Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

আমাদের জীবনসায়রে ' সমুদ্রমন্থন' এর গল্প।

পুরানে বর্নিত সমুদ্রমন্থনের গল্প আমরা সকলেই জানি। ভাগবত পুরান, বিষ্ণুপুরানসহ বিভিন্ন পুরানে এবং মহাভারতেও এই সমুদ্রমন্থনের উল্লেখ পাওয়া যায়। 

দেবতাকূল এবং অসুরকূল একদিন বসে সিদ্ধান্ত নিল,- অমৃত প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে তারা সমুদ্রমন্থন করবে। যেই ভাবা সেই কাজ। একদিন শুভক্ষনে ক্ষীরসাগরে মন্দার পর্বতকে মন্থনদন্ড বানিয়ে এবং বাসুকী নাগকে মন্থনরজ্জু বানিয়ে দেবতা ও অসুরদল মিলে সমুদ্রমন্থন শুরু করল। কিন্তু এত টানাটানির ফলে মন্দার পর্বত সাগরে বসে যাচ্ছিল,- তাই ভগবান বিষ্ণু কচ্ছপরূপে মন্দার পর্বতের নীচে অবস্থান করলেন।

 শুরু হল সমুদ্রমন্থন। পর্যায়ক্রমে একে একে সমুদ্রের তলদেশ থেকে উঠে এল চৌদ্দটি দ্রব্য।

 ★প্রথমেই উঠে আসল হলাহল কালকূট বিষ,- যা স্বয়ং মহাদেব তাঁর কন্ঠে ধারন করে সৃষ্টি রক্ষা করলেন।

★ তারপর আসল কামধেনু গাভী।

★ উচ্ছেশ্রবা ঘোড়া, ঐরাবত হাতী,কৌস্তব মনি এবং  কল্পতরু বৃক্ষ পর পর উঠে আসল।

★ তারপর আসল পর্যায়ক্রমে রম্ভা নামের অপ্সরা, লক্ষ্মী, মাদকের দেবী বারুনী,চন্দ্রমা, পারিজাত বৃক্ষ, পাঞ্চজন্য শঙ্খ, শারঙ্গ ধনুক।

★ সর্বশেষ উঠে এলেন ধন্বন্তরি, - হাতে অমৃতের পাত্র নিয়ে।

 এই যে চৌদ্দটি দ্রব্য একে একে উঠে আসল,- তাদের পর্যায়ক্রমটি অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। প্রথমেই অমৃত উঠে আসলেই তো হত,- এত পরিশ্রম করতে হত না। অথবা,- প্রথমে মাদক আসলেই তো ভাল হত,- তা সেবন করে দেবতা ও অসুরকূল মহানন্দে মন্থনকার্যে লিপ্ত হতে পারত। কিন্তু,-না। নির্দিষ্ট পর্যায়ক্রম মেনেই দ্রব্যগুলো একে একে উঠে আসল। তার একটি বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে।

 প্রকৃতপক্ষে এই সমুদ্রমন্থনের গল্প আমাদের প্রত্যেকের জীবনের গল্প। আমাদের প্রতি প্রত্যেকের জীবনসাগরেই এই মন্থন নিত্য চলছে। সমুদ্রমন্থনে উঠে আসা চৌদ্দটি দ্রব্য হল আমাদের প্রত্যেকের জীবনচলনায় সাধনপথের একেকটি ধাপ।

 দীক্ষা গ্রহন করে শ্রীশ্রীঠাকুরের চরনাশ্রিত হবার পর আমরা যখন তাঁর বিধান পালন করে সাধন পথে চলতে আরম্ভ করি,- তখন আমার মনকে একদিকে গুরু টানতে শুরু করেন,- আরেকদিকে আমার প্রবৃত্তি টানতে থাকে। অর্থাৎ একদিকে টানে আমার অন্তস্থ: দেবতা তথা দৈবীসত্তা,- অপরদিকে টানে আমার অন্তস্থ অসুরসত্তা তথা প্রবৃত্তি। আমার জীবনসমুদ্রে আমার মনকে মন্থনদণ্ড বানিয়ে দেবতা ও অসুরকূল মন্থন শুরু করে। আমার ইচ্ছাশক্তিই হল এই সমুদ্রমন্থনের মন্থনরজ্জু। শুরু হয় সাধনপথে আমার পথচলা।

