Read Mission Indiana - 7 by Bishwadeep Mukherjee in Bengali Science-Fiction | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

Mission Indiana - 7

মিশন ইন্ডিয়ানা
*************
পর্ব - 7
**********
Near To Earth
**************

ইসরোর "স্পেস সাইন্স এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট" থেকে প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীদের একটা করে ছোট্ট চিপ দেওয়া হয়। স্টাডি ম্যাটেরিয়াল হিসেবে বহু ভিডিও থাকে সেখানে। সেই ভিডিও গুলো দেখে স্পেস সাইন্সের বিষয় অনেক তথ্যই জানা যায়। ঠিক এমনই একটা চিপ দেওয়া হয়েছিল তনুশ্রী মজুমদারকে। তখন হয়তো রাত প্রায় বারোটা বাজে। নিজের স্টাডি রুমে বসে ল্যাপটপে সেই ছোট্ট চিপটা লাগিয়ে ভিডিও দেখছিলো তনুশ্রী। সামনে একটা খোলা খাতা এবং হাতে একটা কলম। ভিডিওটা বেশ মনোযোগ দিয়েই তনুশ্রী দেখছিলো। তার বাবা মিস্টার ইন্দ্রজিৎ মজুমদার ড্রইং রুমে টি ভি চালিয়ে তখন খবর দেখছেন। হঠাৎ তনুশ্রী লক্ষ্য করলো, ল্যাপটপে তার পরিস্কার ঝকঝকে ভিডিওটা কেমন যেন অপরিস্কার হয়ে গেল। ভিডিও থেকে আসা আওয়াজটাও যেন পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে না। মিনিট দেড়েক এমন হওয়ার পর শুরু হলো আরেকটা ঝামেলা। ভিডিওটা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আবার কিছু সেকেন্ড পর পুনরায় দৃষ্টব্য হয়ে যাচ্ছে। প্রায় ছয়-সাত বার এমন হওয়ার পর ভিডিও সহ তার ল্যাপটপটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। ল্যাপটপ অন করার কিছুক্ষণ চেষ্টা করলো তনুশ্রী, কিন্তু বিফল হলো। বিরক্ত হয়ে নিজের স্টাডি রুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। সামনেই ড্রইং রুম। তার বাবা একটা সোফায় বসে আছেন। কিন্তু তার সামনে টি ভি টা বন্ধ। 
'টি ভি বন্ধ কেন বাবা?' তনুশ্রী জিজ্ঞাসা করলো ইন্দ্রজিৎ মজুমদারকে। 
'হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। খারাপ হয়ে গেল কি না বুঝতে পারছি না। এখন তো অনও হচ্ছে না।' ইন্দ্রজিৎ মজুমদার বললেন। 
'সে কি! আমার ল্যাপটপের সাথেও তো ঠিক এমনটাই হলো। হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেল। অন হচ্ছে না এখন।'
তনুশ্রী দেখলো ড্রইং রুমের ওপারে একটা বেড রুম থেকে বেরিয়ে এলেন তার মা হাতে একটা মোবাইল নিয়ে। ড্রইং রুমে ঢুকতেই ইন্দ্রজিৎ কে জিজ্ঞাসা করলেন - 'হ্যাঁ গো, তোমার মোবাইলে নেটওয়ার্ক আছে? আমার মোবাইল কাজ করছে না যে।'
ইন্দ্রজিতের মোবাইল তার পাশেই সোফাতে রাখা ছিল। উঠিয়ে দেখলেন। না, তার মোবাইলেও নেটওয়ার্ক নেই। 
'না, নেই তো।' বললেন ইন্দ্রজিৎ। 
তনুশ্রী ছুটে গেল নিজের ড্রইং রুমে। টেবিলের উপর রাখা ছিল তার মোবাইল। উঠিয়ে দেখলো সে। নেটওয়ার্ক তার মোবাইলেও নেই।
'কী হলো কিছুই তো বুঝতে পারছি না।' বেশ চিন্তিত কণ্ঠে ইন্দ্রজিৎ বললেন। 
হাতে মোবাইল নিয়ে তনুশ্রীও বেরিয়ে এসেছে নিজের স্টাডি রুম থেকে। 
'আমাদের বাড়ির ইলেকট্রনিক ডিভাইস গুলো কি তবে খারাপ হয়ে গেল?' ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো তনুশ্রী।
'এমনটা হবে কেন? হওয়ার তো কোনো কারণ নেই। এমন প্রবলেম কি শুধু আমাদের সাথেই হচ্ছে নাকি সবার সাথে হচ্ছে সেটা জানতে হবে আগে।' ইন্দ্রজিৎ বললেন।
'এই মুহূর্তে জানার কোনো উপায় নেই। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।' তনুশ্রী কথাটা বলে অদ্ভুত এক ভয়ের দৃষ্টিতে তাকালো নিজের মা-বাবার দিকে।

