মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-২৪
পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তীকে হস্তিনাপুরে ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তীকে হস্তিনাপুরে ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব
নিজের বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমে পঞ্চপাণ্ডবদের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিবাহ এবং কর্ণসহ দুর্যোধনাদির লজ্জিত ও অপমানিত হোয়ে ফিরে আসার খবর জেনে বিদুর খুশি হোয়ে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে গিয়ে বললেন, মহারাজ, সৌভাগ্যবশতঃ কুরুকুলের জন্য আজ খুব আনন্দের দিন। ধৃতরাষ্ট্র ভাবলেন, দুর্যোধনই দ্রৌপদীকে পেয়েছেন। তিনি আনন্দিত হয়ে বললেন, কি সৌভাগ্য! এই বলে তিনি দুর্যোধনকে আদেশ দিলেন, দ্রৌপদীর জন্য বহু অলংকার নির্মাণ করাও এবং তাঁকে নিয়ে এসো। বিদুর আসল ঘটনা জানালে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চপাণ্ডব আমার অত্যন্ত প্রিয়। তারা কুশলে আছে এবং শক্তিশালী মিত্র লাভ করেছে এজন্য আমি তুষ্ট হয়েছি। বিদুর বললেন, মহারাজ, এমন বুদ্ধিই আপনার চিরকাল থাকুক।
বিদুর চলে গেলে দুর্যোধন ও কর্ণ ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, শত্রুর উন্নতিকে আপনি আমাদের উন্নতি মনে করছেন। এখন আমাদের চেষ্টা করা উচিত যাতে পাণ্ডবদের শক্তিক্ষয় হয়। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, আমারও সেই ইচ্ছা, কিন্তু বিদুরের কাছে তা প্রকাশ করতে চাই না। তোমরা কি কর্তব্য মনে কর তা বলো। দুর্যোধন বললেন, আমরা চতুর ও বিশ্বস্ত ব্রাহ্মণদের দ্বারা পাণ্ডবদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করবো এবং দ্রুপদ রাজাকে প্রচুর অর্থ দিয়ে বলবো তিনি যেন যুধিষ্ঠিরকে ত্যাগ করেন অথবা নিজ রাজ্যেই তাঁকে রাখেন। আমরা চতুর লোক দিয়ে ভীমকে হত্যা করাবো। ভীম মরলে তার ভাইদের শক্তি নষ্ট হবে।
কর্ণ দুর্যোধনকে বললেন, তুমি যেসব উপায় বললে তাতে কিছু লাভ হবে না। আগে তুমি গোপনে পাণ্ডবদের বিনাশ করবার চেষ্টা করেছিলে কিন্তু বিফল হয়েছো। তারা যখন অসহায় বালক ছিল এবং এখানেই বাস করত তখনই কিছু করতে পারনি। এখন তারা শক্তিমান হয়েছে, কৌশলে তাদের বিনাশ করা অসম্ভব। তাদের মধ্যে বিভেদ ঘটানোও অসাধ্য। দ্রুপদের বহু ধন আছে, তাই ধনের লোভ দেখালে তিনি পাণ্ডবদের ত্যাগ করবেন না। আমার মত এই – পাঞ্চালরাজ যত দিন দুর্বল আছেন, পাণ্ডবরা যত দিন প্রচুর অশ্ব, রথ এবং মিত্র সংগ্রহ করতে না পারে, যতদিন পর্যন্ত কৃষ্ণ যাদববাহিনী নিয়ে পাণ্ডবদের সাহায্য করতে না আসেন, তার মধ্যেই তুমি বলপ্রয়োগ কর। আমরা বিশাল চতুরঙ্গ সৈন্য নিয়ে দ্রুপদকে পরাজিত করে পাণ্ডবদের এখানে নিয়ে আসবো।
