Read Jharapata - 25 by Srabanti Ghosh in Bengali Love Stories | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

ঝরাপাতা - 25

ঝরাপাতা

পর্ব - ২৫

💜❤💜❤💜❤💜

- "এত তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে কি করবি? সামনের মাসে পরীক্ষা। তখন আর ঘোরাঘুরি করা যাবে না। আজ যখন সুযোগ পেয়েছি চল সবাই মিলে সিনেমা দেখে আসি।" পলাশ সবাইকে আটকায়। 

আসলে আজ ওদের কলেজের ট্রাস্টি বডির একজন মারা গেছেন বলে কলেজ ছুটি হয়ে গেছে। এঁদের পারিবারিক জমিতেই কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কলেজের সমস্ত স্যার, ম্যাডাম, স্টাফেরা শেষ যাত্রায় যাবেন। 

ছেলেমেয়েরা কলেজ প্রতিষ্ঠার গল্পই কেবল শুনেছে, কেউ কেউ তো আজই শুনল। তাই ওরা নিজের বাড়িতেই ফিরছিল। তখনি পলাশের কাছ থেকে হঠাৎ এই আনন্দ করার প্রস্তাব। এক দুজনের মত আছে, এক দুজনের আপত্তি। আরও জোরাজুরি করতে সবাই রাজি হয়ে গেল। মিলিও আছে দলে। যেতে যে ইচ্ছে করছে না, বা বাড়িতে বারণ করবে তা নয়। সুতরাং মিলিও মাথা নেড়ে দিয়ে মাকে ফোন করে বলে দিয়েছে। 

এবার মনে হচ্ছে, রনিদাকেও এখনই বলে দেওয়া ভালো। রনি ওকে নামিয়েই চলে গেছে। ওদের কি টার্মিনাল এগজামের প্রশ্ন করছে, নিজের ডেস্কে বসে সেরে রাখবে, ক্লাস শুরুর আগে। এসব টুকরো টুকরো একান্ত ব্যক্তিগত কথা রনি ওকে বলে আজকাল। ওর পড়াশোনা, বন্ধুদের মজার কথা, মিলিও বলে ফেলে। রনিদাকে তাই আজকাল আর অনেকটা বড়, লেকচারার হিসেবে নিজের কলেজের টীচারদের মতো দূরের কেউ মনে হয়না, খুব স্পেশাল বন্ধু মনে হয় তার জায়গায়। আর দুবেলা কলেজ, ম্যাডামের বাড়ি, সর্বত্র যাওয়া আসা তো রনির সঙ্গেই। সেই মানুষটাকে ছুটির সময়ে জানাবে বন্ধুদের সঙ্গে আছে, এটা ঠিক নয়। এখনও ক্লাস শুরু হয়নি ইউনিভার্সিটিতে, ফোন করতে বাধাও নেই। 

রনি নিজের প্রশ্নপত্র নিয়ে হিমসিম খাচ্ছিল। ফোনটা বেজে উঠতে তাই অবহেলাভরে বাঁ হাতে তুলে কে করেছে দেখতে গেল, নামটা পড়ে আপাততঃ রেখে দেবে। পরে সময় সুযোগ মত ঘুরে ফোন করবে। মিলির নাম দেখে চমকে উঠল। ওর তো ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ার কথা ! নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়েছে। ও কলেজের কাছেই আছে জানে বলেই ওকে ফোন করেছে। চটপট রিসিভ করে, "কি হয়েছে মিলি? সমস্যা? কি সমস্যা?" তড়িঘড়ি করে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। 

- "সমস্যা না রনিদা। আসলে কলেজের ট্রাস্টি বডির জগবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায় মারা গেছেন বলে কলেজ ছুটি হয়ে গেছে। তাই তোমাকে বলে দিলাম। ফেরার সময় তুমি তোমার মতো বাড়ি চলে যেও।"

রনির আচমকা সব ফাঁকা হয়ে যায়। গত দুমাসের উপর প্রতিটা দিন আসা যাওয়ার পথেই যা যেটুকু মিলির সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। এই লোকটাকে এখন কে যে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যেতে বলল ! সাবিত্রী যেমন সত্যবানের প্রাণ ফিরিয়ে এনেছিলেন, রনি পারলে তাই করে ! 

সে তো হওয়ার নয়, তাই মিলিকে শুধু বলে, "ঠিক আছে, সাবধানে বাড়ি যেও। আমি তোমার সঙ্গে পরে কথা বলে নেব।"

মিলি বোঝে, রনি ওর কথায় ধরে নিয়েছে, ওরা সরাসরি বাড়ি ফিরছে। রনি যাতে ফোন ছেড়ে না দেয় তাই তাড়াতাড়ি বলে, "আমরা বাড়ি যাচ্ছি না রনিদা, সিনেমায় যাচ্ছি।"

রনির মাথার মধ্যে কি যে হয়ে যায় ! ওর মন মেজাজ সব খারাপ হয়ে গেছে, আর মিলি যাচ্ছে সিনেমা দেখতে ! কিন্তু মিলির সঙ্গে যে ছুটির পর দেখা হবে না বলে ওর মুড অফ, সেটা বলারও উপায় নেই। 

