Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 31

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৩১

ভীম কর্তৃক জরাসন্ধ বধ

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

ভীম কর্তৃক জরাসন্ধ বধ

জরাসন্ধের জন্মবৃত্তান্ত এবং তার পরাক্রম বর্ণনা করার পর কৃষ্ণ বললেন, জরাসন্ধের প্রধান দুই সহায় হংস আর ডিম্ভক মরেছে, কংসকেও আমি নিহত করেছি, অতএব জরাসন্ধ বধের এই উপয়ুক্ত সময়। কিন্তু দেবতা ও দানব সম্মুখযুদ্ধে তাঁকে জয় করতে পারবেন না, সেজন্য মল্লযুদ্ধে তাকে মারতে হবে। আমি কৌশলজ্ঞ, ভীম বলবান আর অর্জুন আমাদের রক্ষক, আমরা তিনজন মিলে মগধরাজকে জয় করতে পারবো। আমরা যদি নির্জন স্থানে তাকে আহ্বান করি, তবে তিনি নিশ্চয় আমাদের একজনের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। তিনি বাহুবলে গর্বিত সেইজন্য আমার বা অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করা অপমানজনক মনে করবেন, তাই ভীমের প্রতিদ্বন্দ্বী হোতেই পছন্দ করবেন। মহাবল ভীম নিশ্চয় তাকে বধ করতে পারবেন। যদি আমার উপর আপনার বিশ্বাস থাকে, তবে ভীম ও অর্জুনকে আমার সঙ্গে যেতে দিন।

যুধিষ্ঠির বললেন, কৃষ্ণ, তুমি পাণ্ডবদের প্রভু, আমরা তোমার আশ্রিত, তুমি যা বলবে তাই করবো। যখন তুমি আমাদের সহায় তখন জরাসন্ধ নিশ্চয় নিহত হবেন, রাজারা মুক্তি পাবেন, আমার রাজসূয় যজ্ঞ সম্পন্ন হবে। কৃষ্ণ বিনা অর্জুন অথবা অর্জুন বিনা কৃষ্ণ থাকতে পারেন না, কৃষ্ণ ও অর্জুনের অজেয় কেউ নেই। আর, তোমাদের সহায়তা পেলে ভীম কি না করতে পারে?

কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন ব্রাহ্মণের বেশ ধরে মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। তারা কুরুজঙ্গলের মধ্য দিয়ে গিয়ে কালকূট দেশ পার হোয়ে করে গণ্ডকী, মহাশোণ, সরযু, চর্মন্বতী প্রভৃতি নদী পার হয়ে মিথিলায় এলেন। তার পর পূর্বমুখে গঙ্গা ও শোণ নদী পার হোয়ে মগধ দেশে প্রবেশ করলেন এবং গিরিব্রজ নগরের প্রান্তে চৈত্যক পর্বতে উপস্থিত হলেন। এই স্থানে রাজা বৃহদ্রথ এক বৃষরূপী মাংসাশী দৈত্যকে বধ করেন এবং তার চর্ম আর নাড়ী দিয়ে তিনটি ভেরী তৈরী করিয়ে স্থাপন করেন। কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন সেই ভেরী ভেঙে ফেলে পর্বতের এক বিশাল প্রাচীন শৃঙ্গ উপড়ে ফেলে নগরে প্রবেশ করলেন।

তাঁরা নগরের সমৃদ্ধি দেখতে দেখতে রাজপথ দিয়ে চললেন। এক মালাকারের কাছ থেকে মালা আর অঙ্গরাগ নিয়ে তারা নিজেদের বস্ত্র রাঙ্গিযে নিয়ে, মালা ধারণ করে দেহে অগুরুচন্দন লেপন কোরে নিলেন। তার পর লোকজনে পূর্ণ তিনটি মহল পার কোরে সগর্বে জরাসন্ধের কাছে এসে বললেন, রাজা, আপনার কুশল হোক। জরাসন্ধ তখন একটি ব্ৰত রাখার জন্য উপবাসী ছিলেন। তিনি আগন্তুকদের বেশ দেখে বিস্মিত হলেন এবং যথাবিহিত সম্মান জানিয়ে বললেন, আপনারা বসুন। তিনজনে উপবিষ্ট হোলে জরাসন্ধ বললেন, আপনারা মালা ধারণ ও চন্দনা লেপন করেছেন, রঙ্গিণ বস্ত্র পরেছেন, আপনাদের বেশ ব্রাহ্মণের ন্যায় কিন্তু বাহুতে ধনুর্গুণের আঘাতচিহ্ন দেখছি। সত্য বলুন আপনারা কে। চৈত্যক পর্বতের শৃঙ্গ ভগ্ন করে ছদ্মবেশে পিছনের দরজা দিয়ে কেন এসেছেন? আমি যথাবিধি উপহার দিয়েছি, কিন্তু আপনারা তা নিলেন না কেন?

