Read Jharapata - 26 by Srabanti Ghosh in Bengali Love Stories | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

ঝরাপাতা - 26

ঝরাপাতা

পর্ব - ২৬

❤💕❤💕❤💕❤

মিলি বাইকের পিছনে গোঁজ হয়ে বসে আছে। রনি যখন ধমক দিয়েছিল, পড়াশোনা ঠিক না হলে ম্যাডামকে না বলে দেয়, বাবা মাও কি বলবে - এইসব ভেবে ভয় পাচ্ছিল। এখন যখন পড়াশোনাই হল না, রনির ধমকে যে খারাপ লেগেছিল, সেই অনুভূতিটা ফিরে আসছে। রনি নিজে তো ভেবেই পাচ্ছে না, মিলির সঙ্গে কিভাবে কথা বলবে। 

মিলি একটাও কথা বলছে না দেখে ক্রমশ বুঝতে পারছে, সব আবার জট পাকিয়ে ফেলেছে নিজে। একটু ফাঁকা একটা ছোট দোকানের সামনে বাইক থামিয়ে বলল, "আইসক্রিম খাবে?" 

অন্যান্য দিনও রনি কিছু খাওয়াতে চাইলে মিলি না না করে। রনি বোঝে সেটা স্বাভাবিক ভদ্রতা। আজ মিলির গলায় অন্য স্বর। তফাতটা রনির কানে পরিষ্কার বাজল। এইটুকু একটা মেয়ে এত শক্ত হতে পারে, আন্দাজ করতে পারেনি। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই ভালোই বুঝেছে। আজ আইসক্রিমের সঙ্গে মিলি গলে যাবে না। 

কলকাতার গণ্ডী ছাড়িয়ে দ্বিতীয় হুগলী সেতুর দিকে বাইক ঘুরতেই মিলি প্রশ্ন করে, "কোথায় যাচ্ছ?"

রনি কাতর গলাতেই বলে, "কোথাও একটা যাচ্ছি। কেন আমার সঙ্গে যাবে না? বন্ধুরা কোথায় গেছে? সেখানে নামিয়ে দেব?"

মিলি আরও শক্ত গলায় বলে, "এখন ওদের সামনে গিয়ে কি বলব? তুমি কি বলবে সেটা বলো। তারপর বাড়ি যাব।"

রনি বুঝে গেছে এভাবে হবে না। অবশ্য সেটা আগেই ভেবে মিলির সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছে ও। শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের সামনে নেমে পার্কিং এ বাইক রেখে টিকিট কাটল রনি। চুপ করে আছে ভয়ে, মিলি যদি আরও খেপে যায়, বাড়ি চলে যায়, কথাই না হয় ! একদিন নিজে এগিয়ে কথা বলেনি বলে এত কাণ্ড হয়েছে। আজও যদি মিলির সঙ্গে কথা না হয়... আর এভাবে সম্পর্কটা খারাপ হয়ে গেলে মিলির সঙ্গে তো ওর কোনো যোগাযোগই থাকবে না। 

শীতের মরসুমে বেশ সুন্দর লম্বা লম্বা রাস্তা আর শয়ে শয়ে গাছের এই শান্ত সবুজটুকু, যেন যান্ত্রিকতার মাঝখানে সভ্যতার হৃদপিণ্ড। সপ্তাহের মাঝখানে দুপুরে লোকজন বিশেষ নেই। ছোট ব্যাটারিচালিত গাড়িতে বাগান ঘুরিয়ে দেখানোর বন্দোবস্ত হয়েছে ইদানীং। রনি বলে, "গাড়িতে ঘুরে দেখি? তারপর বোটিং করব?"

মিলির একসুর, "না ঘুরব না। কি বলবে বলো।"

রনি বিপদের গন্ধ পাচ্ছে, মিলিকে আচমকা ধমকানো খুব খুব ভুল হয়ে গেছে। এখন এখানে নিয়ে আসাও কি ভুল হল? রাগ যদি না পড়ে, ও একলা যদি সামলাতে না পারে? মিলির আবার এ্যাটাকটা হবে না তো? 

