মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৫৪
ভীমের সহস্রদল পদ্ম সংগ্রহ ও হনুমানের সঙ্গে সাক্ষাৎকার
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
ভীমের সহস্রদল পদ্ম সংগ্রহ ও হনুমানের সঙ্গে সাক্ষাৎকার
যুধিষ্ঠিরাদি বদরিকাশ্রমে পৌঁছানোর পর সেখানে অর্জুনের প্রতীক্ষায় ছয রাত্রি শুদ্ধভাবে বাস করলেন। বদরিকাশ্রমে থাকার সময় একদিন উত্তরপূর্ব দিক থেকে বাতাসে উড়ে আসা একটি সহস্রদল পদ্ম দেখে দ্রৌপদী ভীমকে বললেন, দেখো, এই পদ্মফুলটি কি সুন্দর ও সুগন্ধ! আমি ধর্মরাজকে এটি দেবো। ভীম, তুমি যাদি আমাকে ভালোবাসো তবে এই রকম অনেক পদ্মফুল আমাকে এনে দাও, আমি কাম্যক বনে নিয়ে যাবো। এই বলে দ্রৌপদী পদ্মফুলটি নিয়ে যুধিষ্ঠিরের কাছে গেলেন, ভীমও গদা নিয়ে পদ্মবনের সন্ধানে যাত্রা করলেন।
ভীম গন্ধমাদন পর্বতে উপস্থিত হলেন এবং আনন্দিত মনে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চললেন। ভয়শূন্য হরিণের দল ঘাস মুখে করে তার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। যক্ষ ও গন্ধর্ব রমণীরা পতির পাশে বসে পরম রূপবান দীর্ঘকায় ভীমকে আড়াল থেকে আগ্রহ সহকারে দেখতে লাগলো। বনচর শুয়োর, মহিষ, সিংহ, বাঘ, শৃগাল প্রভৃতিকে সন্ত্রস্ত করে চলতে চলতে ভীম গন্ধমাদনের সানুদেশে এক সুবিশাল কদলীবন দেখতে পেলেন। তিনি গর্জন করে কদলী গাছ উপড়ে ফেলতে থাকলে হাজার হাজার জলচর পাখি ভয় পেয়ে জল থেকে উঠে আকাশে উড়তে লাগল। তাদের অনুসরণ করে তিনি একটি রমণীয় বিশাল পদ্ম সরোবরে উপস্থিত হলেন এবং মদমত্ত হাতির মতো বহুক্ষণ জলে সাঁতার কেটে করে তীরে উঠে শঙ্খধ্বনি করলেন। সেই শব্দ শুনে পর্বতগুহায় ঘুমন্ত সিংহেরা গর্জন করে উঠল এবং সিংহের গর্জন শুনে হাতির দলও উচ্চ রব করতে লাগলো।
সেই সময় পবননন্দন হনুমান সেখানে ছিলেন। তার ভাই ভীম স্বর্গের পথে এসে পড়েছেন দেখে, তার প্রাণরক্ষার জন্য হনুমান কদলীবনের মধ্যবর্তী পথ রোধ করলেন। সেই সংকীর্ণ পথ দিয়ে কেবল একজন চলতে পারে। হনুমান সেখানে শুয়ে পড়ে তাঁর বিশাল লেজ আন্দোলন করতে থাকলে, তার শব্দ পর্বতের গুহায় গুহায় প্রতিধ্বনিত হল। সেই শব্দ শুনে ভীমে শিহরিত হোলো, তিনি নিকটে এসে দেখলেন, কদলীবনের মধ্যে এক বিশাল শিলার উপরে হনুমান শুয়ে আছেন। তিনি স্বর্গের পথ রোধ করে পর্বতের মতো বিরাজ করছেন। ভীম নির্ভয়ে হনুমানের কাছে গিয়ে জোরে গর্জন করলেন। ভীমের গর্জন শুনে হনুমান তাঁর চোখ ঈষৎ খুলে ভীমের দিকে অবজ্ঞাভরে চাইলেন এবং একটু হেসে বললেন, আমি রুগ্ন, সুখে নিদ্রামগ্ন ছিলাম, কেন আমাকে জাগালে? আমি ধর্ম জানি না, কিন্তু তুমি তো জানো যে সকল প্রাণীকেই দয়া করা উচিত। তুমি কে, কোথায় যাবে? এই পথ দেবলোকে যাবার, মানুষের অগম্য।