******************************************

দার্জিলিংএর পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে গাড়িটা চলে যাচ্ছে শিলিগুড়ির দিকে। শিলিগুড়ি থেকে বাগডোগরা। বাগডোগরা থেকে সকাল এগারোটায় ফ্লাইট মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিকের। সকাল-সকাল রওনা দিয়েছেন লামাহাটা থেকে। এখনো চারিপাশে বেশ কুয়াশা আছে। কুয়াশার কারণে গাড়ি বেশি দ্রুত গতিতে এগোতে পারছে না। রাস্তার ধারে ছোটমত একটা হোটেল দেখতে পেলেন মৃত্যুঞ্জয়। হঠাৎ করেই তার চা খাওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে গেল। হোটেলে চা পাওয়া যাবে এই আশায় তিনি গাড়ি চালককে গাড়ি থামাতে বললেন। গাড়ি থেকে নেমে হোটেলে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন চা পাওয়া যাবে কি না। দোকানি "হ্যাঁ"এর ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো। মৃত্যুঞ্জয় গাড়ি চালককে জিজ্ঞাসা করলেন সেও চা খেতে ইচ্ছুক কি না। সে মানা করে দিলো। এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে এদিক-ওদিক দেখতে থাকলেন মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক। হোটেলের কাউন্টারের ঠিক উপর একটা টি ভি তে খবরের চ্যানেল খোলা আছে। খবরের দিকে নজর গেল মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিকের। এক মহিলা নিউজ রিডার একটা খবর পড়ছিল।
"কাল রাতে ঘটা অদ্ভুত ঘটনাটা শুধু আমাদের দেশেই নয়, বরং বিশ্বের আরো অনেক দেশেই ঘটেছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী এই ঘটনা ভারত ছাড়া, চীন, ইন্ডোনেশিয়া, জাপান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং রাশিয়াতেও ঘটেছে। আপনাদের জানিয়ে দিই, ভারতীয় সময় অনুসারে কাল রাত বারোটা থেকে রাত দুটো পর্যন্ত এসব দেশে কোনো ইলেকট্রনিক উপকরণ কাজ করছিল না। মোবাইল, টি ভি, ল্যাপটপের মত আরো বেশ কিছু জিনিস সম্পূর্ণ ভাবে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, তারা এ বিষয়ে তদন্ত কমিশন বসাবে। এই ঘটনার বিষয় আরো ইনফরমেশন আমরা আমাদের রিপোর্টার সঞ্জয় দাস থেকে পাবো। আমরা চলি এখন সঞ্জয় দাসের কাছে।"
মৃত্যুঞ্জয় কিছু ভাবলেন। কাল তো তিনি রাতে নীহারিকার সাথে বেশ অনেকক্ষণ কথা বলেছেন। কোনো রকমের অসুবিধে তো হয়নি। কিন্তু কটার সময় কথা বলেছেন তিনি? মৃত্যুঞ্জয় সময়টা মনে করলেন। তখন বোধহয় রাত দশটা বাজে। খবরে বলছে এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে রাত বারোটা থেকে দুটো পর্যন্ত। চায়ের দাম মিটিয়ে চিন্তামগ্ন হয়েই গাড়িতে উঠলেন মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক। আজ পর্যন্ত কোনো দিন এমন ঘটনার বিষয় শোনেননি তিনি। অজান্তেই মনের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে গেল তার। কিসের ভয়? সেটার উত্তর খুঁজে পেলেন না তিনি। নিজের হাত ঘড়িতে সময় দেখলেন মিস্টার ভৌমিক। সকাল সাড়ে আটটা বাজে।

