Read Jharapata - 21 by Srabanti Ghosh in Bengali Love Stories | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

ঝরাপাতা - 21

ঝরাপাতা

পর্ব -২১

🌹🌿🌹🌿🌹🌿🌹

বৌভাতের রাতে মিলির কাছ থেকে পালানোর নামে, একরকম নিজের কাছ থেকেই পালিয়ে গেলেও বাড়িতে ফেরার উপায় হল রনির। ফিরে এসে দেখল, যার বিশ্বাসঘাতকতার হাত থেকে পালাতে হবে ভেবেছিল, ওরই বিশ্বাসঘাতকতায় সেই মেয়েটি, ওর মনে আজও যার প্রতি নিজের সব ভালোবাসা লুকিয়ে রেখেছে, সেই মেয়েটি ভেঙেচুরে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে। সেই মিলিকে দেখে ও নিজে কতটা ভেঙে যাচ্ছে প্রতিদিন, কাউকে বোঝাতেও পারবে না, কেউ বুঝবেও না ওর এই ব্যর্থতা। তাই সেই ক্ষত লুকিয়ে হারিয়ে যাওয়া মিলিকে ওর বাবা মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু নিজে আর তাকে পাবে না জেনে গেছে। 

আর এখন নিজের ঘরে এই নে *শা আর নে *শা কাটার মাঝখানে অদ্ভুত একটা মানসিক অবস্থায় চোখ বন্ধ করে সেই মুখটা মনে করার চেষ্টা করে ও। লাল বেনারসি পরা সদ্যবিবাহিতা মিলির মুখের সঙ্গে তাঁতের শাড়ি পরে ঠাকুর বরণের সিঁদুর পরা মিলির মুখ একাকার হয়ে যায়। ওর নে *শা *গ্র *স্থ মস্তিষ্ক দুদিনের ছবি আলাদা করতে পারছে না। নাকি সেই ছবি আসলে ওর স্বপ্নের ছবিটা? ধুর বাবা, কিছুই যে পরিষ্কার করে বুঝতে পারছে না ! 

আসলে আবার যে কাল ওর সব গোলমাল হয়ে গেল মিলিকে দেখে ! মিলিকে আবার দেখে বুকের ভিতরে যে কি হচ্ছিল ! এই মিলিকে তো ওর সঙ্গে করে অঞ্জলি দিতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল এবছর ! গোটা পুজো একলা একলা উদভ্রান্তের মতো সবাইকে ভুল বোঝাতে সবার সঙ্গে না ঘুরে, মিলির হাত ধরে অনেক অনেক পথ হেঁটে যাওয়ার কথা ছিল ! নাকি সেটা আর কখনো হবে না ওর জীবনে ! আজও ওর ভয়ের মীমাংসা হয়নি, মিলির মনে কি কেউ আছে, বিয়ের আগে থেকেই? গতকাল সিঁদুরে রাঙানো মিলির মুখটা দেখে তাই ওর বুকের মধ্যে নতুন করে মুচড়ে উঠেছিল, ওর পরানো সিঁদুর মিলি মুছে ফেলেছে, আগেই দেখেছে। এই নতুন করে সিঁদুর পরল কি সেই পুরনো মানুষটার কাছে ফেরার প্রথম ধাপে? 

রনি ভেবে পাচ্ছিল না, আর কতদিন ওকে এভাবে অপেক্ষা করতে হবে সত্যিটা জানতে? যে সত্যি ওর দিকে ঝুঁকে নেই, যে সত্যি মিলির পাশে আর কাউকে এঁকে দেবে? সেদিন ও কি করবে? এখনই বা কি করবে? এই প্রতীক্ষার ভার কি করে বয়ে নিয়ে যাবে? যে প্রতীক্ষার শেষে শুধু ওর অপেক্ষার অধিকারও ফুরিয়ে যাবে, আর কিছুই হবে না? 

ভেবেছিল বন্ধুদের সঙ্গে কিছুটা টাইম পাস করলে এখনকার মতো মিলিকে ভুলতে পারবে, আজকের রাতটা পার হয়ে যাবে। বাড়িতে হয়ত সবাই খেপে আছে, তবে সত্যিই ওর রাতটা পার হয়ে গেছে। এখনও বাকি আরও কত দিন, কত রাত ! 