ভীম নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, তুমি কে? হনুমান বললেন, আমি বানর, তোমাকে পথ ছেড়ে দেবো না। ভাল চাও তো ফিরে যাও, নতুবা তোমার মৃত্যু হবে। ভীম বললেন, মৃত্যুই হোক বা যাই হোক, তুমি ওঠো, পথ ছেড়ে দাও, তাহলে আমিও তোমার ক্ষতি করবো না। হনুমান বললেন, আমি রুগ্ন, ওঠবার শক্তি নেই, যদি নিতান্তই যেতে চাও তো আমাকে ডিঙিয়ে যাও। ভীম বললেন, শোনো পরমাত্মা দেহে অবস্থান করেন, তাকে অবজ্ঞা করে আমি তোমাকে ডিঙিয়ে যেতে পারি না, নতুবা হনুমান যেমন সাগর লঙ্ঘন করেছিলেন তেমন আমিও তোমাকে লঙ্ঘন করতাম। হনুমান বললেন, কে সেই হনুমান? ভীম বললেন, তিনি আমার ভাই, মহাগুণবান বুদ্ধিমান ও বলবান, তিনি অতি বিখ্যাত বানরশ্রেষ্ঠ। আমি তারই মতো বলশালী, তোমাকে মারবার শক্তি আমার আছে। তুমি পথ ছেড়ে দাও, নয়তো যমালয়ে যাবে। হনুমান বললেন, বার্ধক্যের জন্য আমার ওঠবার শক্তি নেই। তুমি দয়া কর, আমার লেজটি সরিয়ে দিয়ে যাও।
বানরটাকে যমালয়ে পাঠবেন স্থির করে ভীম তার লেজ ধরলেন, কিন্তু নড়াতে পারলেন না। তিনি দুই হাত দিয়ে ধরে তোলবার চেষ্টা করলেন, তার চোখ বিস্ফারিত হোলো, দরদর কোরে ঘাম বেরতে থাকলো, কিন্তু কোনও ফল হল না। তখন তিনি নত হয়ে প্রণাম কোরে হাতজোড় কোরে বললেন, হে বানরশ্রেষ্ঠ, প্রসন্ন হন, আমার কটুবাক্য ক্ষমা করুন। আমি শরণাপন্ন হয়ে শিষ্যের মতো প্রশ্ন করছি — আপনি কে?
হনুমান তখন নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, রাজ্যলাভের পর রাম আমাকে বর দিয়েছিলেন যে, তাঁর কথা যত দিন জগতে প্রচলিত থাকবে তত দিন আমি জীবিত থাকবো। সীতার বরে সর্বপ্রকার ভোগ্যবস্তু আমি ইচ্ছা করলেই উপস্থিত হয়। ভীম, এই দেবপথ মানুষের অগম্য সেজন্যই আমি রোধ করেছিলাম।
তুমি যে পদ্মের সন্ধানে এসেছ তার সরোবর কাছেই। ভীম খুশি হয়ে বললো আমার চেয়ে ধন্য কেউ নেই, কারণ আপনার দর্শন পেয়েছি। বীর, সমুদ্র লঙ্ঘনের সময় আপনার যে রূপ ছিল তাই দেখিয়ে আমাকে কৃতার্থ করুন। হনুমান ভীমের প্রার্থনা পূরণ করলেন, তাঁর সেই আশ্চর্য ভীষণ বিন্ধ্যপর্বতের মতো দেহ দেখে ভীম রোমাঞ্চিত হয়ে বললেন, প্রভু, আপনার বিপুল শরীর দেখলাম, এখন সংকুচিত করুন। আপনি পাশে থাকতে রাম স্বয়ং কেন রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন? আপনি তো নিজের বাহুবলেই রাবণকে সদলবলে ধ্বংস করতে পারতেন। হনুমান বললেন তোমার কথা যথার্থ, রাবণ আমার সমকক্ষ ছিলেন না, কিন্তু আমি তাঁকে বধ করলে রামের কীর্তি নষ্ট হোতো। ভীম, এই হোলো পদ্মবনে যাবার পথ, এখান দিয়ে গেলে তুমি কুবেরের উদ্যান দেখতে পাবে, কিন্তু তুমি বলপ্রয়োগ করে পদ্মফুল সংগ্রহ কোরো না।
হনুমান তার দেহ সংকুচিত করে ভীমকে আলিঙ্গন করলেন। ভীমের সকল ক্লান্তি দূর হোলো, তাঁর বোধ হল তিনি অত্যন্ত বলশালী হয়েছেন। হনুমান বললেন, কুন্তীপুত্র, যদি চাও তবে আমি ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের সংহার করবো, শিলার আঘাতে হস্তিনাপুর চূর্ণ করবো। ভীম বললেন, মহাবাহু, আপনার প্রসাদেই আমরা শত্ৰুজয় করবো। হনুমান বললেন, তুমি যখন যুদ্ধে গর্জন করবে তখন আমিও তার সঙ্গে আমার কণ্ঠস্বর যোগ করবো। আমি অর্জুনের পতাকার উপরে বসে ভয়ঙ্কর গর্জন করবো, তাতে তোমরা অনায়াসে শত্রুবধ করতে পারবে। এই বলে হনুমান অন্তর্হিত হলেন।