******************************************

'ঘুম থেকে উঠে পর। আটটা বাজতে চললো যে।' নীহারিকার ঘরের জানালার পর্দাটা সরিয়ে তার মা বললেন। 
রাতে নীহারিকার ফিরতে বেশ দেরিই হয়েছিল। সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠে যাওয়া তার অভ্যাস। কিন্তু আজ ঘুমটা ভাঙলো না। মায়ের আওয়াজ শুনে এক লাফে বিছানায় উঠে বসলো। বাইরের ঘর থেকে টি ভি'র আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। গত রাত্রে দু ঘন্টার জন্য ভারত সহ বেশ কিছু দেশে ইলেকট্রনিক উপকরণ কাজ না করার খবর দিচ্ছিল একটা খবরের চ্যানেলে। টি ভি'র সামনে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল নীহারিকা।
'দাঁড়িয়ে আছিস কেন? দেরি হবে না তোর?' নীহারিকার মা পিছন থেকে এসে তাকে টুকলেন।
'মা, এই খবরটা শুনেছো? কেমন অদ্ভুত না?' নীহারিকা টি ভি'র দিকে তাকিয়েই নিজের মাকে বললো।
'কত কিছুই হয় আজকাল।' বিড়বিড় করতে-করতে নীহারিকার মা রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
নীহারিকার তৈরি হতে প্রায় ন'টা বেজে গেল। খেতে বসার ঠিক আগে রিং হলো তার মোবাইলে। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো প্রজেক্ট ম্যানেজার স্বর্ণাভ বিশ্বাস তাকে কল করছেন। 
'নীহারিকা, তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো অফিস এসো। আর্জেন্ট কাজ আছে।' মিস্টার বিশ্বাস নীহারিকাকে বললেন।
'এনিথিং সিরিয়াস?' 
'নীহারিকা, আমাদের স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কিছু ম্যাসেজ আসছে।'
'কী ম্যাসেজ?' জিজ্ঞাসা করলো নীহারিকা। 
'ম্যাসেজ এখনো ডি-কোর্ড করা যায়নি। আমাদের মেন কন্ট্রোল রুমের টেকনিক্যাল এসিস্টেন্ট শিল্পী দুবে আমাকে সকালে কল করে জানিয়েছে। ভোর প্রায় পাঁচটা থেকে ম্যাসেজটা নাকি রিসিভ হচ্ছে। আমি এক্ষুনি বেরোচ্ছি। তুমিও বেরিয়ে পড়ো।' নিজের কথা শেষ করলেন স্বর্ণাভ বিশ্বাস।
'চিফকে খবর দেওয়া হয়েছে?' নীহারিকা আরেকটা প্রশ্ন করলো।
'কল করেছিলাম। আউট অফ নেটওয়ার্ক বললো।'
মিস্টার বিশ্বাসের কল কেটে দেওয়ার পর নীহারিকা বেশ কিছু সেকেন্ড পাথরের মত সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। তার মুখ দেখে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছিল। অতঃপর সপ্তর্ষিকে কল করলো নীহারিকা। সব কিছু বললো তাকে। সব শুনে সপ্তর্ষি বললো - 'তোর মনে আছে নীহারিকা সেই মোর্স কোর্ডের বিষয়, যেটা আমরা টাইটান থেকে রিসিভ করেছিলাম? ওই কোর্ডটা দেখে অর্ণব বলেছিল যে, ওটা অত্যাধুনিক মোর্স কোর্ড। অনেক কম লোকেরাই আছে যারা এমন মোর্স কোর্ড ডি-কোর্ড করতে পারে।'
'তুই বলতে চাইছিস যে, আজ যে ম্যাসেজ গুলো আমাদের অফিসে এসেছে, সেটা ওই ধরণের কোর্ড?'
'মে বি। হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। যদি সাধারণ কোর্ডে ম্যাসেজ গুলো হতো, তাহলে ডি-কোর্ড করার লোক অনেক আছে অফিসে।'

