ঝরাপাতা
পর্ব - ১৫
🌷🌿🌷🌿🌷🌿🌷
- "আপনি ঠিক বলছেন ম্যাডাম। আমার বড়মেয়ে যে অন্যায় করেছে, তার জন্য দুটো পরিবারের সবাই মিলে শাস্তি ভোগ করার কোনো মানেই হয় না। আমরা একটা ভুল করে, সেটাকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের এবার এই কথা থেকে বেরোতে হবে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে, অদ্রিজা আর শ্রেয়ান, দুজনেই যেন ভালো থাকে। সে আলাদা হয়ে ভালো থাকলে তাই সই।" গোপা মন শক্ত করে নিয়েছে।
- "ভেরি গুড মিসেস করগুপ্ত। এবার আমরা নতুন করে শুরু করি চলুন। আমি এখন অদ্রিজার কন্ডিশনটা দেখে নিচ্ছি। সব ঠিক থাকলে, ওকে এ ঘরে আনব। মিঃ শ্রেয়ান বা বাকিদের ও কিভাবে নেয় দেখি। সেই অনুযায়ী ওর বন্ধুদের সঙ্গেও ওকে সময় কাটাতে দেবেন। তারপর কলেজ।" ডঃ গিরি চলে গেলেন।
🌷🌿🌷🌿🌷🌿🌷
আজ অন্ধকার থাকতে উঠে বাসী জামাকাপড় ছেড়ে সবাই জড়ো হয়েছে নিচের বসার ঘরে। অবশ্য সবাই বসে নেই। কেউ কেউ সোফায় আধশোয়া। যেমন, সমর, অঙ্কুর, মিলি। এভাবেই গড়িয়ে গড়িয়ে ওরা রেডিওতে মহিষাসুরমর্দিনী শোনে বরাবর। আর এই আনন্দটুকুর লোভে আগের রাতে অমর, দীপা, অঙ্কুর চলে আসে এ বাড়িতে।
দুই ভাইয়ের সম্পর্ক খুবই ভালো। তবে পৈত্রিক বাড়িটি খুব বড়সড় নয়। তাই ওদের বাবা আলোচনা করে বাড়ি লিখে দিয়েছিলেন অমরকে। সমর টাকাপয়সার ভাগ পেয়েছিল। কাছাকাছি জমি কিনে বাড়ি করে চলে এল ওরা। এই দুই ভাই, আর পরের প্রজন্মেরও ভাব ভালবাসা রয়ে গেল একই। বাড়ি তৈরির পর প্রথম বছরে গোপা বলেছিল, রাতে এ বাড়ি চলে আসতে। সকালে দুই ভাই একসঙ্গে তর্পণ করতে যাবে। তা সেই নিয়ম বহাল হয়ে গেছে।
এবছর অবশ্য কারও মন ভালো নেই। কেবল মিলি যাতে কমফোর্টেবল থাকে, তাই সব একরকম হচ্ছে। এই তো বৈশাখ মাসে বিয়ে হল, আর পুজোর সময় ওরা ভাবছে, মেয়ে সুস্থ হবে তো? মনমেজাজ আর কি করে ভালো থাকে?
🌷🌿🌷🌿🌷🌿🌷
তবে মিলির ব্যাপারে ডঃ গিরি সম্পূর্ণ আশা দিচ্ছেন। ওরাও দেখছে, মেয়ে এখন কম কথা বললেও আত্মীয়দের সঙ্গে সবার মাঝে থাকে। সেদিন ওর সঙ্গে থেরাপি রুমে কথা বলে ডঃ গিরি ওকে নিজের চেম্বারে নিয়ে এলেন। ততক্ষণে ওর এ্যাসিস্টেন্ট বড় আলো জ্বেলে দিয়েছে চেম্বারে।
মিলিকে নিয়ে ঢুকে উনি বললেন, "এই দেখো অদ্রিজা, তোমার চেনা লোক। ওদেরও তোমার মতো জ্বর হয়েছিল। তবে প্রথমে চিকিৎসা হওয়ায় ওরা এখন সুস্থ। তুমিও এরকম সুস্থ হয়ে যাবে। খুব শিগগিরই কলেজে যাবে। বোসো।"
মিলি বসল, চিকিৎসা শুরুর তিনমাস পরেও মিলির চেহারা দেখে মণিকার বুকের মধ্যে হু হু করে উঠল, "সারাজীবন আমার উপর হওয়া অত্যাচারগুলো মেয়েদেরই বেশি বেশি করতে দেখেছি। তারপরও মিলিকে না মেয়ে বলে ভেবেছি, না একটা আস্ত মানুষ বলে ভেবেছি।"
রনি ওর দিকে মুখ তুলে তাকাতেই সাহস পাচ্ছে না। বনি ওর শুকনো মুখটা দেখে ভাবছে, কে বলবে এই মেয়েটা পিউর গানের সঙ্গে না নাচলে ওদের পাড়ায় কোনো অনুষ্ঠান জমে না? ঐ অভিশপ্ত দিনটার আগের দিনও দিদির বিয়েতে কি পরবে, কি সাজবে, ঝলমলে মুখে গল্প করছিল?
