মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৩৬
দ্রৌপদীর অপমান এবং ভীমের শপথ
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
দ্রৌপদীর অপমান এবং ভীমের শপথ
পাশা খেলায় দ্রৌপদীকে জিতে নেওয়ার পর দুর্যোধন যখান বিদুরকে বললেন, দ্রৌপদীকে নিয়ে আসুন, সে অন্য দাসীদের সঙ্গে পরিচারিকার কাজ করুক, তখন বিদুর অস্বীকার কোরে বললেন, দ্রৌপদী দাসী হোতে পারেন না, কারণ তাঁকে বাজী রাখবার সময় যুধিষ্ঠিরের তার উপর কোনো অধিকার ছিলো না।
বিদুর অস্বীকার করায়, দুর্যোধন তার এক অনুচরকে বললেন, তুমি দ্রৌপদীকে এখানে নিয়ে এস, তোমার কোনও ভয় নেই। দুর্যোধনের অনুচার দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে বললে, যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব এবং নিজেকে বাজী রেখে হেরে গেছেন। আপনাকেও তিনি পণ রেখেছিলেন এবং দুর্যোধন আপনাকে জয় করেছেন। আপনি আমার সঙ্গে আসুন। দ্রৌপদী বললেন, তুমি যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করে এস তিনি আগে নিজেকে না আমাকে হেরেছিলেন?
দুর্যোধনের অনুচর সভায় এসে দ্রৌপদীর প্রশ্ন জানালে, যুধিষ্ঠির মৃতের ন্যায় বসে রইলেন, কিছুই উত্তর দিলেন না। দুর্যোধন বললেন, দ্রৌপদী নিজেই এখানে এসে প্রশ্ন করুন। অনুচর আবার গেলে দ্রৌপদী বললেন, তুমি সভায় উপস্থিত ধর্মাত্মা নীতিবান সদস্যগণকে জিজ্ঞাসা করো, ধর্ম অনুসারে আমার কর্তব্য কি। তারা যা বলবেন আমি তাই করব। অনুচর সভায় ফিরে এসে দ্রৌপদীর প্রশ্ন জানালে সকলে নতমুখে নীরবে রইলেন। এই সময়ে যুধিষ্ঠির একজন বিশ্বস্ত দূতকে দিয়ে দ্রৌপদীকে বলে পাঠালেন, দ্রৌপদী তুমি এখন রজস্বলা ও একবস্ত্রা, এই অবস্থাতেই কাঁদতে কাঁদতে সভায় এসে শ্বশুরের সম্মুখে দাঁড়াও।
দুর্যোধন আবার অনুচরকে বললেন, দ্রৌপদীকে নিয়ে এস। অনুচর ভয় পেয়ে বললো, তাকে কি বলবো? অনুচর ভীমের ভয়ে ভীত হয়েছে বুঝতে পেরে দুর্যোধন বললেন, দুঃশাসন, তুমি নিজে দ্রৌপদীকে ধরে নিয়ে এস। দুঃশাসন দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে বললেন, যুধিষ্ঠির তোমাকে পাশা খেলায় হেরে গেছে, তাই তুমি দুর্যোধনের সঙ্গে দেখা করে কৌরবদের সেবা করো। দুঃশাসনের কথা শুনে দ্রৌপদী ব্যাকুল হয়ে ধৃতরাষ্ট্রের পত্নীর কাছে চললেন, কিন্তু দুঃশাসন তার কেশ ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকলে, দ্রৌপদী মিনতি কোরে বললেন, আমি একবস্ত্রা রজস্বলা, আমাকে সভায় নিয়ে যেয়ো না। দুঃশাসন বললেন, তুমি রজস্বলা একবস্ত্রা বা বিবস্ত্রা যাই হও, পাশা খেলায় হেরে গিয়ে আমাদের দাসী হয়েছ।
