Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মিষ্টি নামের তিক্ত রোগ - 9

সুগার থেকে মুক্তির উপায় 

চতুর্থ অধ্যায় 


মুক্তিপথের সন্ধানে 


এখন পর্যন্ত আমরা জেনেছি—ডায়াবেটিস কী, কেন হয়, এর কারণে শরীরে কী কী ক্ষতি হয় এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কতগুলো ছোট ছোট ভুল কীভাবে এই “মিষ্টি নামের তিক্ত রোগটিকে” আমন্ত্রণ জানায়। এই নীরব ঘাতক ব্যাধির উপর জয়লাভ করার জন্য যে ধরণের জীবন শৈলী মেনে চলার প্রয়োজন সেই সম্পর্কেও আমরা জেনে নিয়েছি।

এবার আসছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়— মুক্তপথের সন্ধানে। এটি আমাদের মুক্তির অধ্যায়। এই অধ্যায়ের কিছু কিছু বিষয় আপনাদের কাছে রিপিটেড মনে হতে পারে; যদিও এগুলো কোনো ধরণের পুনরাবৃত্তি নয়। সুগারের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার বিস্তারিত পন্থা তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই আগের উত্থাপিত কিছু বিষয়কে এখানে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা আর ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি পাওয়া—এই দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। নিয়ন্ত্রণ মানে হলো সারাজীবন ওষুধের আশ্রয়ে বেঁচে থাকা। কিন্তু মুক্তি মানে—নিজের শরীরের আসল শক্তিকে জাগিয়ে তোলা, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ভেঙে ফেলা এবং শরীরকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা।

এই মুক্তির পথে হাঁটা একদিনে সম্ভব নয়। এটি একটি ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়ার যাত্রা।
প্রতিটি ধাপ আপনাকে আরও একটু শক্তিশালী করবে, শরীরকে আরও একটু মুক্তি দেবে।


এখানে রয়েছে এমন কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত নলেজ না থাকলে সুগার রিভার্স জার্নিটিকে সাকসেস করা সম্ভব নয়।

এগুলো ছাড়াও এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব—

কীভাবে উপবাস (Fasting) শরীরকে রিস্টার্ট করে।

কীভাবে গাট মাইক্রোবায়োম আমাদের নীরব রক্ষক হয়ে ওঠে।

কেন ঘুম ও স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট সবচেয়ে বড় ওষুধ।

কীভাবে সঠিক ব্যায়াম ও শ্বাসের ব্যায়াম শরীরের প্রতিটি কোষকে জাগিয়ে তোলে।

আর কীভাবে খাদ্যাভ্যাস, রুটিন ও শৃঙ্খলা আমাদের জীবনকে সুগারের অভিশাপ থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি দেয়।


এখানে প্রতিটি ধাপই হবে একেকটি চাবি, যা আপনার শরীরের বন্ধ দরজা খুলে দিতে সহায়তা করবে।
আপনি যদি মন থেকে এই পথ অনুসরণ করেন, তবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আপনার শরীর নিজেই প্রমাণ করে দেবে—
“ডায়াবেটিস ইনকিউরেবল নয়, রিভার্সেবল।”

এটি কেবল একটি স্বাস্থ্য–পুস্তক নয়, এটি একটি মুক্তির যাত্রাপথ।
আজ থেকে শুরু হবে সেই যাত্রা—
আপনার সুগারমুক্ত জীবনের যাত্রা।




হাইপোগ্লাইসেমিয়া – ওষুধ নির্ভর জীবনের অন্ধকার ফাঁদ

সুগার ধরা পড়লেই ডাক্তাররা সঙ্গে সঙ্গে ওষুধ ধরিয়ে দেন।
রোগীও ভাবে—
“চল, এবার সব ঠিক হয়ে যাবে।”

কিন্তু আসল কাহিনি শুরু হয় তখনই।

ওষুধের আসল কাজ কী ?