মিলিও মাথা নিচু করে বসে আছে। ডঃ গিরি বললেন, "তোমাকে তো আমি নিজেই বলেছি, যখন তোমার অত জ্বর ছিল, তোমার দিদি ওর বন্ধুকে বিয়ে করেছে। তাই ওরা আর তোমার দিদির শ্বশুর বাড়ির লোক নয়। তুমি অত ফর্মাল হতে হবে না।"
পিউ ইশারাটা বোঝে, মিলির হাত ধরে বলে, "আমরা আবার আগের মতোই থাকব রে। পিউবৌদির সঙ্গে তোর গল্প বন্ধ করিস না।"
🌷🌿🌷🌿🌷🌿🌷
তারপর মিলি আরও দুটো থেরাপি সেশন এ্যাটেন্ড করে ফেললেও, ও বাড়ি যায়নি এখনও। কেউ যাওয়ার কথা তোলেনি ডাক্তারের পরামর্শে। মিলির যাতে বিয়ে হয়ে আসার কথা মনে না পড়ে। তবে রনি বাদে সবাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এ বাড়ি এসেছে। মিলি উঠে যায়নি, বসে কথাবার্তা শুনেছে।
পুজো এসে যেতে কলেজে পাঠানো হয়নি, ছুটির পর যাবে। ইতিমধ্যে অঙ্কুর ওদের বাছাই কজন বন্ধু, যারা লিলির বিয়ে উপলক্ষ্যে নিমন্ত্রিত ছিল, ঝঞ্ঝাটের কিছু হলেও জানে, তাদের কাটছাঁট করে মিলির কাহিনী বলে রেখেছে, কেউ যেন বিয়ের কথা না তোলে।
মিলিকে নিয়ে পুজোর বাজারের ভিড়ে ঘোরা সম্ভব নয়। গোপা স্থানীয় দোকানে নিয়ে গিয়ে কয়েকটা নিত্য কলেজে পরার জামাকাপড় কিনে দিয়েছে। বিয়েতে তো ভালো ভালো শাড়ি জামা কতরকম কেনা হয়েছিল। পিউ সেসব যত্ন করে তুলে রেখেছে। বিয়ের জিনিস ওর সামনে আনা হবে না।
তবে পুজো শপিং দেখার নাম করে একদিন ওর বন্ধুরা এল অঙ্কুরের সঙ্গে। মিলি টুকটাক কথাও বলল। জামাকাপড় দেখে, গোপার হাতের চাউমিন আর সমরের আনা রসগোল্লা খেয়ে, মিলিকে জলদি কলেজ যেতে বলে ওরা চলে গেল। সবাই হাঁফ ছাড়ল, এভাবে চললে, পুজোর পরই কলেজ।
🌷🌿🌷🌿🌷🌿🌷
আজ মহালয়ায় তর্পণ করবে বলে, আগের দিন থেকেই সমররা দুই ভাই নিরামিষ খায়। লিলি, মিলি, অঙ্কুর একদমই রাজি হয়না। বরং ওরা একজায়গায় হয় বলে এটা ওটা বানিয়ে দেয় মায়েরা। খেতে খেতে আড্ডা দেয়। এবার গোপা বলেছিল, ওর শরীর ভালো নেই, বিরিয়ানি কিনে আনতে। মিলি বলল, ওর লাগবে না। কেন কেন? সবাই চেপে না ধরলেও আলগা আলগা ভাব দেখিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন করে।
মিলি যা বলে, সবার পক্ষে চোখের জল সামলানো মুশকিল হয়ে যায়। মিলি বলে, দিদিই তো বিরিয়ানি সবচেয়ে ভালোবাসত। আমিষ খাবারের বায়না দিদিরই বেশি ছিল। দিদি যখন বাড়ি নেই, ওর লাগবে না। অঙ্কুরের আনলেই হবে।
গোপা বলে, বিরিয়ানি আনা হবেই, চারজনই খাবে। পরের দিন, মহালয়ায় ও পোলাও মাংস রান্না করবে। সবাই বোঝে, লিলির উপর রাগে। তবে মিলির এই বাড়ির সবার আদর যত্নে দিদির বিয়ের মনখারাপটা হালকা হয়।
মহালয়ায় দুপুরে রান্নাঘরে মা আর কাকিমার সঙ্গে গল্পও করল। তাতেই ওরা আড়ালে ঠিক করল, মিলিকে পুজোয় ভিড়ে না হোক, পাড়ার প্যান্ডেলে নিয়ে যেতেই হবে। পাড়াতেও গোপাকে আগের মতো পিউ বা মণিকার সঙ্গে দেখে আজকাল সবাই। মিলি যে একটা সামাজিক অসম্মানের ভয় থেকে মানসিক চাপে এমন হয়ে গেছে, এটা মণিকা আর পিউ সময় সুযোগ হলেই বলতে থাকে। যারা ভালো মনের মানুষ তারা একদিকে মিলি আর পরিবারের পাশে দাঁড়ায়। অন্যদিকে সমালোচকদের মাঝে মাঝে উচিত কথাও শুনিয়ে মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে মিলি এখন পাড়ায় অল্প অল্প করে বেরোতে শুরু করতে পারে। ঘরে লুকিয়ে থাকা আর নয়। পুজোর ঘোরাঘুরি নিশ্চয়ই ভালই লাগবে ওর।
ওদিকে বাড়ির সবার জন্য নতুন জামাকাপড় কিনতে গিয়ে মণিকা আর পিউ দুজনেরই মনে পড়ে মিলির কথা। সব ঠিক থাকলে আজ মিলিও আসত ওদের সঙ্গে। মিলি নাকি লিলি, কে আসত সব ঠিক হলে? কোনটা ঠিক তাই বা কে বলে দেবে?
চলবে