মিশন ইন্ডিয়ানা*************
পর্ব - 8
**********
Another Plan
*************
লাইনটা বেশ ভালোই লম্বা। হয়তো সময় লাগবে অনেকটাই। আকাশের অবস্থা খুব ভালো নেই আজ। ভালো রকম মেঘ করে আছে। আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে অরিজিৎ বললো - 'ঠিক মত ফিরতে পারলে হয় আজ।'
সপ্তর্ষি কিছু বললো না। পরপর চারটে বডি রাখা আছে। তার আগেও বেশ অনেক মৃত দেহের লাইন। ঘড়িতে সময় দেখলো সপ্তর্ষি। বিকেল চারটে বাজে। ঠিকই ভেবেছিল সে, আজ আর অফিস ফেরা সম্ভব না।
অর্ণবের মৃত দেহের দিকে একবার তাকালো সপ্তর্ষি। বহু পুরোনো স্মৃতির ভিড় যেন একে-একে চোখের সামনে আসতে চাইছে। টাইটানে যাওয়ার স্মৃতি, তার আগেকার স্মৃতি। অর্ণবের হবু শ্বশুর বাড়ির মোবাইল নাম্বার সপ্তর্ষির কাছে ছিল। এক্সিডেন্টের পরের দিন সকালে তাদেরকে ফোন করে সপ্তর্ষি খবর দিয়েছিল। আজ বর্ধমান আসার পরেও ফোন করলো সপ্তর্ষি। অদিতির বাবা ফোন তুলে বলেছিলেন যে, তার মেয়ের শরীর খুবই খারাপ। দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পর থেকে মারাত্মক শক পেয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি। তাই অর্ণবদের দাহতে তিনি বা অদিতি কেউই আসতে পারবেন না। সপ্তর্ষি ও অরিজিৎ দেখলো মৃত দেহের লাইন এগিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেছে।
'আপনাদের কে আছে, নিয়ে আসুন।' নিজের বাঁ দিক দিয়ে আওয়াজটা শুনতে পেলো সপ্তর্ষি ও অরিজিৎ। শ্মশান ঘাটেরই এক কর্মচারী তাদের বলছে।
সপ্তর্ষি ও অরিজিৎ মিলে অর্ণবের মৃত দেহকে এগিয়ে নিয়ে গেল। দুজনের চোখই জলে ভরা।
'আপনাদের মধ্যে মুখাগ্নি কে করবে?' শ্মশান ঘাটের সেই কর্মচারীটা জিজ্ঞাসা করলো।
সপ্তর্ষি এবং অরিজিৎ একে অপরের দিকে তাকালো।
'তুই মুখাগ্নি কর সপ্তর্ষি। আমি পারবো না।' অরিজিৎ বললো অন্য দিকে তাকিয়ে।
মৃত দেহে ঘি লাগানো এবং পাটকাঠি দিয়ে মুখাগ্নি করার পর সেটাকে ইলেকট্রিক চুল্লিতে দিয়ে দেওয়া হলো। আগুনে ভরা সেই চেম্বারে অর্ণবের মৃত দেহ ঢুকে যাওয়ার পর সপ্তর্ষি ও অরিজিৎ কেউই নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না। তাদের মনের যন্ত্রণা অবশেষে সম্পূর্ণ ভাবে বাইরে প্রকাশ পেয়েই গেল। দুজনে একে অপরকে জড়িয়ে অঝোরে কেঁদে ফেললো। তাদের কান্নার সাথে-সাথে তাল মিলিয়ে বৃষ্টিও যেন নিজের বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। হঠাৎ সপ্তর্ষির মোবাইলে রিং হলো। নীহারিকা কল করেছে তাকে।
'কী খবর ওই দিকের?' নীহারিকা জিজ্ঞাসা করলো।
'অর্ণবকে আগুনে ফেলে দিলাম নীহারিকা, আগুনে ফেলে দিলাম তাকে।' কান্নার সুরেই সপ্তর্ষি বললো নীহারিকাকে।
********************************
রাত আটটা বেজে গেছে তাও নিজের বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে নেই মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিকের। আসন্ন বিপদের থেকে কী করে রক্ষা পাওয়া যায়, সেই চিন্তা সর্বক্ষণ তার মাথায় ঘুরে যাচ্ছে। ভেবেছিল দেবব্রত চৌধুরীর সাথে দেখা হলে কিছু একটা রাস্তা বেরিয়ে আসবে। এই আশা নিয়েই কলকাতা থেকে এতো দূর পারি দিয়েছিলেন তিনি। দেখাও হলো দেবব্রত চৌধুরীর সাথে। