Read Jharapata - 27 by Srabanti Ghosh in Bengali Love Stories | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

ঝরাপাতা - 27

ঝরাপাতা

পর্ব - ২৭

🌌❤🌌❤🌌❤🌌

প্রায় সকলেই জানেন, বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভিতর অগভীর সরু খাল কাটা আছে, যেগুলোর কয়েকটি গঙ্গার সঙ্গে যুক্ত, কয়েকটি আবার বৃষ্টির জল ধরে রাখা। সেরকম একটা সরু খালে প্যাডেল বোট চালিয়ে ঘোরা যায়। দুজন খানিকক্ষণ বোটে চড়ে হাসাহাসি করে আজকের ঘটনা নিয়ে। বন্ধুরা জানে, মিলি পড়তে গেছে, ভাবতেই আরও হাসি পাচ্ছে। 

সেখান থেকে বিখ্যাত বটগাছ, পামগাছের সারি, বিভিন্ন বিদেশি দুষ্প্রাপ্য গাছ, যাদের মধ্যে রয়েছে ম্যাড ট্রি, পাগলা গাছ, যার প্রত্যেকটি পাতা আলাদা। আবার বটগাছের মতোই এই বাগানের অনন্য আকর্ষণ, ভিক্টোরিয়ান ওয়াটার লিলি, পদ্মের পাতার থেকে বেশ বড় পুরু থালার আকৃতির ছড়ানো যে পাতায় চার বছর পর্যন্ত বাচ্চা বসতে পারে। ডুবে যাবে না, এতটাই ভার বইতে পারে এই পাতা। সব ঘুরে ঘুরে দেখে, বোটানিস্ট রনির কাছে সেগুলোর পরিচয় শুনে, ছবি তুলে সময় গড়িয়ে চলে। তবুও কত গাছ দেখা বাকি। 

মিলি একটু উসখুস করছিল বেশ খানিকক্ষণ থেকেই। এবার তিনটে বাজতে যায় দেখে বলে ফেলে, "রনিদা, বিকেল হয়ে যাচ্ছে। তোমার বাইকে ফিরলেও অনেক সময় লাগবে। বাড়িতে তো জানে সাড়ে বারোটার শোতে সিনেমায় গেছি। দেরি হলে মা চিন্তা করবে। ভাইয়াকে ফোন করবে। তখন খুব লজ্জার ব্যাপার হবে।"

রনি কবজি উলটে ঘড়ি দেখে বলে, "হ্যাঁ, এবার ফিরতে হবে। আর একটা জিনিস দেখেই বেরিয়ে যাব। আর শোনো, লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই, বাড়িতে বলে দিও, আমার সঙ্গে এসেছিলে। কাকু কাকিমা আপত্তি করলে আমি কথা বলব।"

মিলির একদিকে খুব গর্ব হয়, রনি মিথ্যে বলতে রাজি না দেখে। আরেকদিকে ভাবে, "আজ প্রথমে এত কথা চালাচালি হয়ে গেছে বন্ধুদের সঙ্গে, এখন এখানে আসার নাম করলেই বন্ধুরা আমাদের দুজনের সব কথা বুঝে যাবে না বললেও। আজ থাক।" সেটাই বলে রনিকে। 

- "ঠিক আছে। আগ বাড়িয়ে আজকের কথা বলার দরকার নেই। তবে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেই তুমি বোলো, ম্যাডাম বাড়ি ছিলেন না। আমি তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলাম।"

- "তখন কেউ যদি কিছু বলে?" মিলির ভীরু প্রশ্ন। রনির এতক্ষণের আনন্দ কোথায় ভেসে যায়। একটা গভীর শ্বাস ফেলে ভাবে, মিলি জানে না, ওর সঙ্গে কোথাও যাওয়া নিয়ে কারও প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায় নেই মিলির। পরক্ষণেই মন শক্ত করে, এসব ভাববে না আর, মিলি ওকে ভালোবাসে বলেছে, আর কি চাই? 

একটু হেসে মিলিকে বলে, "যে যাই বলুক, তুমি আমার নাম করবে। আর তাদের আমি উত্তর দেব। তোমাকে কারও কাছে অসম্মানিত হতে আমি দেব না। এইটুকু ভরসা করো তো?"

মিলি মাথা নাড়ে, "ভরসা করি। তোমাকে নিয়ে আমার কোনো চিন্তা নেই।"

- "ব্যস, তাহলেই হল। কাকিমাকে ফোন করো। বলো আমার সঙ্গে আছ। কিছু খেয়ে বাড়ি ফিরছি আমরা।"

- "না না, কিছু খাওয়ার দরকার নেই। মাকে ফোন করে রওনা দিই চলো।" মিলি তাড়াতাড়ি থামায়। ব্যাগ হাতড়ে ফোন বের করছে ওদিকে। 

- "মিলি, আমার খুব খিদে পেয়েছে। তাতেই বুঝতে পারছি, তোমারও খিদে পেয়েছে। বাড়িতে বলেই দিচ্ছি। আর কেউ চিন্তা করবে না, তোমাকে কিচ্ছু বলবে না। তাহলে খাওয়ার নামে এরকম করো কেন?"