 এই মন্থনের ফলে প্রথমেই উঠে আসে কালকূট বিষ। দীক্ষান্তে চলার শুরুতে কেউ কেউ আমায় নিন্দা করে, ঠাট্টা করে, নিরুৎসাহিত করে। কেউ কেউ খুব প্রশংসাও  করে,-" বা: লোকটার কি গুরুভক্তি!!"  এই প্রশংসা ও নিন্দা,- দুটোই মন্থনের ফলে উঠে আসা কালকূট বিষ। তা  নীরবে উপেক্ষা করে যদি সাধনার পথে আরো অগ্রসর হতে থাকি,- যদি মন্থন অব্যাহত থাকে- তাহলে এর পরেই উঠে আসে কামধেনু গাভী। 

সব গাভীই দুধ দেয়,- কিন্তু কামধেনু গাভীর একটি বিশেষ প্রতিভা বা গুন আছে,- সে নিরন্তর তার দুগ্ধ ক্ষরন করতে পারে। তার দুগ্ধ সর্বক্ষন প্রবাহিত হয়।  এই দুধ দেবতার সেবায় বিশেষভাবে ব্যাবহার করা হয়। তেমনি সাধনপথের দ্বিতীয় পর্যায়ে আমার অন্তস্থ: প্রতিভাগুলি প্রকাশিত হতে থাকে। আমি হয়ত খুব সুন্দর গান গাই, খুব সুন্দর আলোচনা করি, খুব ভাল যাজন করি, খুব ভাল সাংগঠনিক কাজ করতে পারি। আমার প্রতিভাগুলো তখন বিশেষভাবে প্রকাশিত হতে থাকে,- ইষ্টপ্রতিষ্ঠায় সেই প্রতিভা নিয়োজিত হয়।

 যদি কামধেনু গাভী পেয়েই আমি সন্তুষ্ট হয়ে যাই,- অর্থাৎ আমার প্রতিভা প্রকাশেই যদি আমি সন্তুষ্ট হয়ে  শুধু প্রতিভা নিয়েই ব্যাস্ত হয়ে পড়ি তবে আমার আর পরবির্তী ধাপে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়না। মন্থন বন্ধ হয়ে যায়।আর যদি আমার প্রতিভাকে গুরুর সেবায় নিয়োজিত করে আনি মন্থনকার্য তথা সাধনা চালিয়ে যাই,- তবে এর পরবর্তী ধাপে উঠে আসে উচ্চশ্রবা ঘোড়া। 

ঘোড়া হল গতীর প্রতীক। উচ্চশ্রবা ঘোড়া খুব দ্রুত দৌড়ায়,- তেমনি আমার প্রতিভাকে নিয়ে আমি খুব দ্রুত অগ্রসর হতে থাকি ইষ্টের পথে। গুরুর পানে দ্রুত অগ্রসর হতে থাকি।

 এর পরেই উঠে আসে ঐরাবত হাতী। হাতীকে বলা হয় গজ,- অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ। হাতীকে সবাই বেশ শ্রদ্ধা করে, সমীহ করে। গ্রামে যখন হাতী আসে তখন গ্রামবাসীরা ঘর থেকে বের হয়ে হাতীকে অভিবাদন জানায়, কেউ কেউ পয়সা ছুড়ে দেয় প্রনামী রূপে, অনেকেই কলা-আপেল ইত্যাদি ফল খেতে দেয়। অনেকেই হাতীকে সামনে পেয়ে প্রনাম করে।

 সবাই সমীহ করলেও হাতীর পেছন পেছন গ্রামের কুকুরগুলো খুব ঘেউ ঘেউ করতে থাকে,- কিন্তু হাতী ফিরেও তাকায় না। হাতি তার গজচালে হেলতে দুলতে গ্রাম পেরিয়ে যায়। কুকুরের ঘেউ ঘেউ,- বা গ্রামবাসীর সমীহ ও শ্রদ্ধা,- কোনকিছুই হাতীর গতিরোধ করেনা।