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। এখন একটিই উপায় তার সামনে আছে। অনুরাগ বর্মনকে দেবব্রত চৌধুরীর সাথে কথা বলানো। যদি অনুরাগ বর্মনের কথা শোনেন দেবব্রত চৌধুরী। সেটারও গ্যারেন্টি বলে কিছুই নেই। আজ পর্যন্ত মৃত্যুঞ্জয় মজুমদার দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হতে দেখেছেন ও শুনেছেন। দুই গ্ৰহের মধ্যে যুদ্ধের বিষয় কোনো দিন কল্পনাও তিনি করেননি। আজ থেকে দু বছর আগে যখন তিনি ইসরোর ইস্ট্রান উইংএর চিফ হয়েছিলেন, তখন স্বপ্নেও ভাবেননি যে, পরিস্থিতি এমন ভয়ানক হয়ে যাবে। দুই গ্রহের মধ্যে যুদ্ধ কী রূপ হয় সেটার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই তার। দোষটা পুরোপুরি আমাদের। আমরাই আজ থেকে ত্রিশ বছর আগেকার ঘটনাকে গুরুত্ব না দিয়ে পৃথিবীকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিয়েছি। এক্ষেত্রে যদি অন্য কোনো দেশের সাহায্যের প্রয়োজন হয়, তাহলে তারা এগিয়ে আসবে কি? আসা উচিত। কারণ এই বিপদটা শুধু এই দেশের নয়, বরং পুরো বিশ্বের। পরক্ষণেই মৃত্যুঞ্জয়ের দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়। নাসা যে রিপোর্ট দিয়েছে, তাতে পরিস্কার লেখা আছে, ওই অজানা অদ্ভুত যানটা শুধুমাত্র এশিয়ার আশেপাশেই চক্কর কাটছিলো। তার মানে কি তাদের টার্গেট শুধুমাত্র ইন্ডিয়া? বুকটা কেঁপে উঠলো মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিকের। সামনের টেবিলে রাখা কাঁচের গ্লাসের জলটা নিমেষে শেষ করলেন তিনি। চেয়ার থেকে উঠে নিজের চেম্বারের লাইট গুলো বন্ধ করে চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলেন। পার্কিংএ গিয়ে গাড়িতে বসে স্টার্ট করতে যাবেন তিনি, ঠিক সেই মুহূর্তে তার মোবাইল বেজে উঠলো। মৃত্যুঞ্জয় মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলেন অজানা এক নাম্বার থেকে কল এসেছে। এস টি ডি কোড কলকাতার।
'হ্যালো।' ফোন রিসিভ করে তিনি বললেন।
'আমি একটা হোটেলে উঠেছি। সেখান থেকেই কল করছি তোমায়। আমি বড় লোক না। বেশি টাকাও নেই আমার কাছে। তাই হোটেলে বেশি দিন থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমার থাকার ব্যবস্থা আপনাকেই করতে হবে মিস্টার মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক।'
ওপার থেকে চেনা গলার আওয়াজ পেয়ে হঠাৎ মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিকের মুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। নিজের কানে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি।
'মাই গড! দেবব্রত চৌধুরী! আমি তো ভাবতেই পারিনি যে আপনি আসবেন।'
'জীবনে আর কিছু নেই মিস্টার ভৌমিক। তাই ভাবলাম একটা শেষ এডভেঞ্চার করেই নিই।'
