Read Jharapata 40 by Srabanti Ghosh in Bengali Love Stories | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

ঝরাপাতা - 40

ঝরাপাতা

পর্ব - ৪০

💟💕💟💕💟💕💟

সব কথা মনে পড়ার পর থেকে নিজের সঙ্গে একটা অসম যুদ্ধ চলছে মিলির। সেদিন যে প্রশ্নগুলো উঠে এসেছিল, আজ রনিকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে সেগুলো। ওর মনে আসলে কি আছে জানতে ইচ্ছে করছে। তার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হচ্ছে, "যেটা স্বাভাবিক উত্তর, রনিদা যদি সেটাই বলে, ও আমাকে পছন্দ করে না, শুধু আমাকে সুস্থ করার চেষ্টা করছিল ! তার চেয়ে থাক, সব কথা মুখে এনে মুখোমুখি দাঁড়ানোর, চোখে চোখ রেখে ভালো থেকো বলার জায়গাটাও নষ্ট করে কি লাভ !" 

সকালে কলেজে একটাও কথা হয়নি রনির সঙ্গে। শুধু ওর সঙ্গে নয়, কারও সঙ্গেই কথা বলেনি রনি। মিলি জানেনা, ও ক্লাসে চলে যাওয়ার পর রনির সঙ্গে কলেজ কর্তৃপক্ষের কথাবার্তা হয়েছে কিনা। ও তো একবারও মুখ তুলে তাকাতে পারেনি। মনে হয়েছে, "আমার মুখের দিকে তাকালেই আমার মনের সব কথা রনিদা জেনে ফেলবে। কি বোকার মতো সব বলেও বসে আছি। যে লোকটা আমাকে এড়িয়ে বাঁচার জন্য সব ছাড়তে পারে, তাকে ভালোবাসি বলে ফেলেছি !"

এখন রনিকে দেখে বড্ড হতাশ হয়ে পড়ে তাই। কি বলবে আবার? ওর নিজের যে সব মনে পড়েছে, এখানে এভাবে সেই কথাটা বলাও সম্ভব নয়। আবার সব জেনেবুঝে না জানার ভান করাটাও তো প্রতারণাই হবে? অন্য কোনো উপায় নেই দেখেই মিলি পলাশকে আসছি বলে এগিয়ে যায়। রনির কাছে এসে হাত বাড়ায়, যন্ত্রের মতো হেলমেটটা নেয়, পরে, বাইকে উঠে বসে। 

রনির গায়ে হাত রেখেই চমকে যায়, ওর টিশার্টের উপরেও জ্বরের তাপ বোঝা যাচ্ছে। ততক্ষণে রনি বাইকে স্টার্ট দিচ্ছে। মিলি সব ভুলে ওর কাঁধ ধরে নাড়া দেয়, "তোমার তো গায়ে খুব জ্বর !" বলে ফেলেই আপশোষে ডুবে যায়। পরশু এই কাঁধ ধরে টানা নিয়েই..... 

রনি শান্তভাবে স্টার্ট বন্ধ করে, "হুঁ জ্বর এসেছে। কমে যাবে। চলো। ধরে বোসো, চালাই?"

মিলির খুব ইচ্ছে করছে কাল রনির ব্যবহারে ও কষ্ট পেয়েছে সেটা রনিকে বলতে। আগের দিনের মতোই গাল ফুলিয়ে বলে, "কি হয়েছে জিজ্ঞেস না করে কাল বকলে কেন?" কিন্তু এই কথাটা আজ আর জিজ্ঞেস করা সম্ভব না ওর পক্ষে। 

রনি অপেক্ষা করছিল, মিলির তরফে একটা শো ডাউনের। হঠাৎ আজ কলেজ থেকে ফেরত নিতে না এলে মিলি ভাববে ও রাগ করে আছে। ওকে নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে পারে। সবকিছু খুব সহজ, স্বাভাবিক রাখতেই ও এসেছে। যেজন্য গতকালের কথাই তোলেনি। 

মিলিরও একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে, "রনিদা একবার একটাও কথা বলল না। এর মানে কি? এখনও আমাকেই দোষী ভাবছে? পলাশ আমার বন্ধু, সেটাই আমার দোষ ধরার জন্য যথেষ্ট?" 

