Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 44

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৪৫

ভগীরথ কর্তৃক মর্ত্যে গঙ্গা আনয়নের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

ভগীরথ কর্তৃক মর্ত্যে গঙ্গা আনয়নের কাহিনি

মহর্ষি অগস্ত্যের বিভিন্ন কীর্তি বর্ণনা করবার পরে, যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে দেবর্ষি লোমশ ভগীরথ কর্তৃক মর্ত্যে গঙ্গা আনয়নের কাহিনি বললেন। - ইক্ষ্বাকুবংশে সগর নামে এক রাজা ছিলেন, পুত্রকামনায় তিনি তাঁর দুই পত্নীকে সঙ্গে নিয়ে কৈলাস পর্বতে গিয়ে কঠোর তপস্যা করেন। মহাদেবের বরে তার এক পত্নীর গর্ভে ষাট হাজার পুত্র এবং আর এক পত্নীর গর্ভে অংশুমান নামে একটি পুত্র হোলো ।

সগরের ষাট হাজার পুত্র অত্যন্ত দুষ্ট স্বভাবের ছিলো। তারা সকলে মিলে একদিন ইন্দ্রের ঘোড়া চুরি কোরে সমুদ্রের তীরে তপস্যারত কপিল মুনির আশ্রমের পিছনে নিয়ে এসে বেঁধে রেখে কাছাকাছি লুকিয়ে রইলো। চুরি হয়ে যাওয়া ঘোড়া খুঁজতে খুঁজতে দেবরাজ ইন্দ্র কপিল মুনির আশ্রমে এসে সেই ঘোড়া দেখতে পেয়ে, কপিল মুনিকে চোর অপবাদ দিয়ে ঘোড়া নিয়ে চলে গেলো। ইন্দ্রের কাছে কপিল মুনি চোর অপবাদ শুনে, ভীষণ ক্রোধে অভিশাপ দিয়ে বললেন, যাদের জন্য ইন্দ্র কপিল মুনিকে চোর অপবাদ দিলেন, তারা ভস্ম হোয়ে যাক। কপিল মুনির অভিশাপের ফলে সগরের ষাট হাজার পুত্র তৎক্ষণাৎ ভস্ম হোয়ে গেলো।

সগররাজা তার পুত্রদের কপিল মুনির অভিশাপে ভস্ম হোয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে, কপিল মুনির আশ্রমে গিয়ে তার পুত্রদের আত্মার সদ্গতির জন্য প্রার্থনা করলে, কপিল মুনি প্রসন্ন হয়ে বললেন, তোমার বংশের কেউ স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে মর্ত্যে এনে তোমার পুত্রদের ভস্মের উপর দিয়ে বইয়ে দিলে তাদের আত্মার সদ্গতি হবে।

কপিলের কথা শুনে প্রথমে রাজা সগর গঙ্গাকে মর্ত্যে আনবার চেষ্টা কোরে বিফল হলেন। তারপর রাজা সগরের মৃত্যু হোলে, অংশুমান রাজা হলেন। অংশুমান রাজা হওয়ার পর তিনিও গঙ্গাকে মর্ত্যে আনবার চেষ্টা কোরে বিফল হলেন। অংশুমানের মৃত্যুর পরে, তাঁর পুত্র অসমঞ্জ রাজা হয়ে গঙ্গাকে মর্ত্যে আনবার চেষ্টা কোরে সফল হোতে পারেননি।