দুঃশাসন কেশ ধরে টানতে টানতে দ্রৌপদীকে সভায় নিয়ে এলেন। লজ্জায় ও ক্রোধে দ্রৌপদী ধীরে ধীরে বললেন, দুঃশাসন, ইন্দ্রাদি দেবগণও যদি তোমার সহায় হন তবুও পাণ্ডবগণ তোমাকে ক্ষমা করবেন না। এই সভার মধ্যে আমাকে টেনে আনা হোলো কিন্তু কেউ তার নিন্দা করছেন না! ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, আর রাজা ধৃতরাষ্ট্র কি মৃত? প্রবীণ কৌরবগণ এই দারুণ অধর্মাচার কি দেখতে পাচ্ছেন না? ধিক, ভরতবংশের ধর্ম আর চরিত্র নষ্ট হয়েছে, এই সভায় কৌরবগণ কুলধর্মের মর্যাদা লঙ্ঘন নীরবে দেখছেন। দ্রৌপদী করুণ স্বরে বিলাপ করে নিজের পতিদের দিকে তাকাচ্ছেন দেখে দুঃশাসন তাকে ধাক্কা দিয়ে জোরে হেসে বললেন, চুপ করো দাসী! তাই দেখে কর্ণ ও শকুনি খুশি হোয়ে জোরে হাসলেন।
সভায় আর সকলেই অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। ভীষ্ম বললেন, ভাগ্যবতী, ধর্মের তত্ত্ব অতি সূক্ষ্ম, আমি তোমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিতে পারছি না। যুধিষ্ঠির সব ত্যাগ করলেও সত্য ত্যাগ করেন না। পাশা খেলায় শকুনি অদ্বিতীয়, তার জন্যই যুধিষ্ঠিরের খেলবার ইচ্ছা হয়েছিল। শকুনি কপটতা অবলম্বন করেছেন যুধিষ্ঠির এমন মনে করেন না। দ্রৌপদী বললেন, যুধিষ্ঠিরের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধূর্ত লোকেরা তাকে এই সভায় আহ্বান করেছে। তার খেলতে ইচ্ছা হয়েছিল কেন বলছেন? তিনি শুদ্ধস্বভাব, প্রথমে কপটতা বুঝতে পারেননি তাই পরাজিত হয়েছেন, পরে বুঝতে পেরেছেন। এই সভায় কুরুবংশীয়গণ রয়েছেন, এঁরা কন্যা ও পুত্রবধূদের অভিভাবক, সুবিচার করে বলুন আমাকে জয় করা হয়েছে কি না?
দ্রৌপদীর অপমান দেখে ভীম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, পাশা খেলোয়াড়রা তাদের রক্ষিতাকেও কখনও বাজী রাখে না। শত্রুরা কপটতার দ্বারা ধন, রাজ্য এবং আমাদেরও হরণ করেছে, কিন্তু তাতেও আমার ক্রোধ হয়নি, কারণ আপনি এই সমস্তের প্রভু। কিন্তু পাণ্ডবদের ধর্মপত্নী দ্রৌপদী এই অপমানের যোগ্য নন, নীচ, নৃশংস কৌরবগণ আপনার দোষেই তাকে কষ্ট দিচ্ছে। আমি আপনার হাত পুড়িয়ে দেবো, সহদেব আগুন আন।
অর্জুন ভীমকে শান্ত করলেন। দুর্যোধনের এক ভাই বিকর্ণ সভার সকলকে বললেন, দ্রৌপদী যা বললেন আপনারা তার উত্তর দিন, যদি সুবিচার না করেন তবে আমরা নরকে যাবো। কুরুগণের মধ্যে বৃদ্ধতম ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্র, মহামতি বিদুর, আচার্য দ্রোণ ও কৃপ, এঁরা দ্রৌপদীর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না কেন? যে সকল রাজারা এখানে আছেন তারাও বলুন। বিকর্ণ এইরূপে বহুবার বললেও কেউ উত্তর দিলেন না। তখন বিকর্ণ রুষ্ট হোয়ে বললেন, আপনারা কিছু বলুন বা না বলুন, আমি যা ন্যায্য মনে করি তা বলছি। মৃগয়া, মদ্যপান, পাশা খেলা এবং অধিক স্ত্রীসংসর্গ — এই চারটি রাজাদের ব্যসন। এই চারটি ব্যাসনে আসক্ত ব্যক্তি ধর্মচ্যুত হয়, তার কৃতকর্মকে লোকে অন্যায় বলে মনে করে। যুধিষ্ঠির ব্যাসনে আসক্ত হোয়ে দ্রৌপদীকে পণ রেখেছিলেন। কিন্তু সকল পাণ্ডবই দ্রৌপদীর স্বামী, আর যুধিষ্ঠির নিজে হেরে যাওয়ার পর দ্রৌপদীকে পণ রেখেছিলেন, যা যুধিষ্ঠির পারেন না।