- "তোমার এত জ্বর ! না এলেই পারতে। আমাকে একবার বলে দিলে আমি দিব্যি চলে যেতাম।" যাকে নিজের মানুষ ভেবেছে, না চাইলেও তার উপর অভিমান ঝাঁপিয়ে আসছে বুকের ভিতর। আবার নিজের হাতের তালুতে ওর শরীরের তাপ মেপে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছে, মানুষটা অসুস্থ। তাই না বলেও পারে না। 

- "একটা কথা বলব? সত্যি কথা বলবে?" রনির এই প্রশ্নে মিলি নিশ্চিত হয়, রনিদা মিথ্যেবাদীই ভাবছে ওকে। 

- "সত্যিকথাই বলব। বলো কি বলবে।" মিলি গলায় নিস্পৃহ ভাব ফোটায়, রনিদার ঘাড় থেকে নেমে যাবে ও। আজ বলা হবে না, তবে দু একদিনের মধ্যে মন গুছিয়ে নেবে, সব কথা বলে দেবে রনিদাকে। 

- "কাকু বারণ করেছেন আমার সঙ্গে মিশতে?"

গতকাল মিলি আপসেট বুঝে গোপা রাতে মেয়ের সঙ্গে শুয়েছিল। মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলেছিল, ওরা জানে, মিলি কোনো অন্যায় করে না। তাই যে যাই বলুক, বাবা মাকে ও পাশে পাবেই। গোপা জানত না, মিলি তখন এইসব পলাশের ঝামেলা ভুলে মনের আরও বড় একটা আলোড়নে জেরবার হচ্ছে। কিন্তু রনি বাড়ি ছাড়ার পর কেউ এভাবে পাশে ছিল না বলে মিলি যে ভেঙে গেছিল, সেটা আটকে দিয়েছে আজ গোপার আদর আর সাহচর্য। সেই কথার মধ্যে গোপাও রনির নাম নেয়নি, যাতে মেয়ের আরও খারাপ না লাগে, মিলি তো কথাই বলেনি। মাকে জড়িয়ে শুয়ে থেকে নিজেকে সামলে নিয়েছে। সকালে তো বাড়িতে রনির নামই উচ্চারণের সময় ছিল না, কলেজে দৌড়েছে বাপ মেয়ে। 

মিলি সেটাই বলে, "বাবার সঙ্গে সেভাবে কথাই হয়নি আমার। তোমার নামে তো নয়ই।"

রনি ধরে নেয়, ওর ভাবনাটাই ঠিক। মিলিই চায় না ওর সঙ্গ। তাই বলে ফেলে, "আমার নামে কিছু বলা নিয়ে প্রশ্ন করছি না। আমি জানতে চাইছি, আমাকে আসতে বারণ করলে, তুমি কি এখন থেকে নিজে যাতায়াত করবে?"

দুজনেই ভাবছে, সে অন্যের জীবনে অপ্রয়োজনীয়, তাই দুজনেরই কথা দুটি সমান্তরাল রেখা ধরে চলেছে। কেউ কারও কাছাকাছি আসতে পারছে না। রনি যেমন ভেবে নিয়েছে, মিলি ওর সঙ্গে যেতে চায় না, মিলিও ভেবে নিয়েছে রনি ওকে আনা নেওয়া করতে চায় না। 

মিলিই বা ধরা দেবে কেন? ও বলে বসে, "এখন তো শরীর ঠিক আছে। আমি নিজেই যেতে আসতে পারব। তোমাকে কত আগে বেরোতে হয়। আমার খারাপ লাগে।"

রনির হাসি পায়, বড় দুঃখের হাসি, মনে মনে বলে, "আমাকেই তোমার খারাপ লাগে। সেটা বলতে পারলে না। ভদ্রতা করে? ভদ্রতাই হবে।"

বাড়ির সামনে এসে বাইক থামিয়ে মিলিকে বলে, "ঠিক আছে, কাল থেকে তুমি তোমার মতো যেও। আর শোনো না, আমাকে কখনো কিছু বলতে ইচ্ছে করলে বোলো।" রনি বলতে চেয়েছিল, পলাশ আর ওর মধ্যে কাকে বাছল মিলি, সেটা জানার কৌতূহলে ফেটে যাচ্ছে বলে। 

মিলি যা কিছু ভেবেছে, রনিদাকে মুক্তি দিয়ে দেবে ইত্যাদি আদ্যন্ত সিনেমা মার্কা চূড়ান্ত রোমান্টিসিজম, সব শেষ হয়ে যাচ্ছে রনিদার উদাসীন ব্যবহারে। অভিমানের পুঁটুলি খুলে বলে ফেলে, "কথা বলে কি হবে রনিদা? সব কথা কি কোনোদিন তুমি আমাকে বলবে না কোনোদিন আমার সব কথা শুনতে চেয়েছিলে?"