এই ওষুধ শরীরে গিয়ে প্যানক্রিয়াসকে চাপ দেয়—
“আরো ইনসুলিন তৈরি করো।”
ফলে শরীরে বাড়তি ইনসুলিন তৈরি হয়।

জানেন এর ফলাফল কী ?

একদিকে রক্তে শর্করা হঠাৎ করেই অনেকটা কমে যায়।
কিছু সময়ের জন্য রিপোর্ট সুন্দর দেখায়।

কিন্তু হঠাৎ করেই শরীরের ভেতর ঘটে বিপদ।

হাইপোগ্লাইসেমিয়া – সুগারের ফল্ট

যখন ওষুধের চাপে ইনসুলিন অতিরিক্ত বের হয়, তখন রক্তের সুগার লেভেল হঠাৎ করে খুব নিচে নেমে যায়।
তখনই অনেক রোগী বলেন—
“ওষুধ খাওয়ার পর হাত-পা কাঁপতে শুরু করল, ঘাম বের হলো, মাথা ঘুরতে থাকল।”
এটাই হলো হাইপোগ্লাইসেমিয়া।

হাইপো মানে কম।
গ্লাইসেমিয়া মানে রক্তে সুগারের মাত্রা।
অর্থাৎ রক্তে শর্করার মাত্রা একেবারেই নিচে নেমে যাওয়া।

তখন ডাক্তাররা কী বলেন ?

তখন রোগীকে বলা হয়—
“বারবার করে খান, একটানা খালি পেটে থাকবেন না।
দুই ঘণ্টা পরপর অল্প অল্প কিছু খেতে হবে।” বিশেষ করে মুড়ি খেতে বলেন। কারণ মুড়ির মধ্যে রয়েছে উচ্চমাত্রার সুগার।

হাইপোগ্লাইসেমিয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে রোগী সারাদিনে ৬–৭ বার খেতে শুরু করে।
প্রতিবার খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে ইনসুলিন স্পাইক হয়।
আর প্রতিটি স্পাইক ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সকে আরও শক্ত করে তোলে।

অর্থাৎ একদিকে ওষুধের বাড়তি ইনসুলিন, অন্যদিকে বারবার খাওয়ার ফলে স্বাভাবিক ইনসুলিন—
দুটো মিলে শরীরে তৈরি হয় চরম বিশৃঙ্খলা।

কেন ওষুধে সুগার ঠিক হয় না ?

ওষুধ দিয়ে হয়তো রিপোর্ট সাময়িক সুন্দর হয়, কিন্তু আসল সমস্যার সমাধান হয় না।
বরং নতুন সমস্যা যোগ হয়—
হাইপোগ্লাইসেমিয়া।

একজন রোগী তখন দুই আগুনে পড়ে যান—
কখনো হাইপার (সুগার বেশি),
কখনো হাইপো (সুগার খুব কম)।

এই ওঠা-নামার খেলায় শরীর প্রতিদিন দুর্বল হয়ে যায়।

তাহলে মুক্তির আসল পথ ?

সত্যি কথা হলো—
ওষুধ দিয়ে কখনোই সুগার ঠিক হয় না।
ওষুধ শুধু সাময়িক কন্ট্রোল দেখায়।
কিন্তু সুস্থতা আসে তখনই, যখন মানুষ নিজের জীবনযাত্রা পাল্টায়।

যখন খাওয়া-দাওয়া, উপবাস, ব্যায়াম, ঘুম, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট—এই সবকিছু একসঙ্গে মেনে চলা শুরু হয়, তখন শরীর নিজের স্বাধীনতা ফিরে পায়।
তখন আর হাইপারও হয় না, হাইপোও হয় না।
তখন শরীর স্বাভাবিক রিদমে ফিরে আসে।


তাই আজ থেকেই বুঝে নিন—
আপনার আসল মুক্তি ওষুধে নয়।
আপনার আসল মুক্তি আপনার নিজের হাতেই—
আপনার লাইফস্টাইলের ভেতরেই।




ইনসুলিন – আশীর্বাদ না অভিশাপ ?

