Read Jharapata - 28 by Srabanti Ghosh in Bengali Love Stories | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

ঝরাপাতা - 28

ঝরাপাতা

পর্ব - ২৮

🌹🌿🌹🌿🌹🌿🌹

মিলি ফিরে আসতেই রনি একগাল হেসে ওয়েলকাম করতে গেছিল। এবার নিজে থেকেই মিলি ওর পাশে বসায় মনটা আরও ভালো লাগে। ওর তরফে একটার পর একটা অস্বস্তি জমা হচ্ছিলই আজকের দিনে। যতই সব ঠিক করতে চাইছে মন থেকে, এই জীবনটা ওদের দুজনের হওয়ার কথা নয়, এই কথাটা বারবার মাথায় ঘা দিচ্ছে। তার মধ্যে ও পাশে বসতে যেতেই মিলির উঠে যাওয়ায় রনিরও মনে হয়েছিল, ও একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। মিলি ওর স্ত্রী, ও তো মিলির কাছে তার স্বামী নয়। 

এখন মিলি একটা দূরত্ব রেখে বসতেই রনি বোঝে, মিলি ওর প্রতি ভালোবাসাটা স্বীকার করেছে, কিন্তু মনের দিক থেকে সম্পূর্ণভাবে ওর হয়ে যায়নি। আর এত কম সময়ে সেটা হওয়ার কথাও নয়। বরং এটাই একটা ভালো দিক যে ওর সঙ্গ মিলির ভালো লাগছে, মিলির কোনো সাইকোলজিক্যাল প্রবলেমও দেখা দেয়নি সারাদিন। 

মিলি এদিকে টেবিলে রেখে যাওয়া খাবারগুলো ঢাকা খুলে রনির সামনের প্লেটটায় একগাদা খাবার চাপিয়ে ফেলেছে। রনি হাঁ হাঁ করে ওঠে, রেস্টুরেন্টের বাকি লোকের এক দুজন ফিরেও তাকায়, "কি করছ বলোতো? যা পারছ আমার প্লেটে চাপাচ্ছ ! তখন নাহয় একটু বেশিই অর্ডার দিয়ে ফেলেছিলাম। তাও তোমার খুব খিদে পেয়েছে ভেবে। তুমি কি তাতে আমাকে রাক্ষস টাক্ষস ভাবলে নাকি?" 

মিলি চাপা গলায় বলে, "আচ্ছা, যা খাবে তুমি দেখে নাও। কিন্তু চেঁচিও না প্লিজ। সবাই তাকাচ্ছে।"

- "সরি, চেঁচাব না। আর কিছু দিও না। তুমিও নাও।" রনি সার্ভিং বোল থেকে মিলির প্লেটে খাবার দিতে থাকে। মিলি না না করে উঠতেই, থেমে গিয়ে চামচ সরিয়ে নেয়। কোনোভাবেই যেন মিলির মনে না হয়, ও ডমিনেট করছে। 

মিলিকে খেয়ে নাও বলে নিজের ছুরি আর টেবিল স্পুনটা তুলে নেয়, ভয়ানক খিদে পেয়েছে ওর। এতক্ষণে টিফিন ব্রেকে খাওয়া তো হয়েই যায়, তিন চারবার চা খাওয়াও হয়ে যায় ইউনিভার্সিটিতে দলে পড়ে। এখন মনে পড়ে, আজ মিলির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর একটাও সি *গা *রে *ট ও খায়নি। 

- "গুড, ভেরি গুড।" নিজেকেই নিজে বলে, "মিলি আমার ইনফ্যাচুয়েশন কিনা, আমার দোষ ঢাকার জন্য মিলিকে ফিরিয়ে নিতে চাইছি কিনা বোঝা হয়ে গেল। ওর জন্য সব নেশা ভুলে যেতে পারি। এইটুকু পরিষ্কার, ওকে সত্যিই ভালোবাসি, ওকে ভালো রাখতে পারব। এবার থেকে অনেক খোলা মনে থাকতে পারব, সারা পৃথিবীর সামনে দাঁড়িয়ে উত্তর দিতে পারব আমি।"

মিলির দিকে চোখ তুলে দেখে, খাবার নাড়াচাড়া করছে, মুখে তোলেনি, কি যেন ভাবছে। "কি হল খাও" ছোট্ট তাড়া দেয় রনি। 

- "এই তো খাচ্ছি।" চটপট মুখ নিচু করে মিলি। রনি টেবিল স্পুনে উঁচু উঁচু করে বিরিয়ানির রাইস তুলেছে, নিচে হাত পেতে ওর মুখের সামনে ধরে, "প্লিজ খেয়ে নাও, ঠান্ডা হয়ে যাবে। আমার খুব খিদে পেয়েছে। এতবার বলার পরও যদি না খাও, বুঝতে হবে, রাগটা এখনও আছে। মিলি, সরি।" মিলির শুধু ডান কানে কথাগুলো যাবে, বাঁ কানেও নয়, এতটাই গলা নামিয়ে বলে। 