- "মানে? তুমি কিছু বললে আমি শুনব না?" রনি ছিটকে ওঠে, "কি বলতে চাইছ?"

- "কিচ্ছু বলছি না রনিদা। তুমি বলো, বলতে যদি না পারো, ভেবে দেখো, আমার কথা শুনতে সময় দিয়েছ? তুমি আমাকে সব কথা বলেছ? বলো না, এমন কোনো কথা কি নেই, যেটা তুমি আমাকে বলতে চাও না?"

রনির মনে হচ্ছে, মিলির সামনে থেকে পালাতে পারলে হত। মিলি হয়ত গতকালের ঘটনায় রাগ দেখাচ্ছে, কিন্তু মিলিকে ও সবচেয়ে বড় কথাটাই যে বলতে পারেনি। মিলিকে ওর জায়গাটাই দিতে পারেনি। অবশ্য মিলি সেটা ওর কাছে চাইবে কিনা তাও আজও প্রশ্ন হয়ে থেকে গেছে। ভালো থেকো বলে বাইকটা ঘুরিয়ে নেয় রনি। যদি মিলির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতেই হয়, এই কথাগুলোই মনে রেখে দেবে ভেবে নিয়েছে।

💟💕💟💕💟💕💟

মিলি সর্বহারার মতোই বাড়িতে ফিরে আসে, আবার, যেমন ফিরেছিল ফুলশয্যার পরদিন। তবে এবার ও জেনে গেছে, নিজেকে নিজেরই সামলাতে হবে। গোপা আর সমর অবশ্য অনেকখানি সঙ্গ দিয়ে মুড়ে রাখে ওকে। যে পরীক্ষা নিয়ে এত ঝামেলা হল, শুধু সেই পরীক্ষাকেই পাখির চোখ করে পড়তে থাকে মিলি। পরীক্ষার আগে দরকার বোধ না করলে ডঃ গিরির সেশনও বন্ধ রাখতে বলে দেয়। 

বিয়ের ব্যাপারে বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে বুঝেছে। তেমনি খুব সহজ হবে না কথাগুলো। আগেরবার বহু লোকের ইনভলভমেন্ট দেখেছিল একটা বিয়ে নিয়ে। তাই সেসব কথাও ও পরীক্ষার পর তুলবে ঠিক করেছে। 

এই ঘটনার তিনদিন পর, মিলি সেদিন ওর ঘরে পড়ছে, গোপা সমরকে বলে, "আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। আবার কি সর্বনাশ হবে। অদ্ভুত লাগছে, মিলি অনেক বড় হয়ে গেল এই ঝামেলায়। কি সুন্দর সব সামলে নিয়েছে।"

- "সেটা ঠিক। ওর চিকিৎসাটা ওকে আগের চেয়ে অনেক বেশি মেন্টাল পাওয়ার দিয়েছে। ভাগ্যিস। তাই আর কোনো খারাপ দিন দেখতে হল না।"

- "রনির ব্যাপারটাই বরং বুঝতে পারছি না। দুজনকে কথাবার্তা বলতে দেখি না। অথচ দুজনেই দিব্যি আছে। আড়ালে ভাব হয়েছে কিনা, ফোনটোন করে কিনা মেয়েকে জিজ্ঞেসও করতে পারছি না।"

- "একদম জিজ্ঞেস করবে না। এই দুদিন আমি শুধু মিলির দিকে নজর রেখেছিলাম। ও যখন ঠিক আছে, পরীক্ষাটা হোক।"

- "হ্যাঁ বাবা। দুগগা দুগগা করে আমার মেয়েটা ভালো রেজাল্ট করুক। রনির মাথা ঠান্ডা হলে ও নিজেই ভাব করবে ঠিক।"

ওদিকে রনির বাড়িতে তিনজন ছটফট করে দিন কাটাচ্ছে। মিলি সম্পূর্ণভাবে সরে যাচ্ছে, বুঝতে পারছে। রনি বলেই দিয়েছে, মিলির পরীক্ষার আগে কোনো বাধা যেন তৈরি না হয়। ওরা নিজেরাও জানে, আর মেয়েটার পড়াশোনায় বাধা দেওয়া যায় না। 

কিন্তু রনি? ওর মুখের দিকে তাকাতে পারছে না যে। আজ বুঝতে পারছে, একদিন মিলির বাড়ির সবাই কি দিন কাটিয়েছে। যদি এটা রনির, ওদের সবার শাস্তিই হয়, এর তো শেষ হবে একদিন, নাকি? 


চলবে