- "না মানে..."

- "কোনো মানে নেই। এই দেখো, গোলাপের বাগান। আর এখানে রয়েছে বিজ্ঞানীদের হাতে বানানো কালো গোলাপ। সব কথা ভুলে এটা দেখো। তারপর খেতে যাব। ও হ্যাঁ, ফোন করে নাও।"

বিশাল গোলাপ বাগানের অজস্র ফুলের সৌন্দর্যে সত্যিই সব ভুলে যায় মিলি। কত রকম রঙ, গন্ধ, আকার, নামের যে গোলাপ এখানে একসঙ্গে ! মাকে ফোন করেছে, রনির সঙ্গে আছে শুনে আরও পরে আসার কথায় মা দিব্যি আচ্ছা ঠিক আছে বলে দিয়েছে, মিলির আর কোনো ভাবনাই নেই। ও বিভোর হয়ে ফুল দেখতে থাকে। 

রনিও হয়তো কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়েছিল, মিলিকে ডাকতে গিয়ে বিয়ের আগের পুরোনো অভ্যাসে ফিরে গিয়ে বলে বসে, "মিলি, চল এবার যাই। পরীক্ষার পর আরেকদিন নিয়ে আসব আমি।" মিলি চমকে তাকাতেই খেয়াল হয়, তড়িঘড়ি কথাটা চাপা দেয়, "মিলি, খুব খিদে পেয়েছে। চলো, আরেকদিন আসব।"

রনির পিছন পিছন মিলি বেরিয়ে আসে, বাইকে বসে, রনি টের পায়, ভীষণ রকম অন্যমনস্ক। বাইক না থামিয়েই রনি হাওয়ার সাঁইসাঁই আওয়াজের উপর দিয়ে বলে, "শক্ত করে ধরে বোসো। রাস্তা ফাঁকা, জোরে চালিয়ে চলে যাব।" মিলি সাড়া দেয় না, তবে কাঁধের উপর মিলির মুঠোটা আরও শক্ত হয়েছে বুঝতে পারে। 

🌹❤🌹❤🌹❤🌹

পার্ক স্ট্রিটের একটা বিখ্যাত রেস্টুরেন্টের সামনে রনি বাইক থামালে মিলির হুঁশ আসে। নেমে দাঁড়িয়ে রনিকে ফিসফিস করে বলে, "এখানে ঢুকবে?"

- "হ্যাঁ, কেন তোমার অসুবিধাটা কি আমার সঙ্গে খেতে? শোনো...."

- "আরে দূর, তোমার সঙ্গে খাওয়া নিয়ে বলছি না।" মিলি এক ফুঁয়ে রনিকে উড়িয়ে দেয়, "আমি অন্যকথা বলছি। মানে আমি একটা সিম্পল কুর্তি পরে কলেজে এসেছিলাম। এত বড় রেস্টুরেন্টে, এখন, মানে অড লাগবে খুব।"

রনির খুব মজা লাগে। মুখ টিপে হেসে বলে, "আজ কষ্ট করে খেয়ে নাও। পরের দিন বিউটি পার্লার থেকে সেজেগুজে এসো।" বাইকটা সাইডে পার্ক করে রনি এগিয়ে যায়। এত হাসি পাচ্ছে ওর, মিলির দিকে আর ফিরে তাকায় না। 

এখানেও বেশ ফাঁকা সপ্তাহের মাঝখানে বলে। টেবিলে গিয়ে বসে ওয়েটার এসে দাঁড়াতে রনি দুমদাম একগাদা কাবাব, বিরিয়ানি, যা পারে অর্ডার দিতে থাকে। আসলে সেই সকাল থেকে ওর জন্য মিলির খাওয়া হয়নি। এখন যা যা বিখ্যাত এই রেস্টুরেন্টের সব একসঙ্গে খাওয়াবে মিলিকে। মিলিও হাঁ হাঁ করে ওঠে, "কি করছ? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার খিদেয়? এত খাবার কে খাবে?"

- "আরে জ্বালা ! তুমি এত লজ্জা পাচ্ছ কেন, খিদে পেয়েছে, সেটা তো আমি বুঝতেই পারছি। আর আমিও খাব তো।"

- "তুমি থাম।" মিলি ওয়েটারের দিকে ঘুরে যায়, "আচ্ছা, আপনাদের এই কাবাবটা কটা থাকে একপ্লেটে?"