ভয়ে ভয়ে বলে, "একটু এগিয়ে চলো। কোথাও বসে বলছি।" বাঁদিকের রাস্তা ধরে চুপচাপ হাঁটছে দুজনে। এদিকে বড় বড় গাছ, নানান দেশের, নানান প্রজাতির। অনেকটা হাঁটলে গঙ্গার ধারে পৌঁছনো যায়। 

মেইন গেট থেকে একটু এগোতেই আধুনিকতার সম্পর্কচ্যূত প্রকৃতির মাঝখানে মিলির মন শান্ত হয়ে আসছে। ভাগ্যিস সিনেমা হলের অন্ধকারে ঢুকে বসে থাকেনি, কেমন অন্যরকম একটা বেড়ানো হল। শুধু রনিদা যদি এত রাগ করে না থাকত ! কি বলবে বলে ওকে ভয় না দেখাত ! রনিদা রাগ করে আছে বলে ওর যে কিচ্ছু ভালো লাগছে না ! 

হাঁটতে হাঁটতে বড় জলাশয়ের কাছাকাছি চলে এসেছে, রনি ক্রমশঃ নার্ভাস হয়ে যাচ্ছে। কাউকে ধমক ধামক দেওয়া কত সহজ আর কাউকে খুশি রাখা কত কঠিন, এটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে। শেষে মিলিকে ডেকে বাঁধানো রাস্তা থেকে নেমে ঘাসজমিতে বসে পড়ল ও। সামনে জলের ধারে শীতের পরিযায়ী পাখি। এখানে শুধুই কয়েকটা, কাছেই সাঁতরাগাছির ঝিলে তাদের আসল বসতি। 

মিলি কাছাকাছি বসে পড়তেই রনি আবার নরম গলায় বলে, "মিলি, সিনেমা দেখতে যেতে ইচ্ছে করছিল? বারণ করলাম বলে...."

- "না, এখানে খুব ভালো লাগছে।" জলের দিকে তাকিয়েই মিলি বলে। রনির মনে হয় ডুবে যাওয়ার মুখে মিলি ওকে টেনে তুলল। বুক ভরে দম নিয়ে বলেই ফেলে, "তাহলে রাগ করে আছ কেন?"

- "আমি কোথায় রাগ করেছি? তুমি তো আমাকে..... আচ্ছা রনিদা, সত্যি বলো, ম্যাডাম কি বলেছেন, আমি চেষ্টা করছি না? তোমাকে, বাবাকে তো একসঙ্গে বললেন, আমি খুবই খাটছি। তবে ওনার ইচ্ছে নেই দুটো সেমিস্টার দিই। বরং আগামী একমাস একটায় কনসেনট্রেট করলে রেজাল্ট ভালো হবে, এই তো বললেন।"

- "মিলি শোনো..... "

- "না, তুমি আমাকে বকা দাও আর যা করো, এটা বলো, তোমার সঙ্গে কলেজে আসি, আর পড়তে যাই। পনেরোদিন অন্তর শনিবার একটা করে থেরাপির সেশন। আর কোথাও যাই, কিছু করি? নাচের ক্লাসও বন্ধ করে রেখেছি। একদিন, তাও হঠাৎ বন্ধুরা বলায়, সবার মাঝখানে না করলে কত কথা শোনায়। ঠিক আছে, তুমি ঠিকই বলছ, ঐটুকুও সময় নষ্ট করা আমার উচিত নয়। এভাবে বলছ কেন? যেন আমি শুধু ঘুরে ঘুরে....." টপটপ করে জল পড়ছে চোখ থেকে, গলা ধরে এসেছে। মিলি চুপ করে দুহাতে মুখ ঢাকল। এত নির্জনে, মনেই নেই আসলে এটাও পাবলিক প্লেস, যেকোনো সময় যে কেউ এসে পড়বে, ওদের মতো বেড়াতে এসে বা এখানকার স্টাফরা। 

রনি চূড়ান্ত বিব্রত। কি করবে, কি বলবে, মিলির যদি কিছু হয় ! কোনোমতে ডাকল, "এ্যাই মিলি, আমি পড়ো না বলিনি। মানে ঘুরতে যাচ্ছিলে তো, কি হয়েছে বলোতো, আমি তো কোশ্চেন পেপার বানাচ্ছিলাম। মানে খুব টেনশনে ছিলাম। ওরকম করে বলে ফেলেছি। আমি তো জানি, তুমি খুব ভালো মেয়ে। তুমি পড়াশোনায় কত ভালো, চৈতালীদি বলেন তো। এ্যাই, মিলি, শোনো না !"