********************************
হোটেলের সামনে এসে মৃত্যুঞ্জয়ের গাড়িটা দাঁড়ালো। হোটেলটা খুব বড় নয়। লিফ্ট করে চার তলায় গিয়ে রুম নাম্বার পাঁচ শো ছাব্বিশের সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজালেন মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক। দেবব্রত চৌধুরী দরজা খুললেন। তাকে দেখে চেনার উপায় নেই। গতকালই দেবব্রত চৌধুরীর সাথে সাক্ষাত হয়েছিল মৃত্যুঞ্জয়ের। গতকালে দেখা বড়-বড় সাদা চুল-দাড়ি এখন উধাও। দাড়ি আছে ঠিকই, কিন্তু বুক পর্যন্ত না। মাথার ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া এলোমেলো চুল এখন পরিপাটি করে আঁচড়ানো। দেবব্রত চৌধুরী দরজার সামনে থেকে সরে গিয়ে মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিককে ভিতরে ঢোকার রাস্তা বানিয়ে দিলেন।
'মিস্টার চৌধুরী, আপনার জিনিস তো মনে হয় আনপ্যাক হয়নি। এক্ষুনি চেকআউট করুন।' ভিতরে ঢুকেই মৃত্যুঞ্জয় বললেন।
দেবব্রত একটু আশ্চার্য হয়ে তাকালেন মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে।
'যাবো টা কোথায় এতো রাতে?' জিজ্ঞাসা করলেন দেবব্রত।
'আমি নিয়ে যাচ্ছি তো আপনাকে। আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন।'
দেবব্রত একটু হেসে বললেন - 'সে ঠিক আছে মৃত্যুঞ্জয় বাবু। কিন্তু এখানে যে এক রাতের পুরো ভাড়া দেওয়া আছে। তার আগে তো রুম ছাড়তে পারবো না। এক টাকাও রিফান্ড করবে না। আমার থেকে টাকাও নেবে আর রুমটা অন্যকে দিয়েও দেবে।'
'রিফান্ড না দিক, কোনো ব্যাপার না। আমি দেখে নেবো সব। আপনি যতদিন এখানে আছেন, আপনি আমার দায়িত্ব। আপনার কোনো রকম অসুবিধে হবে না। আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে।'
'সে সব আমি জানি মৃত্যুঞ্জয় বাবু। কিন্তু যখন ভাড়া দিয়েছি, চেকআউট টাইমের আগে রুম ছাড়বো না। কাল সকালে চেকআউট টাইম। তখন না হয় লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে পড়বো। এখন আপনি বসুন। কথা বলা যাক।'
দেবব্রত ও মৃত্যুঞ্জয় সামনা-সামনি বসলেন। আজ সারা দিনের ঘটনা গুলো মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক গুছিয়ে বললেন দেবব্রতকে।
'দেবব্রত বাবু, কাল রাতে যে ঘটনাটা ঘটেছিল সেটার সাথে ওই অজানা যানটার যে সম্পর্ক আছে, সেটা এখন অনেকটাই পরিস্কার হয়ে গেছে। যে মুহূর্তে সেই যানটা পৃথিবীর অর্বিটের কাছে এলো, স্যাটেলাইট হয়তো হ্যাক হয়েছিল, কিম্বা ড্যামেজ হয়েছিল।'
একটু চিন্তা করে দেবব্রত বললেন - 'হ্যাক হওয়ার চান্স বেশি। স্যাটেলাইট হ্যাক করার পরেই তারা নিজেদের ম্যাসেজ পাঠাতে সক্ষম হয়। ভালো এটাই যে অজানা যানটার বিষয় নাসা এখনো কোনো প্রেস রিলিজ দেয়নি। মিডিয়ার কাছে এখনও কোনো খবর নেই।'
'হুম। কিন্তু কল্যারিফিকেশন চাওয়া হয়েছে আমাদের থেকে। সেই যানটা থেকে ম্যাসেজের ওয়েব রিলিজ হচ্ছে সেটাও নাসা জানতে পেরে গেছে।'
একটা কাগজ দেবব্রত চৌধুরীর দিকে এগিয়ে দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বললেন - 'এই একটি ম্যাসেজ বারবার আসছে। তাও আমার মর্ডান ল্যাংগুয়েজে।'
দেবব্রত কাগজটা হাতে নিয়ে পড়লেন সেটা। লেখা ছিল -"We want Debabrata as soon as possible."
ম্যাসেজটা পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দেবব্রত চৌধুরী।
'আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি মিস্টার চৌধুরী। ডিপার্টমেন্টের ভুলের জন্য আপনার লাইফ রিস্ক হয়ে যাচ্ছে এবার। বিশ্বাস করুন, খারাপ আমারও লাগছে। কিন্তু আমার কাছে এটা ছাড়া আর কীই উপায় আছে বলতে পারবেন?'