 ঠিক তেমনি,- ইষ্টপথে আমি একটু অগ্রসর হলেই মানুষ আমায় সমীহ করতে শুরু করে, শ্রদ্ধা করে, ভালবাসে। আবার কিছু মানুষ কুকুরের মত আমার পেছন পেছন ঘেউ ঘেউও করে,- তথা নিন্দা, অপবাদ, মিথ্যা রটনা করতে থাকে। এই নিন্দা ও সমীহ উপেক্ষা করে আমি যদি ইষ্টপথে নিজ লক্ষে অগ্রসর হতে থাকি, - তখন উঠে আসে কৌস্তব মনি। 

কৌস্তব মনি ভগবান বিষ্ণুর মুকুটে সজ্জিত থাকে। ভগবান বিষ্ণুর মুকুটের সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজে এই মনি ব্যাবহৃত হয়। তেমনি তখন আমার মাধ্যমে আমার ইষ্টের মহিমা প্রকাশিত হতে থাকে। আমার চলন-চরিত্র-কথা-ভালবাসা-সেবা দেখে মানুষ বুঝতে পারে আমার ঠাকুর কত সুন্দর, আমার গুরু কত মহান। আমাকে দেখেই মানুষ আমার ঠাকুরকে চিনে।

 আর তখনই ঠিক পরবর্তী পর্যায়ে সমুদ্র থেকে উঠে আসে কল্পবৃক্ষ। অর্থাৎ  তখন আমার মধ্যে ইষ্ট এতটাই জাগ্রত থাকেন যে মানুষ তাদের বিপদে-আপদে-সমস্যায় পড়ে আমার সন্নিকটে সহায়তার জন্য আসলে আমি ঠাকুরের কাছে তাদের জন্য যা'ই প্রার্থনা করি, - ঠাকুর তা'ই মঞ্জুর করেন। আমার সকল নিস্কাম প্রার্থনা তিনি পূরন করেন। মানুষ আমাকে কল্পতরু হিসাবেই পায়। ঠিক যেমন,- পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রী আচার্য্যদেব। আমরা বিপদে-আপদে-সংকটে পড়ে তাঁর কাছে গিয়ে নিবেদন করলে তিনি আমাদের মঙ্গলের জন্য শ্রীশ্রীঠাকুরের চরনে প্রার্থনা জানান। ঠাকুর সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করেন।

কিন্তু তার পরেই শুরু হয় সাধনস্তরের এক কঠিন পরীক্ষা। উঠে আসে,- রম্ভা,- এক অপ্সরা। অস্পরা হল কামনা, - তথা বাসনার প্রতীক। ঈশ্বর যেহেতু আমার সকল ইচ্ছা মঞ্জুর করছেন, আমার ইচ্ছাশক্তি যেহেতু শক্তিশালী হয়ে উঠেছে,- তখন আমার ভেতরে প্রাপ্তির চাহিদা আরো ভীষণভাবে বেড়ে উঠে। আমার বাসনা মাথা চাগাড় দেয়। আমি নিস্কাম প্রার্থনা ভুলে সকাম প্রার্থনায় ব্যাস্ত হয়ে পড়তে পারি। আর,- যদি তাই হয়,- তবে মন্থন এখানেই বন্ধ হয়ে যায়। আমার ইষ্টপথে চলার সাধনা এখানেই থেমে যায়।

 যদি,- রম্ভা আমার সাধনা তথা মন্থন রুদ্ধ না করতে পারে,- তারপরেই উঠে আসে লক্ষ্মী। লক্ষ্মী মানে শ্রী, সমৃদ্ধি, ধন। ধনে-জনে-যশে-প্রাচুর্যে আমি ভরপুর হয়ে উঠি। ঈশ্বর আমায় ঢেলে দেন।

 কিন্তু,- তারপরেই আসে আরেক কঠিন পরীক্ষা। উঠে আসে,- বারুনী তথা মাদকতার দেবী। এই শ্রী, সমৃদ্ধি, প্রাচুর্য, যশ, খ্যাতি আমায় নেশাগ্রস্ত করে তুলতে পারে। আমি সব ভুলে এতেই মগ্ন হয়ে যেতে পারি। এই যশ-খ্যাতি ও ধনের নেশা আমার সাধনার পথে কঠিন বাধা হয়ে দাঁড়ায়। 