সভায় অনেকে বিকর্ণের প্রশংসা আর শকুনির নিন্দা করতে লাগলেন। কর্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, এই সভার সদস্যগণ যে কিছু বলছেন না তার কারণ এঁরা দ্রৌপদীকে বিজিত বলেই মনে করেন। বিকর্ণ, তুমি বালক হয়ে প্রবীণের মতো কথা বলছ। নির্বোধ, তুমি ধর্ম জান না। যুধিষ্ঠির সর্বস্ব পণ করেছিলেন দ্রৌপদী তার অন্তর্গত, তিনি স্পষ্টবাক্যে দ্রৌপদীকেও পণ রেখেছিলেন, পাণ্ডবগণ তাতে আপত্তি করেননি। আরও শোন, স্ত্রীদের এক পতিই ধর্মসম্মত, দ্রৌপদীর অনেক পতি, তাই দ্রৌপদী বেশ্যা! শকুনি সমস্ত ধন ও দ্রৌপদী সমেত পঞ্চপাণ্ডবকে জয় করেছেন। দুঃশাসন, তুমি পাণ্ডবদের আর দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ কর।
পাণ্ডবগণ নিজ নিজ উত্তরীয় বসন ফেলে দিলেন। দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্র ধরে সবলে টান দিলেন। লজ্জা থেকে ত্রাণ পাবার জন্য দ্রৌপদী কৃষ্ণকে ডাকতে লাগলেন। তখন অদৃশ্য থেকে কৃষ্ণ বস্ত্রদ্বারা দ্রৌপদীকে আবৃত করতে থাকলেন। দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্র ধরে ক্রমাগত টানতে থাকলেও দ্রৌপদীকে বিবস্ত্র করতে সক্ষম হলেন না। এই আশ্চর্য ঘটনা দেখে সভায় উপস্থিত সকলে দ্রৌপদীর প্রশংসা আর দুঃশাসনের নিন্দা করতে লাগলেন।
ক্রোধে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ কোরে ভীম উচ্চস্বরে বললেন, ক্ষত্রিয়গণ শোন, যদি আমি যুদ্ধক্ষেত্রে এই পাপী ভরতকুলের কলঙ্ক দুঃশাসনের বুক চিরে করে রক্তপান না করি, তবে যেন স্বর্গলাভ না করি। ভীমের এই ভয়ানক শপথ শুনে রাজারা তার প্রশংসা এবং দুঃশাসনের নিন্দা করতে লাগলেন। সভায় দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ করতে না পেরে, দুঃশাসন শ্রান্ত ও লজ্জিত হয়ে বসে পড়লেন। বিদুর সভায় উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, আপনারা ক্রন্দনরতা দ্রৌপদীর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না। তাতে ধর্মের হানি হচ্ছে। বিকর্ণ নিজের বুদ্ধি অনুসারে উত্তর দিয়েছে, আপনারাও দিন। সভার রাজারা উত্তর দিলেন না।
দ্রৌপদী বিলাপ করতে লাগলেন। ভীষ্ম বললেন, কল্যাণী, আমি তোমাকে বলেছি যে ধর্মের গতি অতি দুর্বোধ্য সেজন্য আমি উত্তর দিতে পারছি না। কৌরবগণ অধর্ম করেছে, শীঘ্রই এদের বিনাশ হবে। দুর্যোধন হাসতে হাসতে দ্রৌপদীকে বললেন, ভীম অর্জুন প্রভৃতি বলুন যে যুধিষ্ঠির তোমার স্বামী নন, তিনি মিথ্যাবাদী, তা হলে তুমি দাসীত্ব থেকে মুক্ত হবে। অথবা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির স্বয়ং বলুন তিনি তোমার স্বামী কি না। ভীম বললেন, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির যদি আমাদের গুরু না হতেন তবে কখনই ক্ষমা করতাম না। উনি যদি আমাকে অব্যাহতি দেন, তবে খালি হাতে এই পাপী দুর্যোধন ও তার ভাইদেরকে মেরে ফেলতে পারি।
যুধিষ্ঠিরকে নীরব দেখে দুর্যোধন বললেন, ভীম, অর্জুন প্রভৃতি আপনার আজ্ঞাধীন, আপনিই দ্রৌপদীর প্রশ্নের উত্তর দিন। এই বলে দুর্যোধন কর্ণের দিকে চেয়ে একটু হেসে তার বাম উরু থেকে বস্ত্র সরিয়ে দ্রৌপদীকে দেখালেন। তাই দেখে ভীম ক্রুদ্ধ হোয়ে বললেন, যুদ্ধে তোমার ওই উরু যদি গদাঘাতে না ভাঙি তবে যেন আমার আত্মার সদ্গতি না হয়।