হাতড়ে হাতড়ে চেপ্টে যাওয়া সি *গা *রে *টের প্যাকেট আর লাইটারটা বের করে প্যান্টের পকেট থেকে। দাদা শুধু কোমরের বেল্ট খুলে দিয়েছে। জামাকাপড় ছাড়তে হবে, স্নান করতে হবে। চা চাইতে গেলে বৌদি আজ মা *র *বে। নিজেকে কোনোমতে টেনে তুলে বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারটা খুলে তার তলায় মাথা পেতে দেয়, জামাকাপড় পরেই। 

প্রায় অর্ধেক ট্যাঙ্কের জল মাথায় ঢেলে, দাঁত মেজে রনি যখন বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল, তখন পানীয়ের ঘোর কেটে আগের সন্ধ্যার মতো সম্পূর্ণ মিলিকে নিয়ে চিন্তার ঘোরে ডুবে আছে ও। জামাকাপড় নিয়ে যায়নি স্নান করতে, তোয়ালেটা জড়িয়ে বেরিয়েছে। এখন বহুক্ষণ বেছে আলমারি থেকে একটা জিনস আর টি শার্ট বের করে পরল। মাথায় ঘুরছে, একবার কোনোভাবে মিলির সঙ্গে দেখা করা যায় না? মিলিকে একবার দেখতে পেলে হয়ত কিছুটা শান্তি লাগত। 

জামাকাপড় পরার পর আর করণীয় কিছু নেই। বারান্দায় গিয়ে সি *গা "রে *ট ধরিয়ে চুপ করে ওদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। জানালাগুলোর পর্দা টানা। দোতলায় ওদের মতো প্রতি ঘরের সঙ্গে গোল গোল ব্যালকনি নয়, একটানা বারান্দা। তাতে বেরোনোর তিনটে দরজাই বন্ধ। রনির মনে হচ্ছে, মিলির জীবনের সব দরজা ওর জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। মুখের ভিতরের তিতো ভাবটা বাড়ছে। 

🍃🍂🍃🍂🍃🍂🍃

হঠাৎ ও সোজা হয়ে দাঁড়ালো, লিলি, লিলি এসেছে ও বাড়িতে। রাস্তা দিয়ে যখন এল, রনি খেয়াল করেনি। এখন গেট খুলে ঢুকল লিলি আর একটি তরুণ। নিশ্চয়ই ওর বর। উত্তেজনায় রনি একবার নিজের মুখটা ডলল হাত দিয়ে। এমনিতেও সি *গা *রে *ট টা তিতকুটে লাগছে ওর মুখে, ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কি হয় দেখতে থাকল। 

নিজেই বুঝতে পারছে, এভাবে নজর রাখাটা অসভ্যতা। মিলিকে খুঁজছিল, তারও নাহয় যুক্তি আছে, মিলিকে ও বিয়ে করেছে। লিলির সঙ্গে যা হবে সেটা ওদের একান্ত পারিবারিক ব্যাপার। এবং এই ঘটনার সঙ্গে ওর নামও যুক্ত আছে বলে ওর সরে যাওয়াই উচিত। ওকে কেউ এখন ব্যালকনিতে দেখলে ওর রুচিবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। কিন্তু বিপুল একটা আগ্রহ বুকে নিয়ে রনি দাঁড়িয়েই রইল। 

যা ভেবেছিল তাই। গোপা দরজা খুলে লিলিকে দেখে ঘরে ঢুকতে দিল না। অপমান জনক কথাবার্তাও বলে থাকবে। খুব একটা স্পষ্টভাবে ও শুনতে পেল না। বেশ খানিকক্ষণ কথা বলে কোনো ফল না পেয়ে লিলি চোখ মুছতে মুছতে হাঁটা দিল। গোপা তো আগেই ঢুকে পড়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। 

রনি দুড়দাড় করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল কয়েক ধাপ। আবার ফিরে গিয়ে ওয়ালেটটা পকেটে ভরে রিস্টওয়াচটা হাতে ঢোকাতে ঢোকাতে নেমে এল। 

কাউকে কিছু না বলে ওকে এমন ঊর্ধশ্বাসে দৌড়তে দেখে পিউ রাগ হলেও কিছু বলল না। মণিকা ইতস্ততঃ করছে। বনিই ডাকল, "এ্যাই ভাই, কি হল? তোর সকাল থেকে পাত্তা নেই, চা পর্যন্ত খাসনি। এখন সেজেগুজে চললি কোথায়?"