মৃত্যুঞ্জয়ের কথায় চুপ রইলেন দেবব্রত। সোফা থেকে উঠে খানিক পায়চারি করলেন। পুনরায় সোফাতে বসে বললেন - 'আপনি যদি পারেন তাহলে আগামীকাল ব্যাঙ্গালুরুর জন্য রওনা হয়ে যান। সেখান থেকে পারমিশন নেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। পারমিশন না পেলে আমরা কিছুই করতে পারবো না। আমি আগামীকাল সকালে অফিস যাবো। সেখানেই আমি বলবো, আমার কী-কী লাগবে। আপনি সমস্ত ডি-কোডিং গুলো নিয়ে যাবেন ব্যাঙ্গালুরু। সব কিছু পরিস্কার করে বুঝিয়ে পারমিশন নেবেন। প্রয়োজন হলে আমার সাথে ভিডিও কল করে কথাও বলিয়ে দিতে পারেন।'
'আপনি যাবেন না আমার সঙ্গে?' জিজ্ঞাসা করলেন মৃত্যুঞ্জয়।
'তিরিশ বছর পর অফিসে পা রাখবো মৃত্যুঞ্জয় বাবু। অনেক পুরোনো স্মৃতি জুড়ে আছে। সেগুলোকে একবার রিফ্রেশ করতে হবে।'
********************************
নিজের ঘরের বিছানায় বসে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল নীহারিকা। আকাশে এখনো মেঘ করে আছে। খানিক আগেই এক পশলা বৃষ্টি পড়েছে। সপ্তর্ষি ও অরিজিৎ এখনো কলকাতা ফিরে আসেনি। যতক্ষণ না ফিরে আসে, ততক্ষণ নীহারিকার মনে শান্তি নেই। বারবার মনটা ব্যাকুল হয়ে ওঠার কারণটা নীহারিকা বুঝতে পারছে না। হঠাৎ পিছন থেকে নিজের মায়ের গলার আওয়াজ পেলো নীহারিকা।
'কী রে! এখনো ঘুমোসনি?'
নীহারিকা ঘুরে নিজের মায়ের দিকে তাকালো। কতদিন হয়ে গেছে কাজের ব্যস্ততার কারণে মায়ের কোলে মাথা রাখা হয়নি তার। ইচ্ছে করলো ছুটে চলে যাক মায়ের কাছে আর কোলে মাথা রেখে মন ভরে কাঁদুক। এতে হয়তো একটু হলেও মনের শান্তিটা পাবে। ইচ্ছে থাকলেও সেটা করতে পারলো না নীহারিকা। মায়ের যেন কোনো সন্দেহ না হয়। কিন্তু মায়ের মন। সন্দেহ থেকে মায়ের মনকে দূরে রাখা সম্ভব না। নীহারিকার কাছে এসে বসলেন তার মা। নীহারিকার হাতে নিজের হাত রেখে তিনি বললেন - 'কী হয়েছে রে সোনা তোর? যবে থেকে টাইটান ঘুরে এলি, তবে থেকে তোকে অন্যমনস্ক লাগছে। রাতেও দেরি করে ফিরিস আজকাল। চুপচাপ থাকিস। হ্যাঁ রে, তোর আর সপ্তর্ষির মধ্যে সব ঠিক আছে তো?'
নীহারিকা কী জবাব দেবে বুঝতে পারলো না। খানিক চুপ থেকে বললো - 'আমাদের মধ্যে কিছুই হয়নি মা। সপ্তর্ষি আজ বর্ধমান গিয়েছিল। অর্ণব আর তার পরিবারকে দাহ করতে। এখনো ফেরেনি। তাই চিন্তা হচ্ছে একটু।'
'সত্যি রে সোনা। আমারও খুব খারাপ লেগেছিল জানিস। ওটুকু একটা ছেলে, কেমন করে চলে গেল। কতবার এসেছে এখানে সপ্তর্ষি আর তোর সাথে। এখনো যেন বিশ্বাস করতে পারছি না।' নীহারিকার মা বললেন।
এবার নীহারিকা নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। মায়ের কোলে নিজের মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
'কাঁদিস না সোনা, কাঁদিস না। যার যাওয়ার তাকে কেউ আটকাতে পারে না রে। কেউ না। তোর বাবা যখন গেল, আমি কি পেরেছিলাম আটকাতে? নিজের মনটাকে শক্ত কর সোনা। ভেঙে পড়লে কী করে চলবে?' নিজের মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শ্যামলী দেবী বললেন।
নীহারিকা একটু শান্ত হলো ঠিকই কিন্তু নিজের মায়ের কোল থেকে মাথাটা তুললো না। আসন্ন বিপদের কথা নিজের মাকে কিছুতেই বলতে চায় না সে।
'মা, আজ তুমি আমার কাছে ঘুমোবে?' আবদারের সুরে নীহারিকা জিজ্ঞাসা করলো।
'ঠিক আছে সোনা, ঘুমোবো তোর সাথেই।'