******************************************

নীহারিকা অফিস পৌঁছে সোজা মেন কন্ট্রোল রুমের দিকে এগোলো। কন্ট্রোল রুমটা দু দিক থেকে কাঁচ দিয়ে ঘেরা। বেশ কিছু অত্যাধুনিক কম্পিউটার রাখা আছে। কম্পিউটারের সামনের চেয়ারে বসে আছে বেশ কিছু কর্মচারী। মিস্টার বিশ্বাস ও সপ্তর্ষি নীহারিকার আগেই পৌঁছে গেছে। দুজনেই চেয়ারে বসে থাকা একটা মেয়েকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। এই মেয়েটাই শিল্পী দুবে, যে মিস্টার বিশ্বাসকে সকালে কল করে খবর দিয়েছিল। নীহারিকাও সেই দিকে এগিয়ে গেল।
'কিছু বোঝা যাচ্ছে না নীহারিকা। কাল রাতে এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। আজ সকাল থেকেই এমন অদ্ভুত ম্যাসেজ।' নীহারিকাকে দেখে স্বর্ণাভ বিশ্বাস বললেন। 
নীহারিকা কিছুক্ষণ কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে রইল। খানিক চিন্তা করে সপ্তর্ষিকে সে বললো - 'তুই ঠিকই বলেছিস সপ্তর্ষি। সেম টু সেম।'
মিস্টার বিশ্বাস একবার নীহারিকার দিকে একবার সপ্তর্ষির দিকে তাকালেন।
'সেম টু সেম মানে?' নীহারিকাকে জিজ্ঞাসা করলেন মিস্টার বিশ্বাস।
'স্যার, এই ম্যাসেজ গুলো ওই কোর্ডেই পাঠানো হয়েছে, যে কোর্ড আমরা টাইটানে রিসিভ করেছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় এটা যে, আমার টিমে অর্ণব ছাড়া কেউ সেই কোর্ড ডি-কোর্ড করতে পারতো না।' স্বর্ণাভ বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে নীহারিকা বললো। 
'তাহলে এখন উপায়? আমাদের অফিসে এই মুহূর্তে যারা ডি-কর্ডিং পারে, তাদেরকে দেখানো হয়েছিল। কিন্তু কেউ কিছুই করতে পারলো না। এখন কী হবে কিছুই তো বুঝতে পারছি না।' হতাশার সুরে বললেন মিস্টার বর্মন।
'ম্যাসেজটা কতদূর থেকে আসছে সেটা বোঝা যাবে? আমি জানতে চাইছি ম্যাসেজটা কোনো গ্রহ থেকে আসছে কি না।' জিজ্ঞাসা করলো সপ্তর্ষি। 
সপ্তর্ষির প্রশ্নে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা শিল্পী বললো - 'না। কোনো গ্রহ থেকে আসছে না ম্যাসেজ। ম্যাসেজ আসার ডিস্টেন্সটা অনেক কম। হয়তো পৃথিবীর অর্বিটের কিছুটা বাইরে থেকে।'
'মানে?' নীহারিকা প্রায় চিৎকার করে উঠলো। 
কেউ কিছুই বললো না। সবাই একে অপরের দিকে অদ্ভুত ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দেখলো। 
'আমি এক্ষুনি আসছি।' কথাটা বলে নীহারিকা দ্রুত গতিতে কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