মিলি মাথা নাড়ে, "খাচ্ছি তো। তুমি রাখো।" দু কানই লাল হয়ে গেছে মিলির। 

- "লজ্জা পেতে হবে না। কেউ দেখছে না। নাও বলছি।"

রেস্টুরেন্টের বড় হলে একদিকের কোণায় একটা টেবিলে দেয়ালে পিঠ করা পাশাপাশি সোফায় বসে আছে দুজন। পুরো ফ্লোরটাই দেখা যাচ্ছে। মিলি আড়চোখে দেখে, সত্যিই কেউ দেখছে না, সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। তাড়াতাড়ি খাবারটা মুখে নেয় রনিকে থামাতেই। 

রনি চামচটা প্লেটে নামাতে যেতেই ও হাত বাড়ায়, "ওটা আমাকে দাও, এঁটো হয়ে গেছে। তুমি এটা নাও।" রনি ওর হাতটা ধরে রাখে, "চুপ করো। আমি খাইয়ে দিচ্ছি, খেয়ে নাও। নাহলে খাবে না, আমি বুঝেছি।" ওর হাত ধরা হাতটা রনি নিজের কোলের উপর নামিয়ে এনেছে, ফলে টেবিলের ওপার থেকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না, এটাই ভরসা। 

কয়েকবার রনির হাতে খেয়ে মিলি মাথা নাড়ে, ''এবার হাত ছাড়ো। নাহলে আর খাব না।" রনি ঘাবড়ে গিয়েই হাত ছেড়ে দেয়। ছাড়া পেতেই মিলি নিজের চামচে খানিকটা রাইস তুলে রনির দিকে বাড়িয়ে দেয়। এতটা সৌভাগ্য রনি বেচারা ভাবতে পারেনি। রনি খাবারটা মুখে নিতেই, মিলি দুজনের হাতের চামচদুটো বদলে দেয়। 

- "এটা কি হল?" একমুখ খাবার নিয়েই প্রশ্ন করে রনি। 

- "এবার নিজেরটা নিজে খাও। প্লিজ। আমার খুব লজ্জা করছে, কে কখন দেখবে আমাদের। ঐ কোণের ওরা এ ওকে খাইয়ে দিচ্ছে, আমি দুবার দেখেছি। সেভাবেই কেউ আমাদের দেখবে।"

- "আচ্ছা, তুমি আমাকে ফেলে ঐ দাড়িওলা, লেদার জ্যাকেট পরা, মাথার চুলে পাঁচরকম রঙ করা ছেলেটাকে দেখছিলে?" মিলি খেপে উঠতে গিয়েও দেখে রনি ঠোঁট টিপে হাসছে। নিজেও হেসে ফেলে। 

- "আচ্ছা, আচ্ছা। আমি আর খাইয়ে দিচ্ছি না। এবার খেয়ে নাও।" রনি নিজের চামচে খাবার তুলে এবার নিজের মুখেই দেয়। 

- "হুম, বাড়ি যাব। সন্ধ্যা হয়ে গেল।"

রনির বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে ওঠে, মিলি একটু পরেই চলে যাবে ! আবার প্রায় বারো ঘন্টা, একটা দিনের অর্ধেক সময় ওকে দেখতে পাবে না? কাল থেকে ঐ একটুখানি যাতায়াতের পথে যা দেখা হবে? এভাবে ওকে নিয়ে বাইরে ঘোরাঘুরিও করা উচিত না, সামনে পরীক্ষা। ওর জন্য যথেষ্ট পড়াশোনার ক্ষতি হয়েছে মেয়েটার। তার পরেই ভাবে, এখন এই নিয়ে ও আপসেট হয়ে আছে বুঝলে মিলিও মনখারাপ করবে, খাবে না। চটপট নিজের প্লেট খালি করতে থাকে। ওর দেখাদেখি মিলিও। 

🌹🌿🌹🌿🌹🌿🌹

বাড়ির সামনে বাইক থেকে নেমে হেলমেট খুলছে মিলি। রনি আগেই দেখেছে, নিজের ঘরের ব্যালকনিতে বৌদি হামলে পড়ে দেখছে। মিলি হেলমেটের লকটা টানাটানি করছে দেখেও রনি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। খুলতে হেল্প করলে দেখতে হবে না, সারা সন্ধে ওর লেগপুল চলবে। 

মিলি হেলমেটটা বাড়িয়ে দিতেই চাপা গলায় বলল, "চলে যাচ্ছ? আমি খুব মিস করব। ফোন করলে ধরবে?"