ইনসুলিন আবিষ্কার মানবজাতির ইতিহাসে এক অসামান্য ঘটনা।
বিশ্বের প্রকৃত ডায়াবেটিস রোগী—অর্থাৎ টাইপ–১ ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষদের জন্য এটি বিধাতার অমূল্য আশীর্বাদ।

ইনসুলিন আবিষ্কারের আগে অগণিত শিশু ও তরুণ অকালে মারা যেত। শরীর ইনসুলিন একেবারেই তৈরি করতে পারত না বলে তারা জীবনের আলোই দেখতে পেত না। কিন্তু কানাডার দুই বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক ব্যান্টিং ও চার্লস বেস্ট ১৯২১ সালে ইনসুলিন আবিষ্কার করেন। এর জন্য ব্যান্টিং ১৯২৩ সালে নোবেল পুরস্কারও পান।
এরপর থেকে টাইপ–১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অসংখ্য মানুষ আজ দীর্ঘ জীবন পেয়েছেন—স্রেফ ইনসুলিনের কারণে।

এজন্য ইনসুলিন আবিষ্কার নিঃসন্দেহে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক বিরাট আশীর্বাদ।



কিন্তু টাইপ–২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে বিষয়টা কী ?

এবার আসল প্রশ্নে আসি।
একজন মানুষের শরীরে যদি পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিন থাকে, তবুও তাকে কি বাইরে থেকে রক্ত দেওয়া উচিত ?
না, কখনোই নয়।

তাহলে শরীরে পর্যাপ্ত ইনসুলিন থাকা সত্ত্বেও কেন বাইরে থেকে ইনসুলিন দেওয়া হবে ?

কারণটা হলো—টাইপ–২ ডায়াবেটিস আসলে প্রকৃত ডায়াবেটিসই নয়।
এটি হলো লাইফস্টাইল ডিজঅর্ডার।

টাইপ–২ ডায়াবেটিসে অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন ঠিকই তৈরি হয়, বরং অনেক সময় বেশি হয়।
কিন্তু কোষগুলো ইনসুলিনের প্রতি অসংবেদনশীল হয়ে যায়—যাকে বলে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স।
ফলে রক্তে গ্লুকোজ জমতে থাকে।

অর্থাৎ সমস্যাটা ইনসুলিনের ঘাটতি নয়, বরং ইনসুলিনের আধিক্যেই সমস্যা।
চিকিৎসা হওয়া উচিত এই রেজিস্ট্যান্স ভাঙার জন্য।
আর এর জন্য প্রয়োজন ইনসুলিন স্পাইক কমানো—খাদ্যাভ্যাস, উপবাস, ব্যায়াম, ঘুম ও স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক টাইপ–২ রোগীকেও সরাসরি ইনসুলিন ধরিয়ে দেওয়া হয়।


ইনসুলিন দেওয়ার ভয়ঙ্কর ফলাফল:

যখন শরীরে আগে থেকেই ইনসুলিন বেশি আছে, তার ওপর বাইরে থেকে ইনসুলিন দেওয়া হলে—

রক্তে ইনসুলিন আরও বেড়ে যায় → চরম ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়।

কোষগুলো জোর করে গ্লুকোজ নেয় → কোষের ভেতরে প্রদাহ (Inflammation) বাড়ে।

শরীরে চর্বি জমতে থাকে → স্থূলতা বাড়ে, হার্ট, কিডনি ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

একসময় অগ্ন্যাশয় ক্লান্ত হয়ে পড়ে → ইনসুলিন তৈরি বন্ধ করে দেয়।
তখন রোগী টাইপ–২ থেকে কার্যত টাইপ–১ ডায়াবেটিকে পরিণত হন।


এটাই সেই মারাত্মক দুষ্টচক্র, যেখান থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন।


তবে কি ইনসুলিন একেবারেই নয় ?

