ঝরাপাতা
পর্ব - ৪৩
❤💕❤💕❤💕❤
মিলি জানে না, সবটাই গোপাকে মণিকা আর পিউ শিখিয়ে রেখে গেছে, এদের দুজনের মনের খবর পাওয়ার জন্য। আর জানে না বলেই মিলি ভদ্রতার খাতিরে রনিদাকে দেখতে ও বাড়িতেই চলে গেল।
আজই মিলিকে এরা আনতে পারবে নিশ্চিত না হলেও পিউ তৈরি ছিল। দুচার কথার পরই বলে বসল, "চলো ভাইকে দেখে আসবে।" তিনজনই ওর সঙ্গে রনির ঘরে আসে।
রনিও এদের প্ল্যানের ব্যাপারে কিছুই জানে না। তাই এদের দেখে ভীষণরকম বিব্রত হয়ে পড়ে, বিশেষ করে সমরকে নিয়ে। বসুন বসুন বলে সবাইকে বসতে দিয়ে নিজে চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। গোপাই প্রথম কথা বলে, "কেমন আছ রনি? শরীর খারাপ হয়েছে আমরা জানতেই পারিনি।"
- "তেমন কিছু না, এখন ভালো আছি কাকিমা।" মাথা না তুলেই বলে রনি।
- "বলছিলাম যে, এরকম শরীর খারাপ হলে, কোনো অসুবিধা হলে আমাদের একটা খবর দিও। দিদির বয়স হয়েছে, বাড়িতে একটা বাচ্চা আছে। বনি একা কতদিক সামলাবে?" সমর গলা খাঁকড়ে বলে।
- "দেব কাকু। কিছু হয়নি আমার। আপনি শুধু শুধু চিন্তা করবেন না।" সমর কথা বলায় রনি ধীরে ধীরে সাহস ফিরে পায়।
সমর উঠে এসে রনির কাছে দাঁড়ায়, "রনি, আমার ছেলের মতো তুমি। তা কাকু কি একটু বকাবকিও করতে পারে না? এতদিন ধরে শরীর খারাপ, সামনের বাড়িতে থেকে আমরা জানতে পারলাম না? তোমার জন্য চিন্তা করতেও বারণ করছ?" সমর ঠিকই করে নিয়েছে, রনিকে মাপই করে দেবে। মিলি অন্যায় করেছে ভেবে শাসন করতে গেছিল, এ ছাড়া মিলির ভালোই তো করার চেষ্টা করেছে ছেলেটা।
রনি এবার আরও সংকুচিত হয়ে পড়ে, "এ কি বলছেন কাকু? আমি বড়দের সামনে মাথা গরম করে অসভ্যতা করেছি, আমারই মুখ নেই আপনাদের ভালোবাসা পাওয়ার।"
- "থাক রনি, যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। এখন তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো।" গোপা কথাটা শেষ করতে চায়।
- "সরি কাকিমা, কাকু, আমার অন্যায় হয়েছে। বারবার আপনারা মাপ করে দেন, আর আমি......''
- "তুমি চেঁচামেচি করে পরিস্থিতি জটিল করে ফেলেছিলে এটা ঠিক। আসল কথায় না গিয়ে তাই আমাদের নিজেদের মধ্যে অকারণ তর্কবিতর্ক হয়েছে। তবে তুমিও যে মিলির ভালোই চাও, সেটা জানি। তাই তোমার উপর কি করে রাগ করি বলো? থাক, ওসব কথা ভুলে যাও।" সমরও হাসিমুখে বলে।
পিউ চটপট বলে, "না না একদম ছেড়ে দেবেন না কাকু। দিনদিন খালি মেজাজ হচ্ছে ওর। এই অসুখে ডাক্তার দেখাতে, ওষুধ খাওয়াতে আমার যে কি মুশকিল হয়েছে। আপনারা আচ্ছা করে বকুনি দিন। চলুন এখন নিচে যাই, চা টা খাবেন। মিলি, তুই পড়ার ব্যাপারে কথা বলে নে। তোরা পরে আয় নিচে।"
সমর আর গোপা সবে পিউর পিছনে ঘর থেকে পালাচ্ছে প্ল্যানমাফিক, মিলিও উঠে পড়ে, "না না পড়া নিয়ে কোনো কথা নেই। চলো আমিও যাচ্ছি।''
পিউ দিশেহারা হয়ে যায়, কি করে মিলিকে আটকাবে। একবার অন্ততঃ একান্তে কথা বলার সুযোগ দিলে দুজনের মিটমাট হবে, আশা ছিল।
এদিকে সমর আর গোপা ঝামেলাঝাঁটির কথা মনে রাখছে না দেখে রনির সাহস ফিরে এসেছে, ও বলে, " বোসো, কথা ছিল তোমার সঙ্গে। চৈতালীদির সঙ্গে কথা হয়েছে?" মিলি উত্তর দেওয়ার আগেই বাকি তিনজন পালিয়েছে।