ওয়েটার বেচারা চুপ করে ছিল। তবে রনি যা অর্ডার দিচ্ছিল, সেটা দশজন না হোক, চার পাঁচজন খাইয়ে লোকের পরিমাণ। সে এবার মিলিকে বোঝাতে থাকে, কোন আইটেম একটা সার্ভিং প্লেটে কতটা পরিমাণ থাকে, এক বা দুজন খেতে কতটা অর্ডার দিতে পারে। রনি একটা জলের গ্লাস তুলে ঢকঢক করে জল খেয়ে নেয়। একরাশ তৃপ্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে মিলির গিন্নীপনার দিকে। আর মিলিকে পুঁচকে, ভিতু একটা মেয়ে মনে হচ্ছে না। 

হঠাৎ খেয়াল করে, এখন কি কি ওদের টেবিলে দেওয়া হবে বলার পর আরও একগাদা খাবার ও অর্ডার দিয়ে রাখল। সেগুলো নাকি যাওয়ার সময় পার্শেল নেবে। একবার রনি ভাবল, পার্শেল কেন, সেটা জিজ্ঞেস করা বোধহয় উচিত হবে না। কিন্তু কৌতূহল বড় বালাই, ওয়েটার সরে যেতেই রনি বলে, "পার্শেল কার জন্য? তোমার বন্ধুদের খাওয়াবে নাকি?"

হেসে ফেলে মিলি, "না না, আমরা এখানে খেয়েদেয়ে যাচ্ছি। বনিদা, পিউবৌদি, ওদের জন্য নিয়ে যাও। তুমি যা অর্ডার দিচ্ছিলে, শেষ করতে আমার বন্ধুদের সবাইকেই ডাকতে হত।" রনির মনটা আবার ভারী হয়ে যায়। ও যদি একটু বুদ্ধির পরিচয় দিতে পারত সেদিন, আজ বাড়ির সবাইকে নিয়ে খুশি থাকতে পারত। বোঝে, আরও অনেক লম্বা পথ পেরোতে হবে। সেই পথে মিলি সঙ্গে থাকলে তাও কষ্টটা কমবে। 

- "তোমাকে একটা কথা বলব, একটু অদ্ভুত, হেসো না প্লিজ। আমাকে একটা কথা বলবে?" মিলি একটু ঝুঁকে, গলা নামিয়ে প্রশ্ন করেছে ইতিমধ্যে। মুখটা সিরিয়াস, একটু আগের হাসি গায়েব। 

- "হাসব কেন? কি কথা বলো না।"

- "তুমি আমাকে কি বলে ডাকতে?"

- "মানে? তোমার যা নাম, মিলি বলে ডাকতাম। বরাবরই তো। অবশ্য অদ্রিজাও তোমার নাম। তবে পাড়ার কেউই তো অদ্রিজা বলে না।"

- "নাম নয়, তুমি বলতে, নাকি তুই বলতে আমাকে?"

রনির মনে হয়, রেস্টুরেন্টের সেন্ট্রাল এসি খারাপ হয়ে গেছে। মিলির একদিন সব মনে পড়বে, জানে। তবুও........ আজই মনে পড়া খুব দরকার ছিল? 

- "মিলি, আমি একবার ওয়াশরুমে যাব। তুমিও যেতে পারো। এখানে কেউ তোমার ব্যাগ ট্যাগে হাত দেবে না।" রনি আপাততঃ সামনে থেকে পালায়। 

রুমালে মুখ মুছতে মুছতে রনি যখন ফিরে আসে, ওয়েটার খাবার দিয়ে গেছে। রনি এবার মিলির পাশেই বসতে যায় সোফায়। মিলি উঠে পড়ে, "আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।"

আসলে মিলির একটু ভয় ভয়ই করছিল। খুব স্বাভাবিক প্রবণতা, এতকাল ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকলেও বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের থেকে একটা দূরত্ব বজায় রাখাও অভ্যাস করেছে। প্রথম আবেগ কেটে গেলে রনির উপস্থিতি ভালো লাগলেও, পুরনো একটা অস্বস্তি আবার ফিরছে। ওয়াশরুমে এসে চোখে মুখে জল দেয়, ঠান্ডা মাথায় ভাবতে চেষ্টা করে, শেষে নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়, "নাঃ, আমিই ঠিক। একটা সীমানা টানাই উচিত সব সম্পর্কেই। রনিদা একটি ছেলে, সে যতদূর যেতে পারে, আমি পারি না। এমনকি আমি ততদূর গেলে রনিদাও আমাকে ভালো নাও ভাবতে পারে।"

মিলি ফিরে আসে, হাসিমুখে রনির পাশেই বসে, তবে শুধু পাশাপাশিই বসে, যথেষ্ট দূরত্ব রেখে। রেস্টুরেন্ট একেবারে ফাঁকা নয়। আরও দু তিনটি কাপল রয়েছে, কর্মীরা তো রয়েছেই। রনিদাকে ভালো লাগে বটে, তবে মানুষটা কেমন আরেকটু বোঝার দরকারও ওর রয়েছে। 

চলবে