Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 46

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৪৭

পরশুরাম কর্তৃক ক্ষত্রিয়বিনাশের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

পরশুরাম কর্তৃক ক্ষত্রিয়বিনাশের কাহিনি

পাণ্ডবগণ লোমশ মুনির কাছে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির কাহিনি শোনার পর কৌশিকী নদীর তীরবর্তী অঞ্চল থেকে যাত্রা করে গঙ্গাসাগর সঙ্গমে কলিঙ্গদেশে বৈতরণী নদী প্রভৃতি তীর্থ দর্শন কোরে অবশেষে মহেন্দ্র পর্বতে এলেন। মহাতেজস্বী মহামুনি পরশুরাম মহেন্দ্র পর্বতে আশ্রম নির্মাণ কোরে সেখানে শিষ্যদের সঙ্গে অবস্থান করছিলেন। মহেন্দ্র পর্বতে পৌঁছে যুধিষ্ঠির পরশুরামের অনুচর অকৃতব্রণকে বলেন, ভগবান পরশুরাম কখন তপস্বীদের দর্শন দেন? আমি তাঁর দর্শন পেতে চাই। অকৃতব্রণ বললেন, আপনার আসবার খবর তিনি জানেন, শীঘ্রই তিনি আপনাকে দেখা দেবেন। চতুর্দশী ও অষ্টমী তিথিতে তিনি দেখা দেন, আজ রাত্রি অতীত হলেই চতুর্দশী পড়বে। তার পর যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে অকৃতব্রণ পরশুরামের ইতিহাস বললেন।

প্রাচীনকালে হৈহয় দেশের রাজা ছিলেন কার্তবীর্যার্জুন। হৈহয়রাজ কার্তবীর্যার্জুনের সহস্র বাহু ছিল। তিনি মহর্ষি দত্রাত্রেয়র বরে স্বর্ণময় বিমান এবং পৃথিবীর সকল প্রাণীর উপর আধিপত্য করার অধিকার লাভ করেছিলেন। তাঁর অত্যাচারে নিপীড়িত হয়ে দেবগণ ও ঋষিগণ বিষ্ণুর কাছে গিয়ে বললেন, আপনি কার্তবীর্যার্জুনকে বধ করে তার অত্যাচার থেকে আমাদের রক্ষা করুন। বিষ্ণু সম্মত হয়ে বদরিকায় গেলেন। এই সময়ে খ্যাতনামা মহাবল গাধি কান্যকুজে রাজত্ব করতেন, তাঁর অপ্সরার মতো রূপবতী একটি কন্যা ছিল। ভূগুপুত্র ঋচীক সেই কন্যাকে বিবাহ করতে চাইলে গাধি বললেন, কৌলিক রীতি রক্ষা করা আমার কর্তব্য, আপনি যদি সেই রীতি পালন কোরে দান স্বরূপ আমাকে এক হাজার দ্রুতগামী হলুদ বর্ণের ঘোড়া দেন, তবে আপনাকে কন্যা দান করতে পারি। সেই শর্ত শুনে ঋচীক বরুণের নিকট থেকে ওইরূপ এক হাজার ঘোড়া চেয়ে নিয়ে গাধিকে দিলেন এবং তার কন্যা সত্যবতীকে বিবাহ করলেন।

একদিন সপত্নীক মহর্ষি ভৃগু তার পুত্র ও পুত্রবধুকে দেখতে এলেন। ভৃগু হৃষ্ট হয়ে পুত্রবধুকে বললেন, তুমি বর চাও। সত্যবতী নিজের এবং তার মাতার জন্য পুত্র চাইলেন। ভৃগু তাকে দুটি পাত্রে আলাদা আলাদা চরু দিয়ে বললেন, ঋতুস্নানের পর তোমার মা এই চরু এবং তুমি এই চরু ভক্ষণ করবে। সত্যবতী ও তার মাতা (গাধির পত্নী) ভুল কোরে একে অন্যের জন্য নির্দিষ্ট চরু ভক্ষণ করলেন। ভৃগু তা দিব্যজ্ঞানে জানতে পেরে সত্যবতীকে বললেন, তোমরা একে অন্যের জন্য নির্দিষ্ট চরু খেয়েছো এবং তোমার মা তোমাকে বঞ্চনা করেছেন। তাই তোমার পুত্র ব্রাহ্মণ হলেও স্বভাবে ক্ষত্রিয়ের মতো হবে আর তোমার মায়ের পুত্র ক্ষত্রিয় হলেও স্বভাবে ব্রাহ্মণ হবে। সত্যবতী বার বার অনুনয় করে বললেন, আমার পুত্র যেন ক্ষত্রিয়ের মতো না হয়, তার বদলে আমার পৌত্র সেইরূপ হোক। ভৃগু বললেন, তাই হবে। ভৃগুর বরে সত্যবতীর পুত্র জমদগ্নি নামে এই পুত্র কালক্রমে সমগ্র ধনুর্বিদ্যা আয়ত্ত করলেন। জমদগ্নি যৌবনপ্রাপ্ত হোলে, তার সঙ্গে রাজা প্রসেনজিতের কন্যা রেণুকার বিবাহ হল। রেণুকার পাঁচ পুত্র, তাদের মধ্যে কনিষ্ঠ রাম সর্বগুণে শ্রেষ্ঠ।

