোঝালো...... "

- "বোঝালে? তোমরা ওকে বোঝালে? মাথা খারাপ তোমাদের? কি করে এটা পারলে? এতবড় একটা কথা গোপন করে আজ আমাদের সর্বনাশ করে দিলে কাকিমা?"

মণিকাও বলে ওঠে, "আমার যে সর্বনাশ হয়ে গেল গোপা। এবার আমার ছেলেটাকে নিয়ে পাঁচজন হাসাহাসি করবে। আমার ছেলেদের নামে কেউ কোনোদিন একটা কথা বলতে পারেনি। আমার ছেলেরা যেখানে গেছে, আমাকে লোকে শুধু প্রশংসা করেছে ওদের নামে। আমার এই ছেলেটা তোমাদের কি ক্ষতি করেছিল বলো? আমার উপর রাগ থাকলে, আমার উপর প্রতিশোধ নিতে। এখন কি হবে?"

মাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে রনি, "মা, তুমি শান্ত হও। আমার কিচ্ছু হয়নি।"

এদিকে পিউ আর বাকিরা ফিরছে, মুহুর্মুহু শাঁখ আর উলুধ্বনি, সঙ্গে মেয়েকণ্ঠে কথার উপর কথা। প্রথমে সেসব খেয়ালই করেনি বাড়ির ভিতরের লোকেরা। একেবারে দোরগোড়ায় শাঁখের আওয়াজে মণিকা তাড়াতাড়ি চোখ মোছে, গোপা তখনও বলে যাচ্ছে, "আমরা বুঝিনি দিদি, আমরা একটুও বুঝিনি। আমি কিচ্ছু জানতাম না। তোমার দেওরও এখন আমাকে বলছে, মা হয়ে আমি কেন খবর রাখিনি। সেসব চেঁচামেচি করেই তো অসুস্থ হয়ে পড়ল মানুষটা।"

- "কে অসুস্থ হয়েছে কাকিমা? কি হয়েছে মা? তুমি এরকম করছ কেন? মায়ের কি হয়েছে রে ভাই?" খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে এসেছে সবাই। সামনে হলুদ পাঞ্জাবি পরা বনি, কোলে ওই রকমই পাঞ্জাবি পরে বাবার সঙ্গে ম্যাচিং সাজে টুকাই। পাশে লালপাড় হলুদ তাঁতের শাড়ি গয়নায় ঝলমলে পিউ কাঁখে একটা পিতলের কলসিতে জল নিয়ে দাঁড়ানো। 



চলবে