লিফ্ট দিয়ে বেশ কিছুটা তলা নিচে নামলো নীহারিকা। লিফ্ট থেকে বেরিয়েই আবার দ্রুত কদমে এগিয়ে চললো সে। তার চলার গতি এতটাই দ্রুত ছিল যে, আশেপাশের সবাই তাকে অবাক হয়ে দেখতে লাগলো। নীহারিকা থামলো ক্লাস রুমের সামনে গিয়ে। দরজা একটু ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখলো দেবরাজ বর্মন ক্লাস নিচ্ছেন। নীহারিকাকে দেখে দেবরাজ বর্মন একটু চমকেই গেলেন। 
'সরি টু ডিস্টার্ব ইউ মিস্টার বর্মন। খুবই দরকারি কাজে আমি এখানে এসেছি।' নীহারিকা বললো দেবরাজ বর্মনকে। 
'কী দরকারি কাজ?' একটু রুক্ষ সুরে
জিজ্ঞাসা করলেন দেবরাজ বর্মন। 
'আজ কি তনুশ্রী মজুমদার প্রেজেন্ট আছে?'
'ইয়েস ম্যাম।' তনুশ্রী এক হাত উঠিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। 
'তনুশ্রী, তোমার সঙ্গে একটু দরকার আছে। তোমায় আমার সঙ্গে মেন কন্ট্রোল রুম যেতে হবে।' নীহারিকা বললো। 
তনুশ্রী একবার মিস্টার বর্মনের দিকে তাকালো। হয়তো অনুমতি নেওয়ার জন্য। দেবরাজ বর্মন মুখে কিছু বললেন না, শুধু ঘাড় নাড়িয়ে তনুশ্রীকে নীহারিকার সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।
নীহারিকা তনুশ্রীকে সঙ্গে নিয়ে ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে গেল। 
'কী হয়েছে ম্যাম?' জিজ্ঞাসা করলো তনুশ্রী। 
'তনুশ্রী, তুমি কাল আমায় বললে যে, তুমি ডি-কোডিং খুব ভালো পারো। তাই না?'
'হ্যাঁ ম্যাম। ডি-কর্ডিংএর বিষয় আমার ইন্টারেস্ট ছিল এবং আছেও।'
'নতুন কোনো ল্যাংগুয়েজের বিষয় তুমি জানো? মানে, নতুন ধরণের কিছু কোর্ডিং। যেটা হয়তো টেক্সট বুকে নেই।'
নীহারিকার প্রশ্নে খানিক চিন্তা করে তনুশ্রী বললো - 'চেষ্টা করে দেখতে পারি ম্যাম। তবে কতটা সফল হতে পারবো সেটা জানি না।'
'নো প্রব্লেম। চেষ্টা করেই দেখো না একবার।'
নীহারিকা তনুশ্রীকে নিয়ে মেন কন্ট্রোল রুমে ঢুকলো। স্বর্ণাভ বিশ্বাস আর সপ্তর্ষি এখনো শিল্পীকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। কম্পিউটারের দিকে ইশারা করে নীহারিকা তনুশ্রীকে বললো - 'দেখো তো তনুশ্রী, কম্পিউটারের স্ক্রিনে যে কোর্ডিংটা দেখা যাচ্ছে, সেটা বুঝতে পারো কি না।'
তনুশ্রী ধীর গতিতে কম্পিউটারের দিকে এগিয়ে গেল। ভালো করে তাকালো কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে। কিছুক্ষণ পরে বললো - 'আমার একটা কাগজ আর একটা পেন চাই।'
তনুশ্রীর বলা সাথে-সাথেই শিল্পী তার হাতে একটা কাগজ ও একটা পেন ধরিয়ে দিলো। কাগজ আর পেন হাতে নিয়ে তনুশ্রী পুনরায় কম্পিউটারের দিকে চেয়ে রইল।