ভীম গন্ধমাদনের উপর দিয়ে হনুমানের প্রদর্শিত পথে যাত্রা করলেন। দিনশেষে তিনি বনের মধ্যে হংস, কারণ্ডব ও চক্ৰবাকে ভরা একটি বৃহৎ নদী দেখতে পেলেন, তার জল অতি নির্মল এবং পরম সুন্দর সোনালি পদ্মফুলে ভর্তি। এই নদী কৈলাসশিখর ও কুবের ভবনের নিকটবর্তী এবং ক্রোধবশ নামক রাক্ষসগণ তা রক্ষা করে। ভীম নিঃশঙ্ক চিত্তে খড়্গ হাতে নিয়ে পদ্মফুল নিতে আসছেন দেখে রাক্ষসগণ তাকে প্রশ্ন করলো, মুনির বেশধারী অথচ সশস্ত্র কে তুমি? ভীম তার পরিচয় দিয়ে জানালেন যে তিনি দ্রৌপদীর জন্য পদ্মফুল নিতে এসেছেন। রাক্ষসরা বললো, এখানে কুবের জলক্রীড়া করেন, মানুষ এখানে আসতে পারে না। যক্ষরাজের অনুমতি না নিয়ে যে আসে সে বিনষ্ট হয়। তুমি ধর্মরাজের ভাই হয়ে সবলে পদ্মফুল নিতে এসেছ কেন? ভীম বললেন, যক্ষপতি কুবেরকে তো এখানে দেখছি না, আর তার দেখা পেলেও আমি অনুমতি চাইতে পারি না, কারণ ক্ষত্রিয়রা প্রার্থনা করেন না, এই সনাতন ধর্ম। তা ছাড়া এই নদীর উৎপত্তি পর্বতের ঝর্ণা থেকে, কুবেরের ভবন থেকে নয়, তাই সকলেরই এতে সমান অধিকার।
নিষেধ অগ্রাহ্য করে ভীম জলে নামছেন দেখে রাক্ষসরা তাকে মারবার জন্য এগিয়ে এলো। শতাধিক রাক্ষস ভীমের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হোলো, আর বাকি সবাই কৈলাস পর্বতে পালিয়ে গেল। ভীম তখন নদীতে নেমে অমৃতের মতো জল পান করলেন এবং অনেক পদ্মফুল সংগ্রহ করলেন। পরাজিত রাক্ষসদের কাছে সমস্ত শুনে কুবের হেসে বললেন, আমি সব জানি, দ্রৌপদীর জন্য ভীম ইচ্ছামত পদ্মফুল নিন।
সেই সময়ে বদরিকাশ্রমে বালুকাময় জোরে বাতাস বইতে লাগল, উল্কাপাত হোলো এবং অন্যান্য দুর্লক্ষণ দেখা গেল। বিপদের আশঙ্কায় যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করলেন, ভীম কোথায়? দ্রৌপদী জানালেন যে ভীম তার অনুরোধে পদ্মফুল আনতে গেছেন। যুধিষ্ঠির বললেন, আমরাও শীঘ্র সেখানে যাবো। তখন ঘটোৎকচ তার অনুচরদের সাহায্যে যুধিষ্ঠিরাদি, দ্রৌপদী, লোমশ ও অন্যান্য ব্রাহ্মণদের সঙ্গে নিয়ে ভীমের নিকট উপস্থিত হলেন। যুধিষ্ঠির দেখলেন, অনেক রাক্ষস নিহত হয়ে পড়ে আছে, ক্রুদ্ধ ভীম গদা নিয়ে নদীতীরে দাঁড়িয়ে আছেন। যুধিষ্ঠির বললেন, ভীম, একি করেছ? এতে দেবতারা অসন্তুষ্ট হবেন আর এমন কোরো না। সেই সময়ে রক্ষিগণ এসে সকলকে প্রণাম করলো। যুধিষ্ঠির সেই রাক্ষসদের সান্ত্বনা দিলে তারা কুবেরের কাছে ফিরে গেল।
পাণ্ডবগণ অর্জুনের প্রতীক্ষায় গন্ধমাদন পর্বতে কিছুকাল সুখে যাপন করলেন। তার পর একদিন যুধিষ্ঠির তার ভাইদের বললেন, মহাত্মা লোমশ আমাদের বহু তীর্থ দেখিয়েছেন, বিশালা, বদরী এবং এই দিব্য নদীও আমরা দেখেছি, এখন কোন উপায়ে আমরা কুবেরের ভবনে যাবো তা ভেবে দেখো। এই সময়ে আকাশবাণী হল — এখান থেকে কেউ সেখানে যেতে পারে না। আপনি বদরিকাশ্রমে ফিরে গিয়ে সেখান থেকে বৃষপর্বার আশ্রম হয়ে আচিঁষেণের আশ্রমে যান, তা হলে কুবেরের ভবন দেখতে পাবেন। আকাশবাণী শুনে সকলে বদরিকাশ্রমে ফিরে গেলেন।
______________
(ক্রমশ)