গম্ভীর কণ্ঠে কৃষ্ণ উত্তর দিলেন, রাজা, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য তিন জাতিই ব্রাহ্মণের ব্রত নিয়ে মালা ধারণ করতে পারে। আমরা ক্ষত্রিয় সেজন্য আমাদের বাক্যবল বেশী নেই, যদি চান তো বাহুবল দেখাতে পারি। বুদ্ধিমান লোকে পিছনের দরজা দিয়ে শত্রুর গৃহে এবং সামনের দরজা দিয়ে মিত্রের গৃহে যায়। আপনি আমাদের শত্রু সেজন্য আপনার প্রদত্ত উপহার আমরা নিতে পারি না। জরাসন্ধ বললেন, আপনাদের সঙ্গে কখনও শত্রুতা করেছি এমন মনে পড়ে না। আমি নিরপরাধ, তবে আমাকে শত্রু বলছেন কেন?

কৃষ্ণ উত্তর দিলেন, ক্ষত্রিয়কুলের নেতৃস্থানীয় কোনও এক ব্যক্তির আদেশে আমরা তোমাকে শাসন করতে এসেছি। তুমি বহু ক্ষত্রিয়কে অবরুদ্ধ করে রেখেছ। সৎস্বভাব রাজাদেরকে রুদ্রের নিকট বলি দেবার সঙ্কল্প করেছ। তোমার এই পাপকাজ বন্ধ না করলে আমাদেরও পাপ হবে। আমরা ধর্মাচারী, ধর্মরক্ষায় সমর্থ। মনুষ্যবলি আমরা কখনও দেখি নি, তুমি স্বয়ং ক্ষত্রিয় হয়ে কোন্ বুদ্ধিতে ক্ষত্রিয়গণকে মহাদেবের নিকট পশুর মতো বলি দিতে চাও? ক্ষত্রিয়দের রক্ষার জন্য আমরা তোমাকে বধ করতে এসেছি। আমরা ব্রাহ্মণ নই, আমি কৃষ্ণ, এঁরা দুজন পাণ্ডুপুত্র। আমরা তোমাকে যুদ্ধে আহ্বান করছি, হয় বন্দী রাজাদের মুক্তি দাও, না হয় যমালয়ে যাও।

জরাসন্ধ বললেন, কৃষ্ণ, যাকে সবলে জয় করা হয় তাকে নিয়ে যা ইচ্ছা করা যেতে পারে —এই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়ার জন্য যাদের এনেছি, ভয় পেয়ে তাদের ছেড়ে দিতে পারি না। তোমরা কিপ্রকার যুদ্ধ চাও? সৈন্যবাহিনী নিয়ে, না তোমাদের একজন বা দুজন বা তিনজনই আমার সঙ্গে যুদ্ধ করবে? কৃষ্ণ বললেন, আমাদের তিনজনের মধ্যে কার সঙ্গে তুমি যুদ্ধ করতে চাও? জরাসন্ধ ভীমকে নির্বাচন করলেন।