গম্ভীর গলায় বলে, "বাহ ভালো, দুদিন পর পরীক্ষা। চৈতালী ম্যাডাম বলছেন তুমি দুটো সেমিস্টার একসঙ্গে দেওয়ার মতো তৈরি না, আর তুমি কি করছ? সিনেমা দেখে বেড়াচ্ছ ! এক কাজ করো, সিনেমা দেখে, শপিং করে, ডিনার সেরে, নাইট ক্লাবে ঘুরে ভোরে বাড়ি ফিরো।"

হঠাৎ পাওয়া একটুকরো অবসরে বন্ধুদের সঙ্গটাই এই প্ল্যানের আদত কথা। সেখানে রনির ইঙ্গিতটা এতটাই বিশ্রী, মিলি হতবাক হয়ে যায়। প্রথমে মুখে কথাই যোগায় না। ওদিকে রনিও ওকে চুপ দেখে আবার খোঁচায়, "কি হল, চুপ কেন? নতুনত্ব কিছু নেই আমার কথায়? এরকমই প্ল্যান হয়েছে, তাই তো?"

বন্ধুদের থেকে একটু সরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে মিলি। কারণ ওরা এন্তার চেঁচামেচি করছে আর সিনেমার টিকিট বুক করার নামে সবাই দেখি দেখি করে এর ওর মোবাইল কাড়াকাড়ি করছে। তবুও ওকে দেখতে পাচ্ছে সকলেই। কোনোমতে কান্না চেপে মিলি বলে, "বন্ধুরা সবাই যাচ্ছে, না বললে খারাপ ভাববে, তাই যাচ্ছি। পড়াশোনা করি রনিদা। আমি সত্যিই খুব চেষ্টা করছি।"

- "থাক, চেষ্টার নমুনা তো দেখাই যাচ্ছে। তোমাকে আর চেষ্টা করতে হবে না। সিনেমা থিয়েটার নিয়ে মেতে থাক।"

- "আমি জানি, তুমি আমার জন্য ম্যাডামকে বলে কয়ে রাজি করিয়েছ। পড়তে দিয়ে আসা, কলেজে আসা, সব করে দিচ্ছ। আমি সত্যিই চেষ্টা করছি রনিদা, তোমার সম্মানটা যাতে থাকে। আর তুমি ঠিকই বলেছ, আজ যেটুকু সময় পেয়েছি, আমার বাড়ি গিয়ে পড়া উচিত। আমি বাড়ি যাচ্ছি। রাখছি রনিদা, বন্ধুদের বলে দিচ্ছি, আমি যাব না।" 

মিলি ফোন কেটে দিতে রনির খারাপ লাগতে শুরু করেছে। কেন মিলি দুটো সেমিস্টারের পড়া করে ফেলতে পারছে না, বা দুটো সেমিস্টার একসঙ্গে ওর ঘাড়ে কেন চেপেছে সেটা রনির চেয়ে ভালো কে জানে? তার জন্য এখন মিলি সব বন্ধ করে শুধু রোবোটের মতো পড়বে? আর ধমকটা পড়ার নাম করে দিলেও, আসলে আজ আর দেখা হবে না বলেই যে মাথাটা গরম হয়েছে, সেটাও নিজের চোখে ফুটে উঠছে ততক্ষণে। 

রনির হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। এভাবে মিলিকে ধমক দেওয়ার অধিকার কি ওর আছে? এই মানসিক অবস্থায় ধমকটা মিলি কিভাবে নেবে কে জানে? মিলির সঙ্গে বন্ধুত্ব করে কি লাভ, যদি ওর জন্য মিলিকে উলটো খারাপ সময় কাটাতে হয়? 

ফোন কেটে মিলি বন্ধুদের হাডলটার মাঝখানে ঢোকে, "তোরা সবাই চলে যা, বুঝলি। আমি আজ যাব না। আমার জন্য টিকিট কাটিস না।"

- "যাবি না মানে? ঘাড় ধরে তুলে নিয়ে যাব। এমন একখানা দারুণ প্রশংসা করার মতো ব্যোমকেশের মুভি ! আর বলে কিনা যাবে না।" পলাশ প্রথমেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। 

- "না রে পলাশ। আমি সিরিয়াসলি বলছি। আজ থাক। টিকিট কাটিস না।" মিলি মাথা নাড়ে। 

অঙ্কুর এগিয়ে আসে, "চল না বাবা ! হঠাৎ কি হল? বেশ তো যাবি বললি !"

- "যেতাম, কিন্তু রনিদা বলল... " থেমে গেল মিলি। পড়াশোনার কথাটা বলা যাবে না, অঙ্কুর না হোক, অন্য সবাই হাসবে। 

- "রনিদা কি বলল?" যেটুকু শুনেছে চোখ সরু করে এগিয়ে এল পলাশ। 

- "ঐ মানে রনিদা যেতে বারণ করছিল।" মিলি ঢোঁক গেলে। মনে মনে ভাবছে, কি মুশকিল করেছি রনিদার নাম করে ! 