মিলির মনের খুব দুর্বল অবস্থায় রনি কাছাকাছি ছিল, পাশে ছিল। মিলিকে ভালোবেসে ফেলেছে, ভালো রাখতে চেয়েছে বলে রনি মিলিকে এই কদিন কেবল যত্ন করেছে, প্রশ্রয় দিয়েছে। আবার রনির সঙ্গে যা খারাপ হয়েছে, তার জন্য ওর প্রতি সমবেদনা ছিল মনে, ফলে রনির সঙ্গে কোথাও একটা মানসিক যোগ গড়ে উঠেছে মিলির। সেটা দুজনেই চোখে দেখেনি, বোঝেনি।

মিলির মনে হয়েছিল, এভাবেই রনি সবসময় পাশে থাকবে, এভাবেই যেন চিরকাল পাশে ছিল। আজ সেই ভরসার ভুবনে প্রথমবার রনির কথাতেই ভুল সংকেতগুলো পৌঁছল। মনে হল রনি আসলে বোধহয় ওকে চেনে না, বোঝে না, বিশ্বাস করে না। যত সময় গড়িয়েছে, তত মিলির মনে হয়েছে, যত কাছের মানুষ ভেবে নিয়েছিল, ওর রনিদা ওর তত কাছাকাছি নেই। এদিকে রনিকে যে এভাবে দূরে যেতে দিতে হবে মানতেও পারছে না। 

রনি একটু ইতস্ততঃ করে ওর কাঁধের উপর হাত রাখে, মিলির তরফে কোনো বাধা না পেয়ে অন্য হাতে জোর করে মুখ থেকে হাত সরায়। মিলির দু হাত ধরে বলে, "কেঁদো না মিলি, সরি। আমার খুব মনখারাপ হয়েছিল। তোমার সঙ্গে দেখা হবে না আজ, এটা শুনেই মনখারাপ লাগছিল। সেই রাগটাই তোমার উপর পড়েছে। সরি, ওয়ানস এগেইন।"

সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে আছে মিলি, এখনও চোখের জল গড়িয়ে নামছে গাল বেয়ে, কিন্তু এই কথাগুলো ওর রনিদা ওকে বলছে, বিশ্বাস করতে পারছে না। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছে। তাই একফোঁটা নড়ছে না, চোখের পলক ফেলছে না, চোখের জল মোছার তো প্রশ্নই নেই। একটু নড়লেই যদি স্বপ্নটা ভেঙে যায় ! 

রনি একবার যখন নিজের মনের কথা খুলে বলতে পেরেছে, ও নির্দ্বিধায় সব কথা বলে যাচ্ছে মিলিকে। মিলির দু হাত মুঠোয় ভরে বলে চলেছে, "তোমাকে না দেখে আমি এক মুহূর্তও থাকতে পারি না আজকাল। সকালে কতবার ব্যালকনিতে এসে দেখে যাই, তুমি ঘুম থেকে উঠেছ কিনা, গাছে জল দিচ্ছ কিনা, স্নান করে চুল খুলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বন্ধুদের ফোন করছ কিনা। দিনের বেলায় ক্লাস নিই বলে সময়টা কাটাতে পারি। তোমাকে যখন বাড়ির সামনে নামিয়ে দিই, আর সেদিন দেখা হবে না ভেবে রোজ মনে হয়, তোমাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাই, বাড়ি ফিরব না।"

মিলি বলতে পারে না, একই অবস্থা ওর ও। সকাল থেকে বারবার বারান্দায় ঘুরে ফিরে আসে, রনি ওর ঘরের ব্যালকনিতে আছে কিনা দেখতে। সন্ধেয় বহু সময় রনিকে ব্যালকনিতে দেখে নিজের ঘরের ভিতর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। কি ভীষণ সাড়া দিতে, কথা বলতে ইচ্ছে করে। কি বলবে ভেবে পায় না, তাই লুকিয়েই থাকে। যা কোনোদিন ভাবেনি, আশা করেনি, তাই হয়েছে? রনিরও একই রকম মনে হচ্ছে? ভাবতেই সব রাগ দুঃখ আবার ঝাঁপিয়ে আসে। তাহলে কেন অমন করে বলল? 