- "কথা হয়েছে, পড়তে যাচ্ছি তো। ম্যাডাম, প্রিন্সিপাল স্যার, সবাই বিশ্বাস করেছেন আমার কথা।" মিলি ঘাড় বাঁকিয়ে কিছুটা অহঙ্কারের সঙ্গেই বলে। রনি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। কতদিন পরে দেখল মিলিকে ! মনে পড়ছে, অসুখের সময় প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে ভেবেছে, আর মিলির সঙ্গে দেখা হবে না, কথা হবে না।
- "আমাকে তোমার ম্যাডামই বলেছিলেন, তুমি প্রিন্সিপাল স্যারকে এ্যাপ্রোচ করে পাঠিয়েছ। তবেই বিশ্বাস করেছিলাম। সরি মিলি।"
- "ঠিক আছে। আমি পুরনো কথা মনে রাখতে চাই না। সরি বলতে হবে না।"
- "মনে করেই তো রেখেছ।" বিয়ের আগে যে মিলির সঙ্গে পলাশের সম্পর্ক থাকতে পারে বলে নতুন করে ভেবেছিল, সেকথা ভুলে যায় রনি। একবুক অভিমান নিয়ে বলে, "আমার সঙ্গে কলেজে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছ।"
- "আমি কিছু মনে করে রাখিনি রনিদা। বরং সব কথা ভুলতে চাই।" নিজেকেই যেন উত্তর দেয় মিলি। মনে মনে বলে, "তোমার সঙ্গে জড়িত সব কথা আমার জন্য কতটা যন্ত্রণার, তুমি কেন, কেউ বুঝবে না। সব ভুলতে পারতাম, যদি এই বাড়ি, এই পাড়া ছেড়ে চলে যেতে পারতাম, তবেই শান্তি পেতাম। তা যখন হবে না, সত্যিটাকে সহ্য করার শক্তি যোগাড় করতেই আজ এসেছি।"
মুখে বলে, "তোমার শরীর খারাপ ছিল, তোমার ঘাড়ে চেপে যাতায়াত করতে চাইনি। আমি এখন নিজেই যেতে আসতে পারি। তাও দরকার হলে ভাইয়া আছে, বাবা আছে।"
- "আমার শরীর খারাপ দেখেও একবারও খবর নিলে না?" রনি বুঝতে পারছে, কোথাও যেন সব ফুরিয়ে যাচ্ছে। এই কথাগুলো আজ এখন না বললে, আর কোনোদিন মিলির সঙ্গে কোনো কথা হবে না।
মিলিরও এ্যাটিটিউড একটু টাল খেয়েছে এই সরাসরি অভিযোগে। আমতা আমতা করে বলে, "আমিই তো সেদিন জিজ্ঞেস করলাম, জ্বর হয়েছে। তুমি বললে, ঠিক হয়ে যাবে। তারপর আরও বেড়েছে কি করে জানব?"
- "ইচ্ছে করলেই জানা যায়। একটা ফোন করলেই জানতে পারতে।" মিলিকে তর্কে হারানোর গন্ধ পেয়ে রনি ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।"
- "না, জানা যায় না।" আচমকা বিস্ফোরণ ঘটে মিলি এতদিন ঠোঁট টিপে থাকার পর, "কিচ্ছু জানা যায় না। কে কি করছে, কি ভাবছে, কিচ্ছু জানা যায় না।" রনির জামার কলার খামচে ধরেছে মিলি, "কেউ কিছু বলেছ আমাকে? তোমরা সবাই সমান। পলাশকে আমি কি দোষ দেব? তুমি বলেছ কোনো কথা? তোমাকে তো বিশ্বাস করেছিলাম, ভরসা করেছিলাম।"
মিলি অবজ্ঞা করছে, অবহেলা করছে, অন্য কাউকে ভালোবাসে ভেবে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল রনি। এই অভাবিত আক্রমণে প্রথমে হতভম্ব হয়ে যায়, ওর ভাবনার সম্পূর্ণ বাইরে এই ঘটনা। কিন্তু যত মিলি কাঁদতে কাঁদতে ওর জামা ধরে ঝাঁকাতে থাকে, ধীরে ধীরে মাথায় খেলে, মিলিও ওর মতো এই বিচ্ছেদে অখুশি।
মিলির দুহাত মুঠো করে ধরে বলে, "আমি আবার কি বলিনি? বরং বেশি কথা বলে, চেঁচামেচি করে সবাইকে চটিয়ে দিয়েছি। তোমার সামনে কাকু সেদিন তাই খেপে গেলেন। বাড়িতে সবাই কথা বন্ধ করে দিয়েছিল জানো?"