******************************************

বাগডোগরা থেকে কলকাতা যাওয়ার ফ্লাইটে উঠে পড়েছেন মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক। খানিক আগেই তার মোবাইলে একটা ম্যাসেজ এসেছিল। ম্যাসেজে লেখা ছিল যে, স্বর্ণাভ বিশ্বাস তাকে কল করার চেষ্টা করেছেন। কিছুক্ষণ পর কলকাতা তিনি পৌঁছেই যাবেন। তাই ভাবলেন যে একেবারে অফিস গিয়েই স্বর্ণাভ বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলা যাবে। জানালার পাশে বসে কিছুক্ষণ বাইরের দিকে দেখলেন তিনি। প্লেনে এখনো যাত্রীদের প্রবেশ চলছে। প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে কিছু দেখতে গেলেন তিনি। হঠাৎ একটা নোটিফিকেশনে তার চোখ পড়লো। ইসরো হেড কোয়ার্টার থেকে মেল এসেছে একটা। নিজের মেল আইডি খুললেন মৃত্যুঞ্জয়। মেলটা খুলে পড়লেন তিনি। মেলটা যত পড়ছেন, ততো যেন তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে মেলটা পড়া শেষ হলো। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক। নিজের দু চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

******************************************

সপ্তর্ষির কাছে প্রায় বেলা বারোটা নাগাদ কল এলো বর্ধমানের পুলিশ থানা থেকে। 
'বডি গুলোর পোস্টমর্টেম হয়ে গেছে। আপনারা বডি নিয়ে যান।'
ফোন রেখে নীহারিকার দিকে তাকালো সপ্তর্ষি। অফিসের ক্যাফেটেরিয়াতে বসে ছিল সপ্তর্ষি, নীহারিকা, অম্লান ও অরিজিৎ। আগে থেকেই তাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, তাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। 
'সবাইকে যাওয়ার দরকার নেই। আমি আর অরিজিৎ যাচ্ছি। নীহারিকা, তুই আর অম্লান এখানেই থাক। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো চিফ এসে যাবেন। একেই উনি টেনশনে আছেন। তারপর তোকে না দেখতে পেলে আরো টেনশন করবেন।' সপ্তর্ষি বললো কথাটা।
খানিক চুপ থেকে নীহারিকা সপ্তর্ষিকে জিজ্ঞাসা করলো - 'কী করবি? বডি গুলো কি কলকাতা নিয়ে আসবি?'
'কী করবো কলকাতা নিয়ে এসে? অর্ণবের কোনো রিলেটিভও তো নেই এখানে। এখানে কেন? দূর-দূর পর্যন্ত তার কোনো রিলেটিভ নেই। বর্ধমানের শ্মশানেই দাহ করে দেবো। তবে, ফিরতে সময় লাগবে কিন্তু। হয়তো আজ আর অফিসে নাও ফিরতে পারি। এখানে কিছু হলে খবর দিস।'
কথা শেষ করে সপ্তর্ষি চেয়ার থেকে উঠে গেল। অরিজিৎও উঠলো তার সাথে। 
'আমরা মিস্টার বিশ্বাসকে বলে বেরিয়ে যাচ্ছি। চল অরিজিৎ।'
সপ্তর্ষি বেরোতে যাবে ঠিক সেই সময় নীহারিকা তার হাত ধরে বললো - 'শেষ দেখাটাও দেখতে দিবি না?' নীহারিকার দু চোখ ছলছল করছিল। 
সপ্তর্ষি তার মাথায় স্নেহের হাত রেখে বললো - 'এখানে তোকে দরকার নীহারিকা। তোকে থাকতে হবে এখানে।'