না, তা নয়।
কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে ইনসুলিন একেবারেই প্রয়োজনীয়—

সুগারের কারণে ক্ষত শুকোচ্ছে না।

কোনো ইমার্জেন্সি অপারেশন করতে হবে।

আকস্মিকভাবে রক্তে শর্করা বিপজ্জনক মাত্রায় চলে গেছে।


এই অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শে ইনসুলিন অবশ্যই নিতে হবে।

কিন্তু প্রতিদিন তিনবেলা তিনথালা ভাত খাওয়ার জন্য ইনসুলিন নেওয়া—
এটা কোনো চিকিৎসাই নয়,
এটা আত্মহত্যার নামান্তর।


মনে রাখবেন—
টাইপ–১ রোগীর জীবন ইনসুলিন ছাড়া অসম্ভব।
কিন্তু টাইপ–২ রোগীর আসল মুক্তি ইনসুলিনে নয়, বরং লাইফস্টাইল পরিবর্তনে।





আপনার ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স আছে কিনা জানবেন কীভাবে ?

আমরা সবাই জানি, টাইপ–২ ডায়াবেটিসের মূল কারণ হলো ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—আপনার শরীরে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়েছে কিনা, সেটা কীভাবে জানবেন?

HOMA-IR টেস্ট – ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স মাপার সহজ সূত্র

এটার পূর্ণ নাম হলো Homeostatic Model Assessment of Insulin Resistance (HOMA-IR)।
এটা বের করতে দরকার মাত্র দুটো টেস্ট:

1. ফাস্টিং ব্লাড সুগার (Fasting Blood Glucose)


2. ফাস্টিং ইনসুলিন (Fasting Insulin Level)



এবার হিসেব করুন—

HOMA-IR = (Fasting Glucose × Fasting Insulin) ÷ 405

👉 গ্লুকোজের ইউনিট হবে mg/dl
👉 ইনসুলিন হবে µU/ml

উদাহরণ:

ফাস্টিং সুগার: 100 mg/dl
ফাস্টিং ইনসুলিন: 15 µU/ml

HOMA-IR = (100 × 15) ÷ 405 = 3.7

রেজাল্ট বুঝবেন এভাবে:

< 2 → ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স নেই

2 – 2.5 → সামান্য ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স

> 2.5 → ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স আছে, সতর্ক হতে হবে

> 4 → গুরুতর ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে


অর্থাৎ ব্লাড সুগার নরমাল থাকলেও যদি HOMA-IR বেশি হয়, তবে বুঝতে হবে ভেতরে ভেতরে আগুন জ্বলছে।


C–Peptide টেস্ট – ইনসুলিনের কার্যকারিতা বোঝার আয়না।

আমাদের অগ্ন্যাশয় যখন ইনসুলিন তৈরি করে, তখন আসলে ইনসুলিনের পাশাপাশি C-Peptide নামের একটি প্রোটিনও তৈরি হয়। তাই রক্তে C-Peptide দেখে বোঝা যায়—

শরীর নিজে কতটা ইনসুলিন তৈরি করছে
সেই ইনসুলিন আসলেই কাজ করছে কিনা

বোঝার নিয়ম:

সি-পেপটাইড কম থাকলে → অগ্ন্যাশয় ইনসুলিনই তৈরি করতে পারছে না (টাইপ–১ ডায়াবেটিসে দেখা যায়)

সি-পেপটাইড বেশি, তবুও সুগার কন্ট্রোল হচ্ছে না → শরীরে ইনসুলিন আছে, কিন্তু কোষ সেটা মানছে না → ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স