পলাশের মাথায় আগুন জ্বলে গেছে। ও ভালোই খেয়াল করেছে, এক মিনিটেরও কম সময় বোধহয় রনির সঙ্গে ফোনে কথা বলল। মানে একবার বারণ করতেই মিলি মেনে গেল ! 

- "রনিদা কেন বারণ করল, আমরা খারাপ ছেলে, আমাদের সঙ্গে সিনেমায় না যেতে বলল?" চিবিয়ে চিবিয়ে বলে পলাশ। 

- "ওরকম করে কেন বলছিস পলাশ? খারাপ কেন বলবে? আসলে মানে ইয়ে আরকি" মিলি কথা খুঁজতে থাকে, "মানে রনিদা বলল, একটা কাজ আছে, মানে চৈতালী ম্যামের সঙ্গে দেখা করাবে। ঐ আমার সেমিস্টারের ব্যাপারে কথা বলবে। বুঝেছিস তো?" অঙ্কুরও মিলির যুক্তিটা মেনে নেয়, হতেই পারে, রনিদাই তো ওর পড়াশোনা দেখছে। 

হঠাৎ মিলির ফোনটা বেজে ওঠে, রনি। মিলি অসম্ভব অপ্রস্তুত হয়ে গেছে বন্ধুদের সামনে। কে জানে, কি বলবে রনিদা। কানে ফোন ধরে হ্যাঁ বলো, বলতে বলতে লম্বা লম্বা পায়ে বেশ খানিকটা দূরে চলে আসে। 

ওল হ্যালো শুনেই রনি বলে, "কি করছ?"

মিলি ভয়ে ভয়ে বলে, "আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি। সিনেমায় যাচ্ছি না। বাড়ি গিয়েই পড়তে বসব। ওদের বলে দিয়েছি, আমার টিকিট না কিনতে।"

নিজের কাণ্ডের গুরুত্ব বুঝতেই রনি ফোন করেছিল। মিলি কি ব্যবহার করবে তা নিয়ে একটু বুক ঢিপঢিপ করছে। কিন্তু মিলির শান্ত উত্তর শুনেই ওর আরও অনুশোচনা হতে থাকে। আস্তে আস্তে বলে, "তোমার সিনেমা দেখতে যেতে ইচ্ছে করছে মিলি?"

- "না রনিদা। তুমি ঠিক বলেছ, বললাম তো আমি বুঝতে পেরেছি। তবে ওদের বলতে পারিনি, সবাই খ্যাপাবে। সরি রনিদা, তোমার নামে একটা মিথ্যে বলেছি। ওদের বলেছি, তুমি ম্যামের সঙ্গে দেখা করতে বলেছ।"

মিলির কথাটা শুনেই রনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, "মিলি, বাড়ি যেও না। একটু অপেক্ষা করো। আমি আসছি ওখানে। কথা আছে তোমার সঙ্গে। একটু দাঁড়াও, আমার খানিকক্ষণ সময় লাগবে।"

- "তুমি আসবে? তোমার ক্লাস ক টায়?" মিলি আবাক ! 

- "ক্লাসগুলো ম্যানেজ করে আসতে হবে। সমস্যা হচ্ছে আমি ভেতরে চলে এসেছি, বায়োমেট্রিক হয়ে গেছে। এখন ছুটি করা যায় কিনা দেখছি। ততক্ষণ একটু অপেক্ষা করবে?"

রনি এত কাচুমাচু হয়ে বলে, মিলি অস্বস্তিতে পড়ে যায়। রনির বাঁকা কথা, ধমকও মনে আছে, তার সঙ্গে এমন অনুরোধ ! মিলি অপেক্ষা করছে বলে। নিজেও খুব অবাক, একটা মিথ্যে বলেছিল, রনি ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে বলেছে। সে জায়গায় রনি নিজে আসতে চাইছে কেন?

পলাশ, অন্য বন্ধুরাও কেউ কেউ বলে যায়, "তুই ইচ্ছে করলেই একটা দিন আমাদের সঙ্গে যেতে পারতি। রনিদাকে বলতে পারতি, ছুটির পরের সময়টায় ম্যাডামের কাছে যাবি।" মিলি কিছুই বলতে পারে না। ওরা চলে গেলে কলেজের মাঠে চুপ করে বসে থাকে। 

একটু পরেই রনির ফোন আসে, "বেরিয়ে এসো, আমি আসছি।"

প্রায় একই সময়ে গেটের বাইরে আসে দুজন। মিলিকে নিয়মিত আনা নেওয়া করে বলে, ওর জন্য একটা লেডিস হেলমেট কিনেছে রনি, সেটা এগিয়ে দিয়ে বলে, "বাইকে বসো।"

- "কথা আছে বললে যে !"

- "কথা বলার জায়গায় যাব, চলো।"


চলবে