ধৃতরাষ্ট্র বললেন, কর্ণ, তুমি যে বীরোচিত উপায় বললে তা তোমারই উপযুক্ত, কিন্তু ভীষ্ম দ্রোণ আর বিদুরের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। এই বলে তিনি ভীষ্ম, দ্রোণ ও বিদুরকে ডেকে আনালেন। ভীষ্ম বললেন, পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করা উচিৎ নয়, আমার কাছে ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডু দুজনেই সমান। দুর্যোধন যেমন এই রাজ্যকে পৈতৃক মনে করে, পাণ্ডবরাও সেইরূপ মনে করে। অতএব অর্ধেক রাজ্য পাণ্ডবদের দাও। দুর্যোধন, তুমি কুরুকুলের উচিৎ ধর্ম পালন করো। ভাগ্যক্রমে পাণ্ডবগণ ও কুন্তী জীবিত আছেন। যেদিন শুনেছি তারা পুড়ে মরেছেন সেদিন থেকে আমি মুখ দেখাতে পারিনা। লোকে পুরোচনকে তত দোষী মনে করে না যত তোমাকে করে।
দ্রোণ ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, মহাত্মা ভীষ্মের যে মত আমারও তাই। আপনি বহু ধনরত্ন দিয়ে দ্রুপদের কাছে লোক পাঠান, সে গিয়ে বার বার বলবে যে তার সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ হওয়ায় আপনি আর দুর্যোধন অতিশয় খুশি হয়েছেন। তার পর পাণ্ডবদের এখানে আনবার জন্য দুঃশাসন ও বিকর্ণ পাঠিয়ে দিন। পাণ্ডবরা এখানে এলে তাদেরকে প্রাপ্য অর্ধেক রাজ্য দিয়ে আপনি নিজের পুত্রের মতো তাদের সমাদর করবেন।
কর্ণ বললেন, মহারাজ, যে ভীষ্ম-দ্রোণ আপনার কাছে ধন মান পেয়ে আসছেন, তারা আপনাকে হিতকর মন্ত্রণা দিলেন না। যদি আপনাদের ভাগ্যে রাজ্যভোগ থাকে তবে তার অন্যথা হবে না, যদি না থাকে তবে চেষ্টা করেও রাজ্য রাখতে পারবেন না। আপনি বুদ্ধিমান, আপনার মন্ত্রণাদাতারা সাধু কি অসাধু তা বুঝে দেখুন। দ্রোণ বললেন, কর্ণ, তোমার স্বভাব খারাপ, সেইজন্য আমাদের দোষ দিচ্ছ। আমরা হিতকর কথাই বলেছি, তার অন্যথা করলে কুরুকুল বিনষ্ট হবে।
বিদুর বললেন, মহারাজ, আপনার বন্ধুরা হিতবাক্যই বলবেন, কিন্তু আপনি যদি না শোনেন তবে বলা বৃথা। ভীষ্ম ও দ্রোণের চেয়ে বিজ্ঞ এবং আপনার হিতাকাঙ্ক্ষী কেউ নেই, এঁরা ধর্মজ্ঞ এবং অপক্ষপাতী। বলপ্রয়োগে পাণ্ডবদের জয় করা অসম্ভব। বলরাম আর সাত্যকি যাঁদের সহায়, কৃষ্ণ যাঁদের মন্ত্রণাদাতা, দ্রুপদ যাঁদের শ্বশুর এবং ধৃষ্টদ্যুম্নাদি শ্যালক, তারা যুদ্ধে কি না জয় করতে পারেন? আপনি দুর্যোধন কর্ণ আর শকুনির মতে চলবেন না, এরা অধার্মিক, দুর্বুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞানহীন।
ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ভীষ্ম দ্রোণ আর বিদুর হিতবাক্যই বলেছেন। যুধিষ্ঠিরাদি যেমন পাণ্ডুর পুত্র তেমন আমারও পুত্র। অতএব বিদুর, তুমি গিয়ে পঞ্চপাণ্ডব কুন্তী আর দ্রৌপদীকে পরম সমাদরে এখানে নিয়ে এস।
বিদুর নানাবিধ ধনরত্ন উপহার নিয়ে দ্রুপদের কাছে গিয়ে বললেন, মহারাজ, আপনার সঙ্গে সম্বন্ধ হওয়ায় ধৃতরাষ্ট্র অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন। তিনি, ভীষ্ম, এবং অন্যান্য কৌরব আপনার কুশল জিজ্ঞাসা করেছেন। আপনার প্রিয় সখা দ্রোণ আপনাকে গাঢ় আলিঙ্গন জানিয়েছেন। এখন পঞ্চপাণ্ডবকে যাবার অনুমতি দিন। কুরুকুলের নারীগণ পাঞ্চালীকে দেখবার জন্য উৎসুক হয়ে আছেন।
______________
(ক্রমশ)