পুরোহিত গোচনা, মালা প্রভৃতি মাঙ্গল্য দ্রব্য এবং বেদনা ও মূৰ্ছা নিবারক ঔষধ নিয়ে রাজার কাছে এলেন। স্বস্ত্যয়নের পর জরাসন্ধ মুকুট খুলে ফেলে দৃঢ়ভাবে কেশবন্ধন কোরে ভীমের সম্মুখীন হলেন। কৃষ্ণ ভীমের জন্য স্বস্ত্যয়ন করলে ভীমও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। দুই যোদ্ধা হাত ও পা দিয়ে পরস্পরকে আঘাত করে ক্রুদ্ধ সিংহের ন্যায় মল্লযুদ্ধ করতে লাগলেন। তারা গর্জন করে পরস্পরের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় নির্মম ভাবে আঘাত করতে লাগলেন। কয়েক হাজার ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় স্ত্রী-পুরুষ যুদ্ধ দেখবার জন্য সেখানে সমবেত হল।

কার্তিক মাসের প্রথম দিনে আরম্ভ হয়ে সেই যুদ্ধ বিরামহীন ভাবে চলার পর চোদ্দতম দিনের রাত্রিকালে জরাসন্ধ ক্লান্ত হয়ে পড়লে, কৃষ্ণ ভীমকে বললেন, যুদ্ধে ক্লান্ত শত্রুকে আঘাত করা উচিত নয়, অধিক আঘাত করলে প্রাণহানি হয়। অতএব, তুমি মৃদুভাবে রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করো। কৃষ্ণের কথায় ভীম জরাসন্ধের দুর্বলতা বুঝলেন এবং তাকে বধ করবার জন্য আরও সচেষ্ট হয়ে বললেন, কৃষ্ণ, এই পাপী তোমার অনেক স্বজনকে হত্যা করেছে, এ অনুগ্রহের যোগ্য নয়। কৃষ্ণ বললেন, ভীম, তোমার পিতা পবনদেবের কাছে যে দৈববল পেয়েছ, সেই বল এখন দেখাও।

তখন ভীম জরাসন্ধকে দুই হাতে তুলে বহুবার ঘুরিয়ে মাটিতে ফেলে পদপিষ্ট করে দুই পা ধরে টান দিয়ে তার শরীর দুই ভাগে বিভক্ত করলেন। জরাসন্ধের আর্তনাদ ও ভীমের গর্জন শুনে মগধবাসীরা ভীত হোয়ে পড়লো। তার পর জরাসন্ধের মৃতদেহ রাজভবনের দ্বারে ফেলে দিয়ে কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন সেই রাত্রিতেই বন্দী রাজাদের মুক্ত করলেন।

জরাসন্ধের দিব্যরথে বন্দী রাজাদের মুক্ত কোরে তুলে নিয়ে তারা গিরিব্রজ থেকে বেরিয়ে গেলেন। এই রথ ইন্দ্র উপরিচর বসুকে দিয়েছিলেন, উপরিচরের কাছ থেকে বৃহদ্রথ এবং তার পর জরাসন্ধ পান। কৃষ্ণ গরুড়কে স্মরণ করলে, গরুড় সেই রথের ধ্বজে বসলেন, কৃষ্ণ স্বয়ং সারথি হলেন। কারামুক্ত কৃতজ্ঞ রাজারা সবিনয়ে বললেন দেবকীনন্দন, আমরা প্রণাম করছি, আদেশ করুন আমাদের কি করতে হবে। যে কর্ম মানুষের পক্ষে অসাধ্য তাও আমরা করতে প্রস্তুত। কৃষ্ণ তাঁদের আশ্বস্ত করে বললেন, যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করে সম্রাট হোতে ইচ্ছা করেন, আপনারা তাকে সাহায্য করবেন। রাজারা সানন্দে সম্মত হলেন।

এই সময়ে জরাসন্ধের পুত্র সহদেব তাঁর পুরোহিত অমাত্য ও স্বজনবর্গের সঙ্গে এসে কৃষ্ণকে প্রণাম করলেন। কৃষ্ণ তাকে অভয় দিয়ে তার প্রদত্ত মূল্যবান রত্নসমূহ নিলেন এবং তাঁকে মগধের রাজপদে অভিষিক্ত করলেন। তারপর কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে এসে যুধিষ্ঠিরকে সমস্ত বৃত্তান্ত জানালেন। যুধিষ্ঠির অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং রাজাদের যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে তাদের নিজেদের রাজ্যে যেতে অনুমতি  দিলেন। কৃষ্ণও দ্বারকায় ফিরে গেলেন।

______________

(ক্রমশ)