মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৪
প্রজাপতির বিবরণ এবং সৃষ্টির বিস্তার
প্রাককথন
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
প্রজাপতির বিবরণ এবং সৃষ্টির বিস্তার
মহামতি ভীষ্মকে প্রণিপাত কোরে যুধিষ্ঠির বললেন, “পিতামহ! পূৰ্ব্বে মহাত্মা প্রজাপতি ও বিভিন্ন দিকে অন্যান্য যে সমস্ত মহর্ষিগণ ছিলেন, তাঁদের বিষয়ে অনুগ্রহ কোরে বর্ণনা করুন।”
ভীষ্ম বললেন, “বৎস! পূর্ধ্বতন প্রজাপতি ও মহর্ষিদের বিষয়ে বর্ণনা করছি, মন দিয়ে শোনো। প্রথমে কেবল একমাত্র সনাতন ভগবান ব্রহ্মা বিদ্যমান ছিলেন। তারপর তাঁর মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু ও বশিষ্ঠ এই সাত মহাত্মা পুত্রের জন্ম হয়, যারা ব্রহ্মার সমতুল্য ছিলেন। পুরাণে এই সাত মহর্ষিকে সপ্ত ব্রহ্মা বলে বর্ণিত করা হয়েছে।”
এখন প্রজাপতিদের বৃত্তান্ত বর্ণনা করছি, শ্রবণ কর। মহাত্মা অত্রির বংশে ব্রহ্মযোনি ভগবান প্রাচীনবর্হির জন্ম হয়েছিল। প্রাচীনবৰ্হির থেকে দশজন প্রচেতার জন্ম হয়। সেই দশজন প্রচেতার একটি মাত্র পুত্র জন্ম নিয়েছিল। ঐ পুত্রের নাম দক্ষ। দক্ষ জনসমাজে ‘ক’ নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। মরীচিপুত্র কশ্যপও অরিষ্টনেমি নামে প্রচারিত হন। অত্রির ঔরসপুত্র বীৰ্য্যবান সোমরাজ দিব্য সহস্র যুগ জীবিত ছিলেন। ভগবান অৰ্য্যমা ও তাঁর সন্তানগণ নিখিল ভুবনের উন্নতি সাধন কোরে নানাবিধ নিয়মের প্রচলন করেছিলেন। মহারাজ শশবিন্দুর দশ হাজার স্ত্রী ছিল। তাঁদের প্রত্যেকের গর্ভে হাজার সংখ্যক পুত্রের জন্ম হয়। এইরূপে মহাত্মা শশবিন্দুর দশ লক্ষ পুত্র হয়েছিল। তাঁদের থেকেই অন্যান্য প্রজাগণের সৃষ্টি হয়। পূর্ধ্বতন ব্রাহ্মণগণ শশবিন্দুর সেই পুত্রগণকে প্রজাপতি বলে অভিহিত করেছেন। এতক্ষণ আমি তোমার কাছে যশস্বী প্রজাপতিগের বৃত্তান্ত বর্ণনা করলাম, এবার আমি ত্রিভুবনেশ্বর দেবগণের বিষয়ে বলছি, মন দিয়ে শোনো।”
“ভগ, অংশ, অৰ্য্যমা, মিত্র, বরুণ, সবিতা, ধাতা, বিবস্বান্, ত্বষ্টা, পূষা, ইন্দ্র ও বিষ্ণু, এই দ্বাদশ আদিত্য মহাত্মা কশ্যপের পুত্র। নাসত্য ও দস্ৰনামে অশ্বিনীকুমারদ্বয় মহাত্মা মার্ত্তণ্ড থেকে জন্ম নিয়েছেন। পূৰ্ব্বে এঁরাই দেব ও পিতৃগণ বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। বিশ্বরূপ, যশস্বী, অজৈকপাৎ, অহিব্রধ্ন, বিরূপাক্ষ ও রৈবত ছিলেন ত্বষ্টার পুত্র। হর, বহুরূপ, ত্র্যম্বক, সুরেশ্বর, সাবিত্র, জয়ন্ত, পিনাকী ও অপরাজিত অষ্টবসু বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। প্রজাপতি মনুর সময়ে এঁরাই দেবতা ছিলেন। পূৰ্ব্বে এঁদেরকেই দেবগণ ও দ্বিবিধ পিতৃগণ বলে অভিহিত করা হোতো। ঋতু ও মরুদগণ ছিলেন আদি দেবতা। এই সমস্ত দেবতা ও অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের বিষয়ে বর্ণনা করলাম । ওনাদের মধ্যে আদিত্যগণ ক্ষত্রিয়, মরুদগণ বৈশ্য, অশ্বিনীকুমারদ্বয় শূদ্র ও অঙ্গিরার কুল থেকে উৎপন্ন দেবগণ ব্রাহ্মণ। এইরূপে দেবগণও চারিবর্ণে বিভক্ত হইয়াছেন। যে ব্যক্তি সকালবেলা শয্যাত্যাগ কোরে এই সমস্ত দেবগণের নাম কীৰ্ত্তন করেন, তিনি স্বজাত বা অন্য সংসর্গজ, সমুদয় পাপ থেকে মুক্ত হন।”
“অঙ্গিরার পুত্র যবক্রীত, রৈভ, অৰ্ব্বাবসু, পরাবসু, ঔষিজ, কাক্ষীবান ও বল, এঁরা সকলে ভূতল, অন্তরীক্ষ ও স্বর্গবাসী জনগণের পবিত্রকারক সপ্তর্ষিমণ্ডল এবং মহর্ষি মেধাতিথির পুত্র কণ্ব ও বর্হিষদ ইঁহারা পূৰ্ব্বদিকে; উন্মুচ, বিমুচ, স্বস্ত্যাত্রেয়, প্রমুচ, ইঋবাহ ও মিত্রাবরুণ পুত্র অগস্ত্য এই সমুদয় ব্রহ্মর্ষি দক্ষিণদিকে; উষঙ্গু, করূষ, ধৌম্য, পরিব্যাধ, একত, দ্বিত, ত্রিত ও অত্রিপুত্র ভগবান সারস্বত এই সমস্ত মহাত্মা পশ্চিমদিকে এবং ভগবান আত্রেয়, বশিষ্ঠ, কাশ্যপ, গৌতম, ভরদ্বাজ, কুশিকনন্দন বিশ্বামিত্র ও ঋচীককুমার জমদগ্নি এই সাতজন মহর্ষি উত্তরদিকে অবস্থান করেন। এই আমি যে যে দিকে যে যে অমোঘ প্রভাবসম্পন্ন মহর্ষি অবস্থান করেন, তা বর্ণনা করলাম। এই ভুবনশ্রেষ্ঠ মহাত্মারাই ভুবনের সাক্ষিভূত; এঁদের নাম কীৰ্ত্তন করলে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। যে ব্যক্তি এই মহর্ষিগণের অধিষ্ঠিত দিক সমূহে গমন কোরে তাঁদের শরণাপন্ন হয়, সে সমুদয় পাপ থেকে মুক্ত হয়ে নির্বিঘ্নে জীবনযাপন করতে পরে।”
______________
(ক্রমশ)