ধরুন রাহুলবাবুর ব্লাড সুগার রিপোর্ট নরমাল আসছিল, কিন্তু HOMA-IR হিসেব করে দেখা গেল মান দাঁড়িয়েছে ৩.৫। মানে স্পষ্ট ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স।
তিনি ভাবছিলেন—“আমার তো এখনো ডায়াবেটিস হয়নি।”
কিন্তু ভেতরে ভেতরে ইনসুলিনের ওপর চাপ বাড়তেই থাকছিল। যদি সময়মতো সাবধান না হতেন, কয়েক বছরের মধ্যেই ডায়াবেটিস ধরা পড়ত।


ভয়ঙ্কর বাস্তবতা – ইনসুলিনের অপব্যবহার

অনেক মানুষ আসলে টাইপ–১ ডায়াবেটিক নয়, তবুও বছরের পর বছর ডাক্তারদের পরামর্শে ইনসুলিন নিয়ে চলেছেন।
পরে C-Peptide টেস্ট করে দেখা গেল—
আগে যেখানে মান ছিল ২, এখন নেমে এসেছে ১ বা তারও নিচে।

অর্থাৎ শরীরের নিজস্ব ইনসুলিন তৈরির ক্ষমতাই ধ্বংস হয়ে গেল!
যিনি আগে টাইপ–২ ছিলেন, তিনি এখন কার্যত টাইপ–১ ডায়াবেটিকে পরিণত হলেন।
কারণ অতিরিক্ত ইনসুলিন বাইরে থেকে ঢুকতে ঢুকতে অগ্ন্যাশয়ের কোষ আর কাজ করার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছে।


ভাবুন তো, কোনো পরিবারে প্রতিদিন সুইগি বা জোম্যাটো থেকে রেডিমেড খাবার আসে।
দিনের পর দিন এমন চলতে থাকলে একসময় সেই বাড়ির রাঁধুনি রান্না করাই ভুলে যাবে।
ঠিক তেমনি—শরীরে পর্যাপ্ত ইনসুলিন থাকা সত্ত্বেও যদি বাইরে থেকে প্রতিদিন ইনসুলিন ঢোকানো হয়, তাহলে শরীরের প্যানক্রিয়াসও ধীরে ধীরে “ভুলে” যাবে কীভাবে ইনসুলিন তৈরি করতে হয়।

ফলাফল ?
শরীর নিজে ইনসুলিন তৈরি করার ক্ষমতাই হারায়।
জীবনভর বাইরের ইনসুলিনের ওপর নির্ভরশীলতা।


তাই শুধু ব্লাড সুগারের রিপোর্ট নয়, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বোঝার জন্য HOMA-IR ও C-Peptide টেস্ট করানো অত্যন্ত জরুরি।
ওষুধ বা বাইরে থেকে ইনসুলিন দিয়ে সাময়িক সমাধান পাওয়া গেলেও ভেতরের ক্ষতি হতে থাকে।
তাই সঠিক পথ হলো—ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ভাঙা, লাইফস্টাইল পাল্টানো, আর শরীরকে তার নিজস্ব ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা।






উপবাস: সুগার মুক্তির সোনার চাবি

শরীর হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে স্মার্ট সফটওয়্যার। তাকে ২৪ ঘণ্টা, প্রতিটি মুহূর্ত কাজ করতে হয়।
কিন্তু প্রতিটি যন্ত্রের মতোই শরীরও বিশ্রাম চায়। আমরা মনে করি, ভরপেট খেয়ে বিছানায় শুয়ে থাকাটাই রেস্ট। কিন্তু বাস্তবে তখন শরীরকে সবচেয়ে বেশি কাজ করতে হয়—খাবার মেটাবলাইজড করতে।

শরীরের আসল রেস্ট তখনই হয়, যখন আমরা উপবাস করি।
তখন হজমের দায়িত্ব থেকে শরীর মুক্ত হয়, কোষগুলো নিজেদের মেরামত করার সুযোগ পায়।
এই প্রক্রিয়ার নাম অটোফেজি—যা ডায়াবেটিস রিভার্স করার আসল চাবিকাঠি।