অসমঞ্জ মারা যাওয়ার পরে, তাঁর পুত্র দিলীপ রাজা হলেন, কিন্তু তিনিও গঙ্গাকে মর্ত্যে আনবার চেষ্টা কোরে বিফল হলেন এবং পুত্রহীন অবস্থায় দুইজন স্ত্রীকে রেখে মৃত্যুবরণ করলেন। পুত্রহীন অবস্থায় দিলীপ মৃত্যুবরণ করায়, তার স্ত্রীরা বংশরক্ষা ও গঙ্গাকে মর্ত্যে আনবার জন্য ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে কুলগুরু মহর্ষি বশিষ্টের শরণাপন্ন হোলে, বশিষ্ট দিলীপের দুই স্ত্রীকে বললেন যে, তারা যদি পরস্পর স্বামী-স্ত্রীর মতো আচরণ করে, তবে তাদের একজন গর্ভবতী হোয়ে পুত্রসন্তানের জন্ম দেবে। বৈশিষ্টের উপদেশ পালন করায়, মৃত দিলীপের স্ত্রী একটি পুত্রের জন্ম দিলো, যার নাম রাখা হোলো ভগীরথ। জন্মকালে শিশু ভগীরথের শরীর ছিলো বিকৃত। তার বিকৃত শরীর দেখে, দিলীপের স্ত্রীরা আবার বশিষ্টের শরণাপন্ন হোলে, বশিষ্ট মুনির দেওয়া উপদেশ পালন কোরে অষ্টাবক্র মুনির আশীর্বাদে ভগীরথের শরীর সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে গেলো।

ভগীরথ যৌবনকালে রাজা হওয়ার পরে, কপিলের শাপে ভস্মীভূত হওয়া তার পূর্বপুরুষ ষাট হাজার সগরপুত্রের আত্মার সদ্গতির জন্য গঙ্গাকে মর্ত্যে আনবার জন্য তপস্যা করলে দেবরাজ ইন্দ্র আবির্ভুত হয়ে ভগীরথকে বললেন, গঙ্গা ব্রহ্মার কমণ্ডলুতে অবস্থান করেন। তাই তুমি ব্রহ্মলোকে গিয়ে গঙ্গাকে মর্ত্যে আনবার জন্য ব্রহ্মার প্রার্থনা করো। ইন্দ্রের কথায় ভগীরথ ব্রহ্মলোকে গিয়ে ব্রহ্মাকে তুষ্ট করলে, ব্রহ্মা গঙ্গাকে মর্ত্যে অবতরণ করতে অনুমতি দিলেন। গঙ্গাকে মর্ত্যে আনবার সময়, গঙ্গার প্রবল গতিধারা মহাদেবের জটায় আবদ্ধ হোলে, ভগীরথ মহাদেবকে তপস্যায় তুষ্ট করলে, মহাদেব তাঁর জটার একটি অংশ খুলে দিলে গঙ্গা সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আবার ভগীরথের পিছনে পিছনে কলকল শব্দে চললেন। গঙ্গার প্রবল গতিধারা মহাদেবের জটায় আবদ্ধ হয়েছিল বলে, মহাদেবের আর এক নাম হোলো গঙ্গাধর।

কিছুকাল চলার পরে গঙ্গার চলার শব্দ না পেয়ে, ভগীরথ পিছনে তাকিযে গঙ্গাকে দেখতে না পেয়ে আশ্রমবাসী এক মুনিকে দেখে গঙ্গার কথা জানতে চাইলে তিনি বললেন, আমার নাম জহ্নু মুনি, গঙ্গা  আমার আশ্রম ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তাই আমি তাকে পান করেছি। সেই কথা শুনে, ভগীরথ জহ্নু মুনিকে অনুরোধ করলে, জহ্নু মুনি নিজের জানু চিরে গঙ্গাকে মুক্ত কোরে দিলেন। জহ্নু মুনি গঙ্গাকে পান কোরে নিজের জানু চিরে গঙ্গাকে মুক্ত কোরে দিযেছিলেন বলে, গঙ্গার এক নাম হোলো জাহ্নবী। গঙ্গা আবার ভগীরথের পিছনে পিছনে কলকল শব্দে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম কোরে অবশেষে কপিলের শাপে ভস্মীভূত হওয়া ষাট হাজার সগরপুত্রের ভস্ম ভাসিয়ে নিয়ে সাগরে পতিত হলেন। এইভাবে গঙ্গার পবিত্র জলে প্লাবিত হয়ে সগরসন্তানগণ উদ্ধার লাভ করলেন এবং সমুদ্র আবার জলপূর্ণ হোলো। ভগীরথ গঙ্গাকে মর্ত্যে এনেছিলেন বলে, গঙ্গার আর এক নাম ভাগীরথী।

______________

(ক্রমশ)