******************************************

দুপুর প্রায় আড়াইটা নাগাদ মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক নিজের অফিসে পৌঁছলেন। নিজের কেবিনে ঢুকতে না ঢুকতেই পিছন-পিছন মিস্টার বিশ্বাস এবং নীহারিকা ঢুকলো। মৃত্যুঞ্জয় নিজের চেয়ারে বসলেন, সামনের চেয়ারে মিস্টার বিশ্বাস এবং নীহারিকা।
জলের বোতল থেকে কিছুটা জল খেয়ে মৃত্যুঞ্জয় বললেন - 'মনে তো হচ্ছে দেবব্রত আসবেন না। দেবব্রতকে ছাড়া আমাদের কী ভাবে এগোতে হবে, সেটা নিয়ে বিচার করা যাক। যদি তিনি আসতে চাইতেন, তাহলে আজ সকাল থেকে একবার হলেও আমার সাথে কন্ট্যাক্ট নিশ্চই করতেন। নীহারিকা, তুমি একটা উপায় আমায় কাল রাতে বলেছিলে। সেটা ট্রাই করে দেখতে পারো।'
নীহারিকা মিস্টার বিশ্বাসের দিকে একবার তাকিয়ে আবার মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বললো - 'সে উপায় তো করা হবে স্যার। কিন্তু আজ সকাল থেকে এখানে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে।'
'আবার কী হলো?' একটু বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞাসা করলেন মৃত্যুঞ্জয়। 
'স্যার, আমাদের অফিস আজ সকাল পাঁচটায় কিছু ম্যাসেজ রিসিভ করেছে। মেন কন্ট্রোল রুমের মনিটারের সেই ম্যাসেজ গুলো এসেছে। বোঝাই যাচ্ছে আমাদের স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এই ম্যাসেজ গুলো পাঠানো হচ্ছে। ম্যাসেজ গুলো অত্যাধুনিক মোর্স কোর্ডে পাঠানো হচ্ছে। ঠিক এমনই মোর্স কোর্ডে ম্যাসেজ আমরা টাইটানে পেয়েছিলাম। আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট তনুশ্রী মজুমদার সেই ম্যাসেজ ডি-কোর্ড করেছে। ডি-কোর্ড করে যেটা পেয়েছে, সেটা খুব সুখকর নয়।'
'যাকে দিয়ে ডি-কোর্ড করিয়েছো, সে কি এতে এক্সপার্ট?' মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞাসা করলেন।
এবার স্বর্ণাভ বিশ্বাস বললেন - 'স্যার, অফিসের কেউ ডি-কোর্ড করতে পারছিল না। মর্ডান কোর্ড এটা। এই কোর্ডের বিষয় কোনো টেক্স বুকে লেখা নেই। সেই মেয়েটি পারলো।'
'কী পেলো সে?' গম্ভীর গলায় মিস্টার ভৌমিক জিজ্ঞাসা করলেন।
'স্যার, সব থেকে বড় বিষয় এটা যে, এই ম্যাসেজটা বেশি দূর থেকে আসছিল না। পৃথিবীর অর্বিটের জাস্ট একটু বাইরে থেকে।' নীহারিকা বললো। 
'ওহ নো। তার মানে নাসা যেটা পেয়েছে সেটা ভুল না।' মৃত্যুঞ্জয় বললেন। 
'কী পেয়েছে নাসা?' জিজ্ঞাসা করলেন মিস্টার বিশ্বাস। 
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃত্যুঞ্জয় বললেন - 'আজ সকালে ইসরোর হেড কোয়ার্টার থেকে আমার কাছে একটা মেল আসে। তাতে লেখা ছিল যে, নাসা কাল রাতে ইসরোর হেড কোয়ার্টারের সাথে যোগাযোগ করেছে। আই এস এস'এ থাকা আ্যসট্রনটরা কাল রাতে পৃথিবীর অর্বিটের কাছে এক অদ্ভুত কিছু লক্ষ্য করেছে। অদ্ভুত ভাবে পৃথিবীর মানচিত্রের এশিয়া অঞ্চলের দিকে খানিক ঘুরে ফিরে সেই অদ্ভুত যানটা কোথায় যেন হারিয়ে যায় নিমেষে। বেশ অনেকক্ষণ ছিল সেই যানটা পৃথিবীর অর্বিটের বাইরে। এশিয়ার সমস্ত স্পেস রিসার্চ অর্গনাইজেশন কে মেল করে নাসা এলার্ট করে দিয়েছে। নীহারিকা, ম্যাসেজ ডি-কোর্ড করে কী বেরোলো?'
মৃত্যুঞ্জয়ের প্রশ্নে নীহারিকা ফ্যাকাশে মুখে তাকালো তার দিকে।


ক্রমশ....