হঠাৎ নীহারিকার মোবাইলে নোটিফিকেশনের একটা বিপ হলো। মোবাইলটা তার পাশেই ছিল। হাতে নিয়ে দেখলো চিফ হোয়াটসআ্যপে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন।
'দেবব্রত ইজ ব্যাক।'
সঙ্গে-সঙ্গে তার মোবাইলে সপ্তর্ষির কল এলো।
'হ্যাঁ রে, চিফের ম্যাসেজ পেয়েছিস?' সপ্তর্ষি জিজ্ঞাসা করলো নীহারিকাকে।
'হ্যাঁ, এইমাত্র পেলাম।' শান্ত কণ্ঠে নীহারিকা বললো।
'খুব ভালো খবর এটা। এবার দেখা যাক কাল কী হয়।'
'তোরা এখন কোথায় আছিস?' নীহারিকা জিজ্ঞাসা করলো।
'এই তো, কলকাতার জাস্ট বাইরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবো।'
'ঠিক আছে।'
কথা শেষ করে নীহারিকা মোবাইল রেখে আবার নিজের মায়ের কোলে মাথা গুঁজে দিলো।
********************************
সকাল প্রায় দশটা বাজে। ইসরোর মেন বিল্ডিংএর গেটের সামনে একটা বড় গাড়ি এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে নামলেন মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক এবং দেবব্রত চৌধুরী। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে দেবব্রত ভালো করে মেন বিল্ডিংএর দিকে তাকালেন। ত্রিশ বছরের ব্যবধান। এই বিল্ডিং থেকেই এক সময় অপমান এবং অবমাননা নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন দেবব্রত। এতো বছর পর আবার ফিরে এলেন। বলতে গেলে সমস্ত ইসরো ইস্ট্রান উইংএর নজর এখন তার দিকেই। বিল্ডিংএর ভিতর ঢুকলেন তিনি। মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে এগিয়ে গেলেন চিফের চেম্বারের দিকে। চেম্বারের বাইরেই নীহারিকা, সপ্তর্ষি, অরিজিৎ, অম্লান এবং মিস্টার বিশ্বাস অপেক্ষা করছিলেন। মৃত্যুঞ্জয় সবার সাথে দেবব্রত চৌধুরীর আলাপ করিয়ে দিলেন। নীহারিকার দিকে তাকিয়ে দেবব্রত বললেন - 'তুমি কি ঋদ্ধিমান গাঙ্গুলীর মেয়ে?'
'ইয়েস স্যার। আপনি কি তাকে চিনতেন?'
'হ্যাঁ। ভালো করেই চিনতাম। ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতো। মিশন ইন্ডিয়ানা'র সময় সে এখানেই কাজ করতো।'
সবাই নিজের-নিজের স্থান গ্রহণ করলো। এক বেয়ারা সঙ্গে-সঙ্গে সবার জন্য কফি নিয়ে এলো। কফিতে এক চুমুক দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বললেন - 'আমার যতদূর মনে হয় আমরা সবাই সব কিছুই জানি। ধোঁয়াশা আর কিছু নেই। এবার আমাদের প্ল্যান করে এগোতে হবে।'
'তার আগে আমি একটা কথা বলতে চাই মৃত্যুঞ্জয় বাবু।' কথাটা বলে কফির কাপ হাতে নিয়ে বড় কাঁচের দেওয়ালের দিকে এগিয়ে গেলেন দেবব্রত ভৌমিক। লঞ্চ প্যাড এখান থেকে বেশ ভালো ভাবেই দৃশ্যমান।
'পৃথিবীর অর্বিটের আশেপাশে চক্কর কাটা, স্যাটেলাইট হ্যাক করা এবং ম্যাসেজ পাঠানো, এগুলো কি বন্ধ হবে? তারা যাকে খুঁজছে, যতক্ষণ না তাকে পাবে, ততক্ষণ হয়তো এগুলো চলতেই থাকবে। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে যা কিছু হয়েছে, তারপর থেকে খুব সম্ভবত তারা নজর রেখেছে এই গ্রহের উপর। আমার যতদূর মনে হয়, তাদেরকে এটা জানান দেওয়া দরকার যে, যাকে তারা খুঁজছে, সে উপস্থিত।'
প্রত্যেকে একে অপরের দিকে তাকালো।
'মানে?' প্রশ্ন করলেন মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক।
'আমাদের সুধাকর নেই আর আপনাদের অর্ণবও নেই। লেটেস্ট কমিউনিকেশন কোড কে ভালো পারে?'