রনি থমকে একবার ভাবল। নিজেই বুঝতে পারছে, থেমে যাওয়া সম্ভব নয় ওর পক্ষে, "আমি এক্ষুণি আসছি। একটা কাজ, খুব দরকার। এটা সেরেই আসছি। তখন সব হবে।" 

চোখ মুছে কান্না চেপে পাড়ার রাস্তা পেরিয়ে এসেছে লিলি। যুগল মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে ওর দিকে। এখন বড় রস্তায় উঠে লিলি বাসস্ট্যান্ডে ঢুকছে দেখে বলল, "চলো একটা ক্যাব নিয়ে চলে যাই। বাসে যেতে হবে না। ক্যাব নিয়ে কোথাও ঘুরে আসি। কোথায় যাবে বলো।"

যুগলের প্রশ্নের উত্তর দেবে কি, চোখ গোল গোল হয়ে গেছে লিলির। ইতিমধ্যেই ওদের একদম পাশে যে বাইকটা এসে থেমেছে, সেটা দেখেই ওর কেমন একটা লেগেছিল। মনমেজাজ ঠিক না থাকায় ধরতে পারেনি। এখন রনি বাইক থেকে নেমে হেলমেটটা খুলতেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল। 

ভয়ে ভয়ে লিলি যুগলের দিকে তাকিয়েছে, রনি এসে দুজনের সামনে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট গলায় বলল, "তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে লিলি।"

লিলি মুখ ঘুরিয়ে বলল, "আমার কোনো কথা নেই। তুমি এখান থেকে যাও রনিদা।" রনির নামটা ও বলেছে, যুগলকে ইশারায় রনির পরিচয় দিতে। যদিও যুগল রনির কথার ভাবেই বুঝেছে, ও কে। 

- "তোমাকে আমার কথার উত্তর দিতেই হবে লিলি।" রনি একসুরে বলে যায়। 

যুগল এক পা এগিয়ে প্রায় রনির নাকে কপাল ঠেকে যাওয়ার মতো কাছে দাঁড়িয়ে বলে, "এ্যাই যান তো এখান থেকে। আপনাকে কোনো দরকার নেই। আপনার কথা শোনারও দরকার নেই।"

- "আপনার নেই, কিন্তু লিলির আছে এখনও। লিলির সঙ্গে আমার রেজিস্ট্রি বিয়ের নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। ও বিয়ে না করে চলে এসেছে। কোনো কারণ জানায়নি আমাকে।" 

রনি হয়ত আরও কিছু বলত। যুগল ওকে থামিয়ে তেরিয়া প্রশ্ন করে, "তাতে কি করবেন ? ওসব নোটিশ ফোটিস যাই দিক, আমার সঙ্গে ওর বিয়ে হয়ে গেছে সেটা জানেন না?"

- "আপনি জানতেন, আপনার সঙ্গে বিয়ের পর ও আমার সঙ্গে বিয়ের জন্য সরকারী ফর্ম ফিলআপ করেছে? বাহ খুব ভালো কথা। তাহলে ব্রীচ অফ কন্ট্রাক্ট কেসটা একজন নয়, দুজনের নামেই করব। এবার দুজনেই বলুন, আজ এখন আমার সঙ্গে কথা বলবেন, নাকি কোর্টেই দেখা হবে?"

রনির চেহারায় গত রাতের কিছুটা ছাপ হয়তো থেকে গেছে তখনও, তার উপর অতক্ষণ শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে থেকে চোখ ফোলা, চোখের সাদা টকটকে লাল, গলার আওয়াজ ভারী হয়ে গেছে। এদিকে ওর কথায় যুক্তি আছে। লিলি কোনো জোর জবরদস্তি ছাড়া ফর্ম ফিলআপ করেছিল, এ তো রেজিস্টার ভদ্রলোকই সাক্ষী দেবেন। রনিকে দেখে মনে হচ্ছে ও মরিয়া হয়ে আছে। দুজনেই বোঝে, বিরাট একটা বিপদে পড়ে গেছে। 

যুগলের এমনিতেই রাগ ছিল রনির উপর। স্বাভাবিক, তার প্রেমিকাকে বিয়ে করতে চলেছিল এই ছেলেটি। আর এখনও সে পিছু ছাড়েনি ! তীব্র ঘৃণা নিয়ে কি একটা বলতে যাওয়ার মুখেই লিলি যুগলের হাত চেপে ধরে থামায়। রনিকে বলে, "তুমি কেস করতে পারো, সব আইন আমি জানি না, তুমি হয়তো জিতেও যাবে। তাতে কি হবে? আমার শাস্তি হবে। জেল টেল হবে, নাকি? আমাদের বিয়ে কি ভেঙে যাবে? তোমাকে বিয়ে করতে হবে? এরকম নিয়ম হতে পারে? হলেই বা কি? আমি তোমাকে পছন্দ করি না, প্রাণ থাকতে তোমাকে বিয়ে করব না.... "

- "বিয়ে তোমাকে আমিও করব না। আমার শুধু কিছু কথা জানার আছে। ভালোভাবে উত্তর দিলে ভালো, না হলে আমি আইনের সাহায্য নেব।" লিলিকে থামিয়ে প্রায় ধমকে ওঠে এবার ও। 

- "বেশ বলো কি কথা?" লিলি হাল ছেড়ে দেয়। 

চলবে