তিন ধরণের উপবাস

১) ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং (১২–১৮ ঘণ্টা)

এটাই সবচেয়ে সহজ, কিন্তু কার্যকর উপবাস।

১২ ঘণ্টা → একদম শুরুর জন্য। রাত ৮টায় ডিনার করলে পরদিন সকাল ৮টায় ব্রেকফাস্ট।

১৪ ঘণ্টা → একটু অভ্যস্ত হলে। রাত ৮টার ডিনার মানে পরদিন সকাল ১০টায় খাবার।

১৬ ঘণ্টা → সবচেয়ে জনপ্রিয়। রাত ৮টার ডিনার হলে দুপুর ১২টায় ব্রেকফাস্ট।

১৮ ঘণ্টা → উন্নত ধাপ। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ভাঙার জন্য বিশেষ কার্যকর।


এই ফাস্টিং-এ শরীর ধীরে ধীরে ফ্যাটকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে, রক্তে ইনসুলিনের চাপ কমে আসে, কোষের দরজা খুলতে শুরু করে।

২) ২৪ ঘণ্টার উপবাস (একাদশীর মতো)

আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রতি ১৫ দিনে একাদশীতে উপবাস করতেন।
একদিন শুধু জল, হার্বাল ড্রিঙ্ক বা হালকা লেবুর জল—এতেই শরীরের ভেতরে শুরু হয় অসাধারণ ডিটক্স।

ইনসুলিন অনেকটা নেমে যায়

অটোফেজি জোরদার হয়

গাট হেলথ রিসেট হয়

মনও শান্ত হয়


মুসলিম সমাজে রোজার ধারাও এ কারণেই এত স্বাস্থ্যকর। তবে শর্ত হলো—রোজার শেষে ভরপেট ভাজাভুজি, মিষ্টি নয়; বরং হালকা ও ইনসুলিন-ফ্রেন্ডলি খাবার খেতে হবে।

৩) দীর্ঘ উপবাস (৪৮–৭২ ঘণ্টা)

এটি হলো আসল গেম-চেঞ্জার।
শুধু একজন অভিজ্ঞ লাইফস্টাইল কোচের তত্ত্বাবধানে করলে নিরাপদ।

৪৮ ঘণ্টা উপবাসে শরীর সম্পূর্ণ ফ্যাট-বার্নিং মোডে চলে যায়।

৭২ ঘণ্টা উপবাসে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ভাঙতে শুরু করে, অটোফেজি পুরোদমে সক্রিয় হয়।

কোষগুলোর দরজা খুলে যায়, জমে থাকা টক্সিন পরিষ্কার হয়, ইমিউন সিস্টেম নবজন্ম পায়।


অনেক মানুষ মাত্র একবার ৭২ ঘণ্টার উপবাস করে তাদের HbA1c একেবারে নেমে আসতে দেখেছেন। তবে এটি কখনো একা বা নিজের ইচ্ছেমতো করা যাবে না।


উপবাস মানে নিজেকে না খাইয়ে কষ্ট দেওয়া নয়, বরং শরীরকে প্রকৃত রেস্ট দেওয়া।
আজকের পৃথিবীতে যেখানে খাবারই রোগ তৈরি করছে, সেখানে উপবাসই হলো সবচেয়ে প্রাকৃতিক ওষুধ।

ধাপে ধাপে এগিয়ে যান—
প্রথমে ১২ ঘণ্টা → তারপর ১৪–১৬ ঘণ্টা → মাঝে মাঝে ২৪ ঘণ্টা → আর কোচের তত্ত্বাবধানে দীর্ঘ উপবাস।

এই মন্ত্রটি মনে রাখুন:
“উপবাসে শরীর বিশ্রাম পায়, কোষ নবজীবন পায়, আর আমি ফিরে পাই আমার স্বাধীনতা।”