দেবব্রত চৌধুরীর প্রশ্নে নীহারিকা বললো - 'তনুশ্রী, তনুশ্রী মজুমদার নাম তার।'
পুনরায় নিজের জায়গায় বসে দেবব্রত বললেন - 'তাহলে তাকে ডাকা হোক। আরো কিছু কথা বলার আছে। আমার দরকার একজনের। একজন পাইলটের। শিপে যদি কোনো গন্ডগোল হয়, তাহলে সেটা মোটামুটি আমি নিজেই ঠিক করে নিতে পারবো।'
'একজন পাইলট শুধু?' কথাটা শুনে নীহারিকা চমকে উঠলো।
প্রত্যেকেই তাকালো তার দিকে। নীহারিকার বললো - 'দেবব্রত স্যার, উইথআউট টোটাল টিম আমরা কিছুই করতে পারবো না।'
'তা ছাড়া আমরা পারমিশনও পাবো না মিস্টার চৌধুরী।' কথাটা মৃত্যুঞ্জয় বললেন।
সামনের টেবিলে কফির খালি গ্লাসটা রাখলেন দেবব্রত চৌধুরী।
'মৃত্যুঞ্জয় বাবু, মৃত্যুর সাথে কোনো দিন পাঞ্জা লড়েছেন? আশা করি লড়েননি। প্রার্থনা করবো যেন কোনো দিন লড়তে না হোক। যখন মৃত্যু আপনার সামনে থাকে, তখন আপনি দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যান। কিছুক্ষণের জন্য হলেও আপনার চিন্তা ভাবনার শক্তি বিলুপ্ত হয়ে যায়। সেই মুহূর্তটা সব থেকে কঠিন। আপনি মৃত্যুকে হারিয়ে বিজয়ী হবেন, নাকি মৃত্যু আপনাকে হারিয়ে বিজয়ী হবে। বলা খুব মুশকিল। কিছুটা এক্সপেরিয়েন্স হয়তো নীহারিকারাও পেয়েছে। কী বলো নীহারিকা।'
নীহারিকার দিকে তাকালেন দেবব্রত। আবার বলতে শুরু করলেন - 'ভয়, শুধু ভয় না, বীভৎস ভয়। আমি সেই ভয়ের সম্মুখীন হয়েছি মৃত্যুঞ্জয় বাবু। আমি লড়েছি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা। আমি জানি সেটার অনুভূতি। আমার কপাল ভালো বা অন্যের কপাল মন্দ বলতে পারেন যে, আমি মৃত্যুকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে ফিরে এসেছি। আমি চাই না মৃত্যুর সাথে এই ভয়ানক লড়াইটা অন্য কেউ লড়ুক।'
কিছুক্ষণের জন্য মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিকের চেম্বারে নিস্তব্ধতা ছেয়ে রইল। খানিক বিরতি নিয়ে দেবব্রত আবার বললেন - 'আমি জানি না এই মিশনের পারমিশন আপনারা পাবেন কি না। কিন্তু তবুও আমায় এই মিশনটা করতে হবে। সম্পূর্ণ ভাবে শেষ করে দিতে হবে তিরিশ বছর পুরোনো এই গল্পটাকে। তোমাদের মধ্যে কেউ তনুশ্রী মজুমদারকে কন্ট্রোল রুমে নিয়ে আসতে পারবে? আমি এবার ওখানেই যাবো।'
********************************
মেন কন্ট্রোল রুমে শিল্পী দুবেকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। একটু দূরে একটা চেয়ারে বসে আছেন দেবব্রত চৌধুরী। দেবব্রত চৌধুরীর ঠিক সামনের চেয়ারে তনুশ্রী হাতে কলম আর একটা কাগজ নিয়ে বসে আছে। সবার দৃষ্টি দেবব্রত চৌধুরীর দিকে। মুচকি হেসে দেবব্রত চৌধুরী বললেন - 'তোমরা সবাই আমায় এমন করে দেখছো যেন আমি জঙ্গল থেকে পালিয়ে আসা বা ছাড়া পাওয়া কোনো জন্তু। আমিও তোমাদের মত এক সময় এখানে কাজ করতাম। কাজের বদলে অকাজ বেশি করে ফেলেছিলাম, তাই আমার পশ্চাৎদেশে পদাঘাত করা হলো। এমনও বলতে পারো যে, আমি নিজেই চলে গেলাম। থাক সে সব কথা। আমাদের এখন একটিই মিশন। আমাদের ভিশনটাও তাই এক হওয়া দরকার। ভিশন এক না হলে, মিশন সাকসেস হয় না। সরি তনুশ্রী, তোমার ক্লাস ছাড়িয়ে তোমায় এখানে বসিয়ে রেখেছি।'