বিদুর বললেন, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ, এই ভীম থেকে তোমাদের মহাবিপদ হবে তা জেনে রাখ! তোমরা পাশা খেলার নিয়ম লঙ্ঘন করেছ, সভায় স্ত্রীলোক এনে বিবাদ করেছ। যুধিষ্ঠির নিজেকে হারার পূর্বে দ্রৌপদীকে বাজী রাখতে পারতেন, কিন্তু নিজেকে হারাবার পর তা পারেন না।
এমন সময় একটা শৃগালের চিৎকার শোনা গেলো, গাধা ও পাখীরাও ভয়ংকর রবে ডাকতে লাগল। অশুভ শব্দ শুনে বিদুর, গান্ধারী, ভীষ্ম, দ্রোণ, ও কৃপ ‘স্বস্তি স্বস্তি’ বললেন এবং ধৃতরাষ্ট্রকে জানালেন। তখন ধৃতরাষ্ট্র বললেন, মূর্খ দুর্যোধন, এই সভায় তুমি পাণ্ডবগণের ধর্মপত্নীর সঙ্গে অন্যায় আচরণ করেছ! তুমি অধর্ম করেছ। তার পর তিনি দ্রৌপদীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, দ্রৌপদী, তুমি আমার পুত্রবধুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা এবং ধর্মশীলা সতী, আমার কাছে তুমি বর চাও।
দ্রৌপদী বললেন, এই বর দিন যেন সর্বধর্মচারী যুধিষ্ঠির দাসত্ব থেকে মুক্ত হন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, কল্যাণী, যা বললে তাই হবে। তুমি দ্বিতীয় বর চাও, একটিমাত্র বর তোমার যোগ্য নয়। দ্রৌপদী বললেন, মহারাজ, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব দাসত্ব থেকে মুক্ত ও স্বাধীন হন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, পুত্রী, তাই হবে। দুটি বরও তোমার পক্ষে যথেষ্ট নয়, তৃতীয় বর চাও। দ্রৌপদী বললেন মহারাজ, লোভে ধর্মনাশ হয়, আমি আর বর চাই না। এই বিধান আছে যে বৈশ্য এক বর, ক্ষত্রিয় দুই বর, রাজা তিন বর এবং ব্রাহ্মণ শত বর নিতে পারেন। আমার স্বামীরা দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছেন, আমি এতেই খুশী।
যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের কাছে গিয়ে হাতজোড় কোরে বললেন, মহারাজ, আমরা সর্বদাই আপনার অধীন, আদেশ করুন এখন কি করবো। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, যুধিষ্ঠির, তোমার মঙ্গল হোক। সমস্ত ধন সমেত তোমরা নির্বিঘ্নে ফিরে যাও, নিজ রাজ্য শাসন কর। তুমি ধর্মের সূক্ষ্ম গতি জান, তুমি বিনীত, প্রবীণদের সেবক। যাঁরা উত্তম পুরুষ তারা কারও শত্রুতা করেন না, পরের দোষ না দেখে গুণই দেখেন। এই সভায় তুমি ধর্মসম্মত আচরণ করেছ। বৎস, দুর্যোধনের নিষ্ঠুরতা মনে রেখো না। আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী বৃদ্ধ অন্ধ পিতা, আমাকে আর তোমার মাতা গান্ধারীকে দেখো। তোমাদের দেখবার জন্য এবং এই দুই পক্ষের শক্তি জানবার জন্য আমি পাশা খেলায় মত দিয়েছিলাম। তোমার ন্যায় শাসনকর্তা এবং বিদুরের ন্যায় মন্ত্রী থাকতে কুরুবংশের কোনও ভয় নেই। এখন তুমি ইন্দ্রপ্রস্থে যাও, ভাইদের সঙ্গে তোমার সম্প্রীতি এবং ধর্মে মতি থাকুক।
______________
(ক্রমশ)