এতটা মন খোলার পরও মিলি নিশ্চুপ। না, কথাগুলো বলতে বাধা দেয়নি বা অপছন্দ করছে মনে হয়নি। তবে শোনার পরও তো একই ভাবে তাকিয়ে আছে, কিছু বলা দূরে থাক ! রনি ওর দু হাত ঝাঁকিয়ে বলে, "এ্যাই মিলি, আমি সত্যিই তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারছি না। তোমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। সেজন্যই, তোমাকে একবার দেখার জন্যই আটকে রাখতে চেয়েছিলাম। সরি মিলি, আর কোনোদিন তোমার বন্ধুদের মাঝখানে আসব না, তোমার আনন্দে বাধা দেব না। এই একটাবার মাপ করে দাও। প্লিইইইজ মিলি।"

রনি হাত ঝাঁকানোতে ঘোরটা কেটে গেছে মিলির। আর এবার রনি স্পষ্ট করে বলেছে ভালোবাসার কথা। লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি হাত ছাড়িয়ে নিতে চায়। রনি শক্ত মুঠোয় ধরে আছে, "হাতটা ছাড়িয়ে নেবে? তুমি যা বলবে, তাই হবে মিলি। তুমি বললে আমি ছেড়ে দেব। কিন্তু সারাজীবন তোমার জন্য অপেক্ষা করব। একটা অপরাধের জন্য তোমার হাত ধরার অধিকার ফেরত নিয়ে নেবে?" মিলির হাত ছেড়ে দিয়েছে, প্রবল হতাশায় দুমড়ে মুচড়ে যায় রনির গলা। মিলি জানেনা, রনি ফিরে গেছে ওর আসল অপরাধের রাতে, দুজনের ফুলশয্যার রাতে। 

মিলি শুধু বোঝে এই মুহূর্তে রনির হাহাকারটা। রনি ছেড়ে দিলেও হাত সরিয়ে নেয় না। ওর হাত ধরে বলে, "সত্যিই আমাকে বিশ্বাস করো রনিদা?"

- "করি, তোমাকে আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করি। আমিই বিশ্বাস করার মতো না। আমার কাজই ঠিক না।" রনি আবারও শক্ত করে ধরেছে ওর হাতটা। 

- "তুমি খুব ভালো রনিদা। আমি বরাবর জানি। আর এখন তুমি আমার জন্য যা করছ, অনেক বড় মন হলে করা যায়। কে বলেছে তুমি ঠিক না? আমার তো কষ্ট হচ্ছিল তুমি আমাকে ভুল বুঝছ, রাগ করছ বলে।"

- "ভেবে বলছ তো? আমাকে সান্ত্বনা দিতে বলছ না তো? এইভাবে আমার সঙ্গে থাকবে তো? কোনোদিন কোনো অবস্থাতেই আমার হাত ছেড়ে যাবে না?"

- "না রনিদা। তোমাকে ছেড়ে আমিও থাকতে পারব না। এইটুকু সময় তুমি রাগ করে ছিলে, আমার মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কেউ জলের তলায় ঠেসে ধরে রেখেছে। কখনও আমার হাত ছেড়ে দিও না রনিদা।"

- "তোমারও মনে হচ্ছিল জলে ডুবে যাচ্ছ? দম আটকে যাচ্ছে?" রনি হতবাক ! এত মিল ! মিলির ডানহাতটা নিজের বুকের কাছে টেনে নেয় "প্রমিস করো, আমাকে আর কখনো এরকম কষ্ট দেবে না?"

- "আমি কষ্ট দিয়েছি, নাকি তুমি?"

- "আজ আমিই কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু তুমিও আমাকে ছেড়ে যাবে না। আমার হাত ছাড়বে না, বলো।"

এমন অর্থহীন অথচ দামী কথা আর প্রতিজ্ঞা - পাল্টা প্রতিজ্ঞা চলতে থাকে। পরস্পরের উপর দোষারোপ কমে, দুজন দুজনকে কতটা চোখে হারায় আর কতটা দুজন দুজনের সঙ্গ চায়, সেই কথা চলে। একবার পথে কমবয়সী চারটি ছেলে মেয়েকে দূর থেকে আসতে দেখে চটপট রনি মিলির হাত ছেড়ে দেয়। 

এতক্ষণ মনের সব কথা যেভাবে বাধাহীন ঝরণার মতো বয়ে যাচ্ছিল, তা যেন বাধা পায়। দুজনেই লজ্জা পেয়ে যায়। 

কথা ঘোরাতে রনি তাড়াতাড়ি বলে, "বোটে চাপবে? চলো না, এলামই যখন।"

চলবে