মিলিরও মনে হচ্ছে আরও খানিকক্ষণ যদি ওর সঙ্গে গল্প করতে পারতাম ! কিন্তু এভাবে রাস্তায়, পাড়ার মধ্যে, বাড়ির সামনে, কে কি শুনে ফেলবে ! তার চেয়ে ফোন অনেক ভালো, অনেক নিরাপদ। তাড়াতাড়ি বলে, "হুঁ, ফোনে কথা বলব। এখন যাই। কেউ দেখবে।"

রনির চোখের সামনেটা অন্ধকার করে দিয়ে মিলি প্রায় উড়ে চলে যায়। বাইকটা ঘুরিয়ে নিজের বাড়ির গেট ঠেলে ঢোকার সময় সোজাসুজি দোতলায় তাকায়, বৌদি নেই। যেই মিলি চলে গেছে, ব্যস, আর দরকার নেই। "একনম্বরের বিচ্ছু একটা" বিড়বিড় করতে করতে রনি বাইকটা গ্যারাজে রাখে। দাদার বাইক নেই। মানে এখনও ফেরেনি। 

বৌদির কাছে চা ম্যানেজ করে রনি নিজের ঘরে চলে আসে। ফ্রেশ হয়ে ঘরে পরার জামাকাপড় পরে ব্যালকনিতে এসে সি *গা *রে *ট ধরিয়েছে, বনি ঢুকছে। রনি ওকে দেখে চেঁচায়, "চাবি দিচ্ছি, গ্যারাজে তালা দিয়ে দে।"

- "না থাক। মা কি বলে দেখি, কাল সকালের কিছু লাগে কিনা। তোকে কিছু বলেছে?"

- "না, মা পুজো দিচ্ছে। তুই চলে আয়।"

রনি ঘরে এসে এবার ফোনটা নিয়ে একেবারে ব্যালকনিতে বেরোয়, মিলিকে ফোন করবে। 

বাড়িতে ঢুকতে মিলির বুক ঢিপঢিপ করে, মনে হচ্ছে, মা সব বুঝে ফেলবে। সুট করে ঢুকে দেখে, মা কার সঙ্গে ফোনে গল্প করছে। মিলি আর দাঁড়ায় না। সোজা ঘরে ঢুকে জামা বদলে ফ্রেশ হয়ে বই খুলে বসে যায়। 

গোপা বোনের সঙ্গে গল্প সেরে উঠে এসে মেয়ের পাশে দাঁড়ায়। মাথায় আদরের হাত রেখে বলে, "হ্যাঁ রে রনি তোকে খাওয়াতে নিয়ে গেছিল?" 

দুজন রেস্টুরেন্টে খেতে যাচ্ছে, এটুকুই জানে, তাতেই মন ভালো লাগছে, দুজনের ভাব হচ্ছে দেখে। 

ঢোঁক গিলে মিলি বলে, "ঐ, মানে আমি সিনেমা দেখতে যাইনি বলে..... রনিদা বলল। মা, তুমি রাগ করেছ দেরি হয়েছে বলে?"

- "ওমা ! রাগ করব কেন? ভালোই তো ! তোর পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে রনি, পড়ার পর খিদে পেয়েছে বলে খাওয়াতে নিয়ে গেছে। এতে কেউ রাগ করে?"

- "মা, রনিদা খুব ভালো, তাই না?" দোনোমোনো করে বলেই ফেলে। 

মিলির মুখে রনির প্রশংসা শুনে গোপার একটা গভীর শ্বাস পড়ে। সামলে নিয়ে বলে, "হ্যাঁ, তা ছেলেটা ভালোই। ওদের বাড়ির সবাই ভালো। এত বছর ধরে দেখছি। একদিনে মানুষকে বিচার করতে নেই।"

গোপা যে দিনটার কথা বলছে, মিলিকে ফেলে রনির চলে যাওয়ার দিন, সেটার উলটোটাই জানে মিলি। তাই মিলিও গম্ভীর হয়ে যায়, "দিদি ওর সঙ্গে ভালো করেনি মা। আমি কখনো দিদিকে ক্ষমা করতে পারব না।" 

গোপা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিজের মনে বলে, "তোর যত বড় সর্বনাশ লিলি করেছে, আমিও ওকে কখনো ক্ষমা করতে পারব না। ওকে নিয়ে আর ভাবি না। মনে করি, আমার একটাই মেয়ে। ঈশ্বরের কাছে এখন একটাই প্রার্থনা, সময় এলে তুই রনিকে ক্ষমা করতে পারিস যেন। আমি তো মা, রনি যে আর ভুল করবে না, আমার চোখে এটা ধরা পড়ে।"

দুজনকেই চমকে দিয়ে ফোনটা বেজে ওঠে, পলাশ। মিলি ফোন ধরে, গোপা বেরিয়ে আসে। 

মিলি বলে, "কি রে কেমন সিনেমা দেখলি?"

- "আমি সিনেমা দেখিইনি। যাব বলে ফেলেছিলাম, তাই টিকিট কেটেছি, সবাইকে নিয়ে গেছি। কিন্তু নিজের কিচ্ছু ভালো লাগেনি, কিচ্ছু দেখিনি।"

চলবে