Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 61

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৬১

মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বর্ণিত বক ঋষি, শিবি ও সুহোত্র এবং যযাতির দানের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বর্ণিত বক ঋষি, শিবি ও সুহোত্র এবং যযাতির দানের কাহিনি

ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা পরীক্ষিৎ, মণ্ডুকরাজকন্যা, শল, দল ও বামদেবের কাহিনি বর্ণনার পর মার্কণ্ডেয় ইন্দ্রের সখা দীর্ঘায়ু বক ঋষির কাহিনি বললেন – দেবাসুর যুদ্ধের পর ইন্দ্র ত্রিলোকের অধিপতি হয়ে নানাস্থানে ভ্রমণ করতে করতে পূর্বসমুদ্রের নিকটে বক ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হলেন। ঋষি বক সাদরে অভ্যর্থনা জানালে ইন্দ্র বললেন, আপনার লক্ষ বৎসর বয়স হয়েছে, দীর্ঘজীবীদের কি দুঃখ তা আমাকে বলুন। বক বললেন, অপ্রিয় লোকের সঙ্গে বাস, প্রিয় লোকের বিরহ, অসাধু লোকের সঙ্গে মিলন, স্ত্রী-পুত্রাদির বিনাশ, পরাধীনতার কষ্ট, দারিদ্র্যতার জন্য অবমাননা, অকুলীনের কুলমর্যাদা, কুলীনের কুলক্ষয় ইত্যাদি দীর্ঘজীবীদের দেখতে হয়, এর চেয়ে অধিক দুঃখ আর কি আছে? ইন্দ্র আবার প্রশ্ন করলেন, দীর্ঘজীবীদের সুখ কি তা বলুন। বক উত্তর দিলেন, অসৎ বন্ধুর সাহায্য না নিয়ে দিনের অষ্টম বা দ্বাদশ ভাগে শাক ভক্ষণ কোরে জীবনধারণ করা অধিকতর সুখের, নানান লোভনীয় খাবারের প্রতি আসক্ত না হয়ে সৎভাবে নিজের পরিশ্রমে সংগ্রহ করা ফল বা শাক ভোজন করাই উত্তম, অপরের ঘরে অপমানিত হয়ে সুস্বাদু খাদ্য ভোজন উচিৎ নয়। অতিথি, পরিচারক ও পিতৃগণকে অন্নদান করে যে অবশিষ্ট অন্ন খায় তার চেয়ে সুখী কেউ নেই। মহর্ষি বকের সঙ্গে নানাপ্রকার সদালাপ করে ইন্দ্র দেবলোকে চলে গেলেন।

ঋষি বকের কাহিনি শোনার পর পাণ্ডবগণ ক্ষত্রিয়মাহাত্ম্য শুনতে চাইলে মার্কণ্ডেয় বললেন -  একদা কুরুবংশীয় রাজা সুহোত্র চলার পথে উশীনরপুত্র রাজা শিবিকে দেখতে পেলেন। তারা বয়স অনুসারে পরস্পরকে সম্মান দেখালেন, কিন্তু গুণে দুজনেই সমান এই ভেবে কেউ কাউকে পথ ছেড়ে দিলেন না। সেই সময়ে নারদ সেখানে এসে বললেন, তোমরা পরস্পরের পথ রোধ কোরে রয়েছ কেন? রাজারা উত্তর দিলেন, দেবর্ষি, যিনি শ্রেষ্ঠ তাকেই পথ ছেড়ে দেবার বিধি আছে। আমরা সমগুণসম্পন্ন সখা, সেজন্য কে শ্রেষ্ঠ তা স্থির করতে পারছি না। নারদ বললেন, ক্রুর লোক শান্তস্বভাব লোকের প্রতিও ক্রুরতা করে, সাধু ব্যক্তি অসাধু ব্যক্তির প্রতিও সাধু ব্যবহার করেন, তবে সাধুর সাথে সাধু সদাচরণ করবেন না কেন? শিবি রাজা সুহোত্রের চেয়ে সাধুস্বভাব। তিনি দান করেন কৃপণকে, সত্য বলেন মিথ্যাবাদীকে, ক্ষমা করেন অপরাধিকে এবং সাধুতার দ্বারা অসাধুকে জয় করেন।

নারদ তার পর বললেন, তোমরা দুজনেই উদার। যিনি অধিকতর উদার তিনিই সরে গিয়ে অন্য জনকে পথ ছেড়ে দিন, উদারতার তাই শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হবে। তখন সুহোত্র শিবিকে প্রদক্ষিণ করে পথ ছেড়ে দিলেন এবং তার বহু সৎকর্মের প্রশংসা করে চলে গেলেন। এইরূপে রাজা সুহোত্র তার মাহাত্ম্য দেখিয়েছিলেন।

তারপর মার্কণ্ডেয় পাণ্ডবগণকে রাজা যযাতির দানের কাহিনি বললেন - একদিন রাজা যযাতির কাছে এক ব্রাহ্মণ এসে বললেন, মহারাজ, গুরুর জন্য আমি আপনার কাছে ভিক্ষা চাইতে এসেছি। কিন্তু আমার সঙ্কোচ বোধ হচ্ছে এই ভেবে যে, সাধারণত দেখা যায় লোকে প্রার্থনাকারীর উপর অসন্তুষ্ট হয়, তাই আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি, আমার প্রার্থিত বস্তু আপনি খুশি হয়ে দেবেন কিনা? রাজা বললেন, আমি দান করে তা প্রচার করি না, যা দান করা অসম্ভব তার জন্য প্রতিশ্রুতি দিই না, যা দানের যোগ্য তা দিয়ে আমি অতিশয় সুখী হই, দান করে কখনও অনুতাপ করি না। এই বলে রাজা যযাতি ব্রাহ্মণকে তার প্রার্থিত এক হাজার গাভী দান করলেন।

______________

(ক্রমশ)