যদি বারুনী আমার সাধনার পথ রুদ্ধ করতে না পারে,- তবে এর পর উঠে আসে চন্দ্রমা। চন্দ্রমা তথা চাঁদের আলোর মতই আমার জীবন হয়ে উঠে স্নিগ্ধ, সুন্দর, শীতল, নিরুদ্ধেগপূর্ন। আসে জীবনের সাম্যতা,- অচঞ্চল ভাব। 

একজন সন্নাসীর মুখে শুনেছিলাম,- ঈশ্বরকোটি পুরুষের একটি লক্ষন হল তাদের সৌম্যদর্শন। যেমনটা,- ভগবান শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীশ্রীঠাকুর, শ্রীশ্রীআচার্য্যদেবকে দেখি,- সর্বদাই স্থির, দৈবী স্মিত হাসি, অচঞ্চল। জীবনের কোন ঘাত প্রতিঘাত তখন আর বিচলিত করেনা। জীবনের শান্তি কখনো বিঘ্নিত হয়না। 

এর পরেই উঠে আসে,- পারিজাত বৃক্ষ। এই পারিজাত ফুল অত্যন্ত সুগন্ধী,- স্বর্গে  সর্বক্ষন সুগন্ধ  ছড়ায় এই পারিজাত ফুল। তেমনি সাধনার এই স্তরে আমার কর্ম, চিন্তা, বাক্য, আচরন সারা বিশ্বে ঈশ্বরের সুগন্ধ ছড়াতে থাকে। এই গন্ধে কাতারে কাতারে মানুষ আমার কাছে এসে ভীড় করতে থাকে। যেমনটা হচ্ছে,- পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীআচার্য্যদেব ও শ্রীশ্রীঅবিনদাদার জীবনে। তাঁদের মাধ্যমে শ্রীশ্রীঠাকুরের সৌরভ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিদিন। 

তখন উঠে আসে,- পাঞ্চজন্য ও শারঙ্গ ধনুক। পাঞ্চজন্য শঙ্খ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বাজান,- আর শারঙ্গ ধনুক ভগবান বিষ্ণুর অস্ত্ররূপে শোভা পায় । অর্থাৎ সাধনার এই স্তরে বিশ্বব্যাপী আমার জয় ঘোষিত হতে থাকে,- পাঞ্চজন্য শঙ্খের নাদের ন্যায়। চতুর্দিক আমার জয়ধ্বনিতে মুখরিত হতে থাকে। শারঙ্গ ধনুকের ন্যায় আমার এমন শক্তি অর্জন হয় যে,- বিশ্বব্রম্মান্ড আমি অনায়াসে জয় করতে পারি। ঠিক যেমনটা হচ্ছে,- শ্রীশ্রীআচার্য্যদেব এবং শ্রীশ্রীঅবিনদাদার ক্ষেত্রে। 

সর্বশেষ উঠে আসে অমৃত,- সেই চরম প্রাপ্তি।  ঈশ্বরপ্রাপ্তিই সেই চরমপ্রাপ্তি। ঈশ্বরই অমৃত,- আমরা সব অমৃতের সন্তান। তখন সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরপ্রাপ্তি ঘটে,- তথা ঈশ্বরত্বের সম্পূর্ণ প্রকাশ আমার জীবনে দেখা দেয়। ঠিক যা ঘটছে শ্রীশ্রীআচার্য্যদেবের জীবনে। তিনিই ঠাকুর- শ্রীশ্রীঠাকুরের পূর্ন প্রকাশ তাঁর মধ্যেই। 

ধন্বন্তরিরূপে তিনি দিবানিশি অমৃত বিতরন করে চলছেন। মৃত্যুপথযাত্রী, হতাশ, পথভ্রান্ত কত কত মানুষ তাঁর কাছে গিয়ে সেই অমৃতের সন্ধান পাচ্ছে। সেই অমৃত গ্রহন করে মানুষ উজ্জীবিত হয়ে উঠছে, জীবনে বাঁচার রাস্তা পাচ্ছে।

 তিনি অকাতরে বিলিয়েই চলেছেন এই অমৃত। আমরা  অমৃতপথযাত্রী,- তাঁর কাছে গিয়ে সেই অমৃতের স্বাদ আস্বাদন করি।