'আপনার থেকে যা শিখতে পাবো, সেটা কি কোনো ক্লাস শেখাতে পারবে?' মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে তনুশ্রী বললো।
'যে নিজেই জীবনে কিছু শিখলো না, সে তোমায় কী শেখাবে? ছাড়ো এসব কথা। যার জন্য তোমায় ডাকা, সে কাজটা করা হোক।' তনুশ্রীর দিকে তাকিয়ে দেবব্রত বললেন।
'আই আ্যম রেডি স্যার।'
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেবব্রত বললেন - 'ছোট্ট একটা ম্যাসেজ লিখে ছেড়ে দাও। "আই আ্যম কামিং আ্যজ সুন আ্যজ পসিবল", নিচে আমার নাম লিখে দিও, দেবব্রত চৌধুরী।'
অত্যাধুনিক মোর্স কোডে পুরো কথাটা লিখতে তনুশ্রীর প্রায় দু থেকে তিন মিনিট লাগলো। লেখা হয়ে গেলে সে কাগজটা দেবব্রত চৌধুরীর দিকে এগিয়ে দিলো। দেবব্রত ভালো করে দেখলেন। তনুশ্রীর পিঠে হাল্কা চাপড় মেরে বললেন - 'ভেরি ফাস্ট। ইমপ্রেসিভ।'
কাগজটা হাতে নিয়ে দেবব্রত শিল্পীর কাছে গিয়ে বললেন - 'যে স্যাটেলাইট থেকে ম্যাসেজ রিসিভ হয়েছিল, সেখানে এটা পাঠিয়ে দাও।'
শিল্পী দুবের হাতে কাগজটা দিয়ে কন্ট্রোল রুম থেকে বেরোবার সময় নীহারিকা তাকে টুকলো - 'স্যার, ভি আর টিম। এর আগের মিশনটা আমার টিম করেছিল। আমি চাইবো এই মিশনটাও আমার টিমই করুক।'
দেবব্রত অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন নীহারিকার দিকে।
********************************
কিছুক্ষণ আগে মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক ব্যাঙ্গালুরুর জন্য রওনা দিয়েছেন। সেখান থেকে পারমিশান নেওয়াটা অত্যাবশ্যক। তিরিশ বছরের লম্বা ব্যবধানের পর দেবব্রত আবার নিজের পুরোনো অফিস ঘুরে দেখার সুযোগ পেলেন। এদিক-ওদিক ঘুরতে-ঘুরতে তিনি এক সময় ক্লাস রুমের কছে গিয়ে পৌঁছলেন। এই ক্লাস রুমটাই মহাকাশ যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ। দেবব্রত দেখলেন দেবরাজ বর্মন ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে আসছেন। দেবব্রত চৌধুরীকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন দেবরাজ বর্মন।
'এতো বছর পর কোনো পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়াটা সৌভাগ্যের ব্যাপার।' দেবরাজ বর্মনের দিকে এগিয়ে গেলেন দেবব্রত। দুজনেই এক সাথে লিফ্টের দিকে এগিয়ে গেলেন।
'সৌভাগ্য তখন বলা উচিত ক্যাপ্টেন, যখন পরিস্থিতি নর্মাল থাকে।' লিফ্টের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেবরাজ বললেন।
লিফ্টের দরজা খুলে গেল। দুজনে লিফ্টে ওঠার পর দেবরাজ বর্মন বত্রিশ নাম্বার যেখানে লেখা আছে, সেখানে নিজের একটা আঙ্গুল স্পর্শ করলেন। লিফ্ট উপরের দিকে উঠতে শুরু করলো।
'তুমি আমার বিষয় খোঁজখবর রেখেছিলে, সেটা জেনে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। আমার মোবাইল নাম্বার সহ আমার ঠিকানা সবার জানা ছিল না।' দেবব্রত বললেন।
'নিজের বন্ধুদের আমি ভুলি না ক্যাপ্টেন। আমি ঠিক-ভুলের আগে বন্ধুত্বটা দেখি।' দেবরাজ বর্মনের মুখটা দেওয়ালের দিকেই ছিল।
মুচকি হাসলেন দেবব্রত চৌধুরী।
'ঠিক কি তাই?'