- "বেশ করেছে। তোমার সঙ্গে কিসের কথা? কোনো কথা বলো না, যা বলো মিথ্যে বলো।" মিলির উত্তেজনা কমলেও ফোঁপাচ্ছে।
- "কি মিথ্যে বলেছি মিলি? কি বলিনি তোমাকে? বলো তুমি কি জানতে চাও। সব কথা বলব তোমাকে।"
- "কিচ্ছু বলতে হবে না। কোনো কথা বলব না তোমার সঙ্গে।" মিলি হাত ছাড়াতে চায়।
- "আচ্ছা আমি সরি, ভেরি ভেরি সরি। যা করেছি, মাপ করে দাও। আর রাগ করে থেকো না। বলো না কি হয়েছে?" রনি বুঝেছে, ওর রাগারাগি করা ছাড়াও কিছু ঘটেছে।
- "আমি আর কি বলব? সব তো তুমি জানো। আর সেগুলো কখনো আমাকে বলবেও না। দিদির সঙ্গে তোমার ভাব আছে বলেছ কখনো? তুমি দিদিকে শিখিয়ে দিয়েছ যুগলদাকে পাত্তা না দিতে, সেকথা বলেছ? দিদি তোমাকে বিয়ে করেনি বলে কেস পর্যন্ত করতে চাও, বলেছ আমাকে?"
মিলির কাছে যে সম্পূর্ণ ভুল সংকেত গেছে বুঝতে পেরে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায় রনি। কোন কাজটা কি ভেবে করেছে, সত্যিই মিলিকে কখনো বলা হয়নি। এমনকি ঘটনাগুলোই মিলি জেনেছে অন্য কারও কাছে। তার ফল তো এমনই হবে। এখন এই মেয়েকে বোঝাবে কি করে?
রনির ভয়ে শিথিল হাত থেকে ছুটে গেছে মিলির হাত। "তোমার কথা আর শুনব না" বলে রনির বুকে ধাক্কা মেরে হাত ছাড়িয়ে মিলি চোখ মুছতে মুছতে হাঁটা দিয়েছে। রনির মাথায় একটাই সংকেত পৌঁছয়, মিলিকে আটকাতে হবে, যে করেই হোক আটকাতে হবে।
ছুটে গিয়ে মিলির পথ আটকায় ও, "মিলি, সব কথা শোনো। এভাবে চলে যেও না। আমার কথাটা শোনো।"
সামনে থেকে সরাতে মিলি আবার ধাক্কা মারে ওকে। রনি ওর দুর্বল হাতের ঠেলায় একবার টলে গেলেও হাত ধরে ওকে টেনে আনে ঘরের মাঝখানে, "এ্যাই, এরকম করে নিচে যায় না। বড়রা সবাই আছে। কি ভাববে? চোখ মোছো। আমার কথা শোনো।"
- "হাত ছাড়। শুনব না বলছি তো। আর তোমার মিথ্যে শুনব না। যুগলদার সঙ্গে দিদির ঝামেলা লাগিয়ে দিয়েছ। এবার তুমি ওকে বিয়ে করবে তো? করো। এবারের বিয়েতে আমাকে ডাকতে বোলো দিদিকে, বা তুমিই ডেকো। তোমার পুরনো বন্ধু বলে তোমার বিয়েতে তো যেতেই পারি। দিদির বিয়েতে পরব বলে লেহেঙ্গা কিনেছিলাম জানো? সেদিন পরা হয়নি। থ্যাঙ্ক ইউ, এবার সেটা পরার ব্যবস্থা করে দিলে।" রনির আর ক্ষমতা হয় না, বাড়ির ভিতরে ওর হাত ধরে রাখতে। কি না কি বলে বসবে, কে শুনবে।
মিলি বেরিয়ে যেতে চুপ করে বসে থাকে। বিরাট একটা গণ্ডগোল পেকেছে। প্রথমেই মনে হয়, সবটা ওকেই ঠিক করতে হবে। কারণ লিলির কথা কাউকে বলা যাবে না। তবু ভালো, মিলির মনে কি চলছে, সেটা তো জানতে পেরেছে। পাগলীটা বলে কিনা, "আমি এবার লিলিকে বিয়ে করব আর উনি নিজে সেই বিয়েতে লেহেঙ্গা পরে আমাকে দেখাবেন, আমার অন্যের সঙ্গে বিয়ে হলে কিছু যায় আসে না ওনার। হুঁহ, দেখা যাবে।" একলা ঘরে হেসে ফেলল রনি, "ঐদিন বিয়েতে লেহেঙ্গা পরতে পারেনি শুনিয়ে গেল, ম্যাডাম যে লাল বেনারসি পরে আমাকে গুণে গুণে সাতপাক ঘুরেছিলেন সেই লগ্নে, সেটা মনে পড়লে কি হয়, আমিও দেখব।" সি *গা *রে *ট ধরিয়ে সেই ভবিষ্যতের স্বপ্নই দেখতে শুরু করে।
চলবে