একদিন বিকালে জমদগ্নি নিদ্রিত অবস্থায় ছিলেন। এদিকে সূর্যাস্ত হোয়ে সন্ধ্যা আসন্ন অথচ জমদগ্নির নিদ্রাভঙ্গ না হওয়ায় তাঁর সান্ধ্যকালীন পূজার সময় হোয়ে গেছে দেখে রেণুকা দ্বিথান্বিত হোয়ে পড়লো। রেনুকা যদি জমদগ্নিকে জাগিয়ে দেন তবে তিনি ক্রুদ্ধ হবেন আবার তিনি যদি সান্ধ্যকালীন পূজা না করেন তবে তাঁর পাপ হবে। স্বামীর যাতে পাপ না হয় সেই চিন্তা কোরে রেনুকা জমদগ্নিকে জাগিয়ে দেন। তার ফলে জমদগ্নি ক্রুদ্ধ হোয়ে রেনুকাকে ধিক্কার দিয়ে ভৎর্সনা করলেন এবং তাকে হত্যা করবার জন্য পুত্রদের একে একে আদেশ দিলেন। কিন্তু মাতৃস্নেহে অভিভূত হোয়ে চার পুত্র পিতার আদেশ পালন না কোরে নীরবে রইলেন। জমদগ্নি তাদের উপর ক্রুদ্ধ হোয়ে অভিশাপ দিলে তারা পশু-পাখির মতো জড়বুদ্ধি হয়ে গেলেন। তার পর পরশুরাম আশ্রমে এলে জমদগ্নি তাকে বললেন, পুত্র, তোমার মাতাকে হত্যা করো। পরশুরাম পিতার আদেশ পালন কোরে কুঠার দিয়ে তার মাতার শিরচ্ছেদ করলেন। জমদগ্নি প্রসন্ন হয়ে বললেন, বৎস, আমার আদেশে তুমি দুষ্কর কর্ম করেছ, তোমার বাঞ্ছিত বর চাও। পরশুরাম এই বর চাইলেন যে, মাতা জীবিত হয়ে উঠুন এবং তার মনে এই হত্যার স্মৃতি যেন না থাকে, আমার যেন পাপ স্পর্শ না হয়, আমার ভ্রাতারা যেন তাদের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পান, আমি যেন যুদ্ধে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হই এবং দীর্ঘায়ু লাভ করি। জমদগ্নি এই সকল বর দিলেন। মাতৃহত্যার পর থেকে রাম কুঠার বা পরশু অস্ত্র হিসাবে ব্যাবহার করতেন বলে পরবর্তী কালে তিনি পরশুরাম নামে খ্যাত হয়েছিলেন।

একদিন জমদগ্নির পুত্রগণ অন্যত্র গেলে রাজা কার্তবীর্যার্জুন তাদের আশ্রমে এসে সবলে গরু-বাছুর হরণ করলেন এবং আশ্রমের সমস্ত গাছপালা নষ্ট করলেন। পরশুরাম আশ্রমে ফিরে এসে পিতার নিকট সমস্ত শুনে কার্তবীর্যার্জুনের কাছে গিয়ে তীক্ষ্ণ ভল্লের আঘাতে তার সহস্র বাহু কেটে ফেলে তাকে বধ করলেন। তখন কার্তবীর্যার্জুনের পুত্রগণ আশ্রমে এসে জমদগ্নিকে আক্রমণ করলেন। তিনি তপস্যা করছিলেন সেজন্য মহাবলশালী হয়েও যুদ্ধ করলেন না, অসহায়ের মতো ‘রাম রাম’ বলে কনিষ্ঠ পুত্রকে ডাকতে লাগলেন। কার্তবীর্যার্জুনের পুত্রগণ জমদগ্নিকে হত্যা কোরে চলে গেলেন।

পরশুরাম আশ্রমে ফিরে এসে পিতাকে নিহত দেখে বহু বিলাপ করলেন এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করে একাকীই কার্তবীর্যার্জুনের সমস্ত পুত্র ও অনুচরগণকে যুদ্ধে বিনাশ করলেন। তারপার প্রচণ্ড ক্রোধের বশে তিনি একুশ বার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় কোরে পাঁচটি রক্তপূর্ণ হ্রদ সৃষ্টি করে সেখানে পিতৃগণের তর্পণ করলেন। অবশেষে পিতামহ ঋচীকের অনুরোধে তিনি ক্ষত্রিয়হত্যা থেকে নিবৃত্ত হলেন এবং এক মহাযজ্ঞ সম্পন্ন কোরে মহাত্মা কশ্যপকে একটি প্রকাণ্ড স্বর্ণময় বেদী দান করলেন। কশ্যপের অনুমতিক্রমে ব্রাহ্মণগণ সেই বেদী খণ্ড খণ্ড করে ভাগ করে নিলেন, সেজন্য তাঁদের নাম খাণ্ডবায়ন হল। তার পর ক্ষত্রিয়বিনাশক পরশুরাম সমগ্র পৃথিবী কশ্যপকে দান কোরে এই মহেন্দ্র পর্বতে বাস করছেন।

চতুর্দশী তিথিতে মহাত্মা পরশুরাম পাণ্ডব ও ব্রাহ্মণদের দর্শন দিলেন। তার অনুরোধে যুধিষ্ঠির এক রাত্রি মহেন্দ্র পর্বতে বাস করে পরদিন দক্ষিণ দিকে যাত্রা করলেন।

______________

(ক্রমশ)