দেবব্রত চৌধুরীর এই অদ্ভুত কটাক্ষে দেবরাজ বর্মনের মুখটা লাল হয়ে গেল। ইতিমধ্যেই লিফ্টের দরজা খুলে গেল। দুজনে বেরিয়ে পড়লেন লিফ্ট থেকে। লিফ্টে থেকে বেরিয়ে কিছুটা সোজা হাঁটার পর বাঁ দিকে কিছুটা এগোতেই আর্কাইভ।
'দেবরাজ, একটা কথা বলি? সত্যিই বলতে তোমার থেকে অনেক কিছু শেখা উচিত। আজকালকার দিনে যত দিন এগোচ্ছে, ততো মানুষের মধ্যে প্রেম, ভালোবাসা, মমতা কোথাও যেন হারিয়ে যাচ্ছে। ধীরে-ধীরে মানুষ রোবোর্টে চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। এই যুগে দাঁড়িয়ে তোমার মধ্যে যে ভালোবাসা আর মমতাটা এখন টিকে আছে, সেটাই অনেক বড় কথা। তোমার অনুরাগের প্রতি এই অটুট স্নেহটা যেন তোমার শেষ দিন পর্যন্ত বজায় থাকে। কিন্তু একটা কথা জানো দেবরাজ? প্রেম, স্নেহ, ভালোবাসা ছাড়াও আরো একটা জিনিস হয়, সেটা হলো কর্তব্য। যে মাটির বুকে পা রেখে দাঁড়িয়ে আছি, সেটার প্রতি কিছু কর্তব্য তো থেকেই যায়। তাই নয় কি?'
দেবরাজ বর্মন চুপ করে ছিলেন। আর্কাইভের সামনে পৌঁছে গেছে তারা। দেবব্রত উপরে তাকালেন। বড় একটা সাইন বোর্ডে লেখা আছে, "আর্কাইভ হেড, মিস্টার দেবরাজ বর্মন"। মৃদু হেসে দেবব্রত জিজ্ঞাসা করলেন - 'এটাকে কি পদোন্নতি বলা যেতে পারে?'
এবার নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে গেল দেবরাজ বর্মনের জন্য। ঈষৎ উচ্চ গলায় বললেন - 'এনাফ ইজ এনাফ দেবব্রত। তুমি তখন থেকে কটাক্ষ করে যাচ্ছো আমায়। দেবব্রত, তুমি এটা ভুলে যেও না যে, সেই সময় তোমার যেটা ভালো মনে হয়েছে তুমি করেছো, আর আমার যেটা ভালো মনে হয়েছে আমি করেছি। আমি অন্তত তোমার মত পিঠ দেখিয়ে পালিয়ে তো যাইনি। তুমি তো ক্যাপ্টেন ছিলে। ওই মিশনে সবাই তোমার উপর ভরসা করেই গিয়েছিল। ফলাফল কী হলো? তোমার যদি কোনো দোষ না থাকতো, তাহলে তুমি এখানে থেকে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করতে। যেটা আমার ভাই চেয়েছিল। কিন্তু আমি নিজের ভাইকে সেটা করতে দিইনি। কেন দেবো? তারা কী দায় পড়েছিল? যখন ক্যাপ্টেন নিজেই গায়েব হয়ে গেছে, তখন আমার ভাইয়ের কোনো দায় পড়েনি। ক্যাপ্টেন চৌধুরী, তোমার উপর থেকে আমার শ্রদ্ধা সেই দিনই শেষ হয়ে গিয়েছিল, যে দিন তুমি নিজের পদত্যাগ করেছিলে।'
কথা শেষ করে দেবরাজ বর্মন আর্কাইভের ভিতর ঢুকে গেলন। দেবব্রত এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে।
ক্রমশঃ....